ফানাহ্ 🖤 #পর্বসংখ্যা_২৬

0
498

#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_২৬
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান

– আরে কি হয়েছে বলবি তো? এভাবে মুখ ফুলিয়ে থাকলে বুঝবো কি করে আমি?

– বোঝা লাগবে না তোর

মোহর ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে টানটান চোখে তাকালো। আজকে ক্যাম্পাসে আসতে অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে, তার কারণ অবশ্যই সকালের ঘটনা গুলো। এখন এসে থেকে শ্রীতমার ভার করা মুখ টাই দেখে যাচ্ছে। মেয়েটা না কিছু বলছে নাইবা তাকাচ্ছে, এভাবে গোমড়া মুখে থাকলে বুঝবে কি করে!

– আচ্ছা আমার ভুল হয়ে গেছে। আর হবে না, এখন বল কি হয়েছে!

শ্রী ফুলিয়ে রাখা মুখটা সেভাবেই রেখে ঘুরে তাকালো। মোহরের দিকে তর্যনী তুলে ফ্যাসফ্যাস করে বলল

– তুই খুব খুব খুব খারাপ। তুই আমার বান্ধবীই না। কাল কেন আসলি না তুই বল, আবার আজ এসেছিস তো দেরীতে। এখন কেন শুনতে চাচ্ছিস আমার কথা, আমি কে আমি তো কেও না। কেও আমার খোঁজ খবর রাখে না আমার সাথে দেখা করার দরকার ই নেই তো। আমি আর কে

বলতে বলতে টুপ করে এক ফোঁটা পানি টপকে পড়লো চোখ থেকে। মোহর আবারও মুখ চিরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এই মেয়েটার ঠিই এই স্বভাব টার কারণে মোহর ভয়ে থাকে কখন কি ধরে মুখ ফুলিয়ে বসে।
এগিয়ে এসে বসলো শ্রীয়ের নিকটে। হাতের তালুতে ওর চোখ দু’টো মুছে দিয়ে স্নেহমহী গলায় বলল

– আচ্ছা আর কখনো এমন করবো না। ঝড় হোক তুফান হোক আগে আমি আমার কাঁদুনি বান্ধবী টার কাছে এসে সব কথা শুনবো তারপর বাকি সব। এবার বল তো কি হয়েছে?

– অরুনাভের জন্মদিন আজ, আমি কাল রাতে ওর জন্য স্পেশাল কেক ও অর্ডার দিয়েছিলাম। তুই ছিলি না বলে সন্ধ্যায় একাই গেছিলাম মার্কেটে ওটা আনতে কিন্তু রাস্তার মাঝে একটা হাম্বার সাথে ধাক্কা লেগে কেকটা নষ্ট হয়ে গেছে

– হাম্বার সাথে?

– হ্যাঁ হাম্বা নয়তো কি, অসভ্য টার সাথে ধাক্কা লেগে আমার কেকটা পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। এখন আজ আমি ওকে কিভাবে সারপ্রাইজ দেব, মাসের মাঝামাঝি সময় আমার কাছে টাকাও তো নেই।

শ্রীতিমার শুকনো মলিন মুখটা দেখে মোহরের ভীষণ খারাপ লাগলো। ওর কাছে টাকা থাকলে নিশ্চয় কিছু একটা রাস্তা বেরোতো। কিন্তু ওর সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিস, যাতায়াত সবকিছুই মেহরাজ নিজ দ্বায়িত্বে সামলাই এক্ষেত্রে ওর টাকার প্রয়োজন একেবারেই নেই। আর সেই মানুষ টার কাছে চাওয়ার মতো জড়তাহীনতা ওর কল্পনাতেও হয়নি এখনো

– মন খারাপ করিস না, কেও তো আর ইচ্ছে করে ফেলেনি তাই না

– ইচ্ছে করে ফেললো কি অনিচ্ছায় সে দিয়ে এখন কি হবে বল, ও আমাকে দুইদিন আগেও এই চেন টা দিয়েছে দেখ অথচ আমি ওর জন্য একটা কেক ও নিতে পারলাম না।

বলেই গলায় হাত দিয়ে সোনালী রঙের চিকচিক করা আকর্ষণীয় জিনিসটাকে দেখালো। পুরু, চওড়া ফিতার ন্যায় জিনিসটার বহুমূল্যতা দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

– মোহর একটা কলম হবে তোমার কাছে?

