#ফিরে_আসা
৯
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
বিরক্তিতে গা জ্বলে যাচ্ছে অরার। একটা মানুষের প্রবল বিরক্তির পেছনে আরেকটা মানুষের হাত থাকার প্রবণতাই বেশি। এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি। অরার বিরক্তির কারণ দৈনিক জাগরণ পত্রিকার চিফ এডিটর জাহিদ আলম। সকালে একদফা লোকটার সঙ্গে কথা হয়েছে। অরা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে তার সিদ্ধান্ত। অবশ্য তার সিদ্ধান্ত বললে ভুল হবে, বলা উচিত আরশাদের সিন্ধান্ত। তবুও লোকটা বেহায়ার মতো কল দিয়েই যাচ্ছে।
আজ এফডিসির এগারো নম্বর ফ্লোরে চলছে আরশাদের শুটিং। তবে এই শুটিং সিনেমার নয়, বিজ্ঞাপনের। নামিদামি এক মোবাইল কোম্পানির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর আরশাদ। এর আগেও এই ব্র্যান্ডের জন্যে দুটো বিজ্ঞাপন করেছে। বিজ্ঞাপনগুলোর শুটিংয়ে আরশাদসহ তার পুরো টিমের ওপরে চাপ কম থাকে। অবশ্য সেটাই তো স্বাভাবিক। দুই-আড়াই ঘন্টার সিনেমার শুটিং যেখানে করা হয় চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ দিনে, সেখানে এক মিনিট কিংবা তারও কম সময়ের বিজ্ঞাপনের শুটিং করা হয় তিন থেকে চার দিন ধরে। এবারের সেটটাও চমৎকার হয়েছে। যে দেখছে সেই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রয়েছে।
অরা একবার ভাবলো জাহিদ আলমের ব্যাপারটা নিয়ে আরশাদের সঙ্গে কথা বলে দেখবে কিনা। তবে পরমুহূর্তেই মনে হলো, ভুলেই ওই কাজ করা যাবে না। আজ বহুদিন পর শুটিং সেটে আরশাদ স্বাভাবিক রয়েছে। সকলের সঙ্গে সহজভাবে কথা বলছে। এই পরিস্থিতি নষ্ট হতে দেওয়ার কোনো মানে হয় না।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে অরা প্রবেশ করলো আরশাদের জন্যে বরাদ্দ করা গ্রীন রুমে। তার মেকআপ, গেটআপ, বিশ্রামের সকল ব্যবস্থা এই ঘরটাতেই করা হয়েছে। সাধারণত সিনেমা বা বিজ্ঞাপনের শুটিংয়ে সকল অভিনয়শিল্পীদের একটাই গ্রীন রুম দেওয়া হয়। তবে সেটে আরশাদের মতো সেলিব্রিটি থাকলে ভিন্ন ব্যাপার।
গ্রীন রুমে আপাতত আরশাদ নেই। টিমের অন্যান্য কাউকেও দেখা যাচ্ছে না, কেবল মেহেদীকে বাদে। এই ছেলেটা আরশাদের কস্টিউম ডিজাইনার। কম বয়সে অতিরিক্ত গুণের অধিকারী হয়ে গেছে। গতবছর সিনেমায় আরশাদের কস্টিউম ডিজাইনিংয়ের জন্যে শ্রেষ্ট পোশাক পরিকল্পনার পুরষ্কারও পেয়েছে। অরা মেহেদী দেখে নিজের ছোট ভাইয়ের মতো। না দেখেও উপায় নেই, ছেলেটার ছোট-খাটো সকল আবদার এসে জমা হয় তার অরা আপুর আছেই।
অরাকেই দেখেই মেহেদী হ্যাঙারে ঝোলানো একটা সাদা শার্ট তার সামনে তুলে ধরে বলল, “আপু দেখো, নেক্সট শটে স্যারকে এই শার্ট দেবো। উনাকে মানাবে না?”
