বুকে_যে_শ্রাবণ_তার #পর্ব_৪ #নিশাত_জাহান_নিশি

0
381

#বুকে_যে_শ্রাবণ_তার
#পর্ব_৪
#নিশাত_জাহান_নিশি

বেশ ক্ষিপ্রতা দেখিয়ে সামান্তার মুখের উপর কলটি কেটে দিলো মিশাল। সরি বলার সুযোগটি পর্যন্ত দিলোনা সামান্তাকে!

তবুও হাল ছাড়লনা সামান্তা। নতুন উদ্যমে পুনরায় ডায়াল করল ক্রোধে নিষ্পেষিত মিশালের নাম্বারে। যেকোনো ক্রমেই হোক রাগ ভাঙাতেই হবে মিশালের। এত দীর্ঘ সময় ধরে মিশালের একগুঁয়ে রাগকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবেনা। এত সহজে তো হাল ছাড়ারও পাত্রী নয় সামান্তা। যেখানে তার কোনো দোষই নেই সেখানে তো ঘুনাক্ষরেও নয়। অবুঝের ন্যায় কার্যকলাপ করলে তো চলবেনা মিশালের। পরিস্থিতি বুঝতে হবে তার। নির্বাক দর্শকের ন্যায় সামান্তাকে পর্যবেক্ষণ করছিলেন শাহনাজ বেগম৷ শান্ত হয়ে বুঝতে চাইছিলেন দুজনের মধ্যে কী চলছে।

অন্যদিকে হসপিটালের করিডরে ঠায় দাড়িয়ে মিশাল। আহত অবস্থাতেই স্বপ্নীলকে পুলিশ তাদের ফোর্স নিয়ে অ্যারেস্ট করতে এসেছে হসপিটালে! আর যাই হোক না কেন সমাজের এই কু-খ্যাত ক্রিমিনালকে এত সেবা-যত্নে আলিশান হসপিটালে তো মুক্তভাবে ছেড়ে রাখা যায়না। এতে ক্রিমিনাল হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে শাতাধিক। যা তাদের জন্য চাপের হয়ে যাবে। তাই অতিসত্বর তাকে শিকল পরিয়ে পুলিশদের হেফাজতে থাকা কোনো হসপিটালে ভর্তি করাতে হবে। হসপিটালের পরিবেশ এখন গরম বেশ। পাশেই শোনা যাচ্ছে স্বপ্নীলের মা-বাবা ও আত্নীয় স্বজনদের আহাজারি উপরন্তু চলছে পুলিশ ফোর্সের সাথে তাদের বাক বিতণ্ডা। ক্ষমতার জোরে স্বপ্নীলের বাবা চাইছেন পুলিশের উপরের মহলকে হাত করতে। তবে ভিকটিমদের চাপে পরে ও পরিবেশ গরম বলে পুলিশের উপর মহলও কোনো সাহায্য করতে পারছেননা ইমতিয়াজ চৌধুরীকে!

সেই সূত্র ধরেই পুলিশদের সাথে হসপিটালে আসা মিশালের। এছাড়াও ওসির সাথে আর্থিক কিছু দেনাপাওনারও হিসেব নিকেশ রয়েছে মিশালের! বিনা পারিশ্রমিকে আর কত? ইতোমধ্যেই সামান্তা অনবরত কল করে চলছে তাকে। বিরক্ত তো হওয়ারই কথা তার। যদিও এর আগে থেকেই মিশালের মেজাজ বেশ চওড়া হয়ে আছে।

তৃতীয়বার যখন সামান্তা কলটি করল তখন মিশাল পূর্বের তুলনায় অত্যধিক রেগে গেল। ধৈর্য্যশক্তি তরতরিয়ে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল তার। কলটি তুলল। তবে সামান্তাকে পূর্বের ন্যায় কিছু বলার সুযোগ দিলোনা সে। দাঁতে দাঁত চেপে খিটখিটে মেজাজে বলল,

“আর একবার যদি তুই আমার নাম্বারে কল করেছিস না? তবে ফোনটা কিন্তু এখনি আমি আছাড় মেরে ভেঙে ফেলব! সো বি এলার্ট ওকে?”

“স্ট্রেঞ্জ তো। তোমার ফোন ভাঙলে এতে আমার সমস্যাটাটা কী? নিজের ক্ষতি করার হুমকি তুমি নিজেই আমাকে দিচ্ছ?”

“তারমানে তুই কল রিপিট করতে থাকবি তাইতো?”

