#আমার_ভাঙা_ক্যানভাসে (১৬)
#তানজিলা_খাতুন_তানু
আপাতত ঘুরতে যাবার প্ল্যানটা ক্যান্সিল হয়ে গেল। রুহির দাদু পুনরায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, এই পরিস্থিতিতে ঘুরতে যাওয়াটা একটু বেমানান। রুহি ওর বাবার বাড়িতে আছে, দাদুর অবস্থা খুবই খারাপ বাড়িতে থেকেই সমস্ত ধরনের ট্রিটমেন্ট করছে। সবাই কান্নাকাটি করছে সারাদিন।
– ‘রুহি দিদিভাই এইদিকে একটাবার আসবে।’
রুহি ধীর পায়ে ওর দাদুর পাশে গিয়ে বসল।
– ‘দিদিভাই তুমি তো সকলের থেকে বুঝদার তাই না। তুমিই পারবে আমার এই সংসারটাকে আগলে রাখতে, সবাইকে একসাথে বেঁধে রাখতে। কথা দাও সবাইকে ভালো রাখবে তুমি।’
– ‘হুম কথা দিলাম।’ (কেঁদে দিয়ে)
– ‘আরে পাগলি কাঁদছো কেন? কেঁদো না, জয়কে নিয়ে সুখে থাকবে, খবরদার দুজনে একদম ঝগড়া করবে না একসাথে মিলে মিশে থাকবে। সবাইকে ভালো রাখো রুহি।’
হঠাৎ করেই রুহির দাদুর শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। রুহি সকলকে ডাকাডাকি করতে থাকে, ওনাকে অস্থির হতে দেখে রুহি ঘাবড়ে গিয়ে, কান্না করে দেয়।
কিছুক্ষনের মধ্যেই গোটা বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে যায়। রুহির দাদু ফাঁকি দিয়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। রুহি চিৎকার করে কাঁদছে, দাদুর সাথে সম্পর্কটা খুব মিষ্টি ছিল একটা সময় দাদু ছাড়া কিছুই বুঝত না আজকে সেই মানুষটাই রুহিকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল সেইটা রুহি মেনে নিতে পারছে না। রুহি কান্না দেখে অন্য সকলে আরো ভেঙে পড়ছে। প্রিয়া রুহিকে জড়িয়ে ধরে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে,
– ‘রুহিপু শান্ত হও, এইভাবে কেঁদো না।’
– ‘ওই প্রিয়ু দাদুভাইকে উঠতে বল না, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে রে। কেন দাদুভাই আমাকে একাকে রেখে চলে গেল, কেন তার দিদিভাইকে একাকে রেখে চলে গেল? একটাবার দাদুভাইকে উঠতে বল না।’
রুহির চিৎকারে গোটা বাড়ি কেঁপে উঠছে, রুহিকে কে কি বলে শান্তনা দেবে বুঝে উঠতে পারছে না।
দাফনের সময় এগিয়ে আসছে লাগল, গোসল দেওয়ার পর যখন সাদা কা’ফনে জড়িয়ে খাঁটিয়াতে শুইয়ে দিয়েছে। সকলকে শেষ বারের মতো দেখাচ্ছে তখন হামিদ চৌধুরী রুহিকে ধরে নিয়ে দেখাতে নিয়ে যায়।
– ‘এই তোমরা আমার দাদুভাইকে এইভাবে এতে শুইয়ে রেখেছ কেন? আর কিসব পড়িয়েছ এইসব!’
– ‘রুহি মা শান্ত হও। দাদুভাইকে শেষবারের মতো চোখের দেখা দেখে নাও।’
– ‘বড়ো আব্বু তুমি এইসব কি বলছো? চোখের দেখা দেখব কেন? আমার দাদুভাই আমার কাছেই থাকবে আমি কোথাও যেতে দেব না। দাদুভাই ওহ দাদুভাই ওঠ না।’
রুহি খাটিয়ে ধরতে গেলে হামিদ চৌধুরী ওকে আটকে দিয়ে বলল,
– ‘নিজেকে সামলাও রুহি। তুমি না বুঝদার মেয়ে এইভাবে পাগলামী কেউ করে।’ (কিছুটা ধমক দিয়ে)
রুহি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে হামিদ চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। হামিদ চৌধুরীর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে, তার বুকটাও যে ফেঁটে যাচ্ছে আজকের পর থেকে আর কাউকে বাবা বলে ডাকতে পারবে না, কেউ আর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সাহস দেবে না। কিন্তু ওনাকে যে শক্ত থাকতে হবে, না হলে বাড়ির ছোটদের সামলাবে কিভাবে!
দাফন কাজের জন্য ওনাকে নিয়ে চলে যাওয়া হয়। রুহি কান্না থামিয়ে দিয়ে হঠাৎ করেই একদম গম্ভীর হয়ে উঠে। কাউকে কিছু না বলে চুপচাপ একধারে বসে থাকে।
দুদিন কেটে গেছে, রুহি কারোর সাথে কথা বলে না, ঠিক মতো খায় না। একা একা বসে থাকে আর কি যেন ভেবে চলে মাঝেমধ্যে দাদুর ঘরে গিয়ে সময় কাটায়, একা একা কথা বলে। অন্যরা মোটামুটি নিজেদের সামলে নিলেও রুহির অবস্থা দেখে সবই খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছে।
হামিদ চৌধুরী জয়কে ডেকে পাঠালেন,
– ‘আঙ্কেল আমাকে ডেকেছিলেন?’