অরা কাছে গিয়ে ভালো করে খেয়াল করে দেখলো শার্টটা। লেনিন কাপড়ের পাতলা শার্টটার ওপর সূক্ষ্ম কাজ করা হয়। সাদার ওপর সাদা কাজ করা বলে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, তবে কাজগুলো না থাকলে শার্টের অর্ধেক সৌন্দর্যই যেন ম্লান হয়ে যেত।
অরা মুগ্ধ গলায় বলল, “বাহ্! দারুন মানাবে।”
“শার্টের সঙ্গে স্যার এই ব্রাউন মাফলারটা পড়বে। স্যারকে যা হ্যান্ডসাম লাগবে না আপু! মেয়েরা এই এক শটেই ফিদা হয়ে যাবে।”
অরা ভ্রু কুঁচকে বলল, “এই গরমে মাফলার?”
মেহেদী কয়েক মুহূর্ত হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অরার দিকে। যেন তার মতো বোকা এই পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই।
“তুমি না ফ্যাশনের কিছুই বোঝো না আপু। মাফলারের সঙ্গে আবার শীত-গ্রীষ্মের সম্পর্ক কী? একটা মাফলার লুক এনহান্স করতে কত বড় ভূমিকা রাখে জানো?”
“আমার অতসব জেনে কাজ নেই। সেটা জানা তোর কাজ।”
কথার মাঝেই বেজে উঠলো অরার ফোন। স্ক্রিনে আবারও সেই একই ব্যক্তির নাম ভেসে উঠেছে, জাহিদ আলম।
মেহেদী অরার ফোনের দিকে উঁকি দিয়ে বলল, “এই লোকটা আবার তোমাকে ফোন দিচ্ছে? কত বড় সাহস?”
অরা ক্লান্ত গলায় বলল, “সকাল থেকে দশবার ফোন দেওয়া হয়ে গেছে।”
“সে কী? কই আমাকে দাও তো, এমন কঠিন কঠিন গালি শুনিয়ে দেবো এই জীবনে আর তোমাকে ফোন করার সাহস পাবে না।”
“এজন্যেই তো তুই স্যারের ম্যানেজার নস গাধা! আমাকে আমার কাজটা করতে দে।”
মেহেদী গম্ভীর গলায় বলল, “আপু শোনো, ওর সঙ্গে অত ভালো বিহেভ করার দরকার নেই। আস্ত একটা হারামী এই লোক!”
অরা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “সেটা কি আমি জানি না ভেবেছিস? আমার কাজ হলো সবদিক ম্যানেজ করে চলা, সেটাই করছি। ম্যানেজ করতে হলে একটু-আধটু ভালো বিহেভও করতে হয়।”
“যা ভালো বোঝো করো, আমি শট দেখতে গেলাম।”
মেহেদী হ্যাঙারসহ শার্টটা ঝুলিয়ে রেখে পা বাড়ালো সেটের দিকে। অরা গ্রীন রুমের বিশাল সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে ডায়াল করলো জাহিদের নম্বরে। এই লোকটার সঙ্গে আরেকদফা কথা না বললে আজ সারাটাদিন ফোন করে জ্বালিয়ে মারবে।
একটা রিং বাজতেই অপরপ্রান্ত থেকে ফোন রিসিভ করে জাহিদ হাসি হাসি গলায় বলল, “কী ব্যাপার ম্যাডাম? ফোন করে করে পাগল হয়ে গেলাম আর এতক্ষণে আমার কথা মনে পড়লো?”
