#এক_টুকরো_সুখ
#পর্ব_১৯
#লেখনীতে_শুভ্রতা
“একি নাঈম ভাই তুমি এখানে!”
এত রাতে পেছনে থেকে কাঁধে কেউ হাত রাখায় ভেবেছিলাম হয়তো দুপুর উঠে এসেছে। কিন্তু পেছনে ঘুরে দুপুরের বদলে নাঈম ভাইকে দেখে আমার মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। কিন্তু নাঈম ভাই তো উধাও হয়ে গেছিলো। তবে এখানে এত রাতে আমাদের বাড়িতে কীভাবে এলো? আর ছিলোই বা কোথায়? যেখানেই থাকুক নিজের বাবাকে বলেনি কেনো?
“কেন রে আয়না? এখানে বুঝি তোর জামাইকে আশা করেছিলি? কি ভেবেছিলি তোরা? আমি সরে গেছি তোদের জীবন থেকে? তোর শহুরে জামাইয়ের দু’চারটে ফাঁকা হুমকি শুনে আমি তোদেরকে ছেড়ে দেবো? বলি এতই সহজ নাকি হ্যাঁ? এটা আমার এলাকা, আমি যা বলবো তাই হবে। এবার দেখ আমি তোদের কি অবস্থা করি।”
“দেখো নাঈম ভাই তোমাকে আমার পছন্দ না আর তাছাড়া আব্বাও তোমাকে ভালো চোখে দেখেন না। আব্বা যাকে পছন্দ করেছেন আমি তাকেই বিয়ে করেছি। এতে তোমার রাগ করার কিছু আছে বলে মনে হয় না। চলে যাও এখান থেকে, তাতে তোমারও ভালো হবে আমাদেরও ভালো হবে। আর যদি না যাও তবে আমি চিৎকার করতে বাধ্য হবো।”
আমার কথাতে নাঈম ভাইয়ের মাঝে কোনো রকম হেলদোল দেখা দিলো না। এবার আমার একটু ভয় ভয় করতে লাগলো। দুপুরের নাম ধরে জোরে এক ডাক দিতেই নাঈম ভাই আমার মুখ চেপে ধরলো। আমি আবার ডাকতে গিয়েও পারলাম না। মুখ থেকে আওয়াজই বের হলো না।
নাঈম ভাই আমাকে টানতে টানতে বাড়ির বাইরে নিয়ে যেতে শুরু করলো। আমি ছোটার জন্য ছটফট করলেও পেরে উঠলাম না। বাড়ির উঠোনে থাকা জাম গাছের নিচে এসে আমাদের ধস্তাধস্তিতে কিছু একটা পড়ে গিয়ে শব্দ হলো। অন্ধকার থাকায় কি পড়লো তা ঠিক মতো দেখতে পেলাম না। আর কিছু খেয়াল করার আগেই নাঈম আমাকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গ্রামের শেষ মাথার দিকে চলতে শুরু করলো।
এদিকে ঘুমের মাঝে একবার আয়নার ডাক শুনতে পেলেও তা ভ্রম মনে করে আবারও ঘুমুতে চেষ্টা করে দুপুর। কিন্তু তার কিছু মুহূর্ত পরেই আবারও উঠোন থেকে কিছু একটা পড়ার ফলে বেশ জোরেই শব্দ হয়। হুড়মুড় করে বাইরে বেরিয়ে আসে দুপুর। আয়নার ঘরে গিয়ে তাকে না পেয়ে বুঝে যায় কিছু একটা বিপদ হয়েছে। কাল বিলম্ব না করেই সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে টর্চ জ্বেলে এদিক ওদিক দেখতে থাকে। তখনই নজরে আসে বেশ খানিক দূরে দুটো ছাঁয়া দেখা যাচ্ছে। দুপুরের আর বুঝতে বাকি রইলো না ঐখানে একটা ছাঁয়া অবশ্যই আয়নার।
আমাকে নিয়ে নাঈম ভাই গ্রামের শেষ মাথায় থাকা উঁচু দেওয়ালে ঘেরা এক পরিত্যাক্ত বাড়ির মাঝে ঢুকলো। আমার ভয় আরো বেড়ে গেলো। এখানে আমার মুখ খোলা থাকলে কি হবে? আমার চিৎকার শুনতে কেউ আসবে না। কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না আমি। দুপুর কি আমার গলা শুনতে পায়নি? কি হবে এখন আমার? আবার কিছু যে করবো তারও উপায় নেই। আমার ওড়না দিয়ে আমার হাত বাঁধা। নাঈম ভাই আমাকে নিয়ে ভাঙাচোরা ঘরটার মেঝেতে ফেলে দিলো। নিজে একটা কাঠের চেয়ারে বসে পড়লো।
“কিরে আয়না কেমন লাগছে? জায়গাটা সুন্দর না? আমাদের বাসর করতে কোনো অসুবিধা হবে না রে।”
ঘৃণায় আমার সারা শরীর রি রি করে উঠলো। মানুষ এতটা নিচ কীভাবে হতে পারে! আমার বিয়ে হয়ে গেছে, আমি এখন অন্য কারো স্ত্রী তা জানার পরেও নাঈম ভাইয়ের মুখে এসব কথা বলতে একটুও বাঁধছে না?