ক্রুর হাসল সামান্তা! বুকের উপর একহাত গুজে বেশ আয়েশ করে সোফায় বসল। ডানপিটে গলায় প্রত্যত্তুরে বলল,

“অভেয়েসলি! হোয়াই নট? তুমিতো জানোই আমার স্বভাব সম্পর্কে মিশাল ভাই। নতুন করে আর কী বলব? যা আমাকে না করতে বলা হবে তাই আমি বেশি করে করব। তোমার ক্ষেত্রেও এর বিপরীত হবেনা। এবার বলো তুমি কী চাও?”

“ওহ্ আই সি। তুই কী ভেবেছিস? সবসময় তোর জেদই উপরে থাকবে? আমার জেদের কোনো মূল্য নেই? এবার দেখ আমি কী করি!”

“হেই স্টপ মিশাল ভাই। ভুলেও কিন্তু তুমি ফোন সুইচ অফ করার কথা ভাববেনা!”

“আলবাত ভাবব। কী করবি তুই? তখন আমাকে প্যারা দিতে খুঁজে পাবি কোথায়?”

“কেন? ফোন ট্রেস করতে করতে তুমি অবধি পৌঁছে যাব! এ আবার কঠিন কী কাজ?”

ঝট করে কলটি কেটে দিলো মিশাল। তাৎক্ষণিক ফোনটি সুইচ অফ করে দিলো! প্যান্টের পকেটে ফোনটি গুজে দ্রুত পা ফেলে স্বপ্নীলের কেবিনে ঢুকে গেল। উগ্র গলায় বিড়বিড় করে বলল,

“দেখব। এবার কীভাবে খুঁজে বের করিস আমায়!”

স্বপ্নীলকে পুলিশ অ্যারেস্ট করে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে নিলো। কান্নাকাটি শুরু হয়ে গেল স্বপ্নীলের মা মিসেস জেরিন চৌধুরীর। অকাতরে চোখের জল ফেলে তিনি ওসির কাছে আঁচল পেতে ছেলেকে ভিক্ষা চাইছেন! দৃশ্যটি যদিও হৃদয়বিদারক তবুও পুলিশ বাধ্য তাদের কাজ করতে৷ একজন মায়ের অসহায়ত্বকে সেখানে প্রাধান্য দেওয়ার কোনো সুযোগ-ই নেই। যেখানে তার ছেলে একজন রেপিস্ট। স্বপ্নীলের বাবা ইমতিয়াজ চৌধুরী রক্তশূল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন মিশালের দিকে! কোথাও না কোথাও তার মনে হচ্ছে মিশালের জন্যই পুলিশ তার ছেলেকে খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়েছে! বেশ তোরজোর করেই তিনি হুমকি দিতে তেড়ে এলেন মিশালের দিকে। মুখোমুখি দাড়িয়ে মিশালকে শাসিয়ে বললেন,

“তোকে আমি দেখে নিব মিশাল। তুই পুলিশের সোর্স তা জানলে হয়ত আমি কখনও আমার ছেলের বিয়ে তোর কাজিনের সাথে ঠিক করতাম না! বিয়ে ভেঙে দিয়েছি বলে আমার ছেলের হাত-পা ভেঙে তার শোধ নিলি তুই তাইনা? খুব শেয়ানা?”

ইমতিয়াজ চৌধুরীর হুমকি-ধমকি শুনে ফিক করে হেসে দিলো মিশাল। তার কাছে এসব হুমকি সস্তা মনে হলো! কারণ, প্রতিদিন প্রতিনিয়ত এই জাতীয় কত শত হুমকির সম্মুখীন যে তাকে হতে হয় তার কোনো হিসেব নিকেশ নেই। নাক ঘঁষে মিশাল ইমতিয়াজ চৌধুরীর দিকে হেয়ালি দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ঠোঁটের আলিজে ক্রুর হাসির রেখা ফুটিয়ে বলল,

“বিয়েটা ঠিক সময়ে ভেঙে দিয়েছেন বলেই কিন্তু আপনার ছেলেকে আজ জানে বাঁচাতে পারলেন! অন্তত কয়েকটা দিন চোখের দেখা তো দেখতে পারবেন। এই বা কম কীসের? আপনার কিংবা আপনার ছেলের জন্য যদি আমার কাজিনের লাইফ রিস্ক হতোনা? তবে আ’ম শিওর আপনিও এখানে আমার সামনে দাড়িয়ে কথা বলার সুযোগ পেতেননা! মরে ভূত হয়ে যেতেন। এই মিশালের দেহে শেষ রক্ত বিন্দুটুকু অবশিষ্ট থাকতে তার কাজিনের ক্ষতি কেউ কখনও করতে পারবেনা। মিলিয়ে নিবেন।”