অরা বহুকষ্টে গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বলল, “ব্যস্ত ছিলাম, কী বলবেন বলুন।”
“আমার তো ওই একটাই কথা। ছোট্ট একটা ইন্টারভিউ, বড়জোর পনেরো মিনিট সময় লাগবে।”
“আমি তো আপনাকে বলেছি স্যার ইন্টারভিউ দেবেন না।”
“কেন দেবেন না? উনার সিনেমার শুটিং চলছে, পাবলিক নতুন সিনেমা নিয়ে অনেক বেশি আগ্রহ নিয়ে বসে আছে। ইন্টারভিউতে সিনেমা নিয়েই দুই-চারটা প্রশ্ন করবো।”
“একবার তো বললাম ভাই, স্যার ইন্টারভিউ দেবেন না।”
“কেন দেবেন না? সমস্যা কোথায়? আপনি একবার রাজি করিয়ে দেখুন না! আরে বাবা, আরশাদ হককে সুপারস্টার কে বানিয়েছে? এই আমরা বানিয়েছি। আমরা তাকে নিয়ে লেখালেখি না করলে কেউ দেখতে যেত টা সিনেমা?”
সাংবাদিক জাতীয় মানুষদের এই এক সমস্যা। তারা মনে করে পৃথিবীর সকল সফল মানুষের সফলতার পেছনে তাদের অবদান সবথেকে বেশি। একটা মানুষ যতই গুণের অধিকারী হক না কেন, তারা লেখালেখি না করলে যেন কারো পক্ষে সফলতার স্বাদ পাওয়া সম্ভবই নয়।
অরা বিরক্তির চরম শিখরে পৌঁছে গিয়ে বলল, “সমস্যা হলো আপনাদের পত্রিকা। অন্য কোনো পত্রিকা হলে স্যার ইন্টারভিউ দেওয়ার আগে দুবারও ভাবতেন না।”
জাহিদ ভড়কে গিয়ে বলল, “কেন? আমরা কী করেছি?”
“সবটা না হয় ভাঙিয়ে নাই বললাম। আপনি নিশ্চয়ই খুব ভালো করে জানেন কী করেছেন।স্যার তো একটুর জন্যে আপনাদের পত্রিকার নামে মামলা করেনি। You should be thankful for that.”
অপরপ্রান্ত থেকে আর কোনো আওয়াজ এলো না। সুযোগ বুঝে ফোনটা কেটে দিলো অরা। বেচারি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। লজ্জা থাকলে এই লোকটা আর জ্বালাতে আসবে না তার।
দৈনিক জাগরণ দেশের অন্যতম জনপ্রিয় পত্রিকা হলেও আরশাদের চোখের বিষ। এর যথাযোগ্য কারণও অবশ্য রয়েছে। সময়টা তিন বছর আগে। নওশীনের সঙ্গে আরশাদের কেবল ডিভোর্স হয়েছে। ডিভোর্সের নেতিবাচকতা এড়িয়ে চলতে আরশাদ সঙ্গে সঙ্গে কাজে নেমে পড়ে।
সেদিন একটি বিজ্ঞাপনের এগ্রিমেন্টে সাইন করা হবে ঢাকার গুলশান এলাকার বিলাসবহুল একটি রেস্টুরেন্টে। সেই বিজ্ঞাপনে আরশাদের সহশিল্পী নবাগত এক মডেল। এগ্রিমেন্টে সাইনের সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিজ্ঞাপনের পরিচালকসহ অন্যান্য কলাকুশলীরা। এছাড়াও খবর দেওয়া হয়েছিল টিভি এবং পত্রিকার নানা সাংবাদিকদের।
