বিবর্ণ_বৈশাখে_রংধনু #নুরুন্নাহার_তিথী #পর্ব_৬

0
167

#বিবর্ণ_বৈশাখে_রংধনু
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৬
শীতলতায় পরিপূর্ণ নতুন প্রত্যুষ। খুব ভোরে রুহানীর ঘুম ছুটে গেছে। শেষ রাতের দিকে ঝড়-বৃষ্টি হয়েছিল সেটাও আবহাওয়াতে পরিলক্ষিত। ফজরের নামাজ পড়েই সে তার রুমের সাথে লাগোয়া ছোটো ছাদে চলে যায়। সেখানে গাছের পাতা ও নরম কচি ডাল এসে পরে আছে। তার রুমটা দ্বিতীয় তালাতেই কিন্তু অর্ধেক তালা উপরে। এক দিকে প্রকাণ্ড জানালার কারণে পুরোটাই খোলা বলা চলে আরেকপাশে তো ছোটো ছাদের মতো। সেখান থেকে সকাল সকাল চা বাগানটা দেখে তার ভীষণ যেতে ইচ্ছে করছে। ধরণীতে আলো ফুটলেও পূর্ব দিগন্তে সূর্যরশ্মির এখনো দেখা মিলেনি। রুহানী আর দেরি না করে দ্রুত একটু নিরিবিলিতে হাঁটতে ও সূর্যদোয় দেখতে বেরিয়ে পরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চা শ্রমিকরা বাগানে কাজে চলে আসবে।

আরহান যখনি সিলেটে থাকে তখন তার প্রতিদিনকার অভ্যেস হচ্ছে সকালে ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ে প্রাতঃভ্রমণের জন্য বেরিয়ে পরা। আজও তাই করল। হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা দূরে এসে দেখল একটা মেয়ে ঢালের কাছে বসে কিছু একটা করছে। আরহান সেদিকে এগিয়ে গেল।

“এক্সকিউজ মি ম্যাম, আপনি এখানে বসে আছেন কেন?”

হঠাৎ পুরুষালী কণ্ঠস্বরে হকচকিয়ে উঠে রুহানী। দ্রুত পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে গতরাতের ছেলেটি। আরহানও রুহানীকে দেখে বলে,
“আরে মিস রুহানী! কেমন আছেন? এতো সকালে চা বাগানে যে?”

রুহানী এমনিতেই ঝামেলাতে ফেঁসে গেছে, তারউপর গতরাতের সেই ছেলেটিকে দেখে তার মুখচ্ছবিতে বিরক্তি ফুটে ওঠল। আরহান বিষয়টা লক্ষ্য করে রুহানী কী করছে তা দেখে বলল,
“ওহ সরি। দিন আমি ঠিক করে দেই।”

রুহানী ইশারায় হাত নেড়ে তার জুতো দেখিয়ে কিছু বুঝাল। আরহান কিছুটা আন্দাজ করে বলল,
“কী বলছেন? আমি মু’চি কী-না?”

রুহানী হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়াল। আরহান জবাবে বলল,
“না। আমি মুচি না। তাও কিছুটা হেল্প করতে পারি। তবে আপনাকে দেখেও কিন্তু কোনো অ্যাঙ্গেল দিয়ে মু’চি লাগছে না। আপনি যেভাবে জু*তো ঠিক করতে উঠে পরে লেগেছেন!”

রুহানী এবার উঠে দাঁড়িয়ে জু*তো জোড়া খুলে হাতে নিয়ে বাড়ির পথে হাঁটতে থাকে। তার পাজামার হাঁটুর কাছে ও সাইডে খানিকটা কাঁদা লেগে আছে। সূর্যদোয় দেখার পর এতোটা বিমোহিত ছিল যে সে ঢালের কাছে দাঁড়ানো খেয়াল করেনি। আর পরে গিয়ে কাঁদা তো লেগেছেই সেই সাথে এক পাটি জুতোও ছিঁড়ে গেছে। হাতের তালু কিছুটা ছিলে গেছে সেটাতে এখন তার মনোযোগ নেই। আরহান পিছু পিছু যেতে যেতে বলে,

“আপনি কী হাসতেও জানেন না? সবসময় এমন করে থাকেন কেন?”

