#এক_টুকরো_সুখ
#পর্ব_১৮
#লেখনীতে_শুভ্রতা
আব্দুল্লাহ কাজী, এক সময়ের নামকরা ব্যাবসায়ী। বাপ-দাদার ব্যবসা হাতে পেয়েছেন বেশ অল্প বয়সেই। ব্যাবসার হালচালও খারাপ ছিলো না। সুতরাং অভাব নামক সাগরে কখনো ডুবতে হয়নি বললেই চলে। সে সূত্রে বাবার সংসারে থাকা অবধি তার ছেলেমেয়েদেরও কখনো অভাবে পড়তে হয়নি। কাজী সাহেবের ছয় ছেলে মেয়ে। তিন ছেলে এবং তিন মেয়ে। সবার এখন নিজের সংসার আছে। কাজী সাহেব গত হয়েছেন বেশ ক’বছর আগেই। ব্যবসা এখন তার তিন ছেলে সামলায়। মেয়েদেরও নিজের পছন্দ মতো ছেলের হাতেই তুলে দিয়ে গেছেন তিনি। ভাগ্যের ফেরে শুধু ছোট মেয়েটাই পড়েছে একটু অভাবী ঘরে। যদিও সেখানেও রয়েছে এক কাহিনি।
আব্দুল্লাহ কাজীর ছোট মেয়ে রাবেয়ার বিয়ে হয় তাঁদের এলাকার পাশেই এলাকায় বসবাস করা অন্য এক ব্যাবসায়ীর ছেলের সাথে। বেশ ধুমধাম করেই নিজের ছোট মেয়ের বিয়ে দেন কাজী সাহেব। প্রথম প্রথম সবকিছু ভালোই যাচ্ছিলো কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় বিয়ের কয়েক মাস পর থেকে। রাবেয়ার স্বামী রসূল কোনো কাজকর্ম করে না। বাপের ব্যাবসার টাকাতেই বন্ধু বান্ধবের সাথে আড্ডা দিয়ে বেড়ায়। তাতে যদিও সমস্যা ছিলো না কারণ রসূলের বাবার টাকা পয়সার কোনো অভাব ছিলো না। বরং তার যে সম্পত্তি ছিলো তাতে রসূল সহ তার সন্তানেরা বসে বসে খেতে পারবে। কিন্তু রসূল মিয়া একই সাথে চুরি-চামারি এবং নেশা-টেশাও করতো। স্ত্রীর শরীরে হাত তুলতেও বাদ দিতো না।
রসূলের আচরণে যখন অতিষ্ট রাবেয়া ঠিক তখনই জানতে পারে সে গর্ভবতী। মানে এক ঝামেলার মাঝে আরেক ফাঁসাদ। কিন্তু সন্তান যেহেতু নিজের, ফেলে তো আর দিতে পারবে না। তার এক মাস পরেই হয়ে যায় তাঁদের বিচ্ছেদ। মেয়ের এমন পরিণতি দেখে অনেকটা ভেঙে পড়েন কাজী সাহেব। তারও মাস দুয়েক পর অনেক দূর থেকে নিজের আত্মীয় বাড়িতে বেড়াতে আসা এক মহিলা তার ছেলের জন্য পছন্দ করেন গর্ভবতী রাবেয়াকে। অতঃপর বিয়েও হয়ে যায়। বিয়ের পরেই জন্ম হয় গর্ভের সেই সন্তানের।
সেই সন্তানই হচ্ছে আমার বড় আপা রুবি। এবং পরবর্তী দুই সন্তান আমি আর মুহিন। এখন যখন নানুর অবস্থাও প্রায় যায় যায়, তখন মামারা উঠে পড়ে লেগেছেন সম্পত্তির ভাগ নিয়ে। বড় দুই মামা আলাদা জায়গা কিনে সেখানে থাকেন, যদিও তা বাড়ির কাছে। নানু থাকেন ছোট মামার সঙ্গে। এখন ছোট মামার আবদার যেহেতু নানু তার সাথে থাকে তাই সে সম্পত্তি বেশি পাবে। কিন্তু বাকিরা তা মানতে নারাজ। তাই ছয় ভাই বোন একসাথে হয়ে ফয়সালা করবেন বলে ঠিক করেছেন। কিন্তু সম্পত্তির কথা তুললে আমার আব্বা যে আম্মাকে কিছুতেই যেতে দেবেন না তা সবাই বেশ ভালো জানে। সেই জন্যই নানুর অসুস্থতার বাহানা করেছেন।
মামাদের এহেন পরিকল্পনার কথা জেনে আব্বা তো রেগে আগুন। রাত না হলে আম্মাকে এখনই ফিরে আসতে বলতেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আম্মার আবার ওই সম্পত্তিতে দাবি আছে। তিনি আব্বাকে জানিয়েছেন নিজের ভাগ বুঝে নিয়ে তবেই ফিরবেন। আব্বা যদি সেগুলো গ্রহণ না করতে চান তবে তা আম্মা বড় আপার ছেলের নামে করে দেবেন। এসব শুনে আরো আব্বার রাগ তরতর করে বেড়ে গেছে।
