সদ্য বিয়ে ভাঙল সামান্তার! জীবনের এই বিশাল শোক ও অঘটন কাটিয়ে ওঠতে না ওঠতেই অপ্রত্যাশিতভাবে এরচেয়েও বিরাট এক বিপত্তি এসে তার ঘাঁড়ে পরল। রুদ্রাক্ষের ন্যায় রাগী রূপ ধারণ করে হনহনিয়ে হেঁটে বেডরুমে প্রবেশ করল তার চাচাতো ভাই ‘মিশাল রায়জাদা”! পেছন থেকে সামান্তাকে ডেকে সে তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,
“লিসেন সামান্তা? বাড়ির সবাইকে বুঝা আমি তোকে বিয়ে করতে পারবনা! আমাদের মধ্যে সাপে নেউলে সম্পর্ক। চাইলেও আমরা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে জড়াতে পারবনা। ট্রাস্ট মি, পরিবারের কথা ভেবে আমি টিপিক্যাল ছেলেদের মত তোকে মেনে নেওয়ার লোক দেখানো অভিনয় করতে পারবনা।”
পিছু ঘুরে দাড়ালো সামান্তা। নির্বিকার, নির্লিপ্ত ও নিথর চাহনি তার। মোহনীয় সৌন্দর্যে ভরা মুখশ্রীতে তার নিগূঢ় বিষাদের ছাপ। বেদনায় জর্জরিত সে। একদল ব্যথারা যেন ক্ষণে ক্ষণে তার বুকের পাঁজরকে ক্ষত বিক্ষত করে তুলছে। অথচ মুহূর্ত কয়েক পূর্বেও তার মুখ কতখানি চকচক করছিল। নতুন আশায় বুক বেঁধেছিল। হাসিখুশি যেন উপচে পরছিল। আর পরবেই বা না কেন? ভালো লাগার মানুষটির সাথে যে তার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। কাল বৈশাখী ঝড়ের ন্যায় ক্ষণিকের মধ্যেই সব লন্ডভন্ড হয়ে গেল। সাথে তার মুখ থেকে সমস্ত হাসিখুশিও কেড়ে নিয়ে গেল। মুখের জবানও বন্ধ হয়ে গেল কি-না তা যাচাই করার জন্যই সামান্তা প্রত্যত্তুরে মিশালকে ধীর গলায় বলার চেষ্টা করল,
“আমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব তোমায় কে দিলো মিশাল ভাই?”
থমকালো মিশাল। সামান্তার জীবনের এই বিধ্বস্ত, শোচনীয় ও কঠিন মুহূর্তে দাড়িয়ে মিশালের যদিও এই সময় অনুপযোগী কথা বলতে বড্ড অস্বস্তি বোধ কাজ করছিল তবুও সে পরিস্থিতির চাপে পড়ে স্বাভাবিক গলায় বলার চেষ্টা করল,
“মা-বাবা ও চাচা-চাচীরা মিলে আমাকে ফোর্স করছে তোকে বিয়ে করার জন্য। এভাবে হয় বল? আমিতো তোকে কখনই ওয়াইফ হিসেবে মানতে পারবনা। ইট’স নট ইজি ফর মি। আ’ম হেল্পলেস। প্লিজ তুই কিছু একটা কর।”
“হ্যাঁ তো? আমিই বা কখন বললাম তোমাকে আমি হাসবেন্ড হিসেবে গ্রহণ করতে পারব? আমার জন্যও এটা ইজি নয়।”
স্তব্ধ মিশাল। রাতারাতি কীভাবে সম্ভব নিজের ভাবমূর্তি এভাবে পাল্টে ফেলা? ক্রোধে নিষ্পেষিত মিশালের সামনে দাড়িয়ে থাকা সামান্তাকে দেখে বুঝার কোনো সাধ্যি নেই একটু আগেও সে বিরহে ছিল, হতাশায় মুর্ছা যাচ্ছিল। রূপ বদলাতে বেশী একটা সময় লাগবেনা তা জানলে হয়ত মিশাল কখনই সামান্তার সাথে এত নম্র ও শান্ত গলায় কথা বলতনা! মন ভুলেও নমনীয়তা দেখাত না তার সাথে। রোষাগ্নি হয়ে পাঞ্জাবির কলার ঝারল মিশাল। সামান্তার দিকে গরম দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। আঙুল উঁচিয়ে সামান্তাকে ধমকিয়ে বলল,
“জীবনের এত বড়ো একটা ধাক্কা খাওয়ার পরেও তুই নিজেকে শোধরাবি না তাইতো? এই জটিল পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে থেকেও তুই আমার সাথে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করছিস? নত হওয়ার স্বভাব নেই তোর?”