পাশের বেঞ্চের মেয়েটির কথায় মোহর ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। হ্যাঁ বোধক ইশারা করে ব্যাগের ভেতর হাত ঢুকিয়ে কলম বের করতে নিলে হাতে কাগজের ন্যায় স্পর্শ হলো কিছু একটা। ভ্রু কুচকে কলমটা বের করে মেয়েটির হাতে দিয়ে কৌতূহল বশত ব্যাগের ভেতর থেকে কাগজের মতো জিনিস গুলো বের করলো।
গুণে গুণে ঠিক ছয়টা হাজার টাকার নোট, এতগুলো টাকা ওর ব্যাগে কি করে এলো! ওর কাছে তো কানাকড়ি ও ছিল না। তাহলে? তাহলে কি মেহরাজ রেখেছে! থ মেরেই বসে রইলো খানিক মোহর।
অন্যসময় হলে হয়তো নিজ আত্মগড়ীমাকে দাম্ভিকতার সহিত আগলে সসম্মানে টাকা গুলো মেহরাজের নিকট ফিরিয়ে দিত মোহর, কিন্তু বর্তমানে প্রাণপ্রিয় বান্ধবীর মুখে হাঁসি ফুটানো ছাড়া অন্য কিছু মাথায় আসলো না।

একটা ক্লাস শেষ করে শ্রীতমা আর মোহর দুজনে মিলে নিউমার্কেটে আসলো। শ্রীতমা না চাইতেও মোহর জোর করে ওর পছন্দ মতো একটা কেক কিনে দিল।

– তুই আমার সাথেই চল

বলে মোহরের হাত ধরে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠলো,মোহর একেবারে রাজি না ওদের মাঝে যাওয়ায়। দুজন কপত-কপতীর মাঝে ও কাবাবে হাড্ডি ছাড়া কিছুই না। তীব্র ভাবে নাকচ করে বলল

– শ্রী আমার কথা টা শোন। তোরা দুজন একসাথে পারসনাল টাইম স্পেন্ড করবি এখানে আমি গিয়ে কি করবো বল তো।

শ্রীতমা তীব্র বিরোধ করে বলল

– কি করবি মানে। তোকে ছাড়া আমি কিভাবে কি করবো

– যেভাবে প্রেম করছিস সেভাবেই করবি

মোহরের টুসকি দেওয়া কথায় শ্রীতমার মুখে হুট করেই লজ্জার বর্ষণ ঘটলো। ধবধবে ফর্সা মুখখানা লাল হয়ে এলো। মাছি তাড়ার ভঙ্গিমায় হাত নেড়ে বলল

– যাহ, কিসব বলিস

– ঠিকই বলেছি বাচ্চু। যাও প্রেম করো। আমারে এর ভিতরে নিও না। আর এমনিতেও এক্ষুনি গাড়ি এসে যাবে,ক্লাস বাদ দিয়ে অন্য কোথাও ঘুরছি দেখলে হিতে বিপরীত ভাববে

– হ্যাঁ আমাকে তো ভালোই শোনাচ্ছিস। তোর বর যে এক বেলা তোকে একা ছাড়তে চাইনা, ড্রাইভার না তো অ্যাসিস্ট্যান্ট পাঠিয়ে দেয়, তোরা মনে হয় প্রেম করছিস নাহ

শ্রীতমার বোকা বোকা কথা গুলোতে হুট করেই থমকে গেল মোহর। কথাগুলো যেন ওর সুপ্ত অনুভূতি গুলোর কাছে কৈফিয়ত চাইলো, যার উত্তর ওর কাছে নেই। অস্বস্তি আগলে সপ্রতিভ হয়ে সহাস্যমুখ করে মোহর বলল

– মোটেও নাহ। তুই পকপক বন্ধ করে যা তো, দেরী হয়ে যাচ্ছে। আর আমিও যাই। দুজনে মিলে খুব করে প্রেম কর কেমন

বলেই শ্রীতমার বাহুতে টুস করে একটা চিমটি কে’টে দৌড়ে নিচে নেমে এলো, শ্রীতমা অসহায় চোখে চেয়ে থেকে নিজেই হাঁটা দিল ভেতরের দিকে।
মোহর সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে এসে দ্রুতপায়ে মল থেকে বের হচ্ছিল, তখনি আচানক কারো সাথে ধাক্কা লাগলে হতবিহ্বলিত হয়ে চাইলো মোহর,
ওর বিব্রতিকে তড়বড় করে বাড়িয়ে দিল সামনের মানুষটা, মোহর খানিক হতবুদ্ধির ন্যায় বলল