দৈনিক জাগরণ থেকে এসেছিল দুজন সাংবাদিক। একজন প্রকাশ্যে, আরেকজন গোপনে। গোপনে আসা সাংবাদিক অপেক্ষা করছিল অনুষ্ঠান শেষ হবার। অনুষ্ঠান শেষে আরশাদ যখন রেস্টুরেন্ট থেকে বের হচ্ছে তার পেছন পেছন বের হচ্ছে ওই মডেলও। যদিও আশেপাশে আরও বহু মানুষের ছড়াছড়ি। তবুও গোপনে লুকিয়ে থাকা সেই সাংবাদিক তার ক্যামেরার দক্ষতায় সুকৌশলে ক্যামেরাবন্দী করে কেবল আরশাদ এবং সেই মডেলকে।
পরদিন পত্রিকায় ছাপা হয় – ‘ডিভোর্সের পর নতুন নারীর সঙ্গে রেস্টুরেন্টে আরশাদ হক’ শিরোনামে এক প্রতিবেদন। পুরো প্রতিবেদন জুড়ে রসিয়ে রসিয়ে লেখা কিছু মনগড়া কথা। আরশাদ এবং নওশীনের ডিভোর্স নিয়ে চারিদিকে শোরগোল তখনো শান্ত হয়নি। তার ওপরে আবার এমন প্রতিবেদন যেন আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার কাজ করেছে। আরশাদকে দেখতে পারে না এমন এক দলের বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গেল, তার চরিত্রহীনতাই ডিভোর্সের প্রধান কারণ।
আবারও রিংটোনের শব্দে ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এলো অরা। তবে এবার স্ক্রিনে ফুটে উঠেছে ভিন্ন এক নাম। আসফিয়া হক। উফ! পৃথিবীর সকল বিরক্তিকর মানুষ কি আজ জোট বেঁধে অরাকে ফোন করবে বলে ঠিক করেছে? আরশাদের সহোদর বলতে এই একটিই বড় বোন হয়েছে। আসফিয়া যুক্তরাষ্টের গ্রীন কার্ড ধারী। কয়েক বছর হলো সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। যদিও সে প্রতিবার বলে, “এ বছরই দেশে ফিরে যাব, ইউএসএতে মানুষ থাকে?”
এই মানুষটার সঙ্গে আরশাদের সম্পর্ক কেমন তা বোঝার উপায় নেই। কখনো মনে হয় আরশাদ নিজের বড় বোনকে একেবারেই সহ্য করতে পারে না, আবারও কখনো মনে হয় দুই ভাই-বোনের মধ্যকার সম্পর্ক সুদৃঢ়।
অরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটা রিসিভ করতেই অপরপ্রান্ত থেকে আসফিয়া এক নিঃশ্বাসে বলল, “হ্যালো কে? অরা?”
অরা শুকনো গলায় বলল, “জি আপা।”
“অরা, আরশাদ কোথায়? আরশাদকে দাও তো।”
“আপা স্যার তো শটে…”
আসফিয়া অরাকে থামিয়ে দিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলল, “যেখানে খুশি সেখানে থাকুক, তুমি ওকে ফোনটা দাও। ফাজিল ছেলে! সুপারস্টার হয়ে গেছে তাই না? তাই বলে মাটিতে পাই পড়বে না উনার? আপন মানুষদের এড়িয়ে চলবে?”
“আপা আপনি একটু শান্ত হন।”
আসফিয়া উত্তেজিত হয়ে বলল, “আমি কী করে শান্ত হবো অরা? দেশ থেকে কত দূরে পড়ে আছি, মা সিলেটে একা। আমি কী সবসময় পারি মায়ের খোঁজ রাখতে? ওই বেয়াদব ছেলের কোনো দায়িত্ব নেই? না-কি সুপারস্টার হয়ে গেছে বলে আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের সঙ্গে কথা বলা যাবে না?”