ইমতিয়াজ চৌধুরীকে ঠেলে তরতরিয়ে হেঁটে জীপে ওঠে গেল মিশাল। রাগে বিষধর সাপের ন্যায় ফণা তুলতে লাগল সে। তৎক্ষণাৎ অ্যাম্বুলেন্সের পিছু পিছু ওসি সাহেবও জীপ ছেড়ে দিলেন। জীপ চালানো অবস্থায় থানার ওসি তারেকুল ইসলাম টুটুল পাশ ফিরে তাকালেন জেদী ও গম্ভীর চিত্তে বসে থাকা মিশালের দিকে। আঁচ করতে পারলেন কোনো কারণে হয়ত মিশালের মন খারাপ নয়ত কোনো কারণে বেশ ক্ষেপে আছে। তখনি ওসি টুটুল বেশ আগ্রহী গলায় মিশালের দিকে প্রশ্ন ছুড়লেন,

“কী রে মন খারাপ তোর?”

“উঁহু।”

“দেখে তো মনে হচ্ছেনা। বাই দ্যা ওয়ে, বাইক কেনার টাকা জোগাড় হয়েছে?”

“এখনও না।”

“আরও কত টাকার গড়মিল?”

“লাখ খানিক।”

“ডোন্ট ওরি। আজ রাতেও আরও বড়ো একটা অপারেশন আছে। তুই আমার সাথে থাকবি। আই থিংক কাল বা পরশুর মধ্যে হাজার বিশেক টাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে!”

রাগী ভাবমূর্তি পাল্টে আচমকা হেয়ো হাসল মিশাল। মলিন মুখে পাশ ফিরে তাকালো ওসি টুটুলের দিকে। ক্ষীণ স্বরে বলল,

“এই হাজার বিশেক টাকায় আমার কিছু হবেনা স্যার। যদি উপকার করতে হয় তো আপনাদের পোস্টে একটা চাকরীর ব্যবস্থা করে দিন! নিজের জীবন বাজি রেখে এই খুচরো টাকায় আর কতদিন বলুন? এজ আর্লি এজ পসিবল আমার একটা পার্মানেন্ট জব দরকার। বাবা মারা যাওয়ার পর পরিবারের হাল অবস্থাও তেমন ভালো নয়। পরিবারের সমস্ত ভার এখন আমার উপর। বুঝতেই তো পারছেন আমি কীসের উপর দিয়ে যাচ্ছি? তাছাড়া এখন পরিবারের প্রয়োজনের কাছে বাইক কিনতে চাওয়ার শখ করাটা নিতান্তই বিলাসীতা! যদিও চাচার দেওয়ার কোম্পানির জবটা আপনাদের কাজের জন্যই ছাড়তে হয়েছিল আমার! সেই হিসেবে আপনি কো-অপারেট করতেই পারেন।”

মিশালের অবস্থাটাও ভেবে দেখলেন ওসি সাহেব। দীর্ঘ সময় নিয়ে বেশ ভেবেচিন্তে তিনি বললেন,

“উম। মন্দ বলিসনি। তোর দিকটাও এবার ভেবে দেখা উচিৎ। তোর বাবাও তো কম হেল্প করেননি আমাদের ডিপার্টমেন্টকে। আচ্ছা দেখছি আমি কী করা যায়।”

আশ্বস্ত হলো মিশাল। তবে নিজের ক্যারিয়ার ও ভবিষ্যৎ নিয়ে ভীষণ চিন্তিত সে। বোনটাও বিয়ের উপযুক্ত হয়ে ওঠছে। সবদিকেই তো নজর রাখতে হবে তার। কপালে হাত ঠেকিয়ে মিশাল বিষণ্ন চিত্তে মাথা নুইয়ে বসে রইল। ওসি সাহেব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার মিশালের দিকে তাকিয়ে পুনরায় তার থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন! ক্রুর হেসে আপন মনে কুবুদ্ধি এঁটে বললেন,

“তুই আমার হেল্পিং হ্যান্ড হিসেবেই ভালো আছিস মিশাল! তোর কাজের যে স্কিল, প্রখর বুদ্ধিমত্তা, দূরদৃষ্টি ও অভিজ্ঞতা। বিশেষ করে তোর ফাইট করার যে ক্ষমতা এর কাছে আমার ক্যারিয়ারের বিশ বছরের অভিজ্ঞতাও তুচ্ছ! আমার পজিশনে পৌছাতে তোর বেশী সময় লাগবেনা। খাল কেটে কুমির আনার মত বোকামি আমি করবনা! বরং আশায় বেঁচে থাক তুই!”