রুহানী পিছন দিকে ফিরে দুই হাত জোড় করে ইশারায় পথ দেখায়। তখন আরহান আবার বলে,
“আপনি কথা বলতে পারেন না কিন্তু কানে তো শুনতে পারেন। আপনি যা বলার সাইলেন্টলি মুখ নাড়িয়ে বলতে পারেন। আমি লিপরিড করতে পারি। মানে আমার এসবে জ্ঞান আছে। যারা কথা বলা ও কানে শুনতে পায় না তারা মুখ নাড়িয়ে বলতে পারে না বলে জানি কারণ তারা কোন শব্দের কেমন উচ্চারণ হয় তা ধরতে পারে না। আপনার তো সেটার প্রবলেম হওয়ার কথা না।”

রুহানী থমকে দাঁড়াল। অতঃপর অজান্তেই হেসে ফেলল। মুখ নাড়িয়ে নিঃশব্দে বুঝাল,
“আপনি লিপরিডিং জানলেও সবাই জানে না মিস্টার। আমার লিখে লিখে, ইশারাতে বুঝানোতে অভ্যেস আছে।”

“আমি তো শুধু আমার জন্য বলেছি। অন্যকারও জন্য না।”

কথাটা খুব সাধারণ হলেও আরহানের চোখের ভাষার দরুণ কথাটা রুহানীর শুভ্রকায়াতে শীতল হাওয়া বয়ে যাওয়া অনুভব করাল। রুহানী দ্রুত সম্মুখে অগ্রসর হলো। আরহানের আর একটা ডাকেও সাড়া দিল না। আরহান সাড়া না পেয়ে নিজের চুলে হাত বুলিয়ে মুচকি হেসে অন্যদিকে চলে গেল।

রুহানী বাংলোতে ফিরে দ্রুত শাওয়ার নিয়ে ডায়েরি নিয়ে বসল। ডান হাতের তালুতে কিঞ্চিত জ্বা*লাপো*ড়ার উদ্রেক হলেও সকালের ঘটনাটা লিখে রাখল। তারপর নিজের ব্যাগ থেকে এন্টিসেপটিক ও তুলো বের করে হাতের ওই অংশটুকু পরিষ্কার করে নিল। তারপর একটা ব্যান্ডেজ লাগিয়ে রাখল।

জাহানারা শেখ সার্ভেন্টদের কাছ থেকে রুহানীর খবর পেয়ে ওর ঘরে আসে। তারপর কপট রাগ দেখিয়ে জিজ্ঞেসা করে,
“গতরাতে ঝড়-বৃষ্টি হয়েছে আর তুই সকাল সকাল বেরিয়ে গেছিস! ভালো হয়েছে কাঁদায় মাখামাখি হয়ে এসেছিস।”

রুহানী টেরেসে বসে বসে বই পড়ছিল। চাচির মেকি রাগ দেখে হেসে ফেলে।
“তুই হাসছিস? সাহস বেড়ে গেছে তাই না? একা একা চা বাগানে বের হয়ে যাস।”

রুহানী পাশ থেকে খাতা কলম নিয়ে লিখল,
“আমার ভালো লাগে। সবুজ প্রকৃতি, সবকিছু সবুজে ঘেরা, পাখির কলরব। সব যেনো আমার নিরবতার সঙ্গী হয়। আমার সাথে কথা বলে। আমাকে বিনাবাক্যে বুঝে। আমি তো ভাবছি চাচ্চুকে বলব আমাকে এখানেই ভর্তি করতে।”

জাহানারা শেখ লেখটা পড়ে হতবাক হয়ে রইলেন। কিয়ৎক্ষণ পর বললেন,
“কী বলছিস? তোর চাচা তো তোর জন্য ঢাকায় ভালো প্রাইভেট ভার্সিটিতে ভর্তির ব্যাবস্থা করছে।”

রুহানী আবার লিখল,
“না চাচি। আমি জানি আমার পড়ালেখাতে শুরু থেকেই গ্যাপ পরে গেছে। এইচএসসিও এক বছর আগে দিয়েছি। তাছাড়া ঢাকায় কতোকিছু হলো বলেই তোমরা বিয়ে দিতে এখানে এলে। এখানেও বিয়েটা হলো না। একদিকে ভালোই হয়েছে। আমি এখন এখান থেকেই শুরু করব। আমার কাছে সিলেটেই বেশ ভালো লাগছে। আমি এখানেই থাকতে চাই। এম সি কলেজে ভর্তি হতে চাই। প্লিজ চাচুকে বলো।”