“আমি কিন্তু সবসময় আন্টির খোঁজ রাখি।”
“সেটা তো আমি জানি অরা। কিন্তু মা আশা করে তার ছেলে নিজে ফোন করে খোঁজ খবর নেবে, মা ফোন করলে ফোনটা রিসিভ করবে।”
“ঠিক আছে, আমি স্যারকে বলবো শট শেষ করেই আপনাকে কল করতে।”
আসফিয়া মানুষটা বিরক্তিকর হলেও অরার তাকে ভালো লাগে। আরশাদের মতো সেলিব্রিটিকে শাসন করতে পারে এমন মানুষের দরকার আছে। সবথেকে ভালো হতো আসফিয়া যদি দেশে থাকতো। দিনে তিনবেলা এসে ভাইকে বকাঝকা করে যেতে পারত।
স্যারের খোঁজে গ্রীন রুমের বাইরে পা বাড়ালো অরা। এই মুহূর্তে আরশাদের খোঁজ একমাত্র সেটেই পাওয়া যাবে। শুটিং সেটকে ঘিরে ইউনিটের সকল ব্যস্ততা। শুটিংয়ের প্রথম দিন বলে আজ কারও দম ফেলার সময় পর্যন্ত নেই। সেটে শেষ মুহূর্তের লাইট করা হচ্ছে, ক্যামেরা পজিশন নিয়ে নিয়েছে। একটু পরেই হয়তো নতুন শট শুরু হবে।
শুটিংয়ের সময় ক্যামেরায় ধারণকৃত দৃশ্যটা যাতে পরিচালক স্পষ্ট দেখতে পান, তাই মনিটরের ব্যবস্থা করা হয়। কোনো ভুল-ত্রুটি থাকলে মনিটরের বড় স্ক্রিনে তা সহজেই ধরা পড়ে। মনিটর আপাতত বন্ধ পড়ে আছে, শট শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গেই চালু করা হবে।
মনিটরের সামনে পরিচালক বসে আছেন, তার পাশেই চেয়ারেই শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে আরশাদ। পরিচালক সাহেব হাত নেড়ে নেড়ে দৃশ্যটা বুঝিয়ে দিচ্ছেন, এবং আরশাদ মনোযোগী শ্রোতা। পরনে কালো জ্যাকেট, চুলে জেল আর জ্বলন্ত সিগারেট হাতে আরশাদকে আজ যেন একটু বেশিই হ্যান্ডসাম লাগছে।
অরা আরশাদের কাছে যাবে, এমন সময়ই বাঁধলো বিপত্তি। একটা মেয়ে আসছিল বিপরীত দিক থেকে। মেয়েটা এই বিজ্ঞাপনেরই অংশ। বিজ্ঞাপনে কয়েক সেকেন্ডের জন্যে দেখা যাবে তাকে। অরা ব্যস্ততার সঙ্গে হাঁটতে গিয়ে অসাবধানতাবশত লেগে যায় মেয়েটার সঙ্গে ধাক্কা। মেয়ের হাতে আবার হুট জাতীয় কিছু ছিল। ধাক্কার কারণে সমস্ত জুস গিয়ে উপড়ে পড়ে মেয়েটার সাদা পোশাকে।
অরা কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই মেয়ে তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “হাউ ডেয়ার ইউ! তোমার সাহস কী করে হয় আমাকে ধাক্কা দেওয়ার?”
অরা যথেষ্ট স্বাভাবিকভাবেই বলল, “আই অ্যাম সো সরি।”
মেয়েটা রেগেমেগে উঁচু গলায় বলল, “কীসের সরি? তুমি জানো এই ড্রেসটার দাম কত? উফ! কোথা থেকে যে আসে এরা?”
মেয়েটা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনি শোনা গেল আরশাদের শীতল কণ্ঠস্বর, “কী ব্যাপার? একবার তো বলল সরি, তারপরও এত সিন ক্রিয়েটের মানে কী? তুমি জানো কার ম্যানেজারকে ধমকাধমকি করছ?”
