#এক_টুকরো_সুখ
#পর্ব_১৭
#লেখনীতে_শুভ্রতা
নাজমুল চাচার ছেলের আর কোনো হদিস পাওয়া গেলো না। শুধু তার বন্ধুদের কাছ থেকে জানা গেলো কালকে বিকেলে সে বন্ধুদের সাথেই ছিলো। পরে কারো ফোন পেয়ে নাকি ব্রিজের দিকে যায়। এরপর থেকে তাকে আর কেউ দেখেনি। ফোনও বন্ধ আছে। তারপর সকাল বেলা ব্রিজের ওপর মোটরসাইকেল পাওয়া গেছে। পুলিশকে খবর দেওয়া হয়েছে কিন্তু তারাও কিছু বলতে পারেনি। অনেক বুঝিয়ে তবে নাজমুল চাচাকে আমাদের বাড়ি থেকে নিয়ে গেছে আশেপাশের লোকজন।
সকালের খাবার শেষ করার কিছু সময় বাদেই আম্মা আর মুহিন দিনাজপুরে যাওয়ার জন্য রওনা হয়েছে। আব্বা গেছেন তাঁদের ট্রেনে তুলে দিতে। সেখান থেকেই কাজে চলে যাবেন বলে গেছেন। বাড়িতে আমি একা। রান্নাবান্না আর না করলেও চলবে। আব্বা আসার আগে রান্না হলেই হবে। এরকমই ভাবছিলাম তারপর হঠাৎ মনে এলো দুপুরের কথা। যাব্বাবা লোকটার কথা এত জলদি জলদি ভুলে গেলাম কীভাবে? নিজের জন্য না হলেও তার জন্য তো রান্না করতেই হবে। এসব ভাবনার মাঝেই দুপুর চলে এলো যেন কোত্থেকে।
“কি গো মেম্বার সাহেবের সুপুত্র সাহেবের কথা ভাবছো নাকি সুন্দরী?”
বলতে বলতে আমার পাশে দাওয়ার ওপর মাটিতেই বসে পড়লো। আমি চরম বিরক্ত হলাম তার এহেন কথায়। সে ছেলের কথা আমি ভাবতে যাবো কোন সুখে? যদিও বুঝতে পারছি উনি মজা করেই বলছেন। তবু চোখ মুখ কুঁচকে তবে বললাম
“আমার তো মনে হচ্ছে আমি নয় বরং আপনিই তার কথা ভেবে ভেবে আকুল হচ্ছেন। আপনিই নাকি তাকে হুমকি টুমকি দিয়েছিলেন বলে শুনলাম। সত্যি নাকি? হুম হুম হুম?”
আমার কথাতে তার মধ্যে কোনো রকম হেলদোল দেখা গেলো না। চুল গুলো হাত দিয়ে পেছন দিকে ঠেলতে ঠেলতে বললো
“আরে হুমকি টুমকি কিছুই না। শুধু বলেছিলাম আমার বউয়ের দিকে নজর মনে দিতে। বেশি সুন্দরী কি না! তবে কে জানতো ওই এক কথার জন্য এত ঝামেলা হবে?”
“কেনো জানলে কি আর বলতেন না?”