“না নেই। কারণ আমি জানি, আমাদের মধ্যে সম্পর্ক ভালো নয় বলেই যে তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাইছনা বিষয়টা পুরোপুরি এমন নয়। একচুয়েলি তোমার তো খালাতো বোনের সাথে এফেয়ার চলছে! যা তুমি মুখে স্বীকার করতে পারছনা। আমি তোমাকে বলছি, যদি তোমার সৎ সাহস থাকে তো নিজের বাবা-মাকে গিয়ে বলো তুমি আমাকে নয় বরং তোমার খালাতো বোন ‘জেনিয়াকে’ বিয়ে করতে চাও! যাও বলো।”
“জাস্ট শাট আপ সামু। আমার পার্সোনাল ম্যাটারে ইন্টারফেয়ার করার কোনো অধিকার দিইনি আমি তোকে। ইভেন আমিও কখনও তোর পার্সোনাল ম্যাটারে নাক গলাইনি। কীভাবে আমার পেছনে লাগবি তা নিয়ে চিন্তা না করে বরং তুই এখন কী করবি তা নিয়ে চিন্তা কর। একচুয়েলি তোর সাথে কথা বলতে আসাটাই আমার চরম ভুল হয়েছে। বিয়ে ভেঙেছে তোর, আমার কী? সো তোর ব্যাপার তুই বুঝে নে। আমি তোকে বিয়ে করতে পারবনা ব্যস একটুকুই বলতে এসেছিলাম তোকে। কেউ ফোর্স করলেও না। মাইন্ড ইট।”
নিজের জেদে অনড় থেকে মিশাল জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। কান্নায় ভেঙে পরল সামান্তা। গাঁ থেকে বিয়ের গহনাগাঁটি খুলতে খুলতে সে ভরাট গলায় চিৎকার করে বলল,
“হ্যাঁ যাও যাও। তোমাকে বিয়ে করতে আমিও বসে নেই। বিয়ে-ই ভেঙেছে শুধু, মেরে ফেলে দেওয়া হয়নি আমাকে যে আমার জীবনটা এখানেই শেষ হয়ে গেল! আমি একাই যথেষ্ট এই পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসার জন্য। কারো দয়ার কোনো প্রয়োজন নেই আমার।”
দরোজার চৌকাঠ পাড় হয়ে মিশাল রুমের বাইরে চলে গেলেও পিছু ফিরে একবার হিংস্র দৃষ্টিতে তাকালো অশ্রু বিজরিত সামান্তার দিকে। হাত ঝেরে সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আমি জানি তোর কারোর দয়ার প্রয়োজন নেই। তোর জন্য তুই একাই যথেষ্ট। যেমন নিজের বিয়ে তুই নিজেই ঠিক করেছিস। কারো থেকে কোনো সাজেশন বা কাউকে কিছু জানানোর প্রয়োজনও মনে করিসনি! সবক্ষেত্রে আমার সাথে তোর টেক্কা দিতেই হবে? ভালোমন্দ বাচবিচার না করেই। এর ফল কী হলো? এখন অশান্তি ভোগ করছে কে? তোর যদি কিছু বলার থাকে তো পরিবারের সবার সামনে এসে বল। ড্রইংরুমে বাড়ির সবাই আমাদের জন্য ওয়েট করছে।”