– সরি স্যার, আমি খেয়াল করিনি

ফায়াজ তখনও যথাবৎ ভাবে খেয়াল করেনি মোহরকে, চেনা পরিচিত কণ্ঠে সুপ্রসারিত নয়নে তাকালে মোহরকে দেখে বেশ বিস্মিত হলো, তার চেয়েও বেশি বিস্মিত গলায় বলল

– মোহর তুমি এখানে? এখনও তো তোমার ক্লাস টাইম শেষ হয়নি?

মোহর অপ্রস্তুত হলো। বাঁ হাতের আঙুল গুলো ডান হাতে গলিয়ে কচলাতে কচলাতে বলল

– আসলে একটু কাজ ছিল আরকি

ফায়াজ ভ্রুদ্বয় প্রসারিত করলো। আশপাশে তাকিয়ে সকৌতুকে মোহরের অস্বস্তি ভরা মুখ পানে চেয়ে বলল

– এই সময় কাজ? তুমি ক্লাস বাদ দিয়ে মলে এসেছো এটাও দেখতে হচ্ছে?

পরমুহুর্তেই কিছু একটা ভেবে বেশ রম্য করা গলায় বলল

– ওহ, হাসব্যান্ড এর সাথে এসেছো তাই তো? তা কোথায় সে বউকে ফেলে একাই শপিং করছে?

মোহর অপ্রসন্ন হলো। কেন যেন মনে হলো ফায়াজ ওকে খোঁচা দিয়ে বলল কথাগুলো। বেশ গম্ভীর করে বলল

– শ্রীয়ের সাথে এসেছিলাম স্যার। একটু দরকার ছিল

ফায়াজ ভ্রুকুটি করলো। দুইহাত সামনে গুঁজে দাঁড়িয়ে বলল

– তার মানে দুজনেই ক্লাস ফাঁকি দিয়েছো?

মোহর অপরাধীর ন্যায় মাথা উপর নিচে নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল। ফায়াজ ডায়ে বায়ে মাথা নেড়ে বলল

– শেষ সময়ে এসে এরকম ফাঁকিবাজি করা মোটেও ভালো নাহ। আর তো মাত্র কয়েকদিন, তার পর থেকে ইন্টার্নি। এই সময়টা খুব সিরিয়াসলি হ্যান্ডেল করতে হবে। তোমার পারফরম্যান্স বলবে তুমি কোন হসপিটালে চান্স পাবে। বুঝছো?

মোহর সদা সর্বদা বাধ্য ছাত্রীর পরিচয় দিয়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। ফায়াজ আশপাশ তাকিয়ে বলল

– তা সে কোথায়। তুমি একা ছুটে বেড়াচ্ছো কেন?

– ওর একটু কাজ আছে। আমার বাড়ি যাওয়ার সময় হয়েছে তাই চলে যাচ্ছি।

তারপর খানিকটা নীরব থেকে বলল

– তাহলে আসি স্যার?

– দাঁড়াও!

সৌজন্য সুলভ কথা টুকু বলেই পা বাড়াতে নিয়েছিল মোহর। তক্ষুনি ফায়াজের ডাক পড়লো। ইতস্তত নিয়ে দাঁড়ালে ফায়াজ এগিয়ে এসে বলল

– একাই ফিরছো?

– জ্বি স্যার

– চলো আমি পৌঁছে দেই

মোহর বিব্রতবোধ করলো। ভেবেছিল সেদিন এতগুলো কথার পর হয়তো ফায়াজ ওর উপর রেগে যাবে, আগের মতো কথা বলবে না। কিন্তু ফায়াজের ব্যবহারে খুব একটা পরিবর্তন দেখতে পেল না মোহর।

– আমি একাই ফিরে যেতে পারবো স্যার

– আমি ড্রপ করে দিলে সমস্যা? নাকি এখন বিবাহিত বলে আমার গাড়িতে আর ওঠা যাবে না?