“সামান্য কিছু সম্পত্তির ভাগাভাগির জন্য তোর মামারা আমার কাছে ওই মুরুব্বি মানুষটার অসুস্থতা নিয়ে মিথ্যে বললো আয়ু। তোর আম্মাকে নেবার জন্য নাকট করলো ওরা। আর এখন নাকি সে ভাগ না নিয়ে আসবে না। আমি না নিতে চাইলে রুবির ছেলেকে দিয়ে দেবে। কেন ওই সম্পদ তোর আম্মার নিতে হবে বল তো। আমরা বা রুবিরা কি খেয়ে-পরে ভালো নেই? নাহয় একটু আছে আমাদের সংসারে টানাটানি। তা বলে কি আমি শশুরের টাকায় তা দূর করবো? কখনোই না। দিয়ে দিক ওগুলো রুবির ছেলেকে। তুই ওসবের দিকে ফিরেও তাকাবি না। আর যদি তাকাস তবে জানবি তোর আব্বা আর নেই।”
আব্বার শেষের কথায় চমকে উঠলাম আমি। আমার আব্বা মানুষটা বড়ই সাদামাটা-সরল কিন্তু জেদি। প্রখর তার আত্মসম্মান বোধ আর ন্যায়-নীতি। ছোট থেকে আমাদের বাড়িতে কম সমস্যা বা টানাটানি দেখিনি। কিন্তু কখনো আব্বা কারো কাছে ছোট হননি। আম্মা বলেছেন তার ভাইদের থেকে সাহায্য নিতে, রাজি হননি। এমনকি আমার নিজের ফুপু সাহায্য করতে চাইলেও আব্বা নেননি। কাজের জায়গায় দুনম্বরি করার ব্যাপক সুযোগ থাকার পরেও কখনো অন্যায় করেননি। ফলে তিনি যে নানাভাই এ সম্পত্তির কিছুই নেবেন না তা জানা কথা। আর যেখানে আমার আব্বা নেই সেখানে আমি নিজেও নেই।
“আমি তোমার মেয়ে আব্বা। না খেয়ে থাকলেও কখনো ওদের সাথে এগুলো নিয়ে কথা বলতে যাবো না। আমার আব্বার মতো আমার কাছেও যে আত্মসম্মান সব কিছুর উর্ধে। তুমি চিন্তা করো না। যাও শুয়ে পড়ো।”
আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আব্বা কিছু একটা বিড়বিড় করতে করতে চলে গেলেন। আম্মার আচরণে বেশ কষ্ট পেয়েছেন বোঝা যাচ্ছে। আপার প্রতি আম্মার যে দরদ একটু বেশি তা তো জানা কথা। কিন্তু তা বলে আব্বার মুখের ওপর এভাবে না বললেও পারতেন। তিনি তো জানেনই আব্বা কেমন। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আমার ভেতর থেকে।
“কি বললো তোর স্বামী রাবে? আসবে নাকি সে সব কিছুর বোঝাপড়া করতে?”
নিজের ছোট ভাই আহাদের কথায় ধ্যান ভাঙলো রাবেয়ার। স্বামীর সাথে কথা কাটাকাটির পরে ফোন রেখে সেসবই আরেক দফা সাজাতে নিয়েছিল সে। স্বামী তার নিজের আত্মসম্মান বজায় রাখার তাগিদে হলেও এ সম্পদের দিকে ভুলেও চাইবে না। কিন্তু সে অবশ্যই নিজের অধিকার বুঝে নেবে। তার বড় মেয়ে রুবি তো আছে। আয়না, মুহিনের জন্য আব্বা, ফুপু থাকলেও রুবির কেউ নেই। তাকেই নাহয় দিয়ে দেবে।
“তাকে লাগবে কেনো ছোট ভাই? আমি নিজের ভাগ নিজেই বুঝে নিতে পারবো। তোমাদের অত ভাবতে হবে না।”
ছোট ভাই পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো। তাই সব কথাই তার কর্ণগোচর হয়েছে। বোনকে খোঁচা মেরে বললো
“আমি কেমন যেন শুনলাম দুলাভাই তোকে এসব ঝামেলা না করে খুলনায় ফিরে যেতে বললো। তা বলছি কি রাবে স্বামীর কথা শোন। ফিরে যা খুলনায়। তুই না থাকলে তোর ভাগ নাহয় আমিই নেবো। এসে তো সবসময় আমার বাড়িতেই উঠিস।”
কোত্থেকে যেন এবার ছোট ভাবিও এসে ফোড়ন কেটে বসলো।
“হ্যাঁ রে রাবে। আমি আর তোর ভাই তো কখনো তোদের যত্নে কোনো কমতি রাখিনি। তা আনাস যখন চাইছেই না ভাগ নিতে তবে তুই জোর কেনো করবি? সংসারে অশান্তি করে লাভ আছে খামোখা? তোর ছোট ভাইয়ের নামে দিয়ে যা বরং।”
রাবেয়া প্রথমে কিছু সময় থমকে চেয়ে রইলো নিজের ভাই আর ভাবির দিকে।এরাও ছাড়ছে না সুযোগ কাজে লাগাতে? অথচ আমার নিজের ভাই!
