#এক_টুকরো_সুখ
#পর্ব_১৬
#লেখনীতে_শুভ্রতা
“ওভাবে সরে গেলে কেন সুন্দরী? ভয় পাচ্ছো আমাকে? কিন্তু আমায় ভয় পাওয়ার কি আছে বলো দেখি। আমি তো বাঘও না আবার ভাল্লুকও না। আমি তো তোমার মিষ্টি, কিউট,ভোলাভালা, ইনোসেন্ট, ছোট্ট,বাচ্চা জামাই।”
ছেলের এলেম আছে বলতে হবে। কাল রাতে আমার সাথে কথা বলা দুপুর আর এখনকার দুপুরের মাঝে বেশ ফারাক। রাতে কেমন আমাকে হবু জামাই নিয়ে পিঞ্চ মেরে কথা বললো আর এখন নিজেকে কিভাবে নির্লজ্জের মতো আমার জামাই বলে দাবি করছে। একে তো শিক্ষা দিতেই হবে।
আমি দুপুরের সাথে কোনো রকম কথা না বলে হাতের জিনিস গুলো রেখেই বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম। দুপুর বোধহয় আমার ব্যবহারে বেশ খানিকটা অবাক হলো। হওয়ারই কথা। সবসময় তো আর আমি এ ধরণের আচরণ করি না। বরং যে যাই করুক, বলুক, আমি সবসময় শান্ত থাকতে চেষ্টা করি। কারো সাথে রাগ, অভিমান করে কথা না বলা আমার স্বভাবে নেই বললেই চলে।
“আয়ু তোমার কি খারাপ লাগছে? অসুস্থ তুমি? এভাবে হঠাৎ শুয়ে পড়লে যে! কি হলো বলো আমাকে। কথা বলছো না কেনো? সুন্দরী!”
লে হালুয়া। ভাবলাম কি আর হলো কি! এ ভাবছে আমি অসুস্থ! লাইক সিরিয়াসলি? বলতে তো ইচ্ছে হচ্ছে কত কিছু কিন্তু না এখন কথা বলা যাবে না। দুপুর আবারও কথা বলার আগেই মিনা আপা আমাদের দুজনের খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকলো। আমাকে এভাবে শুয়ে থাকতে এবং দুপুরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেও কিছু বললো না। অবাক লাগলো খানিক। কিছু বললো না কেন?
“এই আয়না ওঠ। উঠে দুপুরকে খাবার বেড়ে দে আর নিজেও খেয়ে নে। দুপুর গড়িয়েছে ঢের সময় হলো। এখনো কিছু মুখে দিসনি। তাড়াতাড়ি উঠে পড় তো এখন।”
আপার কথা শেষ হওয়ার পরে খেয়াল করলাম আসলেই আমার ক্ষিদে পেয়েছে। এতক্ষণ ঝামেলা গুলোর জন্য বুঝতে পারিনি। এখন আপা মনে করিয়ে দিতেই হুশ এলো। ঝটপট উঠে বসলাম।
“হ্যাঁ আপা তুমি যাও আমি দিচ্ছি।”
মিনা আপা চলে গেলো। আমি নিজের মতো করে দুই প্লেটে খাবার সাজাতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লাম। গোছানো শেষে চেয়ে দেখলাম দুপুর এখনো এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে। কিছু বুঝতে পারছে না হয়তো বেচারা। আহা মজা!
“আরে দুপুর ভাইয়া, দাঁড়িয়ে আছেন যে বড়। এসে বসুন। খাওয়া শুরু করুন বসে। আমার বিয়ে উপলক্ষে আমাদের বাড়িতে এসেছেন, খেয়ে যাবেন না?”