মোহর লজ্জিতা স্বরূপ অনুবলে বলল

– নাহ তা নয় স্যার। আপনি ভুল বুঝছেন আমাকে।

– ঠিকাছে ভুল বুঝবো না। চলো আমার সাথে

বলেই সামনে ইশারা করে হাঁটতে লাগলো ফায়াজ। গোলগাল চশমা পরা মুখটাতে সীমাহীন গাম্ভীর্য। এর পরেও নাকচ করাটা হয়তো সরাসরি অপমান হবে তাই মোহর নিরাভরণ অস্বস্তি, অনিশ্চয়তা নিয়েই পেছন পেছন হাঁটতে থাকলো।

এই দৃশ্য টা যে একেবারে নতুন তা নয়, মোহরকে এর আগেও বহুবার ফায়াজ গাড়িতে করে বাড়ি পর্যন্ত ছেড়েছে। পার্থক্য টা শুরু বাড়ির ভিন্নতার। তখন মোহর শুধু ফায়াজের ছাত্রী, মোহর শিকদার ছিল। এখন মোহর মেহরাজ আব্রাহামের স্ত্রী তার সহধর্মিণী। এখন সে চাইলেই যার তার সাথে উঠতে বসতে পারে না অনুমতি হীনা । আর চলমান মুহূর্তে এই কথাটা বোঝানোই হয়তো সবচেয়ে দুর্বোধ্য কাজ মোহরের নিকট।

গাড়িটা পুরোটা পথ নিঃশব্দে এলো। শুরু দিকনির্দেশনা নিতে ফায়াজ বার দুয়েক প্রশ্ন করেছিল এই আরকি। ফায়াজ হার হামেশাই শান্ত স্বভাবের অমায়িক ব্যক্তিত্বের একটা মানুষ। মোহরকে এসএসসির পর থেকেই প্রাইভেট পড়াতো,তখন ফায়াজ মেডিক্যালের ব্রাইট স্টুডেন্টদের একজন ছিল। কোনো এক জিডি করার ব্যাপার নিয়ে মোহরের বাবার সাথে ফায়াজের পরিচিতি।
খুব অদ্ভুত ভাবেই মানুষের সাথে বন্ধুত্ব এড়িয়ে যাওয়া মোহরের বাবা ফায়াজকে নিজের ছেলের মতো স্নেহ করতে শুরু করে। এমনকি তার মা ও। মোহরকে ফায়াজের জিম্মায় দিয়ে তারা যেন নিশ্চিন্তের আব্রুতে থাকতেন। সে এখন ঢাকা শহরের নামকরা হসপিটালের ডক্টর। সেদিক থেকে মোহরের উপরে ফায়াজের অধিকার খাটানো টা নিতান্তই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার স্যাপার।
তবে মেহরাজের সেদিনকার বাচনভঙ্গি যাকে বলে শান্ত স্বরের হুমকি মোহরের তীক্ষ্ণ মস্তিষ্কে অন্য কিছুর বীজ বুনেছে। মেহরাজের ভীষণ শান্ত স্বভাবের বৈশিষ্ট্য টা অনেকটা কার্বন মনোক্সাইডের ন্যায়। খুব ধীরে ধীরে প্রক্রিয়া, বিক্রিয়া ঘটায় যার ফলাফলে ঘাত সুনিশ্চিত।
এই কয়দিনে একই ছাদের নিচে থেকে অন্তত এটুকু বেশ পাশবদ্ধ করেছে মোহরের মস্তিষ্ক। আর এটাই তার সমস্ত দুশ্চিন্তার কারণ।
খুব একটা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাপার মোহরকে বেশ ভাবায়, কিছু একটা আঁচ করতে গিয়েও যেন পারে না। কিছু একটা দেখতে গিয়েও দেখে না।

ও যেন একটা ব্যাপার অনুভব করতে পারে যে কিছু একটা আছে যা খুব চাতুর্য আর নৈপুণ্যের সহিত মোহরের চক্ষুর অগোচরে রাখা হয়। কিন্তু তা কি? কি এমন ব্যাপার যা মোহরকে বারংবার ভাবায়, কৌতুহলের অসহিষ্ণু বীজ ফাঁপরে তোলে অন্তঃস্থলে অসংখ্যবার!

