#তুমি_অপরূপা(২৬)
“দেখতে তো ভদ্র মনে হয়, তাহলে এরকম ছ্যাবলামি করেন কেনো?
আপনার ব্যক্তিত্বের সাথে কি যায় এসব কাজ?
এতো পড়াশোনা করে কি লাভ হলো যদি নিজে এরকম সস্তা দরের মানুষ হয়ে থাকেন?”
এক দমে কথাগুলো বলে রূপা গটগট করে হাটা শুরু করে দিলো।সমুদ্র থমকে দাঁড়িয়ে রইলো। কি বলছে এসব রূপা!রূপা কি তাকে কোনোদিন বুঝবে না!
রূপা আজ সব ক্লাস না করেই চলে এসেছে। তবুও কলেজ থেকে বের হয়ে দেখে সমুদ্র দাঁড়িয়ে আছে বাহিরে।
এই ছেলেটা কি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকে না-কি?
বিরক্তি এসে ভর করলো রূপার মনে। সে যেই লক্ষ নিয়ে এই শহরে এসেছে সেই লক্ষ্য থেকে কিছুতেই সরবে না।
বাসায় গিয়ে বাবাকে কল দিলো।বাবার সাথে কথা বলে বুঝতে পারলো সালমা আবারও অসুস্থ হয়ে পড়েছে । রূপা ভেবে পায় না তার কি করা উচিত!
হুট করে সিদ্ধান্ত নিলো সে গ্রামে যাবে।মা’কে দেখতে যাবে।
যেই ভাবা সেই কাজ।দুপুরে খেয়ে রূপা অপেক্ষা করতে লাগলো রত্না পান্নার জন্য।
ক্লাস শেষ করে বাসায় এসেই দু’জনে ছুটে এলো রূপার কাছে।রূপার সাথে দুজনের ভীষণ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। রূপা যখন জানালো সে গ্রামে যাবে রত্না পান্না দুজনের মুখ শুকিয়ে গেলো।
পান্না কাঁদোকাঁদো হয়ে বললো, “কেনো যাবি বল?না গেলে হয় না?
দূর তুই গেলে আমাদের ভালো লাগবে না। ”
রূপা মলিন হেসে বললো, “আমি ও তোদের অনেক মিস করবো। অনেক দিন হলো এসেছি, বাড়ির জন্য মন কেমন করছে। মা’কে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব।মা খুব অসুস্থ।”
রত্না বললো, “ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি আসিস।তোর অপেক্ষায় থাকবো আমরা। ”
রূপা মুচকি হাসলো। তারপর দুজনকেই জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে।
ভ্যানিটি ব্যাগে দুই সেট জামা আর দুইটা বই নিয়ে রূপা বের হলো বাসা থেকে। রত্না এসে বলেছে রূপা তার গ্রামের বাড়ি যাচ্ছে। এরপর থেকেই রূপকের মন খারাপ হয়ে আছে।না সে রূপার মুখোমুখি হয় না,রূপার বিরক্তির কারণ হতে চায় না।তবুও তো মন জানতো রূপা পাশের ফ্ল্যাটে আছে, ইচ্ছে করলেই তাকে দেখতে পারবে রূপক।
রূপা বের হওয়ার সময় ছাদে দাঁড়িয়ে এক নজর দেখতো রূপক। কিন্তু এখন কাকে দেখবে সে?
রত্না পান্নার সাথে যখন হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতো রূপক তখন দূরে দাঁড়িয়ে রূপার পিঠময় ছড়িয়ে থাকা কোঁকড়ানো চুলের ঢেউ খেলানো দেখতো।
রূপকের একটা গোপন ইচ্ছে, কোনো একদিন নিজের হাতে এই তেলতেলে চুলগুলো সে ধরবে।নিজের হাতে এই চুলে গাঁদা ফুলের মালা জড়িয়ে দিবে।
কে জানে কখনো এই ইচ্ছে পূর্ণ হবে কি-না!
