তুমি_অপরূপা (১৮)

0
374

#তুমি_অপরূপা (১৮)
রেশমা এক প্রকার জোর করেই বাসায় অবস্থান নিলো।জুয়েলের অকথ্য ভাষায় গালাগালি ও তাকে টলাতে পারলো না। রাগে জুয়েল যখন রেশমাকে মারতে গেলো, রানা গিয়ে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরলো। কাঁদোকাঁদো হয়ে বললো, “মা,আমি আর তুমি চলে যাবো এখান থেকে, বাবা তোমাকে বকা দেয় শুধু। ”

ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে জুয়েলের আর সাহস হলো না ছেলের সামনে রেশমাকে আর কিছু করতে বা গায়ে হাত তুলতে।এদিকে অন্তরার মুখে যেনো আষাঢ়ের মেঘ জমেছে। জুয়েল জানে এটা অন্তরার জন্য কেমন দুর্বিষহ একটা ব্যাপার। কিন্তু কি করবে সে!

ছেলের জন্য সবসময় সবকিছু মেনে নিয়েছে জুয়েল,যদি অন্তরা জীবনে না আসতো তাহলে হয়তো রেশমাকে আবারও মেনে নিতো শুধু ছেলেটার দিকে তাকিয়ে। এখন কোন দিকে যাবে জুয়েল ভেবে পেলো না!

দুপুরে রানাকে খেতে ডাকলে রানা এলো না।মায়ের সাথে খাবে বলে মায়ের গলা ধরে বসে রইলো। রেশমা মেইন দরজার পাশে এসে যে বসেছে আর উঠার নাম গন্ধ নেই।

সারাদিনের না খাওয়া রেশমার কথা ভেবে অন্তরার ভীষণ খারাপ লাগলো। যাই হোক,একজন মানুষ এভাবে বাসায় এসে না খেয়ে আছে তা অন্তরা মানতে পারলো না।
খাবারের প্লেট বেড়ে রানাকে ডেকে বললো, “রানা,প্লেট নিয়া তোমার মা’রে লইয়া ভাত খাও।”

রানা মায়ের হাতে খাওয়ার লোভে ছুটে এলো। তারপর প্লেট নিয়ে গেলো মায়ের কাছে। কোনো জড়তা না রেখে রেশমা খেয়ে নিলো।

জুয়েলের জন্য ভাত বেড়ে অন্তরা রুমে এনে দিয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়। জুয়েল অন্তরার হাত ধরে টেনে তুলে বললো, “আমাকে ভুল বুঝিও না অন্তু,আমি কি করবো এখন তুমি বলে দাও?আমার অবুঝ ছেলেটার দিকে তাকিয়ে জোর করে ওকে বের করে দিতে ও পারছি না।তুমি যদি চাও তবে আমি রানাকে ওর মায়ের কাছে দিয়ে দিই,তাহলে হয়তো ওর না চলে যাবে।”

এই কতো দিনে রানার জন্য অন্তরার মনে প্রচন্ড মায়া,ভালোবাসা জন্ম নিয়েছে।রানা চলে যাবে এটা অন্তরা ভাবতেই পারছে না।আৎকে উঠে বললো, “না না,রানা কোথাও যাবে না।রানা আমার ও ছেলে,ওকে আমি যেতে দিবো না কিছুতেই। ”
জুয়েল স্বস্তি পেলো কিছুটা। রানার প্রতি যে অন্তরার বেশ ভালো রকমের টান আছে সেটা আগেই জুয়েল বুঝতে পেরেছে। সেই দুর্বলতাকেই কাজে লাগলো জুয়েল।

————–

আহত অবস্থায় রূপক বাসায় এলো। রত্না, পান্না সবেমাত্র ড্রেস চেঞ্জ করে ডাইনিং এ এসে বসেছে।এই অবস্থায় দাদাকে আসতে দেখে দুজনেই চমকে গেলো। সুস্থ একটা মানুষ এই অল্প সময়ের মধ্যে কিভাবে এরকম করলো!

দুই বোনকে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রূপক হেসে বললো, “হ্যালো হামটি,ডামটি!”

রত্না এগিয়ে গিয়ে দাদাকে ভেতরে আসতে সাহায্য করলো। পান্না জায়গায় জায়গায় এরকম কাঁটা ছেঁড়া দেখে শিউরে উঠলো।
ব্যতিব্যস্ত হয়ে দাদাকে জিজ্ঞেস করলো, “এরকম কিভাবে হলো দাদা?”

হেসে রূপক বললো, “রাস্তায় চল,একটা কারের সাথে ধাক্কা লাগিয়ে আবার দেখাবো তাইলে কিভাবে হলো। ”

রত্না কাঁদোকাঁদো হয়ে বললো, “এখনো তোমার এরকম ফাজলামো গেলো না দাদা।কিভাবে পারো এই মুহূর্তে ও এরকম চিল মুডে থাকতে, ব্যথা লাগছে না? ”

রূপক একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, “ব্যথা!
সে তো অনেক আগে থেকেই পাচ্ছি রে, কিন্তু কী করবো বল?”