– আমি যদি ভুল না হই এটাই তোমার বর্তমান ঠিকানা মোহর

চেনা পরিচিত আকণ্ঠ গলার স্বরে ধ্যান ক্ষুণ্ন হলো মোহরের। বিহ্বল চোখে একবার ফায়াজের দিকে তাকিয়ে আবার কাঁচের জানালার ফাঁক দিয়ে বাড়িটার দিকে তাকালো। অতঃপর মুখে সামান্য হাসির রেখা টানার প্রচেষ্টায় বলল

– থ্যাংক ইউ স্যার, আসি।

ফায়াজ প্রত্যুত্তর করলো নাহ। ওর অস্থূল,কৃশ দৃষ্টি তখন সামনের প্রাসাদতুল্য বাড়িটি আর সুস্পষ্ট ভাবে চক্ষুগোচর হওয়া নেইম প্লেটের দিকে। মোহর গাড়ি থেকে বেরিয়ে ত্রস্ত পায়ে হেঁটে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়লো। ফায়াজ ততক্ষণ পর্যন্ত তাকিয়ে রইলো যতক্ষণ না মোহর দর্শনশক্তি থেকে গূঢ় না হয়।
লমস্ত চোখের দৃষ্টি বিচিত্র যা শমিতের তুলনায় অত্যাধিক বিপরীত। বেশ মুহূর্ত খানেক অতিবাহন হলো সেই অপলক দৃষ্টির মানসে। তার পরেই ইঞ্জিন টা প্রচণ্ড শব্দে গুঙিয়ে উঠে ছুটিয়ে নিল চার চাকার সত্তয়ারি।

স্টিয়ারিংয়ে এক হাত ঘুরাতে ঘুরাতে অন্য হাতে পকেট থেকে ফোনটা বের করলো, গ্যালারি তে ঢুকলে খুব যত্নসহকারে একটা আলাদা করে রাখা ফোল্ডারের অপশন টাতে আঙুলের স্পর্শ পেতেই একঝাঁক ছবি ভেসে উঠলো সারিবদ্ধভাবে। ফায়াজ খুব যত্ন নিয়ে ফোনটা ছুঁয়ে একটা ছবিকে জুম করলো, ষোড়শী অথবা সপ্তদশীর এক কিশোরীর সাধাসিধে, অকৈতব ছবিটি।
দুই বেণী দুইপাশে ঝোলানো, দুই ওষ্ঠভাঁজের মাঝখানে কলম আঁটকে ধরে রেখেছে। অপলক চাহনির আহেল নজরে চেয়ে রইলো ফায়াজ। এক, দুই,তিন করে অসংখ্য মুহুর্ত কাটিয়ে দিল সে ছবির দিকে তাকিয়ে। দুই অধরের মধ্যবর্তী স্থান থেকে শুধু দুটো লাইন ই বেরিয়ে আসলো

– কথা দিয়েছিলাম, হারাতে দেবো না

___________________

– সাঞ্জে, তোমাকে একটা প্রশ্ন করবো?

চাহনিটা ছোট্ট শরীরের নিষ্পাপ চেহারাতে আবদ্ধ রেখেই বলল মোহর। সাঞ্জে তাকালো না ওর দিকে, গ্রীবার কাছ দিয়ে হাত রেখে তাতে ভর করে রাখা মুখটা দূর রাস্তায় স্থির রেখেই বলল

– হ্যাঁ বলো

মোহর দ্বিধা বোধ করলো বেশ, এহেন প্রশ্ন করাটা ওর উচিত হবে কি না জানে নাহ কিন্তু জানাটা ওর দরকার, খুব ই দরকার।
অস্বস্তি ঠেলে স্বাভাবিক গলায় বিনয়ীতা ঢেলে বলল

– তাথই আপাকে কি জো’র করে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল? বা উনার কি এ সম্পর্কে কোনো সমস্যা আছে যার কারণে শ্বশুড়বাড়ি বা সেখানকার মানুষের কথা শুনলেই এমন রেগে যায়

সাঞ্জে মিনিট খানেক চুপ রইলো। মোহর ওর নীরবতাকে উত্তর দেবার অনিচ্ছায় ধরে নিল। ঠিক তখনি নীরবতার বুক চিরে শোনা গেল সাঞ্জের দীর্ঘশ্বাস , প্রাণোচ্ছল গলায় একরাশ খেদোক্তি মিশিয়ে বলল

– জো’র করে দেওয়া হয়েছে কিনা জানি নাহ, তবে আপি মনের উপরে জোর করেই বিয়েটা করেছে

মোহর ললাটে সূক্ষ্ম ভাঁজ ফেলে সাঞ্জের দিকে তাকালো। ওর জিজ্ঞাংসুক চেহারাটা সাঞ্জে না তাকিয়েও উপলব্ধি করতে পারলো। তাই অবিলম্বেই আবারও বলতে লাগলো