রূপা রুমের সবার থেকে বিদায় নিয়ে বের হলো। মাহি ভীষণ খুশি হলো। মনে মনে দোয়া করতে লাগলো রূপা যাতে আর না ফিরে আসে।এই কয়েকদিনে মাহি সবসময় মনে মনে দোয়া করতো রূপার যাতে সমুদ্রের সাথে প্রেম হয়ে যায়। তাহলে তার আর ভয় নেই রূপককে নিয়ে ।
সমুদ্রের ফোনে একটা টেক্সট এলো, ওপেন করে দেখলো লিখা,”রূপা তার গ্রামের বাড়ি যাচ্ছে কয়েকদিনের জন্য। ”
বিছানায় শুয়েছিলো সমুদ্র, টেক্সট পেয়ে আর দাঁড়ালো না।সমুদ্র জানে কোন জায়গা থেকে গাড়িতে উঠতে হবে।তাই নিজের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ছুটে গেলো। এই ব্যাগটা সবসময় তার গুছানো থাকে।হুটহাট বেরিয়ে পরার স্বভাব তার এজন্য আগেই গুছিয়ে রাখে।
রূপার বুক কাঁপছে দুরুদুরু করে। এই প্রথম সাহস করে বের হচ্ছে একা একা বাড়ির উদ্দেশ্যে। ঠিকঠাক পৌঁছাতে পারবে তো? কাঁপতে কাঁপতে সিড়ি দিয়ে নামতে লাগলো রূপা।এক মনে আল্লাহকে ডেকে যাচ্ছে যাগে সহি সালামতে বাড়ি গিয়ে পৌঁছাতে পারে।
রূপক গ্যারেজে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে বাইকের চাবি। রূপা আড়চোখে একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো।সেদিনের পর থেকে রূপক সাথে রূপার কথা হয় নি।রূপা রূপককের সামনে পড়তে চায় না।হয়তো রূপক ও রূপার মনোভাব বুঝতে পেরেছে তাই রূপাকে বিরক্ত করে না।
তবে রূপা অনুভব করে কেউ তাকে নিবিড়ভাবে দেখছে।
রূপা বের হয়ে রিকশায় উঠে। রূপক বাইক নিয়ে পিছন পিছন যায়। কিছুটা পথ যেতেই রূপক রূপার রিকশার পাশাপাশি বাইক এনে জিজ্ঞেস করে, “কবে আসবে তুমি? ”
রূপা বিরক্তিতে ভ্রুঁ কুঁচকায়।ম্লান হেসে রূপক পিছিয়ে যায়।রূপক বুঝতে পারে এই মেয়েটা গ্রামের মেয়ে হলেও এর মন ভীষণ শক্ত। অন্য কোনো মেয়ে হলে আরো আগেই পটে যেতো। অন্তত রূপকের প্রেমে না হলেও সমুদ্রের প্রেমে ঠিকই পড়ে যেতো।
হয় আবেগে পড়ে প্রেমে পড়ে যেতো নয়তো সবাই প্রেম করছে এই ভেবে নিজেও প্রেমে পড়ে যেতো।
কিন্তু তা হচ্ছে না রূপার সাথে। ওর ব্যক্তিত্ব খুবই স্ট্রং।এজন্যেই হয়তো সমুদ্র এভাবে হাবুডুবু খাচ্ছে।
রূপা রিকশা থেকে নেমে কোনোদিন ভ্রুক্ষেপ না করে রূপা কাউন্টারের দিকে এগিয়ে যায়।এই বাসেই করে তো এসেছিলো। মুখে অতিরিক্ত গাম্ভীর্য ফুটিয়ে তুলে রূপা এগিয়ে যায়।রূপকের বুক ছিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো। মনে মনে বললো, “একটা জীবন আমার ফুরিয়ে যাবে এক বুক আক্ষেপ নিয়ে। আহা ভালোবাসা! ”
রূপা টিকিট কেটে কাউন্টারে বসলো। ঝড়ের বেগে সমুদ্র এসে হাজির হলো। সেও একটা টিকিট কাটলো দিঘলির।
রূপা চমকে গেলো সমুদ্রকে দেখে।বিড়বিড় করে বললো, “ও আল্লাহ,আমাকে শক্তি দাও।নিজের লক্ষ্যে অবিচল থাকার মনোবল দাও।”
নির্দিষ্ট সময়ে বাস এলো। বাসে উঠতেই রূপার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো। এতো মানুষ বাসে,তার সীট কোনটা?
