#আমার_ভাঙা_ক্যানভাসে (১৪)
#তানজিলা_খাতুন_তানু
জয় রুহির উপর ভীষন ক্ষেপে আছে, রুহির সাথে কথা বলার কোনরকম চেষ্টা করেনি এই দুইদিন। যদিও বা রুহি এতে কোনো অসুবিধা নেয়, সে তার নিজের মতো দিনযাপন করছে।
রুহির মা নিজের মেয়ের ঘরে এসে বিরক্ত হলেন। চারদিকে রং, তুলি, জামাকাপড়, কাগজপত্র এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে।
– ‘রুহু এইসব কি? তুই আগে তো এইরকম এলোমেলো ছিলিস না!’
– ‘ভালো লাগছে না কিছু।’
– ‘আর দুইদিন পর শশুর বাড়ি চলে যাবি, আর এখনো নিজের কাজটা নিজে করবি না!’
– ‘মা এতগুলো বছর তো নিজের কাজটা নিজেই করে এসেছি, কিন্তু এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে কিছুই ভালো লাগছে না আমার।’
রুহির মায়ের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। মেয়েটা বাইরে থেকে এতটা লড়াই করেছে, অথচ কাউকেই বুঝতে দেয়নি কিছু।
– ‘মা আমার এইভাবে হুট করে বিয়ে দেওয়ার কি খুব প্রয়োজন ছিল!’ (এলোমেলো কন্ঠে)
– ‘পরিস্থিতি বাধ্য করেছে।’
– ‘কি এমন পরিস্থিতি, যার জন্য হঠাৎ করে আমার বিয়ে দিতে হলো, তার উপর আবার জয়ের সাথে?’
– ‘তোর মামা তিথির হলুদের দিন দাদার কাছে তোর আর অর্নবের বিয়ের কথা বলতে আসে, আর সেখানে দুজনের মধ্যে কথাকাটাকাটি হয়। তোর মামা চলে যাবার পর দাদা আমাদের ডেকে সবটা বলেন এবং জানান তিথির সাথে তোরও বিয়ে দিয়ে চাই।’
– ‘তাই বলে জয়ের সাথে?’
– ‘হ্যাঁ তোর আর জয়ের বিয়ে অনেক আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। তোর বাবা আর জয়ের বাবা অনেক ভালো বন্ধু ছিলেন, সেই সূত্রেই ওদের দুজনের বিয়ে ঠিক আর ছিল।’
– ‘কই আমি তো এইসবের কিছুই জানতাম না।’
– ‘দাদা তোদের বলতে বারন করেছিল, ছোট বয়সে এইসব মাথায় ঢুকে গেল আর পড়াশোনা হবে না বলে।’
– ‘বিষয়টা জয় জানত?’
– ‘হ্যাঁ। জয় কিভাবে যেন বিষয়টা জেনে যায়, কিন্তু ওকেও বারন করা হয় যাতে বিষয়টি তোকে না জানায়।’
– ‘ওহ।’
– ‘হ্যাঁ অনেক কথা হলো, এইবার আয় তো আমি তোর মাথাতে তেল দিয়ে দিই।’
– ‘মা আমি চুলে তেল দিই না।’
– ‘তো কি হয়েছে আজকে আমি দিয়ে দেব। চুপচাপ বস।’
রুহির মা মেয়ের চুলে তেল দিয়ে দিলেন। কতগুলো দিন পর এইভাবে মেয়েকে যত্ন করছেন, চোখে পানি জমা হলো। মেয়েটা এতটাই বড়ো হয়ে গেছে দুইদিন পর শশুর বাড়ি চলে যাবে তখন আর শুধু ওনার মেয়ে হিসাবে থাকবে না, একটা বাড়ির বউ হয়ে যাবে।
***
আজকে রুহি আর জয়ের রিসেপশন। ছোটখাটো একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। রুহি বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে এইসব ঝামেলা পোহাতে পোহাতে। এত ভারী ভারী মেকআপ,শাড়ি তার উপর সকলের সাথে দাঁড়িয়ে দাঁত বের করে হাসা উফ্ অসহ্য।
রুহির চোখ পড়ল প্রিয়ার দিকে, মেয়েটা কিরকম একটা চুপচাপ হয়ে গেছে। ওর সাথে কথা বলেনি সেইদিনের পর থেকে, হয়তো বিয়েটা মেনে নিতে পারছে না। আবারো আত্মীয় আসাতে রুহি তাদের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
কিছুক্ষন আবারো প্রিয়ার দিকে চোখ পড়ল, এই বার প্রিয়া একা নয় জয়ও আছে ওর সাথে। রুহির বুকটা ধ্বক করে উঠলো অজানা ভয়ে।
– ‘কি ব্যাপার প্রিয়া তুমি এত চুপচাপ হয়ে আছো কেন? ওইদিকে তো সবাই আনন্দ করছে।’
– ‘আমার জীবন থেকে আনন্দের মানুষটাই যে হারিয়ে গেছে।’
– ‘মানে?’
– ‘আপনার এত বুঝে লাভ নেই, রুহুপুর কাছে যান।’
– ‘না তুমি কি বললে সেটা বলো। কাউকে ভালোবাসতে নাকি? ছ্যাকা খেয়েছো?’