– এই যে রাগচটা, গম্ভীর, বদমেজাজি, খিটখিটে তাথই কে দেখছো না? আমার আপি কখনোই এমন ছিল নাহ। আমার এই চঞ্চলতা, অস্থির স্বভাব তো আমি আপির থেকেই শিখেছি। সারাটা সময় বাড়িঘর মাথায় করে রাখা সবাই কে বিরক্ত করে ফেলা মাতামাতি,প্রাণোচ্ছলতা এসবে আপি আমার চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল নাহ। আর পাঁচজনের মতো ওউ হাসতো,খেলতো,গল্প করতো, আনন্দ করতো, আবেগ অনুভূতি প্রকাশ করতো। কিন্তু জীবনে খুব অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই মোড় ঘুরে ওর ব্যক্তিত্বটাকে দুমড়ে মুচড়ে একটা পাথর বানিয়ে দিয়েছে।

মোহর এইটুকু শুনেই যেন অনেকটা আঁচ করতে পারলো। সাঞ্জের হাতটা এক হাতে ধরে বলল

– তাথই আপা অন্য কাওকে ভালোবাসতো?

সাঞ্জের চোখ টলমলিয়ে উঠলো। মনে পড়ে গেল মাত্র বছর তিনেক আগের কথা, বোনের উচ্ছ্বসিত, আনন্দ,প্রফুল্লতায় ভরা চেহারাটা চোখের বিকল্পনায় ভেসে উঠলো। দমে যাওয়া গলায় বলল

– বাসতো। আপুর প্রথম প্রেম, ভালোবাসা, অনুভূতি সবটাই ছিল। দাভাইয়ের একটা বন্ধু ছিল। বন্ধু কম ভাই বেশি। দাভাই যতটা গম্ভীর, সিরিয়াস স্বভাবের তার বন্ধুটা ঠিক ততটাই রসিক আর চঞ্চল স্বভাবের ছিল।
এ বাড়ির একটা সদস্যের মতই সম্পর্ক ছিল সবার সাথে। স্কুল,কলেজ, ভার্সিটি সবটা একসাথেই পড়েছে দুজন। তাথই আপাও তখন কিশোরী বয়সের। এ বাড়িতে রোজ রোজ আসতে আসতে কখন যে তাথই আপা আর ইয়াসির ভাইয়ের মাঝে একটা বন্ধন,মায়া, টান হয়ে গেল এটা হয়তো ওরাও বুঝতে পারেনি।
আমি তখন অনেক ছোট, সবে হাই স্কুলে উঠেছি। উনাদের যত প্রেমপত্র বিনিময়, দেখা সাক্ষাৎ সবকিছুতেই আমার হাত ছিল। তবে এটা আমি আপি আর ইয়াসির ভাই, এই তিনজনের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল। এমনকি দাভাই ও জানতো না। ইচ্ছে ছিল ইয়াসির ভাই পড়াশোনা শেষ করে সেটেল্ড হলেই বাড়িতে জানাবে। হয় তো তাই হতো , ইয়াসির ভাই জার্মানির একটা নামি দামি ভার্সিটি পড়ার স্কলারশিপ পায়। কথা ছিল পড়া শেষ করে এলেই বিয়ের কথা বলবে বাড়িতে। কিন্তু ভাইয়া জার্মানিতে যাওয়ার মাস ছয়েকের মধ্যেই চাচ্চু আর বাবা মিলে হুট করেই একদিন আপুর বিয়ে ঠিক করে ফেলে অরুণ ভাইয়ার সাথে । হুট করে ব্যাপারটা তো আমাদের কাছে ছিল আসলে অরুণ ভাইয়ার বাবা চাচ্চুদের বিজনেস ফ্রেন্ড। তারা অনেক আগেই বিয়ে ঠিক করে রেখেছিলেন। তাথই আপা অনেক চেষ্টা করেছিল ইয়াসির ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করার কিন্তু কোনো ভাবেই তাকে ফোন কল, ম্যাসেজ কিছুতেই পাইনি। হাজারো চেষ্টা করেও একটা বারের জন্য যোগাযোগ করতে পারেনি। পারিবারিক চাপ, সম্মান আর নিজের বাবাদের ব্যবসায়িক লাভ সবকিছুর বিবচনায় হেরে গিয়ে অন্তরদাহ করে রাজি হয়েছিল আপি বিয়েতে। অনেক চেষ্টা করেছে মানিয়ে নেওয়ার।
বিয়ের কিছুদিন অব্দি ও ভালোই ছিল। তার পরেই ধীরে ধীরে ঘরকোণাচে, একগুঁয়ে, রূঢ় হয়ে গেছে। আগে আমাকে অনেক কিছুই বলতো এখন তাও বলে নাহ, জানি না আপুর মাঝে কি চলে বা কি হয়েছে। অরুণ ভাই আদও যেমন ভালোবাসা দেখায় তেমন কি না তাও জানি নাহ