“তুমি বখাটে তা জানতাম নাঈম ভাই। কিন্তু তুমি যে এতটা চরিত্রহীন তা জানা ছিলো না আমার।”
আমার কথা শুনে সে বিশ্রী ভাবে হেসে উঠলো। মধ্য রাতে এই জনমানব শুন্য বাড়িটার চতুর্দিকে প্রতিফলিত হলো সেই হাসি। আরেক দফা শিউরে উঠলাম আমি।
“সে তুই আমাকে যে গালিই দিস না কেন আয়না বাসর তো আজ হবেই। তোর আর আমার বাসর। আচ্ছা তোর বরের সাথে বাসর হয়েছে নাকি? সে যাই হোক। হলে বা আমার কি আর না হলেই বা আমার কি? আমার সাথে হলেই হচ্ছে এখন, কি বলিস?”
এবার আমি মুচকি হাসলাম। ভয় পেয়ে লাভ হবে কি? ও আরো বেশি ভয় দেখাবে। আমার হাসি দেখে নাঈম ভাই ভড়কে গেলো বৈ কি। ড্যাপড্যাপ করে চেয়ে রইলো আমার পানে। স্তম্ভিত ভাব কাটিয়ে উঠতেই চেঁচায়ে বলে উঠলো
“এই মেয়ে এই তুই হাসছিস কেন? ভয় হচ্ছে না তোর আমাকে দেখে? আমি পরপুরুষ হয়ে তোকে ভোগ করবো, তোর চিন্তা হচ্ছে না? কেউ আসবে না রে তোকে বাঁচাতে। সবাই ঘুমে বেহুঁশ। ও বুঝেছি, তুইও মনে মনে আমাকে চাস তাই না। হাহাহাহা। সেটা আগে বললেই পারতিস। এত কষ্ট করতে হতো না আমাকে।”
ছেলেটার অনর্গল এহেন নোংরা কথা শুনে আমার গা গুলিয়ে উঠলো।
“তোমার মতো নোংরা একটা মানুষকে আমি চাইবো তা ভাবলে কি করে? আমার হাসির কারণ অন্য। আসলে কি বলোতো, ওই উপরে সৃষ্টিকর্তা বলে একজন আছেন। আমাদের সাথে কি কি ঘটবে তা একমাত্র উনি ব্যাতিত কেউই জানে না। উনি যদি আমার ভাগ্যে এরকম সর্বনাশ রেখে থাকেন তবে তাতে আমার আফসোস কেনো থাকবে বলো? আমার জন্য যা ভালো উনি অবশ্যই তাই রেখেছেন আমার জন্য। তার বাইরে তুমি চাইলেও কিছু করতে পারবে না নাঈম ভাই।”
আমার কথা শুনে তার চোখ মুখ রক্তিম হয়ে এলো। চেয়ার থেকে উঠেই তড়িৎ গতিতে এসে এক হাতে আমার গাল চেপে ধরলো।
“তোদের বাপ মেয়ের এত তেজ কোত্থেকে আসে শুনি? একদম হুবহু বাপের মতো হয়েছিস না রে। কিন্তু কি বল তো আয়না, এখানে তোর কোনো সৃষ্টিকর্তা তোকে আমার হাত থেকে বাঁচাতে আসবে না। আর না তো আসবে তোর ওই শহুরে হিরো বা অন্য কেউ। সর্বনাশ তোর আজ আমি করবোই। একসাথেই বাপ বেটির শিক্ষা হবে।”
আমি কিছু না বলে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। এরকম মানসিকতার লোকজনের সাথে কথা বলাই বৃথা সময় নষ্ট। তা দেখে নাঈমের রাগ আরো বেড়ে গেলো বোধহয়। নিজের শার্ট খুলে ছুড়ে মারলো সে।
“দেখ আয়না শুভ কাজে দেরি আমার একদম পছন্দ না। বাসর যখন করতেই হবে তখন আগে ভাগেই করে ফেলি চল। আর যদি তুই রাজি না হোস সহজে তবে আর কি? অগত্যা আমাকে জোরই করতে হবে।”
কথা শেষ হতে না হতেই সে আমার দিকে এগোতে শুরু করলো। ভেতরে ভেতরে তো আমি ভয়ে শেষ। আমার মতো গরিব বাবার মেয়ের এরকম সর্বনাশ হলে আর সমাজে মুখ দেখাতে পারবো না। এমনকি হয়তো দুপুরও আমাকে ছেড়ে দেবে। এখন কি করবো আমি? নিজেকে কীভাবে বাঁচাবো? মনে মনে আল্লাহর নাম নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই আমার। ভয়ের চোটে শেষমেষ চোখ জোড়া বন্ধই করে নিলাম।