পান্না বললো, “ব্যথার মলম লাগিয়ে দিই দাদা?”

রূপক হাসলো মিষ্টি করে। তারপর বললো, “বাহিরের ব্যথায় সবাই মলম লাগাতে চায়,মনের ব্যথার বেলায় কেনো কাউকে পাওয়া যায় না?
তাহলে তো একটা আঘাত পাওয়া মন নিয়ে বেঁচে থাকতে হতো না। ”

পান্না সুযোগ পেয়ে বললো, “একটা ভাবী নিয়ে আসো আমাদের জন্য। সে লাগিয়ে দিবে তোমার মনের ব্যথায় মলম।”

বোনের কথা শুনে রূপক হেসে বললো, “আগে তোদের বিদায় করবো। নয়তো কাল ননদী হয়ে আমার বউকে তোরা জ্বালিয়ে মারবি।”

ফাস্ট এইড এনে রত্না দাদার গায়ের কাটাছেঁড়ায় লাগিয়ে দিলো।রূপক রুমে বিশ্রাম নিচ্ছিলো তারপর শুয়ে।তন্দ্রা লেগে আসছিলো সেই সময় রত্না এসে ডেকে বললো, “দাদা,ছোট চাচা এসেছে। ”

রূপকের তন্দ্রা কেটে গেলো, এক রাশ বিরক্তি এসে ভর করলো রূপকের মনে।প্রতিবার চাচা আসে আর শুরু হয়ে যায় ঝামেলা। রূপক ভেবে পায় না মানুষ এরকম স্বার্থান্বেষী কিভাবে হয়?

নিজেকে নিজে বুঝালো মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে উত্তেজিত হওয়া যাবে না কিছুতেই।নিজেকে শান্ত করে রূপক বসার ঘরে গেলো। রূপকের চাচা সেলিম খান সোফায় বসে ঠান্ডা লেবুর শরবত পান করছেন।রূপক এসে চাচাকে সালাম দিলো।
।সেলিম খান গলা খাঁকারি দিয়ে বললো, “এই কী অবস্থা তোর?হাত পায়ের এই হাল কীভাবে?
গুন্ডামী এখনো ছাড়িস নি তুই?এতো অধঃপতন তোর!”

রূপক শান্ত স্বরে বললো, “আপনি তো এখানে থাকেন না যে আমার গুন্ডামী দেখতে হবে আপনার। এখন যদি বেশি অসুবিধা হয় তবে চোখ বন্ধ করে রাখেন চাচা।”

সেলিম খান মুখ গম্ভীর করে বললো, “আদব লেহাজ তো তোর মধ্যে কোনোদিনই ছিলো না। তাই তোর থেকে ভদ্র ব্যবহারের আশা ও করি না।যাক গে সেসব,এখন বল এভাবে আর কতো দিন? ”

রূপক না জানার ভান করে বললো, “কিভাবে চাচা?”

সেলিম খানের প্রচন্ড রাগ হলো এরকম হেঁয়ালিপূর্ণ কথা শুনে। এই ছেলেটা যে মহা ত্যাঁদড় তা তিনি জানেন।তাই ধৈর্য রেখে বললেন, “এরকম একটা জমি তো এভাবে ফেলে রাখা চলে না।ভাবনা চিন্তার ব্যাপার আছে। ডেভেলপাররা তো আমাকে পাগল করে দিচ্ছে। ওই জমিতে কি না হবে বল?হাসপাতাল, শপিংমল, এপার্টমেন্ট সব হবে।এরকম সোনার খনি এভাবে ফেলে রাখার মতো বোকামি কোন পাগলে করে? ”

রূপক আগের মতো শান্তস্বরে বললো, “কোনো পাগলে করে না চাচা,সুস্থ মানুষ করে। আমি করি।”

তানিয়া অফিস থেকে ফিরে দেবরকে দেখে বুঝলেন ঘটনা কি।ছেলের দিকে না তাকিয়ে বললেন, “কি সিদ্ধান্ত নিলেন ছোট ভাই?”

বড় ভাইয়ের বউকে দেখে সেলিম খানের সাহস বাড়লো কিছুটা। মা ছেলের কোন্দলের কথা কারো অজানা নয়।সেলিম খান মন খারাপ করে বললেন, “সিদ্ধান্ত আর কি, রূপকেই তো রাজি হয় না।তা না হলে কোটি টাকার সম্পদ কেউ এভাবে ফেলে রাখে,বলেন ভাবী?”

তানিয়ার চোখ চকচক করে উঠলো। তিনি জানেন ছেলে রাজি হবে না,তবুও বললেন,”তাহলে তো ভালোই, আপনি না হয় আগামীকাল পার্টি নিয়ে আসবেন।কথা বলে ফাইনাল সিদ্ধান্ত নিয়ে নেওয়া যাবে।এভাবে আর কতো অপেক্ষায় থাকবেন?”

