#তুমি_অপরূপা (৪২)
সময় গড়িয়ে যায় নিজের মতো করে। সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছু বদলে যায়। আজকে অন্তরাদের বাড়িতে চাঁদের হাট বসেছে।
অনামিকা আর শাহেদ আজকে দেশে আসবে।সঙ্গে আসবে তাদের পুচকুটা।
সিরাজ হায়দার, সালমা,অন্তরা,অপরূপা সবাই অপেক্ষা করছে কখন আসবে ওরা।
ভিডিও কলে অনামিকার পুচকু অন্তরকে দেখে সবার যেনো আর তর সইছে না।
মশলার গন্ধে মৌ মৌ করছে চারদিকে। সালমা নানান রকম রান্না করছে।সিরাজ হায়দার অস্থির হয়ে পায়চারী করছেন।
অন্তরা গলদা চিংড়িতে হলুদ লবণ মাখছে। রূপা বেরেস্তা করছে অনেকগুলো পেঁয়াজের। পোলাও করবে সবার শেষে, পোলাওতে দিতে হবে বেরেস্তা।
সিরাজ হায়দার বের হয়ে এসে রূপাকে বললেন,”ও রূপা,দেখি সেজো জামাইকে একটা কল দিয়ে দেখ ওদের আর কতক্ষণ লাগবে আসতে?”
রূপার গাল লাল হয়ে গেলো জামাই শব্দটা শুনে।রূপকের সাথে ঘরোয়া আয়োজনের মাধ্যমে রূপার বিয়ে হয়েছে মাসখানেক আগে। এখনো রূপার কেমন লজ্জা করে রূপকের কথা শুনলে।
শাহেদদের নিয়ে রূপক আসবে ঢাকা থেকে। রূপা কল দিলো রূপককে,সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “আর কতক্ষণ লাগবে আপনাদের আসতে?”
রূপক ফিসফিস করে বললো, “কেনো,মিস করছ নাকি আমাকে?”
রূপা লজ্জা পেলো শুনে।আশেপাশে মা আপা সবাই আছে।রূপা জবাব দিলো না।
রূপক আবারও ফিসফিস করে বললো, “আমার শ্বশুর এতো রসকসহীন ক্যান বউ?
এই যে আমারে আমার বউয়ের কাছে যাইতে দেয় না,তার মেয়ের ইন্টার ফাইনাল এক্সামের পর অনুষ্ঠান করার পর নাকি দু’জন এক সাথে থাকবো।আমি ও বলে দিলাম,আজকে এলে আমি ও আমার মেয়েকে ঢাকায় নিয়ে যাবো।
ব্যাটা বউ ছাড়া থাকলে বুঝবে আমার কষ্ট। ডিল হবে তার সাথে, তার মেয়ে আমার কাছে থাকবে তবেই আমার মেয়েকে তার কাছে দিবো।”
রূপা হাসতে হাসতে পিড়ি থেকে পড়ে গেলো মাটিতে। সালমা বিরক্ত হয়ে বললো, “এখন তোগো হাসনের সময়? অরা কখন আইসা পড়বো তাড়াতাড়ি হাত চালা।আমার দুইটা জামাই বিয়ার পর প্রথম বার শ্বশুর বাড়ি আইতাছে।”
অন্তরা মাথা নিচু করে চিংড়ি ভাজতে লাগলো। কেমন দম বন্ধ লাগে তার আজকাল। জীবনে এরকম একটা ভুল কেনো করলো!
আজ কি পেলো?
অথচ আজকে তো তার স্বামী ও থাকতো এই মিলন মেলায়। জুয়েলের সাথে শেষ বার দেখা হয়েছিলো অন্তরার কোর্টে।ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার দিন।
কেনো জানি ঘৃণায় অন্তরা লোকটার দিকে তাকাতে পারে নি।
বের হয়ে আসার সময় জুয়েল ফিসফিস করে বললো, “চামড়া সাদা মাইয়াগো অনেক সুবিধা। তোর মতো *** করে যদি জীবন চালাইতে কোনো অসুবিধা হয় না। এসব মাইয়াগো জামাই লাগে না।এজন্যই তো নাগর দিয়া আমারে মাইর খাওয়াইছস।আজকে নাগরেরা আসে নাই লগে?”
অন্তরার মনে হলো পুরো পৃথিবী ঘুরছে।এতো জঘন্য কথা মানুষ বলতে পারে!
