তুমি_অপরূপা(৪৩-শেষ পর্ব)

0
647

#তুমি_অপরূপা(৪৩-শেষ পর্ব)

শাহেদেরা এসেছিলো ১ মাসের জন্য। ১ মাস শেষে ওরা ফিরে যায়।এর মধ্যে শাহেদ অন্তরকে নিয়ে একদিন বাড়িতে গিয়েছিল।হাসানুজ্জামান এবং রোজিনা দুজনেই রেগে ছিলো তার উপর। একে তো বউকে বিদেশে নিয়ে গেছে, তার উপর আবার শ্বশুর বাড়িতে এসেছে।

শাহেদ মুচকি হেসে বললো, “আমার স্ত্রী সন্তান যেখানে নিরাপদ আমি তো সেখানেই আসবো মা।”

রাগে,ক্রোধে দুজনের একজন ও ছেলেকে বসতে বলে নি। শাহেদ এরপর আর যায় নি।শুধু চলে যাবার দিন স্ত্রী, পুত্রকে নিয়ে বাবা মা’কে সালাম করতে যায়।
রোজিনা রেগেই ছিলো। হাসানুজ্জামান তবুও একটু ভালো কথা বলে ছেলেকে বিদায় জানিয়েছে।

বাড়িতে অন্তরা,অনিতা আর বাবা মা।
অন্তরার একটা চাকরি হয়েছে প্রাইমারি স্কুলে। অন্তরা সিদ্ধান্ত নিলো বিয়ে না করার।বোনেরা সবাই যখন নিজের সংসারে ব্যস্ত হয়ে যাবে তখন বাবা মা কার কাছে থাকবে?
তাছাড়া বিয়ের যেই দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা হয়েছে এরপর আর কোনো ইচ্ছে নেই অন্তরার।

রূপক আর রূপা একসাথেই থাকে।।ইদানীং তানিয়ার ইচ্ছে করে ছেলের সাথে একটু কথা বলতে, এক সময় ছেলের উপর করা সকল অন্যায় কেমন বারবার মনে পড়ে যায় তার।
এতো দিন সন্তানদের তেমন একটা খোঁজ খবর রাখেন নি।এখন মনে হচ্ছে দিন শেষে তাকে মা বলে যারা ডাকে তাদের চেয়ে আপন তার আর কেউ নেই।
রূপক বউ নিয়ে আলাদা ফ্ল্যাটে থাকে।তানিয়ার ইচ্ছে করে মাঝেমাঝে ছেলে আর ছেলের বউকে বাসায় নিয়ে আসতে।
কিন্তু সাহস পায় না।

সকাল সকাল রূপা রান্না বসিয়ে দিলো। তার ক্লাস আছে দুপুরের দিকে। রূপক তখনও ঘুমে। কলিং বেলের শব্দ শুনে রূপা হাত মুছতে মুছতে দরজা খুলতে গেলো।
দরজা খুলে দেখে সমুদ্র দাঁড়িয়ে আছে। হাতে মিষ্টির প্যাকেট।
সমুদ্রকে দেখে রূপার মুখ হাসিহাসি হয়ে গেলো। সমুদ্র হেসে বললো, “তোমার জনাব কোথায়?এখনও ঘুমাচ্ছে নিশ্চয়? ”

রূপা হেসে বললো, “তাছাড়া আর কি করবে?”

সমুদ্র ওদের রুমে গিয়ে রূপকের গায়ে পানির ছিটা দিতেই রূপক তড়াক করে উঠে বসলো। তারপর সমুদ্রকে দেখে বললো, “কিরে, এক সপ্তাহ পরে কই থেকে আসলি?কোথায় ছিলি?”