“কি বলোতো ভাবি, তোমার নন্দাই চাইছে না কারণ তার মেয়ের যার সাথে বিয়ে হয়েছে তার আর কোনো ভাই বোন নেই। বাবার যা আছে সবই সে ছেলের। আর ছেলের জন্য তার ছেলে মুহিনের জন্য ওনার যা আছে তা যথেষ্ট। কিন্তু আমার মেয়ে, আমার রুবি, তার কি হবে? একে দজ্জাল শাশুড়ি তারউপর ননদ। আমার মেয়ে তো জলে ভেসে যাবে গো ভাবি। সত্যি বলছি, রুবি যদি একটা হিল্লে থাকতো তবে আমার ভাগ ছোট ভাইকে দিতে দু’বার ভাবতাম না গো।”
কথা শেষ করেই রাবেয়া চললো নিজের মায়ের ঘরের দিকে। আজ অনেক দিন পর মায়ের কাছে রাত কাটাবে। মায়ের কোলে ঘুমানোর যে কি সুখ তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এদিকে রাবেয়া যেতেই তার ছোট ভাবি গর্জে উঠলো।
“সে কেমন দিতে সব জানা আছে আমার। ওপর ওপরই সবার ছোট ভাইয়ের প্রতি দরদ। বলেছিলাম না তোমাকে কেউ তোমার কথা ভাবে না? আমার কথা তো শুনবে না, বেশি দরদ কি না বোনদের জন্য। এখন দেখো। না জানি আমার মেয়েটার কপালে কি আছে!”
নিজের স্ত্রীকে থামালো আহাদ।
“আহ থামো তো রিমুর মা। রাবে কি ভুল কিছু বলেছে? রুবির তো আর আপন কেউ নেই। তাছাড়া রিমু আমাদের একমাত্র মেয়ে, আমি যা পাবো সবই তো ওর। আর চিন্তা কিসের শুনি।”
মুখ ঝামটা দিলেন সে।
“রুবি আবার কেউ নেই। তোমার মায়ের যত জমানো টাকা পয়সা সব তো ওই মেয়েকে দেয়। ও মেয়ে যে কেমন সেয়ানা তা তুমি ধারণাও করতে পারবে না বুঝলে। আমি বিয়ে হয়েছে থেকে কখনো আনাসকেও দেখিনি রুবি আর আয়নার মধ্যে পার্থক্য করতে। যত পার্থক্য তোমার মা আর বোনেরাই করে।”
কথা গুলো বলে স্বামীকে কিছু বলতে না দিয়েই উনি চলে গেলেন। আহাদ সাহেবের একবার মনে হলো তার স্ত্রী তো ভুল কিছু বলেননি। আনাস তো কখনো রুবিকে আলাদা করেনি। আবার মনে হলো তার বোন রাবে নিশ্চই ভুল বলবে না। সেও স্ত্রীর পিছু পিছু ঘরের দিকে এগোলেন।
আব্বা ঘরে চলে যাওয়ার পর তখন রেখে যাওয়া খাবার গুলো সামনে নিয়ে বসেছিলাম কিন্তু তা আর গলা দিয়ে নামলো না। সব রেখে উঠে গিয়ে দাঁড়ালাম উঠোনে। রাত কম হয়নি। সবাই বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। আকাশে বেশ বড় একটা চাঁদ। পূর্ণিমা কাছাকাছি হবে হয়তো। বারবার মনে পড়ছিলো আম্মার কথা। সে কেবল বড় আপার জন্যই ওই সম্পত্তিতে ভাগ বসাতে চাইছে তাতে বিন্দু মাত্র সন্দেহ নেই। কিন্তু তবু আব্বার সামনে মুখের কথা অন্তত বলতে পারতো যে সে এগুলো তার সন্তানদের জন্য নিচ্ছে। সবসময় আম্মা কেবল বড় আপার কথাই ভেবে গেলো। কই আমি বা আব্বা তো আপা আমাদের রক্তের না তা জেনেও কখনো তাকে কোনো রকম অবহেলা করিনি। তবে আম্মা কেনো করেন?
রাতের আকাশে একলা চাঁদ দেখে নিজের জীবনের কথা মনে পড়ছে। আমার জীবনটাও আব্বার মতো হয়ে গেলো। সবই আছে, আশেপাশে আপন মানুষ গুলোও আছে, খেয়ে-পরে দিব্যি আছি বললেও ভুল হবে না, তবু যেন কোথাও কিছু একটা নেই। এটা মনে হওয়ার কারণ কি শুধু আম্মা? কেবল আম্মার জন্যই কি আমার আর আব্বার জীবনে সব থেকেও নেই? আম্মার জন্যই কি আমাদের কাছে ধরা দেয়নি #এক_টুকরো_সুখ? এসব ভাবনার মাঝেই পেছনে থেকে কেউ কাঁধে হাত রাখলো।
চলবে…?