সুদীর্ঘ কথাগুলো বলে দম ছাড়লো সাঞ্জে। চোখ দিয়ে দুফোঁটা পানি গড়ালেও খুব সাবধানে তা মুছেও নিল। মোহর শুধু নিষ্প্রভ তাকিয়ে রইলো কোলের মাঝে গুটিয়ে থাকা বাচ্চাটার দিকে।

আচ্ছা পরিস্থিতির কাছে হেরে গেল তাথই আপা, পারিবারিক সম্মানটা অক্ষত রইলো, যাকে ভালোবেসেছিল সেও দূরেই চলে গেল। এর মাঝে বাচ্চাটার কি দোষ? ও তো কারো ক্ষতি করেনি? তাহলে কেন এতটুকু বাচ্চা মায়ের স্নেহ, পিতার আদর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। মায়ের কোল জুড়িয়ে দেওয়া প্রশান্তিময় সন্তান টাও মায়ের কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছে? এতে এই ছোট্ট প্রাণটার কি আদও কোনো দোষ আছে?

__________________________

রাতের প্রায় মধ্যিভাগ। মেহরাজ আজ বাড়িতে ফিরেছে বেশ দেরিতে। মোহরের সাথে শেষ সাক্ষাত টা ছিল ক্যাম্পাসে যাওয়ার আগ মুহূর্তে। মেহরাজ নয়টার দিকে বাড়িতে ফিরলেও সেসময় মোহর তাথইয়ের ঘরে ছিল। অনেকটা চেষ্টা করে যেটুকু স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেছিল, গতদিন অরুণ নামক মানুষটা আসার পর থেকে আরও বিগড়ে গেছে সবটা।
তাথইয়ের জীবনের ছোট্ট অংশটুকু শোনার পর থেকেই মন জুড়ে একরাশ আকুলিবিকুলি ছেয়ে আছে। মোহরের মনে হচ্ছে আরও কিছু আছে, আপাতদৃষ্টির অন্তরালে আরও অনেকটা আছে যা সকলের চক্ষের অগোচরে । যা একটা মানুষকে ক্রমেই অসুস্থ, অস্বাভাবিক করে তুলছে।

মোহরের ভাবনার মাঝেই খট করে দরজাটা খুলে গেল। ঘরের ভেতর প্রবেশ করলো লম্বাটে গড়নের মানুষটা। খুব সুধীরভাবে নব মুচড়ে লক করে দিল ডিজিটাল লক সিস্টেমের দরজাটা। মোহর আড়চোখে চাইলো। সবেমাত্র ফ্রেশ হয়ে বেরিয়েছে। সন্ধ্যা থেকে বইটা ধরা হয়নি বলেই বসেছিল ভারী মোটা বইটার পৃষ্ঠা খুলে।
বেশ কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পরেও বই থেকে মুখ তুললো না মোহর, নেত্র দুটি নিচে স্থির রেখেও স্পষ্ট বুঝতে পারলো মেহরাজ স্থির দাঁড়িয়ে আছে কাবার্ডের সাথে হেলান দিয়ে, তার তীক্ষ্ণ চাহনি বদ্ধ শুধুমাত্র মোহরের দিকে।