কথা গুলো বলার পর দেখলাম দুপুরের মুখটা দেখার মতো হয়েছে। আহা কেমন চুপসে আছে।
“দুপুর ভাইয়া মানে? জামাই হই আমি তোমার। আর আমি তো আমার বিয়েতেই এসেছি। মানে বলতে চাইছি তোমার বিয়ে তো আমার সাথেই হলো।”
অবাক হওয়ার ভান করে বিছানা থেকে নেমে দুপুরের সামনে দাঁড়ালাম আমি। মুখে হাত রেখে চোখ বড় বড় করে বললাম
“ওমা তাই? কি বলছেন আপনি এসব দুপুর ভাইয়া? আমি তো এগুলো আপনি না বললে জানতেই পারতাম না। তাহলে আপনার সঙ্গেই আমার বিয়ে হয়েছে? তবে আপনি যে গতরাতে আমাকে কল করে আমার হাব্বি সম্পর্কে জানতে চাইলেন! সেগুলো কি ছিলো?”
দুপুর এতক্ষণে বুঝতে পারলো তার আয়না সুন্দরীর এরকম অদ্ভুত আচরণের কারণ। আয়নার বিয়ে দুপুরের সাথেই হচ্ছে জেনেও দুপুর কেন আয়নাকে জানায়নি তাই নিয়েই যত ঝামেলা। মনে মনে হাসলো দুপুর।
“বাব্বাহ সুন্দরীর দেখছি ভালোই রাগ হু। গতবার তো সময়ের অভাবে রাগ দেখার সৌভাগ্য হয়নি, এবার মন ভরে দেখা যাবে তবে। কি বলো সুন্দরী?”
কিছু না বলে খেতে বসে পড়লাম আমি। বোঝা যাচ্ছে দুপুর আমার গড়বড়ের কারণ ধরে ফেলেছে।
“কিসের রাগ? কার রাগ? কোনো রাগ টাগ নেই ভাই আমার। যাগ্গে আমার ক্ষিদে পেয়েছে, আমি খাওয়া শুরু করলাম। আপনার খেতে হলে খান না হলে না খান।”
এই বলে একমনে খেতে থাকলাম। দুপুর নিজেও এসে আমার সামনের দিকটায় বসে খাওয়া শুরু করলো। খাওয়া প্রায় শেষ হয়ে এলে আমি উঠে যেতে নিলেই দুপুর পিছু টান দিলো।
“আরে আরে সুন্দরী যাচ্ছো কোথায়?”
“আমার খাওয়া তো শেষ। তো আমি যাবো না?”
“তোমার খাওয়া শেষ তো কি হয়েছে? আমি তো এখনো খাচ্ছি তাই না?”
“আপনি খাচ্ছেন তাতে আমার কি বুঝতে পারছি না। আমি কেনো যাবো না হ্যাঁ?”
“বুঝলে না? আমার মানেই তো তোমার গো!”
দুপুরের কথা বলার ভঙ্গি দেখে হাসতে গিয়েও হাসলাম না। চেপে রাখলাম হাসিটা। দুপুরের খাওয়াও শেষ হয়ে গেছে। তা দেখে উঠে পড়লাম। সব কিছু ঠিকঠাক করে রাখতে বের হয়ে গেলাম। বাইরে এসে দেখি দুপুরের বাবা মানে আমার শশুর আর মামা শশুর যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাহলে ওনারা এখনই চলে যাবেন! আমাকে দেখেই দুপুরের বাবা এগিয়ে এলেন।
“শুনেছি তুমি বড় লক্ষী মেয়ে আয়না। আমার শালাবাবুর মুখে তোমার নামে প্রশংসা শুনতে শুনতে অনেক সময় বিরক্তও হয়েছি। তবে এখন মনে হচ্ছে সেগুলো কিছুই মিথ্যা ছিলো না। দুপুর আমার মা মরা ছেলে। ছোট বেলায় মা মরার পর থেকেই সৎ মায়ের সাথে থেকেছে তবু কখনো সৎ মা বলে তাকে কোনো রকম অসম্মান করেনি। সে মহিলাও আমার সামনে কখনো ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করেননি। এখন থেকে দুপুরের জীবন তোমার সাথে জড়িয়ে আছে। ওর ভালো মন্দ, ভুল-ত্রুটি গুলো নিজের মনে করে নেবে। যেটা শুধরে নেওয়া দরকার সেটা বলবে। এরপর না শুনলে তো আমরা আছিই তোমার সাথে। আমার কথা গুলো রেখো মা।”