– ‘হুম তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।’
– ‘জ্বি বলুন।’
– ‘বাবার মৃত্যুতে রুহি কতটা শক পেয়েছে এসটার তো তুমি জানোই। ওকে কিছুতেই স্বাভাবিক জীবন যাপনে ফিরিয়ে আনতে পারছি না। তুমি যেহেতু ওর স্বামী কাজটা তুমিই ভালো পারবে।’
– ‘আঙ্কেল আমি তো আগেই ওকে ওই বাড়িতে নিয়ে চলে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু বাড়ির পরিস্থিতি দেখে কিছু বলতে পারিনি।’
– ‘রুহি এখন কিছুদিন এই বাড়িতেই থাকুক। তুমি এই বাড়িতে ওকে সময় দাও আশা করছি ঠিক হয়ে যাবে।’
– ‘আচ্ছা তাহলে তাই হবে। আঙ্কেল আমি রুহিকে নিয়ে বিকালে একটু বের হতে চাই।’
– ‘আচ্ছা।’
বিকালে..
রুহি মনখারাপ করে একা ঘরে বসে আছে। জয় ধীর পায়ে ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়, রুহির সেইদিকে খেয়ালই নেয় ওহ নিজের মতো ভাবনায় ব্যস্ত। জয় রুহির কাঁধে হাত রাখতেই রুহি ধরফরিয়ে উঠে বলল,
– ‘দাদুভাই, দাদুভাই।’
জয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুহির হাতটা শক্ত করে ধরে বলল,
– ‘রুহি নিজেকে সামলাও। দাদুভাই আর ফিরে আসবে না।’
– ‘তুমি এইসব কি বলছো? কে বলেছে আমার দাদুভাই আর ফিরে আসবে না! ঠিকই আসবে। তুমি যাও তো আমাকে আমার মতো থাকতে দাও।’
– ‘না সেটা তো হচ্ছে না। আজকে এখুনি তুমি আমার সাথে বাইরে যাবে।’
– ‘কেন?’
– ‘দরকার আছে তোমার সাথে চলো।’
রুহি প্রথমে যেতে চাইনি শেষে জয়ের জোড়াজুড়িতে রাজি হয়েছে। বর্তমানে রুহি নিজের মধ্যে নেয়, কাকে কি বলছো নিজেই জানে না। বলে চলে রুহি বাস্তব জীবন থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
নদীর ধারে বসে রুহি নদীতে একটার পর একটা ঢিল ছুড়ে চলেছে। এই অভ্যাসটা ওর দীর্ঘদিনে, মনখারাপ থাকলেই ঢিল ছুড়তে থাকে।
– ‘খাবি!!’ (জয় রুহির সামনে বাদাম ভাজা ধরে বলল)
– ‘না।’
– ‘আচ্ছা রুহি এইভাবে মনখারাপ করে থাকলে কি সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে? দাদুভাই কি ফিরে আসবে!’
রুহি কিছু না বলে চুপ করে নদীর পানির দিকে তাকিয়ে আছে।
– ‘জানিস রুহি আমাদের জীবনটা এই নদীর মতোই। কখনো জোয়ার আবার কখনো ভাটা। তাই বলে আমরা থমকে যাবো! প্রতিটা মানুষকেই একদিন না একদিন এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে হয় আজ দাদুভাই করেছেন কাল হয়তো আমি করব।’
জয়ের এইরকম কথা শুনে রুহি ওর দিকে তাকায়। জয়ের মুখে এইরকম একটা শুনে চমকে উঠেছে। জয় ওর মনোভাব বুঝতে পেরে বলল,
– ‘আমি জাস্ট কথার কথা বলেছি। প্লিজ রুহি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আয়, তোকে এইভাবে মনমরা দেখতে আমাদের কারোর ভালো লাগছে না। তোকে নিয়ে বাড়ির প্রতিটি মানুষই চিন্তিত।’
– ‘বাড়ি ফিরব আমি।’
জয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুহিকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসল। কথাগুলো কাজ দিয়েছিল, রুহি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে।
হামিদ চৌধুরী সকলকে ডেকে পাঠালেন। কিছু কথা বলার জন্য। মাঝে বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেছে, রুহিও আগের থেকে স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে।
– ‘তোমাদের সকলকে আমার একটা সিদ্ধান্ত জানানোর ছিল।’
– ‘কি সিদ্ধান্ত দাদা?’
– ‘বাবা তো চলেই গেছেন তাই….
#চলবে…
পর্বটা লিখতে তিনটে দিন লেগেছে আমার। ইমোশনাল পর্বটা সাজাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছিলাম,বারবার আটকে যাচ্ছিলাম😪