বেশ খানিক অস্বস্তি নিয়ে মোহর সামান্য ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো মেহরাজের দিকে। সুস্থিত চেহারার মানুষটা আজ যেন একটু বেশিই স্থির। মুখাবয়বের স্থৈর্যতা টাতে যেন কেমন সূচালো আঁশ অনুভব করলো মোহর। খপ করে বইটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো। অদূরের সেল্ফের তাকে গিয়ে বইটা রেখে পেছনে ঘুরতেই নিজের অত্যাধিক সন্নিকটে মেহরাজের চেহারাটা দেখে অকস্মাৎ ভয়ে সিটিয়ে গেল সেল্ফের গায়ে, মুখ দিয়ে মৃদু চিৎকার তোলার আগেই মেহরাজের ভারী,ঠান্ডা হাতটা চেপে ধরলো মোহরের ওষ্ঠাধর।
ঘনঘন তপ্ত নিঃশ্বাসে বুকের ওঠানামা টা বৃদ্ধি পেল। আড়ষ্ট হাত তুলে মেহরাজের হাতটা সরিয়ে দিতেই ও আরও এগিয়ে এলো মোহরের সন্নিকটে, ব্যগ্রতায় মুখ খিঁচিয়ে নিয়ে অন্যদিকে ফেরালে মেহরাজ ওর থুতনিতে হাত রেখে নিজের দিকে ফেরালো। পুরুষোচিত গলার আকণ্ঠে তীব্র ভার মিশিয়ে বলল

– আমি আপনার কি হই মোহ?

আচানক এহেন আচরণ আর প্রশ্নে ভড়কে গেল মোহর। কম্পান্বিত চোখে তাকালো মেহরাজের গাঢ় ধূসর চোখে। প্রত্যুত্তরের অপেক্ষায় চাহনিটা আরও রুষ্ট হয়ে উঠলো। এতদিনেও মোহর মেহরাজের এহেন চাহনির শি’কার হইনি।

– কি হই আমি আপনার?

ভড়কে গেল ভীষণ ভাবে,বিবশ গলায় শুকনো ঢোক গিলে বলল

– স্ স্বামী

দৃষ্টির পরিবর্তন হলো নাহ, ভরাট অপলক চাহনি মেলেই বলল

– তাহলে কি আপনার উচিত না স্বামীর বাধ্য আর অনুগত থাকা?

মোহর কোনো প্রকার অভিব্যক্তি ঠাওর করতে পারছে নাহ। কিন্তু মেহরাজের এহেন চাহনি ওকে ভীষণ জর্জরিত করছে। কোনো কিছু না ভেবেই প্রত্যুত্তরে ঘনঘন মাথা নাড়ালো। অবিলম্বেই পুরুষোচিত কণ্ঠ বলে উঠলো

– আমি যখন নিষেধ করেছি, তার পরেও ডক্টর ফায়াজের সাথে এক গাড়িতে কেন বসেছেন? আপনার জন্য কি আমি গাড়ি সময়মত পাঠাইনি?

– আ আসলে…

স্বরতরঙ্গ ভেদ করে আসা আধো বুলি টুকু সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই কণ্ঠ রোধ হয়ে এলো। লম্বা, কঠিন পাঁচটা আঙুলের স্পর্শ এসে ঠেকলো মোহরের গ্রীবা আর কণ্ঠনালীর মাঝে। অনেকটা হিসহিসানির ন্যায় কণ্ঠে হাতের মালিক টি বলল

– আপনার প্রতিটি সুবিধা অসুবিধা, ইচ্ছা অনিচ্ছা, ভালো লাগা খারাপ লাগার খেয়াল যদি আপনার স্বামী খুব যত্নসহকারে রাখতে পারে তাহলে আপনি কেন তার একটা কথা রাখতে পারলেন না মোহ?
.
.
.
চলমান।

#হীডিংঃ উপন্যাসটির ছাব্বিশ তম পর্ব চলছে, অনেকেই অনেক ভালোবাসা, সৌহার্দ্যপূর্ণ মন্তব্য উপহার দিচ্ছে আবার অনেকেই এড়িয়েও যাচ্ছে। এতে করে আমি পাঠকমহলের মনোভাব, অভিব্যক্তি টা সসম্পূর্ণরূপে বুঝে উঠতে পারছিনা। সকলের ধারণা, প্রতিক্রিয়া, অভিযোগ বা আবদার সব মিলিয়ে গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি, যাতে করে আমি আপনাদের পছন্দ-অপছন্দের মাপকাঠিটাকে বিবেচনায় রেখেই পরবর্তী ধাপগুলো উন্মুক্ত করতে পারি।।
ভালোবাসা রইলো ❤️

#Humu_❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here