তর্কে জড়ালো না সামান্তা। কারণ, সব জায়গায় তর্ক খাটেনা। যেখানে ভুল তার নিজের সেখানে পরিস্থিতি বুঝে চুপ থাকাটাই শ্রেয়। তবে মানুষ না চেনার এই ভুলের শাস্তি তাকে এত কঠিনভাবে পেতে হবে তা দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি সামান্তা। জীবনের এত বড়ো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অন্তত মিশালের সাথে একবার পরামর্শ করার উচিৎ ছিল তার! যদিও চোর গেলে বুদ্ধি বাড়ে।
বেনারসি কাপড়ের কুচি সামলে সামান্তা ধীর পায়ে হেঁটে মিশালের পিছু নিলো। সবার মুখোমুখি হওয়া উচিৎ তার। সামান্তা নিজেও মিশালকে এরমধ্যে জড়াতে চায়না৷ তার সাথে যে অন্যায়টা হয়েছে তার ভার একান্তই তার। অন্যকাউকে এরমধ্যে জড়ানোর কোনো মানেই হয়না। আলো, রোশনাই, বিভিন্ন সুগন্ধি ফুলে ও চাকচিক্যতায় ঘিরে থাকা বাড়িটি মুহূর্তের মধ্যেই অন্ধকার, হতাশায় ও শোকে তলিয়ে গেল। আত্নীয়-স্বজনদের হৈ-হুল্লোড় থেমে গেল। শোরগোলে মত্ত থাকা বাড়িটি চুটকির মধ্যেই ফাঁকা ও নিস্তব্ধ হয়ে গেল। সর্বত্র থমথমে পরিবেশ বিরাজ করতে লাগল। বাড়ির এই নিরাশ অবস্থা দেখে থেমে থেমে সামান্তার মনটাও কেঁদে উঠল।
এক পা দু’পা করে সামান্তা বাড়ির ড্রইংরুমের দিকে এগিয়ে যেতেই লক্ষ্য করল বাড়ির সব সদস্যরা ড্রইংরুমে নিরবচ্ছিন্নভাবে বসে আছে। সবাই বেশ বিষণ্ণ ও আশাহত। তাদের মধ্যে সামান্তার বাবা-মা, ছোটো দুই বোন, মামা-মামী, ও খালা-খালুরা রয়েছে। মিশালের মা, ছোটো বোন, তাদের ফুফু, ফুফা ও ফুফাতো ভাই সাহিলও এখানে উপস্থিত রয়েছে। তাদের মধ্যমণি হয়ে মাথা নুইয়ে দাড়িয়ে রয়েছে মিশাল। সবাই তার মুখের দিকে কাঙ্খিত কিছু শোনার অপেক্ষায় অধীর আগ্রহ নিয়ে মুখিয়ে আছে। অস্বস্তির এক পর্যায়ে সামান্তার বাবা মিজানুর রহমান সোফা ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালেন। আশাবাদী হয়ে তিনি মিশালের দিকে প্রশ্ন ছুড়লেন,
“কথা হয়েছে তোদের মধ্যে? রাজি তোরা এই বিয়েতে?”