হঠাৎ বাইরে কয়েক জোড়া পায়ের শব্দ শুনে জানে পানি এলো আমার। এরপরই হুড়মুড় করে সেই ভাঙা ঘরের মধ্যে দুপুর সহ কয়েকজন পুলিশ প্রবেশ করলো।বুঝলাম দুপুর তখন যেকোনো ভাবে আমাদের এদিকে আসতে দেখেছে। এবং সেই পুলিশ ডেকে এনেছে। এতক্ষণ শক্ত থাকতে পারলেও দুপুরকে দেখে আর ঠিক থাকতে পারলাম না। ডুকরে কেঁদে উঠলাম আমি। তা দেখে দুপুর ছুটে এসে আমার হাতের বাঁধন খুলে আমাকে বুকে জাপটে ধরলো।
“কাঁদে না আয়ু। আমি এসে গেছি তো। কিচ্ছু হবে না তোমার, আমি আছি তো তোমার সাথে। তাকাও আমার দিকে।”
চিবুক ধরে মুখ উঁচু করে আমার চোখের পানি মুছে দিলো দুপুর। আমি আর কোনো কথা বলতে পারলাম না। লেপ্টে রইলাম তার বুকে। এদিকে নাঈম ভাই দুপুর আর এতজন পুলিশ দেখে একপ্রকার দিশেহারা। সে সুযোগেই তাকে পাকড়াও করা হয়। টানতে টানতে তাকে আমাদের সামনেই পুলিশ নিয়ে গেলো। তাঁদের সাথে সাথে দুপুরও আমাকে নিয়ে বাড়িতে এলো। আব্বাও এতক্ষণে সব জেনে চিন্তায় চিন্তা ময় অস্থির হয়ে আছেন।
“ওই মেম্বারের ছেলে তোমাকে অতদূর কীভাবে নিয়ে গেলো? তোমার তো খাওয়া শেষ করে ঘরে শুয়ে পড়ার কথা ছিলো তাই না? কথা বলো আয়না।”
দুপুরের প্রশ্নে কি উত্তর দেবো তা ভেবে পাচ্ছি না আমি। সে তো ঠিকই বলছে। আমার তো শুয়ে পড়ার কথাই ছিলো। আমিই তো বাড়াবাড়ি করে উঠোনে দাঁড়াতে গেছিলাম। আমি এরকম না করলে তো আর নাঈম ভাই আমাকে নিয়ে যেতে পারতো না।
“আসলে ঘুম আসছিলো না বলে একটু বাইরে দাঁড়িয়েছিলাম। তখনই নাঈম ভাই…”
আমাকে আর কিছু বলতে না দিয়েই আব্বা ধমকে ওঠেন।
“চুপ করো আয়না। তোমার কি ধারণা অনেক বড় হয়ে গেছো তুমি? যখন যা ইচ্ছে হবে তাই করবে? এত রাতে উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকার মানে কি? তুমি জানতে না নাজমুল মেম্বার আর তার ছেলে আমাদের ক্ষতি করার জন্য কেমন মুখিয়ে থাকে! তোমার থেকে এরকম বোকামি আমি কখনো আশা করিনি আয়ু।”
আর কিছু না বলেই আব্বা ঘরে চলে গেলেন। আব্বা কখনো আমার সাথে এত কড়া ভাবে কথা বলেননি। কিন্তু এখানে মন খারাপ করার থেকে বেশি রাগ হচ্ছে আমার নিজের ওপর। আমার জন্যই এত কিছু হলো। আব্বা, দুপুর কত চিন্তায় পড়ে গেছিলো।
“আমিও কিন্তু তোমার থেকে এরকম কিছু আশা করিনি আয়না। নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে হতো তোমাকে।”
দুপুরও চলে গেলো। আচ্ছা আমি কি জানতাম নাকি যে এরকম কিছু হবে? মানলাম ভুল করেছি, তা বলে সবাই এভাবে চলে যাবে? ভুল তো মানুষেরই হয় তাই না? আমারও হয়েছে। ওরা দুজনই এভাবে না চলে গেলেও পারতো। যাক ওরা, লাগবে না আমার কাউকে। আমি একাই থাকতে পারবো। আবেগের বশে নিজের ভুলের দিকে না তাকিয়েই আব্বা আর দুপুরের ওপর অভিমান করে বসলাম আমি। এটা আমার মস্তিষ্ক বুঝতেই পারলো না যে তারা যা বলেছে সবই আমার ভালোর জন্য।
চলবে…?