“কোথায় না কোথায় গিয়ে হয়তো নেশা টেশা করে পড়ে আছে কে জানে। তাই নিয়ে এসেছে আমাকে দোষ দিতে। মানুষ পারেও বটে।”
আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে নিজের মতো কথা বলায় রাগ হলো আমার বেশ। তুই বলতিস না,ঠিক আছে। কোনো ব্যাপার না। তাই বলে কি কথার উত্তর দিবি না? এগুলো কেমন ব্যবহার। এসব ভেবেই আর কিছু বললাম না। উঠে যেতে নিলেই দুপুর হাত ধরে বসলো আমার।
“সবসময় এত পালাই পালাই করো কেন শুনি।”
কথাটা বলেই দুপুর আমাকে পেছন দিক থেকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে কাঁধের ওপর নিজের চিবুক ঠেকালো। শিউরে উঠলাম আমি। কেঁপে উঠলো আমার শরীরের প্রতিটা অঙ্গ। জীবনে প্রথম নিজের এত কাছে কোনো ছেলেকে অনুভব করে একসাথে দাঁড়িয়ে গেলো আমার প্রতিটা লোম। নড়বার মতো শক্তিও যেন হারিয়ে ফেলেছি এমন মনে হচ্ছিলো।
“আরেহ সুন্দরী এভাবে জমে যাচ্ছো কেনো? আমি তো তোমারই হাব্বি। আমার কাছে এত সংকোচ কিসের তোমার? নরমাল হও একটু।”
দুপুর আমাকে নরমাল হতে বললো বটে তবে আমি না পারলাম নরমাল হতে আর না তো পারলাম কিছু বলতে। আমাকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দুপুর হয়তো কিছুটা বুঝতে পারছিলো আমার অবস্থা। তাই বোধহয় ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে দাঁড়ালো।
“এই আয়ু কুল। আমি টাচ করেছিলাম বলে তোমার অস্বস্তি হচ্ছে? এই দেখো আর টাচ করছি না। তুমি না বললে আর করবোও না। তাকাও আমার দিকে। লুক অ্যাট মি।”
খানিক শান্ত হলাম আমি। নিজেকে ধাতস্ত করে বললাম
“না না ঠিক আছে। হঠাৎ করে নতুন পরিস্থিতি বলে একটু ঘাবড়ে গেছিলাম। সমস্যা নেই। তাছাড়া আপনার তো এখন অধিকার আছে। আচ্ছা আমি রান্না ঘরে যাই কেমন। আপনাকে তো দুপুরে খাবার দিতে হবে। বেলা অনেক হয়েছে। আপনি বসুন।”
কথা গুলো বলে আমি রান্না ঘরের দিকে এগোলাম। দুপুরকে বসতে বললেও উনি বসলেন না। আমার পিছু পিছু রান্না ঘর অবধি চলে এলেন। তা দেখে আমি একটু ভ্রু কুঁচকালাম তবে কিছু বললাম না। আমি উনুনে ভাত বসালাম তারপর তরকারি কাটতে বসলাম। দুপুর এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেও এবার বসে পড়লো। শুধু বসলেও সমস্যা ছিলো না কিন্তু উনি আমার হাত থেকে বটি টেনে নিলেন। এবার আর চুপ থাকা গেলো না।
“আরে বাবা সমস্যা কি আপনার? বটি নিয়ে টানাটানি করছেন কেনো? দেখছেন না তরকারি কাটবো আমি। এরপর ভাত হয়ে গেলে শুধু শুধু উনুন জ্বলতে থাকবে। দিন বটি দিন।”
বটি তো আমাকে দিলোই না উল্টো আমাকে অবাক করে দিয়ে নিজেই তরকারি কাটতে শুরু করলো।
“খেপে যাচ্ছো কেনো শুনি? আজ আমি তোমাকে তরকারি কেটে দেবো। তুমি মসলা গুছিয়ে ফেলো।”
বলে কি ছেলে! সে নাকি কাটবে তরকারি।
“আরে আরে করছেন কি! আমি থাকতে আপনি কেনো রান্না ঘরের কাজ করতে যাবেন? আপনি বাড়ির নতুন জামাই। এভাবে কেউ যদি এসে আপনাকে তরকারি কাটতে দেখে তবে আমাদের মানসম্মান কিছু থাকবে?”
কে শোনে কার কথা? দুপুর একমনে তরকারি কাটতে থাকলেন। আমার আর কি করার? সে যে আমার কথা শুনবে না তা বেশ বুঝতে পারছি। অগত্যা আমিও নিজের মতো অন্য সব জোগাড় করতে থাকলাম। কিন্তু ঐযে কথায় আছে না যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়! আমাদের দুজনের কাজের মধ্যেই বাড়িতে প্রবেশ করলো আমাদের দুই বাড়ি পরে থাকা রত্না চাচি।
“কই গো রাবেয়া ভাবি। দুই মেয়ের জামাই পেয়ে কি আমাদের ভুলে বসলে নাকি গা? খোঁজ খবর নাও না যে। বলি ও রাবেয়া ভাবি… সাড়া দেয় না যে। ও রুবি, আয়না কই গেলি রে তোরা সব।”
কি করে সাড়া দেবে? আম্মা বা রুবি আপা কেউ তো এখন নেই এবাড়িতে। দুপুরকে পাশ কাটিয়ে আমি উঠে গেলাম উঠোনে।
“বড় আপাকে দুলাভাই কাল বিকেলে নিয়ে গেছে গো চাচি। আর আম্মা সকালে ভাইকে সাথে নিয়ে দিনাজপুর রওনা হয়েছে। বাড়িতে এখন আমি আর তোমাদের ছোট জামাই আছি।”
“বলিহারি তোর মা বাপের আক্কেল আয়না। কাল বিকেলে বিয়ে হতে না হতেই আজ সকালে সেই জামাইয়ের সাথে তোকে একা বাড়িতে রেখে বেড়াতে চলে গেলো। যাগ্গে, আমার বাপু অত চিন্তা করে লাভ নেই। যাদের মেয়ে জামাই তারা বুঝুক। কই দেখি দেখি কেমন হলো তোর মায়ের ছোট জামাই। কই আছে জামাই বাবাজি!”