___________________________________

রাগে নিশপিশ করে বাড়ি থেকে বের হয়ে এলো সামান্তা। তড়িঘড়ি করে সাহিলের গাড়িতে ওঠে বসল। প্রায় অনেকক্ষণ যাবত বদ্ধ গাড়িতে সামান্তার জন্য নিরলসভাবে অপেক্ষা করতে করতে মেজাজের অবস্থা সাংঘাতিক রকম চটে গেল সাহিলের! ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটেই বসল সামান্তা। ভ্যাপসা গরমে ঘাড় বেয়ে টপটপ করে ঘাম ঝরছিল সাহিলের! যদিও গাড়ির এসিটা আচমকা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে তার। তাইতো অসহ্য গরমে এত ভোগান্তি সহ্য করতে হলো তাকে। শার্টের কলার ঝেরে সাহিল পাশ ফিরে গরম দৃষ্টিতে তাকালো সামান্তার দিকে। সামান্তাকে বকাঝকা করতে গিয়েও আচমকা সে থেমে গেল। রক্তিম মুখশ্রী সামান্তার। চোখেমুখে রুক্ষতা৷ মেজাজ তার তুঙ্গে তা দেখেই আন্দাজ করা যাচ্ছে। ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুঁচকালো সাহিল। কৌতূহলী গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

“কী হয়েছে সামান্তা? কার উপর এত রেগে আছিস?”

সাহিলের দিকে ফিরেও তাকালোনা সামান্তা। বরং সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সু-প্রশ্বস্ত রাস্তার দিকে। ফোঁস করে শ্বাস ফেলে প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,

“গাড়ি ছাড়ো। আমাদের এক্ষণি থানায় যেতে হবে।”

“বললি তো হসপিটালে যাবি। এখন আবার থানায় কেন?”

“স্বপ্নীলকে কোন হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে মিশাল ভাই এই সম্পর্কে কিছু বলেনি। তাই আামাদের আগে থানায় যেতে হবে। এরপর ওখান থেকে খবর নিয়ে হসপিটালে যেতে হবে। আ’ম ড্যাম শিওর মিশাল ভাইয়া হসপিটালেই আছে।”

“মিশালকে একটা কল করলেই তো কনফিউশন দূর হয়ে যায়। এত খাটাখাটুনির কী দরকার?”

“ফোন সুইচ অফ তার। আমার সাথেই কথা বলতে চাইছেনা আর তোমার সাথে কথা বলা তো দূর!”

“এই লিসেন সামান্তা? মিশালকে এত ইম্পর্টেন্স দেওয়ার কিছু নেই! তার টপিকটা মাথা থেকে ঝেরে ফেল।”

রোষাগ্নি দৃষ্টিতে সামান্তা পাশ ফিরে তাকালো রগচটা সাহিলের দিকে। খরতর গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

“ভুলটা তবুও তুমি স্বীকার করবেনা তাইতো?”

তৎক্ষনাৎ সামান্তার থেকে ক্ষীণ দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো সাহিল। চোয়াল উঁচিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিলো! ভাবভঙ্গি দ্বারা বুঝিয়ে দিলো এই বিষয়ে সে সামান্তার সাথে কথা বলতে আগ্রহী নয়। সামান্তাও সাহিলের ইশারা বুঝে চুপ হয়ে গেল। তবে কোনো সন্দেহ ছাড়াই সাহিল তার অপছন্দের জায়গায় আরও একবার জায়গা করে নিলো!