রূপক উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “চাচা,ওই জমিটা আমার নামে দিয়ে গেছেন দাদা।ওটা ফুফুর ভাগের জমি।ওই জমিতে যা করার ফুফু করবে।কাউকে আমি ওই জমি থেকে এক কণা মাটি ও নিতে দিবো না।ওটা ফুফুর ওয়ারিশি সম্পদ।আর ওয়ারিশের সম্পদ না বুঝিয়ে দিলে আমার দাদাকে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে।তার ছেলেরা যে নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছুই বুঝবে না তা আর দাদার অজানা ছিলো না ।”

তানিয়া ফোড়ন কেটে বললো, “আমি বুঝি না মানুষ এরকম সেন্সলেসের মতো কাজ করে কীভাবে!
এতো গুলো বছর কেটে গেলো, যে মেয়ে বাড়িতে ফেরে নি আর।বাবা মা কারো কথা যার মনে নেই,যে বেঁচে আছে কি-না তা নিয়েও সন্দেহ, তার জন্য এরকম একটা জায়গা এভাবে ফেলে রাখার কি মানে!”

রূপক মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে বললো, “ফুফু বেঁচে যদি না থাকে তার ছেলে মেয়েরা আছে।কেউ না কেউ তো আছেই,এক দিন না একদিন পাবোই।সেদিন তাদের সম্পদ আমি তাদের বুঝিয়ে দিবো।কিন্তু তার আগে ওই জমি দিয়ে কারো স্বার্থ পূর্ণ করতে আমি দিবো না।আমি ভুলে যাবো কে আমার মা আর কে আমার চাচা।”

আর এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে রূপক নিজের ঘরে চলে গেলো। সেলিম খান ও বিরস মুখে বের হলেন বাসা থেকে।

পরদিন সকালে রূপক বাহিরে বের হয়ে বোনদের রিকশায় তুলে দিলো।তারপর এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখলো সমুদ্র বাসার উল্টো দিকে কিছুটা দূরের দোকানের সামনে বসে আছে।

রূপক ঘড়িতে টাইম দেখলো।এতক্ষণে তো মেয়েটার বের হয়ে যাবার কথা।
ভাবতে না ভাবতেই দেখলো চুলে দুই বিনুনি করে রূপা হন্তদন্ত হয়ে বের হচ্ছে। রূপক গেটের ভেতরে ঢুকে আড়ালে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইলো। রূপা কিছুটা যেতেই সমুদ্র উঠে এসে রূপার পেছন পেছন হাটতে লাগলো।

রূপক এবার নিশ্চিন্ত হলো তার ভাবনা ভুল ছিলো না । হেসে বললো, “দেখা যাক সমুদ্র, তোমার লক্ষ্যে তুমি পৌঁছাতে পারো কি-না, নাকি তার আগেই তোমার লক্ষ্য অন্য কারো হয়ে যায়! ”

আজকেও সমুদ্র পিছু পিছু আসছে দেখে রূপা ঘুরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কী সমস্যা আপনার? আবার ও পিছু পিছু আসছেন কেনো?”

সমুদ্র থতমত খেয়ে বললো, “মানে,আপনার ওই ওড়নাটা আমার কাছে তো,ওটা কি ফেরত দিবো আপনাকে তা জিজ্ঞেস করতেই এলাম।”

রূপা বিরক্ত হয়ে বললো, “আমি গ্রামের মেয়ে হতে পারি,তবে এরকম খোঁড়া অযুহাত আমার গ্রামের ছেলেরা ও দিতো।তাদের চোখেই ফুটে উঠতো তাদের মনের ভাষা।”

সমুদ্র হেসে বললো, “না আমি তেমন না।তবে কেনো জানি আপনার সাথে বন্ধুত্ব করতে ইচ্ছে করছে। ”

রূপা দৃঢ় কণ্ঠে বললো, “আমি যদি আর কোনো দিন আপনাকে এভাবে আমার পিছু নিতে দেখি তবে আমি লোক জড়ো করে বলবো আপনি আমাকে টিজ করছেন।দয়া করে আর কখনো এরকম করতে আসবেন না আমার সাথে। ”

সমুদ্র হাহা করে হেসে বললো, “আপনি তো ভীষণ কঠোর মেয়ে।মেয়েরা না-কি নরম মনের হয়,আপনার মনটা এতো শক্ত কেনো?লোহার না-কি? ”

রূপা ক্রুদ্ধ স্বরে বললো, “ইস্পাত দিয়ে তৈরি। ”

সমুদ্র রূপার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললো, “সেই ইস্পাতকে গলিয়ে ভালোবাসার সমুদ্রে রূপান্তর করার দায়িত্ব না হয় আমি নিলাম কপালকুণ্ডলা। ”

রূপা কিছু বলার আগেই সমুদ্র চলে গেলো উল্টো দিকে।
রূপা বিড়বিড় করে বললো, “আমি বাবাকে কথা দিয়েছি,বাবাকে দেওয়া কথা আমি রাখবো । ”

চলবে…..

রাজিয়া রহমান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here