এই বলেই রত্না চাচি ঘরে যেতে গেলে আমি বাধা দিলাম তাকে।
“আসলে চাচি উনি ঘরে নেই।”
চাচি আমাদের দিকে একটু সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালেন।
“মানে কি বলছিস? ঘরে নেই তো আছে কোথাও? পুকুর পাড়ে বুঝি?”
“না চাচি রান্না ঘরে।”
আমার এ কথা শুনে চাচি বোধহয় অনেক বেশিই অবাক হলেন। আমাকে কিছু না বলেই রান্না ঘরের দিকে ছুটলেন। সেখানে দুপুরকে বসে তরকারি কাটতে দেখে হায় হায় করে উঠলেন।
“একি একি, বাড়ির নতুন জামাই রান্না ঘরে বসে মেয়েদের মতো তরকারি কাটছে! বলি তোর কি কোনো কাজ হয় আয়না? এভাবে জামাইকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিচ্ছিস!”
“আমি ওনাকে বারণ করেছিলাম চাচি, উনি শোনেনি।”
“থাম মেয়ে। দয়া করে আল্লাহ কি একটু রূপ দিয়েছে না দিয়েছে তাতেই এই! নিজের জামাইটাকেও ছাড়লি না? বললি তো মা বাড়ি নেই। দুই, তিন জনের রান্নায় কি এমন কাজ যে তুই ছেলেটাকে দিয়ে দিলি মেয়েলি কাজে?”
চাচি আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিজে নিজেই বকে যাচ্ছেন। আরে বাবা আমাকে কিছু বলতে তো দিবি অন্তত। ওই ছেলেকে তো আমি বারণ করেছিলাম। কিন্তু সে কি এত ভালো ছেলে যে আমি মানা করলেই শুনে বসে থাকবে চুপচাপ। তার জন্য এখন এই মহিলার কাছে আমাকে কথা শুনতে হচ্ছে দোষ না করেও।
“আপনার ভুল হচ্ছে আন্টি। আয়না আমাকে কোনো কাজ করতে বসিয়ে দেয়নি। আমি নিজেই জোর করে ওর থেকে বটি কেড়ে নিয়েছি। ও তো আরো আমাকে বারণ করছিলো।”
চাচির ক্যারক্যার শুনে দুপুরই উঠে এসে কথা গুলো বললো। কিন্তু এতে চাচি থামলো তো নাই বরং যেন কথা শোনাবার আরো অজুহাত পেলো।
“থাক থাক বাবা। তোমাকে আর বউয়ের হয়ে কথা বলতে হবে না। আমার এই চুল গুলো বাতাসে পাকেনি বুঝলে, বয়সে পেকেছে! একটু রূপসী বউ পেয়েছো তো, বউয়ের কথাই সব। তোমাদের আজ কালকার ছেলেপুলের যে কি একটা অবস্থা বাবা। বউ পেলে আর দুনিয়ার হুশ থাকে না।”
চাচির কথায় এবার আমার কান্না পেয়ে গেলো। কি এক রূপ নিয়ে জন্মেছি যার কারণে মা, বোন, প্রতিবেশী, আত্মীয় সবার কাছে খোটা শুনতে হচ্ছে। এমন রূপ না থাকলেই ভালো হতো।
“এগুলো আপনার ভুল ধারণা আন্টি। হ্যাঁ হয়তো আপনার বয়স, অভিজ্ঞতা অনেক বেশি কিন্তু মানসিকতা খুবই নিচু। আপনারা সবসময় মেয়েদের কথা শুনিয়ে দিতে পারলেই বেঁচে যান বলে আমার মনে হয়। আচ্ছা বলুন তো কোথায় লেখা আছে যে রান্নাবান্না, ঘরের কাজ কেবল মেয়েদের? ছেলেরা করতে পারবে না! এখানে তো আমার তেমন কোনো কাজ নেই। তাহলে আমি নিজের স্ত্রীকে তার কাজে একটুখানি সাহায্য করলে সমস্যা কোথায়?”