– ‘তাকে তো নিজের মনের কথাটা বলতেই পারিনি।’
– ‘তাহলে বলে দাও।’
– ‘বলে আর কি লাভ সে তো অন্যকারোর।’
– ‘মানে?’
– ‘তার বিয়ে হয়ে গেছে।’
– ‘আচ্ছা কে সে?’
– ‘আপনি।’
জয় চমকালো না। বিষয়টা আগেই আন্দাজ করেছিল,
– ‘ওইদিকে চলো, তোমার সাথে কিছু কথা আছে।’
– ‘কি কথা।’
– ‘চলো না।’
জয় প্রিয়ার হাতটা ধরে সাইটে নিয়ে গেল। রুহি ক্ষেপে উঠল বিষয়টিতে, মনে মনে প্রিয়াকে ঝাড়তে লাগল।
– ‘শয়*তান মেয়ে, অন্যের বরের দিকে তোর নজর কেন? আর জয় এই তো চরিত্র, বিয়ের কদিন পরেই অন্যের সাথে ঢলাঢলি শুরু করে দিয়েছিস।’
**
– ‘কি হলো আমাকে এইখানে আনলেন কেন?’
– ‘তোমাকে কি কিছু কথা বলার জন্য এনেছি। তুমি আমার ছোট বোনের মতো আমি চাই না, তুমি কষ্ট পাও তাই তোমাকে এইখানে এনেছি কথাগুলো তোমার জানা প্রয়োজন।’
– ‘কি কথা।’
– ‘রুহি আর আমি সেই ছোটবেলার বন্ধু এইটা নিশ্চয় তুমি জানো।’
– ‘হুমম।’
– ‘রুহি আর আমার বিয়ে সেই ছোট বেলা থেকে ঠিক করা ছিল। বিষয়টি আমি কিংবা রুহি কেউই জানতাম না, দুজন দুজনের বেস্টফ্রেন্ড ছিলাম একে অপরকে ছাড়া কিছুই বুঝতাম না। তখনও আমি রুহি কে নিয়ে অন্যকিছু ভাবতাম না, একদিন হঠাৎ করেই জানতে পারি রুহি আর আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। মাকে জিজ্ঞেস করলে মা পুরো বিষয়টা জানায়, সেইদিন থেকে রুহির প্রতি অন্যকিছু অনুভব করতে শুরু করি কিন্তু রুহিকে কিছুই বুঝতে দিতাম না। একটা সময় গিয়ে আমি বুঝতে পারি রুহিকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি সিদ্ধান্ত নিই রুহি জানাব কিন্তু তখনি তোমার বড়ো আব্বু আমাকে নিষেধ করে। নিজের ভালোবাসার মানুষটি মনের কথা বলতে না পারার কষ্টটা তিল তিল করে আমাকে শে’ষ করে দিতে থাকে। একটা সময় পর আমি বুঝি রুহিও আমাকে ভালোবেসে ফেলেছে কিন্তু একটা ঝড় আমাদের সম্পর্কটাকেই এলোমেলো করে দেয়। রুহি আমার উপরে রাগ করে মামার বাড়ি চলে যায়। তারপর আর আমার সাথে স্বাভাবিক হয়নি।’
প্রিয়া অবাক হলো। জয় আবারো বলতে লাগল,
– ‘রুহি আর আমার ভাগ্য জোড়া ছিল তাই তো এত ঝামেলার পরেও আমরা দুজন এক হয়েছি। জন্ম মৃ*ত্যু বিয়ে সবটাই সৃষ্টিকর্তার হাতে থাকে। হ্যাঁ তুমি আমাকে পছন্দ করতে তাই বলে এই নয় যে আমার জন্য নিজের জীবন থামিয়ে রাখবে কিংবা প্রতিশো’ধ পরায়ন হয়ে ক্ষ’তি করার চেষ্টা করবে। কিন্তু ক্ষতিটা কার হবে, আমার হবে রুহির হবে আর তোমার হবে। তোমার কথাটা জানার পর কি তোমার পরিবারের কেউ তোমাকে আগের মতো ভালোবাসতে পারবে!ভরসা করতে পারবে! হয়তো তোমার মনে হচ্ছে কথাগুলো কেন বলছি। কথাগুলো কেন বললাম জানো, তোমার অল্প বয়স এইসব কথা মাথাতে আসতেই পারে। কি বোঝাতে চাইছি বুঝতে পেরেছো?’
– ‘হুমম।’
– ‘এইবার যাও সকলের সাথে আনন্দ করে, দেখবে ভালো লাগবে। সময় চলে যাবে কিন্তু এই দিনটা আর ফিরে আসবে না, তাই সুন্দর করে সময় কাটাও।’
প্রিয়া চলে গেল। জয় একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলল, রুহির মামার আসল উদ্দেশ্য না জানা পর্যন্ত শান্তি পাবে না, প্রিয়াকে আগে থেকে বুঝিয়ে রাখল যাতে রুহির মামা ওকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে। জয় চাই না ওদের জীবনে নতুন করে কিছু ঝামেলা আসুক।
#চলবে…
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আসসালামু আলাইকুম।