#তুমি_অপরূপা(৩২)
ব্যতিব্যস্ত হয়ে অন্তরা আবারও জিজ্ঞেস করলো, “আপনি রূপাকে কিভাবে চেনেন বললেন না তো!”
রূপক এবার একটূ কৌশল প্রয়োগ করলো। হতভম্ব হয়ে বললো, “আপনাকে কেনো বলবো আমি? আপনি কে?”
অন্তরা হতবাক!
এই লোক বলে কি?
পাগল না-কি মাথা খারাপ!
নিজেই তাকে দেখে আনমনে রূপা বলে উঠলো এখন আবার বলছে সে রূপার কে হয়!
এই লোক নিজেই তো মনে হয় অসুস্থ!
ধীর গলায় বললো, “আমি রূপার বোন।আপনি আমার বোনকে কিভসবে চেনেন?”
রূপক অবিশ্বাসের সুরে বললো, “দেখেন,প্রথিবীতে একই চেহারার ৭ জন মানুষ আছে,তাই হতেই পারে আপনি ও রূপার মতো দেখতে কেউ।আপনার কাছে আমি কেনো রূপার কথা বলতে যাবো?আপনি প্রমাণ দিতে পারবেন আপনি রূপার বোন?”
অন্তরা বিস্মিত এবং বাকরুদ্ধ!
এই লোকটা কি বলছে?
রূপক বললো, “আচ্ছা, বলেন তো রূপারা কয় ভাই বোন?”
অন্তরা বললো, “চার বোন,অন্তরা,অনামিকা,অপরূপা,অনিতা।আর আমি অন্তরা।”
রূপক নিজেই জানে না রূপারা কয় বোন,তবুও এমন ভাব করলো যেনো সবজান্তা!
একটু পর রূপক বললো, “আচ্ছা, বেশ!এবার বলেন তো সালমা নামের কাউকে চেনেন আপনি? রূপার বোন হলে নিশ্চয় চিনবেন।”
অন্তরা এবার বিরক্ত হয়ে বললো, “কি বলছেন আপনি? আমার মা’কে আমি চিনবো না কেনো?সালমা তো আমার মা’য়ের নাম।”
রূপক যেনো শক খেলো এই কথা শুনে। রূপা তার ফুফুর মেয়ে!
মাথা কাজ করছে না রূপকের।এ ও সম্ভব!
গলা ধরে এলো রূপকের। তবুও শিওর হওয়ার জন্য বললো, “শেষ প্রশ্ন,আপনি রূপার বোন হলে নিশ্চয় জানবেন আপনার নানার বাড়ি কোথায়।আপনার মামা খালা কয়জন।এবার সঠিক উত্তর দিতে পারলে আমি মেনে নেবো আপনি রূপার বোন।”
অন্তরার ভীষণ বিরক্ত লাগলো। একে তো নিজের জীবনের অশান্তি তার উপর আবার এই লোকের প্রশ্ন।বিরক্ত হলেও অন্তরা জবাব দিলো।
“আমার মামা খালা কারো কথা কখনো মা বলেন নি।মায়ের বাবার বাড়ি ঢাকায় কোথাও।মা সবসময় তার বাবার বাড়ির প্রসঙ্গে চুপ হয়ে যেতেন শুধু জানি তার একজন ভাইয়ের ছেলে ছিলো। রূপক।মায়ের বড় আদরের ছিলো সে।
মাঝেমাঝে যখন মায়ের মন ভীষণ খারাপ থাকতো, তখন মা রূপক আব্বারে বলে কাঁদতেন। সবসময় বলতেন আমার রূপক আব্বার জন্যে শুধু মনটা পোড়ে,রূপক ছাড়া কারো কথা আমার মনে পড়ে না কোনো দিন।আর মনে পড়লেও অতটা কষ্ট লাগে না।সবাইকে ভুলতে পারছি আমার রূপকরে ছাড়া। না জানি আমার বাপজান এখন কার কাছে থাকে,মায়ের আদর তো পায় নাই,এখন কি মায়ের আদর পায় ছেলেটা! ”
রূপকের কি হলো রূপক জানে না। অন্তরা দেখলো এতো বড় একটা ছেলে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেছে।
অন্তরা হতবাক হয়ে ছেলেটার এই আকুল হয়ে করা কান্না দেখতে লাগলো। অন্তরা কিছুতেই বুঝতে পারছে না তার মায়ের কথা শুনে ছেলেটা কাঁদছে কেনো!
বাসের সবাই তাকিয়ে রইলো রূপকের দিকে। রূপক নিজেকে সামলে নিলো কিছুক্ষণের মধ্যে। তারপর চোখ মুছে অন্তরাকে বললো, “সরি। আসলে আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারি নি। আপনি যে রূপার বোন আমি বিশ্বাস করছি।”
অন্তরা বললো, “আপনি আমার বোনকে চেনেন কিভাবে?আপনি কে?”
রূপক হেসে বললো, “আমি কে তা না হয় আপনার বাড়িতে গেলে জানবেন।আর রূপা আমাদের বাসায় ভাড়া থাকে ঢাকায় তাই চিনি।আমার বোনদের ফ্রেন্ড ও”
অন্তরা আবারও অবাক হলো। রূপা ঢাকায়?