সমুদ্র বিছানায় আ তুলে বসতে বসতে বললো, “একটা সুখবর আছে দোস্ত।আমার ভিসা হয়ে গেছে। দুবাই চলে যাচ্ছি। ”

রূপকের হাসিমুখ মলিন হয়ে গেলো। সমুদ্র চলে যাবে দেশের বাহিরে!
রূপক চুপ করে রইলো কিছুক্ষণ। এমন একটা ব্যাপার যা নিয়ে কথা তুলতে চায় না কেউ-ই। যেনো কেউ-ই কিছু জানে না অথবা কিছুই হয় নি এমন ভাব করে থাকে সবাই।
কিন্তু এটা হতে দেওয়া যায় না।সমুদ্র যদি কবির কাকার মতো অভিমান করে চলে যায় তাহলে কি হবে!
একটা বংশ এখানেই শেষ হয়ে যাবে।সমুদ্রের পরের প্রজন্ম আসবে না কখনো?

রেখা আন্টি যতোই দোষ করুক,ছেলের থেকে পাওয়া এই শাস্তি তার জন্য অনেক বেশি হয়ে যাবে।তার তো আর কোনো সন্তান নেই সমুদ্র ছাড়া।

রূপক চুপ করে আছে দেখে সমুদ্র বললো, “রাগ করিস না।কেনো জানি মন বসে না দেশে।শান্তি পাই না কিছুতেই।বাসায় যেতেই ইচ্ছে করে না।বাসায় গেলে মনে হয় কোনো জাহান্নামে আছি।আছি সত্যি নিরুপায় দোস্ত।”

রূপক অন্যদিকে তাকিয়ে বললো, “অথচ তুই কথা দিয়েছিলি আমরা দুই বন্ধু আজীবন একসাথে থাকবো।এমনকি আমাদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে বিয়ে দিয়ে আমাদের সম্পর্ক আরো মজবুত করবো।একসাথে ব্যবসায় করবো।সব ভুলে গেলি?”

সমুদ্র কিছুই ভুলে নি।কিন্তু কি করবে সে!দিন শেষে সে ভীষণ একা।এরকম নিঃসঙ্গতা নিয়ে থাকা যায় না।তার উপর রেখার ক্যাটক্যাটে কথা। সমুদ্র আর নিতে পারছে না।

হেসে বললো, “দূর,ওসব কথা বাদ দে।বিয়ে টিয়ে আমাকে দিয়ে হবে না।আর আমার মায়ের সাথে এডজাস্ট করতে পারবে এরকম মেয়ে নেই।”

রূপক এক মুহুর্ত ভেবে বললো, “আমার বিয়ের সব কিছু তুই করেছিলি,এমনকি আমাকে না জানিয়ে বিয়ের তারিখ ও তুই ঠিক করেছিস।আমাকে সেই দায়িত্ব দিবি না নিজের বেলায়!”

সমুদ্র জবাব দিতে পারলো না। রূপক তার জন্য সারাটা জীবন ত্যাগ করে এসেছে। সে যদি রূপাকে রূপকের জন্য ত্যাগ না করতো তবে বিবেকের কাঠগড়ায় আজীবন অপরাধী হয়ে থাকতো।হয়তো রূপাকে পেতো,রূপক কখনো সমুদ্রের মনে আঘাত দিতো না।কিন্তু তাতে কিছুতেই সুখী হতে পারতো না।সব সময় জিতে সুখ নেই।হারতে শিখে যে,হেরে যাওয়াকে সাদরে গ্রহণ করতে জানে যে সেই প্রকৃত সুখী।

রূপাকে পায় নি বলে সমুদ্রের মনে খানিকটা কষ্ট আছে সত্যি কিন্তু তার চাইতে কঠিন সত্যি ওদের দু’জনকে পাশাপাশি দেখলে বুকের মধ্যে যে স্বস্তি অনুভব হয়,তা হয়তো রূপাকে পেলে হতো না তার।
এখন যে কষ্ট হয় তার চাইতে বেশি কষ্ট হতো রূপাকে পেয়ে গেলে।সারাজীবন মনে হতো স্বার্থপর সে।কখনো নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছুই বুঝে নি।

রূপক আলতো করে নাড়া দিয়ে বললো, “কি ভাবছিস তুই?
নাকি আমার কথা তোর পছন্দ হয় নি! না-কি তুই চাস না আমি তোর জন্য আমার পছন্দের মেয়ে সিলেক্ট করি যে সবকিছু মানিয়ে নিতে পারবে!”