কিভাবে খুঁজবে?
কার পাশে বসবে?
গাড়ির কন্ডাকটর এগিয়ে এলো। রূপা নিজের টিকিট দেখিয়ে বললো, “এই সীট টা কোনটা? ”
কন্ডাকটর এক নজর রূপার দিকে তাকাতেই রূপা মুহূর্তেই চোখে মুখে অতিরিক্ত গাম্ভীর্য ফুটিয়ে তুললো। সীট খুঁজে দিয়ে কন্ডাকটর চলে গেলো। রূপা খুশি হলো জানালার পাশে সীট পেয়ে।তার পাশের সীট এখনো ফাঁকা। রূপার বুক কাঁপতে লাগলো। রূপা সিনেমায় দেখেছে সবসময় নায়িকার পাশের সীটে ভুল করে হোক বা ইচ্ছে করে হোক নায়কেরই সীট পড়ে।
সমুদ্র সীট খুঁজতে খুঁজতে এগিয়ে এসে রূপার পাশে দাঁড়ালো । রূপার সারা শরীর ভয়ে ঠান্ডা হয়ে গেলো। রূপা বুঝতে পারলো এটাই সমুদ্রের সীট। চোখ বন্ধ করে মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগলো রূপা। একটু পরেই বুঝতে পারলো তার পাশে কেউ ধপ করে বসে পড়েছে।
রূপার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। কিছুতেই সে সমুদ্রের সংস্পর্শে থাকতে চায় না সেখানে পাশাপাশি বসে এতো দূর যাবে!
চোখ মেলে তাকাতেই দেখতে পেলো তার পাশের সীটে বছর ষাটের একজন ভদ্রমহিলা বসেছে। মুখে জর্দা দেওয়া পান। জর্দার কড়া ঘ্রাণ আসছে তার শরীর থেকে। হুট করেই রূপার এতো ভালো লাগলো। তীব্র জর্দার ঘ্রাণও রূপার কাছে ভীষণ সুঘ্রাণ মনে হলো। আল্লাহ তার ডাক শুনেছেন।পিছনে তাকিয়ে দেখলো সমুদ্র ঠিক তার পিছনের সীটে,জানালার পাশে।
পিছনে তাকাতেই দুজনের চোখাচোখি হয়ে গেলো। সমুদ্র হেসে বললো, “পিছনে ফিরে আমাকেই খুঁজছিলে তাই না?আমি তোমার কাছাকাছি আছি অপরূপা। ”
মাথা সামনের দিকে ঘুরিয়ে মনে মনে রূপা বললো, “আর পিছনে তাকাবো না।এই জন্মের মতো আর তাকাবো না।
শা//লা!”
পান খাওয়া ভদ্রমহিলা রূপার দিকে তাকিয়ে বললো, “তুমি কোনখানে নামবা বইন?”
“দিঘলি নামবো আমি।”
“আমি নামমু দিঘলির পরে।ঢাকা কি করো?”
“ঢাকায় থেকে পড়ি।”
“বাপ মা কউ থাকে?গেরামে?”