মিশালদের বাড়ির ঠিক পাশের পাঁচতলা ফাউন্ডেশনটিই হলো সামান্তাদের বাড়ি! যদিও পাঁচতলা এখনও কমপ্লিট হয়নি। তিনতলা অবধি কমপ্লিট হয়েছে। রুমের বেলকনিতে কাপড় শুকাতে এসেছিলেন সামান্তার মা মিসেস জেসমিন হক ও সামান্তার ছোটো বোন সামিয়া। সেই কখন থেকেই তারা দুজন সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষন করছিল গাড়িতে অবস্থারত সামান্তা ও সাহিলকে। গাড়িটি ছেড়ে দিতেই মিসেস জেসমিন হক ব্যস্ত হয়ে ছুটে গেলেন তার রুমে। সামিয়াও তার মায়ের পিছু পিছু ছুটল রুমে। তার মায়ের ঠিক পেছনের দিকটায় দাড়িয়ে সে বেশ উত্তেজিত গলায় বলল,

“মা? আপু আর সাহিল ভাইয়া কোথায় গেল?”

ফোন ঘাটতে ব্যস্ত মিসেস জেসমিন হক। বেশ মনোযোগ সহকারে তিনি কারো নাম্বারে ডায়াল করছেন। চটপটে গলায় তিনি তার পনেরো বয়সী মেয়ে সামিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

“দাড়া। সাহিলকে কল করছি।”

দাম্ভিক ভঙ্গিতে গাড়ি চালাতে ব্যস্ত সাহিল। প্যান্টের পকেটে ফোনটি সাইলেন্ট মোডে বেজে ওঠতেই সাহিল বিরক্ত হয়ে ফোনটি প্যান্টের পকেট থেকে বের করল। সর্তক দৃষ্টিতে স্ক্রীণে তাকাতেই দেখল তার ছোটো মামীর নাম্বার। গলা ঝাকিয়ে সাহিল তাৎক্ষণিক কলটি তুলল। পাশের সিট থেকে সামান্তা ভ্রু উঁচিয়ে সাহিলের দিকে তাকালো। কলটি তুলে সাহিল বেশ শিথিল গলায় বলল,

“আসসালামু আলাইকুম মামী।”

সালামের জবাব নিয়ে মিসেস জেসমিন হক আচমকা প্রশ্ন ছুড়লেন,

“কোথায় যাচ্ছ তোমরা?”

পাশ ফিরে সাহিল প্রশ্নবিদ্ধ সামান্তার দিকে তাকালো। সামান্তা চোখের ইশারায় সাহিলকে শুধালো, কে? সামান্তার ইশারাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে সাহিল তার মামীকে বলল,

“আমরা একটু থানায় যাচ্ছি মামী।”

“থানায়? কিন্তু কেন?”

“কারণটা তো সামান্তাই জানে মামী। এই বিষয়ে আমি কিছু জানিনা।”

“শোনো সাহিল? তুমি সামান্তাকে ভালো করে বুঝিয়ে বলো যে এসব পাগলামি এবার বন্ধ করতে। অনেক সহ্য করেছি তার পাগলামি, কিন্তু আর নয়। তুমি এক্ষুণি তাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এসো।”

সামান্তার এতক্ষণে বেশ বুঝা হয়ে গেল ফোনের ঐ প্রান্তে কে রয়েছে! রাগে রি রি করে সে সাহিলের কান থেকে ফোনটি ছিনিয়ে নিলো। মুহূর্তের মধ্যেই কলটি কেটে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলো! ফোনটি সাহিলের হাতে তুলে দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“লিসেন সাহিল ভাইয়া? তুমি যতক্ষণ অবধি আমার সাথে থাকবে ততক্ষণ অবধি আমার বাড়ি থেকে কোনো কল এলে তুমি তুলবেনা! যদি আমার শর্ত মেনে আমার সাথে থাকতে পারো তো থাকো, না হয় তুমি চলে যেতে পারো।”

“এই শোন? আমি তোকে ছেড়ে কোথাও যাচ্ছিনা! ছায়া হয়ে সবসময় তোর পাশে থাকব।”

সাহিলের প্রেমময় ও স্নিগ্ধ দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে সামান্তা অন্যপাশ ফিরে গেল! সাহিলের আবেগকে যতটুকু সম্ভব এড়িয়ে গেল। মনমরা হয়ে গেল সাহিল। সব বুঝেও কী সামান্তা তার সাথে অবুঝের মত ভান ধরে? তবে সামান্তা কবে তার ভালোবাসা বুঝবে?