“তুই তোর চাচুকে বুঝাস। তোর চাচু তো কাল রাতে বলল, পরশু ঢাকায় ফিরে যাবে। প্রাইভেট ভার্সিটিতে এখন সামারের সার্কুলার ছেড়েছে। এখন ভর্তি করানো যেত। তুই আর তোর চাচা যা বুঝিস কর। এদিকে সকাল সকাল রিহা ফোন করে বলছে জামাই সহ এখানে আসবে! ও আসা মানে কিছু তো বলবেই।”

চাচির মুখ থেকে রিহার আসার কথা শুনে রুহানী চোখ নিচু করে ধীর গতিতে খাতায় লিখল,
“আসুক। তারও তো অধিকার আছে। তোমরা আপুর মা-বাবা, আপু তোমাদের কাছে তো আসবেই। তোমরা অযথাই চিন্তা করছ। কিছু হবে না। আমি নাহয় আজ ঘর থেকে বেরোব না।”

জাহানারা শেখ রুহানীর পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“তুই কেন বের হবি না? অবশ্যই বের হবি। এই বাংলোটা তোর। আপু-ভাইয়া নিজেদের শখে এই বাংলো করেছে। এটা তোর নামে লেখা ছিল। তোর বাড়িতে তোকেই কেন লুকিয়ে থাকতে হবে? তুই তোর মতো থাকবি।”

রুহানী ঠোঁটের কোণের কৃত্রিম হাসির রেখা টানে। জাহানারা শেখ মলিন হেসে রুম থেকে চলে যান।
_________

আরও কিছুক্ষণ হাঁটার পর বাড়িতে ফিরে আরহান দেখল তার দাদী খাবার টেবিলের চেয়ারে বসে চা খাচ্ছে। আরহান উৎফুল্ল মনে দাদীকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে।
“গুড মর্নিং দাদী।”
আরহানের দাদী আয়েশা খানম হেসে আরহানের হাতে স্নেহের পরশ দিয়ে জুসের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলেন,
“গুড মর্নিং দাদুভাই। যাও হাত-মুখ ধুঁয়ে আয়। তোর বাবা এখনি নাস্তার জন্য আসবে।”
আরহান জুসটুকু খেয়ে নিয়ে বলে,
“হ্যাঁ যাচ্ছি।”

আরহান যাওয়ার পথেই তার বাবার সাথে দেখা হয়ে যায়। সকাল সকাল বাবাকে দেখে প্রতিদিনকার মতো পাশ কাটিয়ে না গিয়ে এক টুকরো মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে নিজের ঘরের দিকে যায়। আজমল খান ডাইনিং টেবিলে এসে বসে বলেন,

“মা, আপনার নাতি আজ একটু বেশি ফুরফুরে না?”
“হ্যাঁ তাই তো দেখছি। হয়তো আজ আবহাওয়াটা ফুরফুরে তাই ওর মনটাও।”
“হয়তো।”

এই বলে আজমল খান সার্ভেন্টকে নাস্তা আনতে বললেন।

কিছুক্ষণ পর হাত-মুখ ধুঁয়ে এসে খাবার টেবিলের কাছে এসে তার বাবার বিপরীত পাশে চেয়ার টেনে বসে। নিজেই রুটি-ভাজি তুলে নিয়ে খাচ্ছে তখন আজমল খান খেতে খেতে বলেন,
“রহমত শেখ আজকে তার বাড়িতে আমাদের ইনবাইট করেছে।”

আরহানেরও গতরাতের কথা মনে পরে। সে বলে,
“হু। আমাকেও বলেছে।”
“তাহলে দুপুরে তৈরি থেকো। তুমি, আমি ও মা যাব।”
“আচ্ছা।”

আজমল খান ছেলের এতো শান্ত ভাবে মেনে নেওয়াতে কিছুটা অবাক হলেন। তাও তিনি প্রশ্ন করলেন না। নাস্তা শেষে আরহান বলে,

“আজ সন্ধ্যায় আমার ফ্লাইট আছে। রহমত আঙ্কেলের ওখান থেকে ফিরে আমি চলে যাব।”

আজমল খান কিছু বললেন না। আয়েশা খানম বললেন,
“আজকেই? তুই তো আগে বলিসনি।”

“কাল রাতেই জানলাম। আগে জানতাম না।”

এই বলে দাদীর এক গাল টেনে হেসে নিজের ঘরে চলে যায়।

চলবে ইনশাআল্লাহ,
ইদ মোবারক প্রিয় পাঠক। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here