আমার মাথায় হাত রাখলেন তিনি। আমিও মুচকি হেসে তার কথায় সম্মতি দিলাম। আব্বা, ফুপু, মিনা আপা, আম্মা সকলেই তাঁদের কাছে আমার ঝুড়ি ঝুড়ি প্রশংসা করে চলেছে। সামনের ওপর নিজের প্রশংসা শুনে যেখানে আমার লজ্জা পাওয়া উচিত সেখানে আমি অবাকের পর অবাক হচ্ছি। আম্মা আমার প্রশংসা করছে! ভাবা যায়? পরে আবার মনে পড়লো পরীক্ষার আগের কথা। তখনও তো আম্মা এভাবেই আমার পক্ষ নিয়ে আপাকে কথা শুনিয়েছিল। কিন্তু তার পরেও আম্মার অনেক খারাপ ব্যবহার সহ্য করতে হয়েছে আমাকে। এবারও বোধহয় তেমন কিছুই।
দুপুরের বাবা, মামা চলে গেলেন। ফুপু, মিনা আপা, মিনাল তাঁদের সাথেই বাড়ির দিকে রওনা হয়েছে। রয়ে গেলো দুপুর, সে নাকি আমাকে হোস্টেলে রেখে তবেই যাবে। এ ছেলের বোধহয় আর কাজকর্ম নেই। সেই কবে থেকে দেখছি শুধু বেড়াচ্ছে। বড় আপা আর দুলাভাইও তাঁদের ছেলে নিয়ে চলে যাচ্ছেন। বাড়িটা কিছু সময়ের ব্যাবধানেই কেমন ফাঁকা হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ মন খারাপ করে থেকে আমিও ব্যাস্ত হয়ে পড়লাম আম্মার হাতে হাতে কাজ করতে। দুপুর গেলো আব্বার সাথে বাজারের দিকে।
রাতে আম্মা আর আমি যখন রান্নাবান্না শেষ করে হাত মুখ ধুয়ে বারান্দায় এসে বসেছি তখনই ফোন এলো আমার ছোট মামার নাম্বার থেকে। সেখানে নাকি আমার নানু অসুস্থ অনেক। আম্মাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যেতে বলা হচ্ছে। নানু আম্মাকে দেখার জন্য ছটফট করছেন। নানুর ছয় ছেলেমেয়েদের মধ্যে আমার আম্মা সবার চেয়ে ছোট। দুই খালামনি আর তিন মামা সবার বাড়িই প্রায় নানু বাড়ির কাছাকাছি। আমরাই শুধু একটু দূরে। কথায় আছে ছোট সন্তানের প্রতি বাবা মায়ের টান থাকে বেশি। নানাভাই তো বেঁচে নেই। এখন তাই নানুর এই টানের ঠ্যালা সামলানো লাগবে।
আমার নানু বাড়ি দিনাজপুরে। খালামনি আর মামারা সবাই ওই দিনাজপুরের মধ্যেই কিছু দূরে দূরে থাকেন। একমাত্র আমার আম্মাই পরে গেছেন অনেক দূরে। এই খুলনা থেকে দিনাজপুর যেতে অনেকটা সময় পার করতে হয়। জার্নি করতে গিয়ে কোমর ব্যথা হয়ে যায়। আমার তো নানু বাড়ি যাওয়ার কথা শুনলেই নানা অজুহাত খুঁজি না যাওয়ার জন্য। অতিরিক্ত দূরে হওয়ার জন্যই আমার বিয়েতে বা বড় আপার বিয়েতে সেখানকার কেউ আসেনি। যদিও আব্বা বলেছেন তাঁদের আসার কথা কিন্তু তারা আসতে পারেনি। তা নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই। আমার মাথা ব্যথা হলো এখন আম্মার সেখানে যাওয়া নিয়ে।