মাথা উঁচিয়ে সংশয় ভরা দৃষ্টিতে মিশাল তার ছোটো চাচার দিকে তাকালো। চাচার মুখের দিকে তাকিয়ে তার বড্ড মায়া হলো। কতটা আশ্বাস ও ভরসা নিয়ে তিনি মিশালের দিকে তাকিয়ে আছেন। ইশ, এই বুঝি চাচাকে তার নিরাশ করতে হবে। এই প্রথম চাচার কোনো আবদার রাখতে ব্যর্থ হলো সে। তবে তার কাছে এটা আবদার কম, বরং অন্যায় আবদারই বেশি মনে হলো! যার বিপক্ষে এখন দাড়িয়ে সে। মিশালের মৌনতা দেখে উপস্থিত সবার মধ্যে আবারও ভয় বাসা বাঁধতে লাগল। সবার উৎকণ্ঠা দূর করতে মিশালের মা শাহনাজ বেগম হঠাৎ আমতা আমতা করে বলে উঠলেন,
“রাজি হবেনা মানে? আমার ছেলে তো রাজিই ভাই সাহেব! আপনি বরং তাড়াতাড়ি করে কাজি ডেকে এনে তাদের বিয়েটা পড়িয়ে দিন! শুভ কাজে বেশি দেরি করতে নেই।”
তৎক্ষণাৎ মিশাল তার মায়ের কথায় ফোড়ন কাটল। এই প্রথম উপস্থিত সবার সামনে সে কড়া দৃষ্টিতে তার মায়ের দিকে তাকালো! চোয়াল উঁচিয়ে বলল,
“আপনি চুপ থাকুন মা! আমি সামান্তাকে বিয়ে করতে পারবনা!”
মিশালের থেকে কয়েক ফুট দূরত্বে দাড়িয়ে সাহিল মনেপ্রাণে বলতে চাইছিল সামান্তাকে বিয়ে করতে চায় সে! তবে সামান্তার ভয়ে মুখ খুলে রা টি করতে পারলনা সে। সামান্তা সাহিলকে পছন্দ করেনা তা বেশ ভালোভাবেই জানা সাহিলের। তবে সামান্তার প্রতি সাহিলের ভালোবাসাও তো মিথ্য নয়!
ইতোমধ্যে সামান্তা এসেও মিশালের কথায় তাল মিলালো। উপস্থিত সবাইকে রীতিমতো অবাক করে দিয়ে সামান্তা ভাবশূণ্য ভঙ্গিতে মিশালের পাশে দাড়ালো। অত্যন্ত সাহসীকতার সাথে নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে সে শক্ত গলায় বলল,
“মিশাল ভাই যা বলেছে ঠিক বলেছে। আমিও মিশাল ভাইকে বিয়ে করতে পারবনা! বিয়ে ভাঙা এমন কোনো মস্ত বড়ো অপরাধ নয় যার কারণে একই সময়ে একই দিনেই আমাকে অন্য কাউকে বিয়ে করতে হবে। নয়ত আমার জাত যাবে! কিংবা আমার ফাঁসি হবে। নিলামে উঠাচ্ছ আমাকে! জোর করে কিছু হয়না তোমাদের প্রত্যেকের তা বুঝা উচিৎ। আমরা চাচাতো ভাই-বোন হিসেবেই পার্ফেক্ট আছি। এরচেয়ে বড়ো কোনো সম্পর্কে জড়াতে গেলে সম্পর্কে তিক্ততা বাড়বে। তোমরা সবাই সমাজকে নিয়ে ভয় পাচ্ছ তাইতো? ভাবছ বিয়ে ভেঙে যাওয়া একটা মেয়েকে সমাজ কী চোখে দেখবে? তাহলে আমিও বলি সমাজের দু-একটা কটু কথায় আমার কিছু যায় আসবেনা। কারণ আমি একজন শিক্ষিত, চাকুরীজীবি ও প্রতিষ্ঠিত মেয়ে। আমার ঘিলুতে যেমন শিক্ষাদিক্ষা আছে তেমনি জীবিকা নির্বাহের জন্য চাকরীর ব্যবস্থাও আছে। কোনোকিছুতেই কমতি নেই আমার। সমাজ আমাকে ত্যাগ করলেও আমি নিজের ব্যবস্থা নিজেই করতে পারব। এখন তোমরা এসব গোল বৈঠক বন্ধ করো তো। যে যার রুমে যাও। আর মিশাল ভাইকেও তার বাড়ি ফিরে যেতে দাও। এসবের মধ্যে মিশাল ভাইকে টেনে এনো না প্লিজ।”