মেয়েটা মুহূর্তেই গলার স্বর এবং মুখভঙ্গিতে নমনীয়তা এনে বলল, “ওহ মাই গড! আমি জানতামই না উনি আপনার ম্যানেজার।”
আরশাদ আবারও শীতল গলায় বলল, “জানলে কী করতে? রেসপেক্ট দিয়ে কথা বলতে? সকলকেই সমান রেসপেক্ট করা উচিত, শুধুমাত্র আমার ম্যানেজার বলে কাউকে বেশি রেসপেক্ট করতে হবে না।”
আরশাদের সঙ্গে কাজ করার এই একটা মজা। নিজে সারাদিন হাজারটা ধমক দেবে, কথায় কথায় চাকরি থেকে ফায়ার করার হুমকি দেবে। তবে বাইরের কারোর মুখে টিমের কাউকে নিয়ে একটাও কটু কথা সহ্য করবে না আরশাদ। মেয়েটা আরও কয়েক দফা অরাকে সরি বলে ঝড়ের গতিতে সেট থেকে বেরিয়ে গেল।
অরা আরশাদের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, “আসফিয়া আপা আপনাকে ফোন করতে বলেছে স্যার।”
আরশাদ থমথমে গলায় বলল, “বলে দাও আমি বিজি, আজ কল করতে পারবো না।”
অরা শুকনো গলায় বলল, “বলেছিলাম স্যার, লাভ হয়নি। আপা ধমক দিয়ে বলেছেন আজই ফোন করতে।”
আরশাদ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল অরার দিকে। এই মেয়েটার হয়েছেটা কী? তার ম্যানেজার হয়ে মানুষের কাছে ধমক খেয়ে বেড়াচ্ছে। অবশ্য ধমক খেয়েছেও আসফিয়া আপার কাছে। এই মানুষটা ধমক না দিয়ে কোনো কথোপকথন শুরু করতে পারেন না।
শট শেষে গাড়িতে গিয়ে বসলো আরশাদ। গাড়ির এসি চলছে তবুও ঘামছে ছেলেটা। সেটের কোথাও এসি না থাকলেও সর্বক্ষণ তার সামনে প্রকান্ড এক স্ট্যান্ড ফ্যান ঘোরে, শুধুমাত্র শট চলাকালীন সময়ে বন্ধ থাকে।
আরশাদ ডায়াল করলো আপার নম্বরে। একটা রিং বাজতেই কল রিসিভ করে আসফিয়া অপরপ্রান্ত থেকে বলল, “হ্যালো আরশাদ? এই বেয়াদব ছেলে! তোর সমস্যা কী?”
আরশাদ গম্ভীর গলায় বলল, “আমার কোনো সমস্যা নেই। ফোন তুমি করতে বলেছ, সমস্যা থাকলে তোমার থাকবে।”
আসফিয়া ধমকের সুরে বলল, “ফাজলামি করবি আমার সঙ্গে। সমস্যা না থাকলে মায়ের ফোন রিসিভ করিস না কেন?”
“তুমি তো জানো কেন। অযথা প্রশ্ন করছ কেন?”
আসফিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নরম গলায় বলল, “আরশাদ, ওই ঘটনার তিন বছর হয়ে গেছে। তিন বছর কী কম সময়? মাও তার ভুলটা বুঝতে পেরেছে, তোর সঙ্গে কথা বলতে চাইছে। একটা সুযোগও কি তুই দিবি না?”
“এখন কথা বলে কী লাভ আপা? যখন সবথেকে বেশি আমার পাশে কাউকে প্রয়োজন ছিল, তখন তো তাকে পাইনি।”
“ওই এক ঘটনা নিয়ে আর কতদিন পরে থাকবি ভাই? ভুলে যাওয়ার চেষ্টা কর না।”
আরশাদ দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “চেষ্টা করার কিছু নেই আপা, আমি ভুলেই গেছি।”
“সত্যি সত্যিই ভুলে গিয়ে থাকলে তো খুব ভালো কথা। সবসময় চিয়ারফুল থাকবি বুঝলি? একটা ভালো বুদ্ধি দেই?”
“কী বুদ্ধি?”
আসফিয়া ফিসফিস করে বলল, “সময় নষ্ট না করে আরেকটা বিয়ে করে ফেল।”
আরশাদ বিরক্তির চূড়ান্ত সীমার পৌঁছে বলল, “তোমার ফালতু কথা শেষ হয়ে গেলে আমি রাখলাম।”
আসফিয়াকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে আরশাদ ফোনটা কেটে দিলো। ডিভোর্সের পর থেকে বহু মানুষ বহু এই একটা কথা বলেছে তাকে। নতুনভাবে জীবনটাকে শুরু করতে। যার জীবন একটা নির্দিষ্ট জায়গায় আটকে আছে, সে আবার নতুন করে জীবন শুরু করবে কী করে?
(চলবে)