মিনিট দশের মধ্যে থানার মূল গেইটের সামনে গাড়ি পার্ক করল সাহিল। তড়িঘড়ি করে সামান্তা গাড়ি থেকে নেমে থানার ভেতরে প্রবেশ করতেই তার সুদূর দৃষ্টি পরল থানার পাশে থাকা একটি বিশাল মুদি দোকানের দিকে। জ্বলন্ত সিগারেট হাতে নিয়ে দাড়িয়ে মিশাল। পাশে রয়েছে তার কয়েকজন বন্ধু। সবার মাঝখানে দাড়িয়ে সে আড্ডা ও হাসাহাসিতে ব্যস্ত। মিশালকে এত সহজে খুঁজে পেয়ে যাবে তা ভাবনার অতীত ছিল সামান্তার। এ যেন মেঘ না চাইতেই জল৷ দেঁতো হেসে সামান্তা দ্রুত পায়ে হেঁটে মিশালকে চমকে দিতে চলে গেল! সাহিলও ততক্ষণে গাড়ি থেকে নেমে দাড়ালো।

মিশালের খুব কাছের বন্ধু চারজন। ছোটোবেলা থেকেই একসাথে বড়ো হওয়া তাদের। একই স্কুলে, একই কলেজে পড়াশোনা তাদের। যদিও এইচএসসির পর সবাই আলাদা আলাদা সেক্টরে চলে যায়। ভার্সিটি ভিন্ন হয়ে যায়। তবুও যোগাযোগ ও দেখা সাক্ষাৎ বন্ধ হয়নি তাদের। পড়াশোনা শেষ করে সবাই বেশ ভালো অবস্থানে পৌঁছে গেছে। কেউ ওকালতি করছে, কেউ ব্যাংকে জব করছে কেউ আবার শিপ ইঞ্জিনিয়ার৷ খুব কম সময়ই তাদের দেখা পাওয়া যায়। সবাই তাদের কর্মস্থল নিয়ে বড্ড ব্যস্ত। তবে মিশালের জীবনেই আশানুরূপ কিছু হলোনা! সংসারের অভাব- অনটন, অসুস্থ অবস্থায় তার বাবার আকস্মিক মৃত্যু। বাবার চিকিৎসার টাকা জোগাড় করার জন্য সমস্ত জায়গা জমিন বিক্রি করে দেওয়া সব মিলিয়ে আজ শূণ্য মিশাল! ভালো একটি ক্যারিয়ার গড়তে হলেও বাবার অঢেল টাকা থাকতে হয়। যা কখনই মিশালের ছিলনা। আর এখনও নেই! বিশেষ করে সৎ মায়ের জন্যই মিশালের বাবা বেঁচে থাকতেও মিশালের জন্য ভালো কিছু করে যেতে পারেননি। এই নিয়ে যদিও বাবার প্রতি কোনো অভিযোগ নেই মিশালের!

মিশালের বন্ধু লিওন একজন শিপ ইঞ্জিনিয়ার। আগামী ২৯ তারিখ তার বিয়ে। সেই উপলক্ষেই বেশ তাড়া নিয়ে বন্ধু মহলদের দাওয়াত করতে আসা তার। হাসি দুষ্টুমির এক পর্যায়ে মিশাল হঠাৎ তার বন্ধু লিওনের দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,

“তোর ঐ পমপম সুন্দরীর কী খবর রে? সস্তা টিকটকার! প্লিজ এখন এটা বলিসনা যে সে তোকে ছ্যাকা দিয়ে চলে গেছে।”

মুহূর্তেই একেকজন হাসিতে লুটোপুটি খেতে লাগল। সবার হাসি দেখে রাগে গাঁ পিত্তি জ্বলে উঠল লিওনের। গম্ভীর গলায় সে অন্যপাশ ফিরে বলল,

“তার সাথেই আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে!”

বন্ধুমহলে হঠাৎ শোকের ছায়া পরে গেল! প্রত্যেকেই শক খেয়ে হা করে বলল,

“হোয়াট?”

তখনি মিশাল অনুভব করল কেউ পেছন থেকে তাকে আঙুল দ্বারা পুক করছে! ভ্রু যুগল কুঁচকে মিশাল তৎক্ষনাৎ পিছু ঘুরে তাকালো। তার সম্মুখেই ভ্রু নাচিয়ে ক্রুর হাসতে থাকা সামান্তাকে দেখে সে অবাকের শীর্ষে পৌঁছে গেল! হতভম্ব গলায় শুধালো,

“তুই?”

“হ্যাঁ। কেন অবাক হচ্ছ? এক্সপেক্ট করোনি আমায়? ভেবেছ তোমাকে ট্রেস করা অতো সহজ নয়?”

#চলবে..?

[রি-চেইক করা হয়নি। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here