সামান্তার বিচক্ষণ কথায় উপস্থিত সবাই নারাজ হলেও মিশাল বেশ সন্তুষ্ট হলো। সারাক্ষণ দুজন একে অন্যের পেছনে লেগে থাকলেও সামান্তার সময় উপযোগী কথায় চাচাতো ভাই হিসেবে মিশাল ভীষণ গর্ববোধ করল। সামান্তা অন্তত সমাজের করালগ্রাসে বন্দি নেই। নিজের সুস্থ মন-মানসিকতার পরিচয় দিয়েছে। পরিবারের চাপে পরে জীবনের দ্বিতীয় কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেয়নি! তবে সামান্তার সোজাসাপটা কথায় ঠাস করে তার গালে চড় পরতে বেশী বেগ পেতে হলোনা! সামান্তার মা জেসমিন বেগমই চড় মারলেন সামান্তার গালে। ক্ষিপ্ত গলায় তিনি সামান্তাকে শাসিয়ে বললেন,
“চাকরী করে দু-এক টাকা ইনকাম করিস বলে নিজেকে খুব বড়ো মনে করছিস? ভাবছিস সব জিতে গেছিস? সমাজ, সংসার নেই আমাদের? একে তো নিজের পছন্দমত ছেলেকে বিয়ে করার জন্য আমাদের মাথা খেয়ে নিয়েছিলি! ভালো করে একটু খোঁজ খবরও নিতে দিসনি তার। জানিনা কোন ভূত চেপেছিল তোর মাথায়। এখন সাধ মিটলো তো পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করার? দিলো তো ধোঁকা? সমাজে আমাদের মাথা নিচু করলি তো তুই? খুশি হয়েছিস এবার? যা এবার তুই আমার বাড়ি থেকে বের হ! তোর মুখ ও দেখতে চাইনা আমি।”
সুযোগ বুঝে শাহনাজ বেগম আগ্রহী গলায় বলে উঠলেন,
“সামান্তা তাহলে কয়েকদিন আমাদের বাড়িতে বেড়িয়ে আসুক। সবার মন দিল ঠিক হলে না হয় আবার এই বাড়িতে ফিরে আসবে।”
এমনিতেই হার্টের সমস্যা জেসমিন বেগমের। তার উপর এত দুঃশ্চিন্তা ও চিৎকার চ্যাচাম্যাচি। সব মিলিয়ে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়ার পূর্বেই মিশাল এসে সময়মত তার চাচীকে ধরে ফেলল। সবাই এবার ব্যস্ত হয়ে পরল জেসমিন বেগমকে নিয়ে। মুহূর্তের মধ্যে পুরো বাড়িতে শোকের ছায়া নেমে এলো। বিপদ যেন কিছুতেই কাটছেইনা তাদের। বরং আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরছে।
___________________________________
গভীর রাত। প্রকৃতি আজ নিকষ কালো আঁধারে ঢাকা। সেই সাথে বাড়িঘরের পরিবেশও শান্ত, নিস্তব্ধ ও নির্বিকার। সবাই যে যার রুমে। অসুস্থ জেসমিন বেগম এখন কিছুটা সুস্থবোধ করছেন। তবে ঘুম নেই কারো চোখে। সবাই চিন্তাগ্রস্ত। এই প্রথম তাদের বাড়িতে কোনো বিয়ে ভাঙল। সমাজে এই নিয়ে কথাও উঠল। হাসিখুশি পরিবারে তাদের অনায়াসে দুঃখ নেমে এলো।
গাঁয়ে কালো রঙের একটি সুতির জামা পড়ে সামান্তা বারান্দায় দাড়িয়ে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনছে। এলোমেলো চুল বাতাসে উড়ছে। চোখের কোণায় শুকনো জল। শুকনো মুখশ্রীতে দহনের ছাপ ও বিষণ্নতা। মনমরা হয়ে বারান্দায় গ্রীলে মাথা ঠেকিয়ে দাড়ানো সে। ইচ্ছে করেও চোখ থেকে একফোঁটা জল ফেলতে পারছেনা। ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে কান্না আসছে। হাতে থাকা মুঠোফোনটি এক পর্যায়ে সামান্তা ভেঙেচুরে গুড়িয়ে দিলো! ফুঁপিয়ে ওঠে চিৎকার করে কেঁদে বলল,