এক ছুটে অন্তরা পালিয়ে এলো।
নিজের ভাবনায় মগ্ন থাকা অন্তরা খেয়াল করলো না বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিরাজ হায়দার ও মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন।
এই মেয়েটা তার বড় মেয়ে,বড় আদরের মেয়ে।বাবা হওয়ার প্রথম আনন্দ তো ওর জন্যই পেয়েছেন তিনি।
অথচ সেই মেয়েটাই আজ সবচেয়ে দুঃখী। ছোট দুই বোনের স্বামী আসবে অথচ বড় মেয়েটা একা।
একটা ভালো ছেলে কোথায় খুঁজে পাবেন তিনি?
কেউ জানে না,দিন রাত সিরাজ হায়দার শুধু অন্তরার কথা ভাবেন।মেয়েটার একটা গতি না হলে তিনি স্বস্তি পাবেন না।
কি করবেন মেয়েকে নিয়ে তিনি!
রান্না যখন শেষ পর্যায়ে প্রায় বাড়ির বাহিরে গাড়ি এসে থামলো। পড়িমরি করে সবাই ছুটে গেলো বাড়ির বাহিরে ।
সিরাজ হায়দারের বাড়িতে গাড়ি এসেছে দেখে আশেপাশের লোকজন ও আসতে লাগলো।
অন্তরকে কোলে নিয়ে রূপক বের হলো সবার আগে। সালমা হাত বাড়িয়ে নাতিকে কোলে নিলেন।নাতিকে কোলে নিতেই যেনো তার কলিজা ঠান্ডা হয়ে গেলো। মনে হলো এতোদিন ধূ-ধূ মরুভূমিতে ছিপেন এখন এক পশলা বৃষ্টির সন্ধান পেয়েছেন।
এরপর অনামিকা আর শাহেদ নামলো গাড়ি থেকে। অনামিকা বাবা মা’কে জড়িয়ে ধরে ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে লাগলো।
সবার চোখেই পানি এসে গেলো অনামিকার কান্না দেখে।
শাহেদ শ্বশুর শাশুড়ি কে সালাম করলো।
অন্তরা অন্তরকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিলো। বাবুর নাম অনামিকা অন্তর রেখেছে বড় বোনের নামের সাথে মিলিয়ে। অন্তরার মনে হলো অন্তর যেনো তারই একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ।
এতো মায়া লাগছে তার অন্তরের জন্য।
সালমা পোলাও বসিয়ে দিলো। সবাই মিলে কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে পোলাও হয়ে যাবে।
রান্না শেষ হতেই রূপা দ্রুত হাতে পাটি বিছিয়ে দিলো।সিরাজ হায়দার নাতিকে কোলে নিয়ে হাটছেন।অন্তর নানার গায়ের সাথে জড়িয়ে রইলো।
সিরাজ হায়দারের মনে হচ্ছে একখন্ড তুলো যেনো জড়িয়ে আছেন।কি নরম,কি আদুরে শরীর!
যেনো কত শত বছরের চেনা। যেনো আত্মার আত্মীয়।
বুক কেমন কেঁপে উঠলো। অন্তর কে ইচ্ছে করলো বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখতে।
রূপক বললো, “রূপা একটু এদিকে আসো তো,আমি হাত মুখ ধুতে যাবো।আমার জন্য একটু টিউবওয়েল চাপতে হবে।”
রূপা তৎক্ষনাৎ একটা পাতিল হাতে নিয়ে বললো, “আমার তো একটু কাজ আছে,আপনি অন্য কাউকে ডাকুন।”
রূপক ভ্রুকুটি করে তাকালো। শাহেদ হেসে বললো , “চলো আমি টিউবওয়েল চেপে দিব তোমাকে। ”
রূপক বজ্রাহতের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলো
রূপা মুচকি হেসে চলে গেলো। রূপক শাহেদের পিছুপিছু কলঘরে গেলো।
শাহেদ কল চাপতে চাপতে বললো, “জ্বালা,জ্বালা!অন্তরে জ্বালা।কেমন পোড়া পোড়া গন্ধ আসছে না ভাইসাব?”