সমুদ্র কিছু বলার আগে রূপক বললো, “আমি যদি তোকে বলি আমার কলিজার একটা টুকরো আমি তোর হাতে তুলে দিতে চাই,তুই কি গ্রহণ করবি না? ”

সমুদ্র বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।

রূপক নরম স্বরে বললো, “আমি যদি রত্নাকে আজীবনের জন্য তোর হাত তুলে দিই তোর সুখ দঃখের সাথী করে, গ্রহণ করবি?”

সমুদ্র চমকে উঠলো। রত্না!
রূপক তার কাছে রত্নাকে দিতে চাইছে!
রত্না পান্না দুজনেই রূপকের কলিজার টুকরো। বোনদের কেমন সযত্নে বড় করেছে রূপক সমুদ্র তা জানে।সেই ভালোবাসার, আদরের মানুষ যখন রূপক সাগ্রহে তার হাতে তুলে দিতে চাইছে সমুদ্র কি করে নিষেধ করবে!

রূপক রত্নাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, “আমি যদি তোর বিয়ে নিজের পছন্দে ঠিক করি তুই কি রাগ হবি?তোর কি কাউকে পছন্দ আছে?আমাকে না বললে তোর ভাবীকে বলতে পারিস।”

রত্না ভাইয়ের হাত ধরে বললো, “দাদা,আজীবন তোমার ছায়ায় বড় হয়েছি।বাবা মা দুজনের আদর তোমার কাছে পেয়েছি। কখনো তোমার আদেশ ছাড়া এক পা ফেলি নি,কি করে ভাবলে জীবন সঙ্গী ঠিক করার মতো সেনসেটিভ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিজে নিজে নিবো!
আজীবন দেখেছি তুমি আমাদের জন্য সবসময় বেস্টটা দিয়েছ,আমি জানি জীবন সঙ্গী হিসেবেও যাকে ঠিক করবে সে বেস্ট হবে।”

রূপক বোনের হাত ধরে বললো, “সমুদ্র কে তো তুই জানিস,সবই জানিস তুই।সমুদ্র ছছন্নছাড়া হয়ে যাচ্ছে বোন।ওকে গুছিয়ে দেওয়ার জন্য এমন কাউকে চাই যে শক্ত হাতে সব সামলাতে জানে।আমি জানি আমার বোনের চাইতে ভালো কেউ পারবে না এই কাজ।তোর অমত নেই তো!”

রত্না হেসে বললো, “দাদা,তুমি আমাকে এতটা ভরসা করতে পারো?
আমি নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করবো দাদা।আমি জানি আমি পারবো।”

দুই দিন পর সমুদ্র যখন সন্ধ্যা বেলা রত্নাকে বগলদাবা করে বাসায় গিয়ে হাজির হলো, রেখা তখন ডাইনিং টেবিলে বসে আছে। চেয়ারে বসে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ভাবছে।
রত্না গিয়ে টুপ করে সালাম দিলো রেখাকে।

একটা লাল রঙের জামদানী শাড়ি পরে রত্না দাঁড়িয়ে আছে, পাশে সমুদ্র।

রেখা আৎকে উঠলো। সমুদ্র মুচকি হেসে বললো, “আমার বউ মা।নিজের বিয়ে নিজেই করে নিলাম।তুমি হয়তো রাগ করেছ,কিন্তু আমার কিছু করার নেই তাতে।ভাবলাম কাকার মতো রাগ করে হারিয়ে যদি যাই তাতে নিজেরই লস।তোমার কোনো অসুবিধা হবে না।আমার খুশি অখুশির চাইতে তোমার কাছে তোমার অহংকার অনেক বড়।তাই আমি ও নিজের খুশিকে খুঁজে নিলাম।”

রেখা চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে আর ভাবছে,”সেই সালমার ভাইয়ের মেয়ে!
সালমা আর দূরে গেলো না,জড়িয়েই রইলো কোনো না কোনো ভাবে।”

সমাপ্ত।

রাজিয়া রহমান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here