“কেন স্বপ্নীল কেন? কেন তুমি আমার সাথে এত বড়ো বিশ্বাসঘাতকতা করলে? কেন কথা দিয়েও তুমি আমাকে বিয়ে করতে আসলেনা? কোথায় হারিয়ে গেলে তুমি বলো? কেন আমার পরিবারকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে দিলে? আমি এখন তোমাকে কোথায় খুঁজব বলো? আমিতো দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারিনি স্বপ্নীল তুমি আমার সাথে এভাবে চিট করবে। ভালোবাসি বলে বলে আমার ভালো থাকাটাই ছিনিয়ে নিবে। এত ইজিলি আমি কীভাবে একটা ফ্লড ছেলের পাল্লায় পরে গেলাম?”
ফট করে মাথা ধরে গেল সামান্তার। মাথায় হাত দিয়ে সে ধপ করে ফ্লোরে বসে পরল। নিজেকে শান্ত করার জন্য কিছুক্ষণ এভাবেই ফ্লোরে বসে রইল। অসুস্থতাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করল। তাকে এভাবে ভেঙে পরলে চলবেনা। স্বপ্নীলকে তার খুঁজে বের করতে-ই হবে। বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিশোধ তাকে নিতেই হবে।
পাশের রুমের বেলকনিতে স্থিরচিত্তে দাঁড়িয়ে মিশাল। শার্টের প্রথম দুটো বোতম খোলা তার। ভ্যাপসা গরমে জান বের হয়ে আসার জোগাড়। তাই তাড়াহুড়ো করে বেলকনিতে হাওয়া খেতে আসা তার। আনমনে মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকা চাঁদকে দেখতে ব্যস্ত মিশাল। বেখেয়ালে কখন যে তার হাতের আঙুলে জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাকা লাগল বুঝতে-ই পারলনা সে! তৎক্ষণাৎ ফর্সা হাতে কালসিটে দাগ পরে গেল। কিন্তু তার ধ্যান এখনও ভাঙলনা। বুকে যে শ্রাবণ তার! পাঁচবছর বয়সে মাকে হারিয়েছে মিশাল। সৎ মায়ের সংসারে অযত্নে, অনাদরে বেড়ে ওঠা তার। দুইবছর আগে তার বাবাও হার্ট অ্যাটাকে মারা যান! এতিম করে চলে যান তাকে। ক্রমশ ভাগ্য তার নির্মম হতে লাগল। মধ্যবিত্ত পরিবারে বড়ো হওয়া মিশালের জীবনে কোনোকিছুর তেমন অভাব না থাকলেও মায়ের আদরের বড্ড অভাব। এই অভাব পোষবার নয়। বরং একবুক আফসোস নিয়ে বয়ে বেড়াতে হয়।
কিছুক্ষণ আগেও তার সৎ মা এসে তার সাথে চোটপাট করে গেল। কেন সে সামান্তাকে বিয়ে করতে রাজি হলোনা সেজন্য! সামান্তার বাবার তো টাকা-পয়সা, স্বয়-সম্পত্তির অভাব নেই! মিশালের বোকামির জন্যই আজ তার সৎ মায়ের বড়োলোক হওয়ার আশা ভেঙেচুরে চুরমার গেল। তবে মিশাল জানে তার সৎ মা এত সহজে দমে যাওয়ার পাত্রী নন। ছলেবলে, কৌশলে, কুট কাচালি করে হলেও তার উদ্দেশ্য হাসিল করবে!