রূপক কপট রাগ দেখিয়ে বললো, “আপনি তো মিয়া বউরে বগলদাবা কইরা রাখছেন,তাই বউ থাকার পরেও ব্যাচেলর এর কষ্ট বুঝেন না।যা একটু বইরে কাছে পাওয়ার চেষ্টা করছি আপনি মাঝখানে ঢুকে গেলেন।”
শাহেদ হাসতে লাগলো রূপকের কথা শুনে। তারপর বললো, “অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয়।”
রূপক বললো, “ভাইরে,আমার এখন মনের মধ্যে চৈত্রের খরা চলতেছে। এখন আমার মিষ্টি দরকার নাই, টক হইলেও চলে। ”
শাহেদ হাসতে লাগলো। হাতমুখ ধুয়ে দুজনে এসে বসলো। অনামিকা মা বোনদের সাথে বসবে বলে বসলো না।রূপক,শাহেদ,সিরাজ হায়দার বসলো।
সিরাজ হায়দারের ভীষণ আনন্দ লাগছে আজ।শুধু আফসোস একটাই আজ যদি বড় জামাই থাকতো তাহলে তার সব আশা পূর্ণ হতো।
পুরুষদের খাওয়ার পর মেয়েরা বসলো। অনামিকা এক লোকমা খেয়ে কেঁদে উঠলো। ভাতের প্লেটে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললো, “মা’গো তোমার হাতের রান্না এতো মিস করছি। নিজে যা রান্না করতাম সব কেমন ঘাস ঘাস লাগতো। ইচ্ছে হতো এক দৌড়ে তোমার কাছে চলে আসি।বেশি কিছু লাগবে না,তোমার হাতের রসুন দিয়ে ঝাল ঝাল শুঁটকি ভুনা দিয়ে এক থালা ভাত খাইতে পারি যদি তবে মনটা শান্ত হয়।এই দুনিয়ায় টাকা থাকলে সব পাওয়া যায় শুধু মায়ের ভালোবাসা পাই না গো মা।”
অনামিকার সাথে সাথে বাকিরা ও কেঁদে উঠলো।
খাওয়ার পর অন্তরা এঁটো বাসন সব নিয়ে বের হলো। বড় ঘরের সামনে আরেকটা ঘর তোলা হয়েছে রূপার বিয়ের আগে। তিন রুমের সেই ঘরের এক রুম রূপার। রূপক সেই রুমে গিয়ে শুয়ে চিৎকার করে বললো, “ফুফু একটা পান পাঠাও আমার জন্য। ”
সালমা পিরিচে করে একটা পান মিষ্টি জর্দা দিয়ে সাজিয়ে দিয়ে রূপাকে দিয়ে বললো,”যা রূপকের জন্য নিয়ে যা।যাওনের আগে গায়ের এই ছেড়া ফাঁটা জামা পালটে একটা সুন্দর শাড়ি পইরা যা।”
লজ্জায় রাঙা হয়ে রূপা বললো, “আমি যাবো না মা।অনিতারে দিয়ে পাঠাও।আমার কাজ আছে। ”
শাহেদ এসে বললো, “আমি যাচ্ছি আম্মা।”
রূপা স্বস্তি পেলো যেনো।রূপক রূপার জন্য অপেক্ষা করছে বসে বসে। শাহেদ অনামিকাকে ঈঙ্গিত দিয়ে চলে গেলো। দরজায় নক হতেই লাফিয়ে উঠে দরজা খুলতেই দেখে শাহেদ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রূপক
এর দিকে তাকিয়ে শাহেদ অট্টহাসি দিয়ে উঠলো।
তারপর বললো, “এতো তাড়া কিসের বৎস!রজনী এখনো অনেক দেরি।এখনই এতো উতলা হইও না।মেন্টাল প্রিপারেশন নাও আগে।নিজেকে প্রিপেয়ার কর,ম্যাচ এতো তাড়াতাড়ি শুরু করতে হবে না ।আশেপাশে লোকজন আড়ি পাতবে।”
রূপক হেসে বললো, “তোমার বেডরুমে আমি সিসি ক্যামেরা লাগাবো দেইখো।একবার শুধু আমার বউরে কাছে পাই,আগামী দুই দিন ঘরের দরজা বন্ধ থাকবে।”
শাহেদ হাসতে লাগলো শুনে।
একটু পর আবারও দরজায় নক হলো, রূপক দরজা খুলে চমকে উঠলো। লাল টকটকে একটা জামদানী শাড়ি পরে রূপা দাঁড়িয়ে আছে মাথা নিচু করে। দুই হাতে চুড়ি দুটো, মাথায় ঘোমটা।
শাহেদ উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “আমার শালিকে রেখে গেলাম,সহিসালামতে রাইখো।”
এই বলে শাহেদ চোখ টিপ দিয়ে বের হয়ে গেলো। রূপার মনে হলো সে যেনো বরফের মতো জমে যাচ্ছে। শাহেদ বের হতেই রূপক রূপাকে এক টানে বুকে জড়িয়ে নিয়ে নাক ডুবিয়ে দিলো রূপার ঘন কালো চুলে।
বুকের ভেতর যে উথাল-পাতাল ঝড় ছিলো তা যেনো এক নিমিষেই থেমে গেলো।
চলবে…..
রাজিয়া রহমান