এশার বেশ খানিক বাদেই আব্বা আর দুপুর বাড়িতে ফিরলো। খাবার সময় আম্মা আব্বার কাছে মামার বলা কথা গুলো বলেন। আব্বার কোনো আপত্তি নেই আম্মার দিনাজপুর যাওয়া নিয়ে। কিন্তু আমাকে একা বাড়িতে রেখে যাওয়াটা আব্বার পছন্দ হচ্ছে না কারণ আব্বা প্রায় সময় তার কাজের জন্য বাইরে থাকেন। তাই সিদ্ধান্ত হলো দুপুর আমাদের বাড়িতেই থাকবেন আম্মা না ফেরা অবধি। তারপর আম্মা ফিরলে আব্বা আর দুপুর মিলে আমাকে হোস্টেলে রেখে আসবেন। কাল সকাল সকাল আম্মা আর মুহিন দিনাজপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হবেন ট্রেনে চড়ে।
রাতটা সবার কোনো রকমে কেটে গেলো। দুপুর নিজে থেকেই গিয়ে মুহিনের সাথে ঘুমিয়ে পড়লো। আব্বাকে নাকি আবার বলেছে অনুষ্ঠান করে আমাকে তাঁদের বাড়িতে না নেওয়া অবধি আমরা আলাদাই থাকবো। আব্বা তার এরকম আচরণে অনেক খুশি হয়েছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যাক তাতে আমার আবার কোনো মাথা ব্যথা নেই। সকাল সকাল উঠে আম্মার সাথে হাতে হাতে রান্না শেষ করে সবাইকে খাবার দিচ্ছিলাম। এমন সময় নাজমুল চাচা নিজের দলবল নিয়ে আমাদের বাড়িতে ঢুকে পড়েন। সবাই খাবার মুখে নিয়েই সেদিকে চেয়ে পড়লাম।
“আমার ছেলের সাথে কি করেছো ঠিকঠাক সব সত্যি করে বলো আনাস ভাই।”
নাজমুল চাচার এহেন কথার আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারলাম না আমরা। আব্বা খাবার রেখে উঠে গিয়ে কথা বললেন।
“মানে আপনি কি বলছেন মেম্বার সাহেব?”
“না বোঝার ভান করো না। কালকে তোমাদের বাড়ি থেকে যাওয়ার সময় তোমার ছোট মেয়ে জামাই যে আমার ছেলেকে হুমকি দিয়েছে তা আমি জেনে গেছি। কাল রাত থেকে আমার ছেলের কোনো খবর নেই। আজ সকালে বিলের ধারে ব্রিজের ওপর ওর মোটরসাইকেল পাওয়া গেছে। মোটরসাইকেল রেখে আমার ছেলে নিশ্চই হাওয়া হয়ে যায়নি। তোমরাই কিছু করেছো আমার ছেলের সাথে। বলো আমার ছেলে কোথায়।”
মানে কি এগুলোর? নাজমুল চাচার ছেলে গায়েব তার সাথে দুপুরের কথার কি সম্পর্ক?
“আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে চাচা। উনি আপনার ছেলের সাথে কিছু করেননি। উনি তো রাতে বাড়িতেই ছিলেন ভাইয়ের সাথে। আপনি অযথা আমাদের বাড়িতে এসে হাঙ্গামা করতে পারেন না এভাবে। আমরা চাইলেই কিন্তু আপনার নামে মামলা করতে পারি।”
“আমাকে মামলার ভয় দেখাচ্ছো মেয়ে। বলিহারি তোমার সাহস। এসব আলগা কথায় কাজ হচ্ছে না। আমি আমার ছেলেকে চাই।”
অদ্ভুত জ্বালায় পড়া গেলো তো। এখন কে বোঝাবে এই লোককে যে দুপুর তার ছেলের সাথে কিছু করেনি। ওগুলো তো শুধু কথার কথা ছিলো। আর তারচেয়ে বড় কথা ছেলেটা মোটরসাইকেল ব্রিজের ওপর রেখে গেলোই বা কোথায়? কিছু হয়ে যায়নি তো আবার? নাকি এসব আমাদের হেনস্থা করার ফাঁদ?
চলবে…?