“জি।”
“বিয়া হইছে নি বইন তোমার? ”
রূপা এই প্রশ্নের জবাব দিলো না। সে বুঝে গেলো এর পরের কথাটা কি হতে পারে। ভদ্রতাসূচক হেসে চুপ করে রইলো।
ভদ্রমহিলা দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে বললো, “ও বুইঝছি বিয়া হয় নাই।আমার আবার একটা নাতি আছে বুঝলা বইন।দেখতে একটু কালা।তয় কালা হইলো গিয়া গলার মালা,সোন্দর হইলো ঝাড়ুর শলা।এইটা মুরব্বিগো কথা বুঝলা।তুমি আবার মন খারাপ কইরো না।তুমি ম্যালা সোন্দর। তোমারে আমার মনে ধরছে।আমার নাতি মেট্টিক পরীক্ষা দিছে। পাশ দিতে পারে নাই যদিও,তয় সে ভালো ছেলে।গেরামে দুইটা পুকুরে মাছ চাষ করে, গরু আছে ৪ টা,জায়গা জমি ও করছে।ঘর ও করছে।চার চালা টিনের ঘর।অনেক বড় কইরা ঘর করছে। এখন পাকা পায়খানা বসাইবো। দুইটা বোইনেরে বিয়া দিছে।
এখন তার বিয়ার পালা।”
সমুদ্র কান খাড়া করে শুনতে লাগলো দুজনের কথোপকথন। ভদ্রমহিলার কথা শুনে বললো, “বুড়িরে,তোর নাতির গুষ্ঠি কিলাই আমি।তুই শুধু একবার ঠিকানাটা বল।ওর মাছের পুকুরে গিয়ে আমি মাছ মা/রারা ঔষধ ঢাইলা আসমু।আমার সামনে বসে আমার কলিজা ছিনিয়ে নেওয়ার ধান্ধা! ”
রূপা কিছু না বলে মুচকি হাসলো। মাথা ধরে যাচ্ছে তার।তবে মায়া ও লাগছে।এই মানুষগুলো ভীষণ সহজ সরল। নয়তো চেনা নেই জানা নেই,একটা মেয়ের কাছে সব বলা শুরু করে দিয়েছে। শহরের মানুষের মধ্যে এই স্বভাব নেই।
ভদ্রমহিলা এবার প্রসঙ্গ থেকে সরে গিয়ে তার স্বামীর প্রসঙ্গে চলে গেলেন।রূপার হাত ধরে বলতে লাগলো, “বুইঝলা বইন,তোমার দাদা মানে আমাগো ঘরের উনি।আমার নাতি ওনার মতোই হইছে।তোমার দাদায় গো বইন,আমারে এতো আদর করতো। আমারে রাইখা মাঠে খেতের কামেও যাইতে চাইতো না।বারবার কইয়া যাইতো দুপুইরা আমি নিজের হাতে যেনো হের লাইগা ভাত লইয়া যাই।কাউরে দিয়া পাঠাইলে সে খাইবো না।এমন পাগল আছিলো তিনি।”
সমুদ্র পেছন থেকে বিড়বিড় করে বললো, “একেবারে আমার মতো ছিলো দাদী।দেখেন না,আমিও আমাগো ঘরের ওনারে ছাড়া কিছু বুঝি না।এরজন্য তো তার সাথে সাথে আমিও চলে আসছি।শুধু তারে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য দাদী।
দিন নাই,রাইত নাই,আমাগো ঘরের ওনারে এক নজর দেখার জন্য মহল্লার কুত্তাগুলার লগে ফুটপাতে বইসা থাকতে থাকতে এখন একদিন যাইতে দেরি হইলেই ওরা আমারে ঘেউঘেউ কইরা জিজ্ঞেস করে, এতো দেরি হইছে ক্যান!তবুও সে আমারে বুঝে না,অথচ এলাকার কুত্তাগুলা ও আমারে বুইঝা গেছে।”
নির্দিষ্ট গন্তব্য আসতেই রূপা নেমে গেলো বাস থেকে।রূপার পিছু পিছু সমুদ্র ও নেমে গেলো।রূপা রিকশা নিয়ে সোজা রিকশায় উঠে গেলো। সমুদ্র হা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো বোকার মতো। কেনো এসেছে সে এখানে?
কোনো দরকার ছিলো তার?
না তো,শুধু রূপাকে নিরাপত্তা দিতেই এসেছিলো।
মনে মনে হাসলো সমুদ্র নিজের বোকামির জন্য। অযথা একটা কাজ করে বসলো অথচ মনে ভীষণ প্রশান্তি লাগছে।সারাটা জীবন যদি এই মেয়েটাকে এভাবেই আগলে রাখার দায়িত্ব সমুদ্র পেতো!
ভাগ্য কি এতোটা সদয় হবে তার উপর!
কে জানে!
চলবে……
রাজিয়া রহমান