এবার দুপুরের কথা গুলো শুনে চাচি প্রচন্ড রেগে গেলেন।
“হয়েছে হয়েছে। নাহয় তোমরা একটু বেশি লেখাপড়া করেছো বাপু। তাতেও এভাবে কথা শোনানোর কিছু নেই। চলে যাচ্ছি আমি। তোমরা তোমাদের মানসিকতা নিয়ে থাকো। হুঁহ। আদিক্ষেতা দেখলে গা জ্বলে যায়।”
আরো নানা কথা একা একা আওড়াতে আওড়াতে মহিলা বেরিয়ে গেলেন বাড়ি থেকে। আমাদের প্রতিবেশী মানুষ গুলোর এই এক সমস্যা। এরা নিজের কাজ করার থেকে অন্যের কাজের নিন্দে করে বেশি আনন্দ পায়। কে কোথায় কি করলো, কার কে মরলো, কার মেয়ে কোথায় যাচ্ছে সহ নানা তালবাহানা। আমি জানতাম কেউ দুপুরকে কাজ করতে দেখলে এরকম কিছুই হবে। তাই বারণ করেছিলাম। কিন্তু সে কি আর আমার কথা শুনবে!
“বলেছিলাম না কাটতে হবে না আপনাকে তরকারি? আমি করে নিতে পারব নিজের কাজ। কেউ দেখলে শুধু শুধু কথা শুনতে হবে তা জানতাম আমি। শুনলেন না তো আমার কথা। এখন ভালো লাগছে তো আমাকে এত গুলো কথা শুনিয়ে?”
বলেই রান্না ঘরে ঢুকে নিজের কাজ করতে শুরু করলাম। দুপুর আবারও এসে সেখানে বসলো।
“তুমি যার তার কথায় কান দাও কেনো বলো তো? এদের কথায় কোনো যুক্তি আছে হ্যাঁ? এরকম মানুষের কথা শুনে কখনো নিজের মন খারাপ করবে না বলে দিলাম। মুখের ওপর জবাব দিয়ে দেবে। তাতে যা ভাবার ভাবুক।”
আমি আর কথা বাড়ালাম না। এখন আর একটুও ইচ্ছে নেই এসব নিয়ে তর্ক করার। দুপুর হয়ে এলো রান্না শেষ করতে হবে। আবার আব্বাও খেতে চলে আসতে পারেন বলা যায় না।
বিকেলের দিকে আব্বা বাড়ি ফিরলেন। জানালেন কালকে আমাকে নিয়ে যাবেন কলেজে ভর্তি করাতে। আমি বেশ খুশি হলাম আব্বার কথা শুনে। আবার নতুন করে নতুন জায়গা থেকে , নতুন বইয়ের সাথে আমার লেখাপড়া শুরু হবে। আনন্দ পাওয়ারই তো কথা। পরদিন যথারীতি গেলাম আব্বা আর দুপুরের সাথে কলেজে ভর্তি হতে। ব্রজলাল কলেজে ঠায় হলো আমার। খারাপ না, ভালোই হবে। বেশ খুশিখুশি দিন পার হলো আমার।
রাতের বেলায় যখন আব্বা আর দুপুর খেয়ে শুয়ে পড়েছেন আর আমি খাচ্ছি, তখন আবার ফোন এলো দিনাজপুর থেকে। আম্মা ওপাশ থেকে ফোনটা আব্বার কাছে দিতে বললেন। আমিও তাই করলাম। কথা বলতে বলতে আব্বার চেহারা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে উঠলো। তারপর ফোন রেখে আব্বা জানালেন আসলে নানু কোনো কালেই অসুস্থ হননি। সেগুলো ছিলো আম্মাকে দিনাজপুর পর্যন্ত নেওয়ার বাহানা। অর্থাৎ পুরোটাই মিথ্যে কথা।
চলবে…?