ধ্যান ভাঙতেই পাশের রুমের বেলকনিতে হঠাৎ চোখ পরল মিশালের। দূরদৃষ্টিতে লক্ষ্য করল সামান্তা অকেজো অবস্থায় ফ্লোরে বসে আছে। অস্থির হয়ে উঠল মিশাল। ভাবল সামান্তা কোনো অঘটন ঘটিয়ে বসল না তো? বিপদের তো কোনো হাত-পা নেই। তাছাড়া সামান্তা এখন ডিপ্রেশন আছে। এগ্রেসিভ হয়ে কখন কোন দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বসে। যতই দুজনের মধ্য বিবেধ থাকুক না কেন চাচাতে ভাই হিসেবে তার এই মুহূর্তে সামান্তার পাশে দাড়ানো উচিৎ।
হম্বিতম্বি হয়ে মিশাল ছুটে গেল সামান্তার রুমে। ভাগ্যিস সামান্তার রুমের দরোজাটি ভেজানো ছিল। খুব সহজেই মিশাল দরোজা খুলে সামান্তার রুমে প্রবেশ করল। আতঙ্কিত হয়ে বেলকনিতে গিয়ে দেখল সামান্তা হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে স্থির হয়ে বসে আছে। সামান্তার পাশে হাঁটু গলিয়ে বসল মিশাল। সামান্তাকে না ছুঁয়ে বিচলিত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,
“হেই? আর ইউ ফাইন সামান্তা?”
ব্যথিত দৃষ্টিতে সামান্তা হাঁটু থেকে মুখ তুলে উদ্বিগ্ন মিশালের দিকে তাকালো। চোখমুখ অসম্ভব রকম ফুলেফেঁপে আছে তার। রক্তিম মুখশ্রী। বিষাদ ছুঁয়েছে তাকে। ক্রন্দনরত গলায় সামান্তা অনুনয় করে মিশালকে বলল,
“আই নিড ইউর হেল্প মিশাল ভাই।”
“আমি জানতে চাইলাম তুই ঠিক আছিস কি-না আর তুই চাইছিস আমার থেকে হেল্প?”
“আমি স্বপ্নীলকে খুঁজে বের করতে চাই মিশাল ভাই! প্লিজ হেল্প করবে আমায়? আমি জানি তুমি আমায় ফেরাবে না।”
“লিসেন সামু? তুই ফার্স্টে নিজেকে ঠিক কর। দেন যা করার কর। তুই জানিস স্বপ্নীলকে খুঁজে পাওয়া ইট’স নট ইজি ফর আস। কোনো মানুষ নিজ থেকে হারিয়ে গেলে তাকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তার উপর স্বপ্নীল তো ছিল এক প্লে-বয়!”
চ্যাচিয়ে উঠল সামান্তা মিশালের উপর! ক্ষিপ্ত গলায় বলল,
“তার সম্পর্কে যেহেতু তুমি এতকিছুই জানতে তাহলে আমাকে এসব আগে বললেনা কেন? প্লিজ এখন এটা বলোনা যে, তার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে তুমি জানতে না।”
#চলবে…?
#বুকে_যে_শ্রাবণ_তার
#পর্ব_১
#নিশাত_জাহান_নিশি
[আসসালামু আলাইকুম প্রিয় পাঠকমহল। আবার ও নতুন গল্প নিয়ে আপনাদের মাঝে ফিরে এলাম। প্রথম পর্ব কেমন হয়েছে অবশ্যই জানাবেন। আশা করি আপনারা প্রথম থেকে শেষ অবধি গল্পটির পাশে থাকবেন। ভালোবাসা সবাইকে।]