তার ছোট্ট বোনটা এতো বড় হয়ে গেছে যে একা একা এখন ঢাকা থেকে পড়ে!
কতো দিন বাড়ির খবর নেয় নি,কিছুই জানে না তাই।আচ্ছা, অনামিকা কোথায় এখন?
ও পড়ে কোথায়?
হুট করে অন্তরার ভীষণ ভয় করতে লাগলো। কিভাবে আবারও বাড়ি যাবে সে!
সেই তো আবারও বাবা মায়ের কাছে ফিরে যেতে হচ্ছে।
ভেবেছিলো তাদের মুক্তি দিতে পেরেছে অথচ এখন বুঝতে পারলো সন্তানের দায় দায়িত্ব থেকে বাবা মা কখনো মুক্তি পায় না।
আর বাবা মা ছাড়া সন্তানের ও দ্বিতীয় কোনো জায়গা নেই যাওয়ার।
রূপকের কাছে সবটা স্বপ্নের মতো লাগছে।এতো কাছে রূপা ছিলো অথচ কেনো বুঝলো না রূপক যে রূপা তার ফুফুর মেয়ে!
কেমন আছে ফুফু?
বড় আদরের ফুফু তার।মায়ের থেকে পাওয়া অনাদর, তাচ্ছিল্য সব ফুফুর আদর পেয়ে ভুলতো।
তারপর ফুফু যখন হারিয়ে গেলো তারপর থেকে কারো আদর পায় নি রূপক।
এই যে এখনো বুকের ভেতর একখণ্ড শুকনো জমি নিয়ে বেঁচে আছে রূপক।কোনো দিন কেউ তাতে ভালোবেসে যত্ন করে ফুল ফোটাবে সেই আশায়।
অথচ সে জানে না,সে বুঝতে ও চায় না বুকের ভেতর জমে থাকা ব্যথারা আজ দখল করে নিয়েছে রূপকের পুরোটা। শুধু একটু ভালোবাসার স্পর্শ পেলেই তাসের ঘরের মতো সব বিলীন হয়ে যাবে।
দীর্ঘ যাত্রা শেষে রূপকেরা যখন রূপাদের বাড়িতে গিয়ে পৌছায়, ততক্ষণে রোদ পড়ে গেছে।
চারদিক কেমন নির্জন হয়ে আছে। অন্তরার একটু একটু ভয় করছে।
বাড়ির কাছাকাছি যেতে অন্তরা ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে নিলো।তারপর রূপককে বললো, “আপনাকে একটা কথা বলার ছিলো। ”
রূপক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো।
অন্তরা একটা বড় করে নিশ্বাস ফেলে বললো, “বেশ কয়েকমাস আগে আমি একজনকে ভালোবেসে তার হাত ধরে বাড়ি ছেড়ে চলে যাই।আর তার কয়েক মাস পর জানতে পারি আমি তার সেকেন্ড ওয়াইফ।তার ফার্স্ট ওয়াইফ অন্য এক জনের সাথে পালিয়ে যায়,তার একটা ছেলে আছে প্রথম পক্ষের।সেই ছেলের একটা মায়ের অভাব দেখে সে আমার সাথে ভালোবাসার খেলা খেলে।আমি ছেলেকে মেনেই তার সংসার করি।তাছাড়া আমার উপায় ও ছিলো না।আমরা যেহেতু চার বোন,আমার ডিভোর্সি ফুফু,ফুফাতো বোন,দাদী,বাবা,মা মিলিয়ে অনেক বড় সংসার। প্রতিদিন ৯ জন মানুষের ৩ বেলা খাবার খেতে হলে হিসেব করে দেখেন,দিন ২৭ জন মানুষের খাবার ব্যবস্থা, আমাদের চার বোন এবং আমার ফুফাতো বোনের লেখাপড়ার ব্যবস্থা সবই আমার বাবাকে একা করতে হতো। আপনি হয়তো বুঝবেন না আমাদের বাস্তবতা কেমন ছিলো। আমি বাবার বড় মেয়ে যেহেতু প্রতিক্ষণ আত্মগ্লানিতে ভুগতাম বাবার জন্য কিছু করতে পারি না বলে।
সেই আত্মগ্লানি থেকেই অনেকটা পালিয়ে গেলাম,ভেবেছিলাম বাবার মাথার উপর থেকে আমার একজনের চাপ তো কমবে।
অথচ দেখুন আমার ভাগ্য!
যার কাছে গিয়েছিলাম তার প্রথম স্ত্রী ফিরে আসার পর সে আবার তাকে মেনে নেয়।আমি হয়ে যাই চক্ষুশূল। তাই আবারও বাবা মায়ের কাছে ফিরে যেতে হচ্ছে। আপনি তো আমাদের বাড়িতেই যাবেন,হয়তো অনেক সিনক্রিয়েট হবে। গ্রামের মানুষ তো আমরা,আশেপাশের সব মানুষ এসে জড়ো হবে দেখবেন।আমাকে জোকার মনে হবে সবার কাছে। নানান মানুষ নানান মন্তব্য করবে।সেসব দেখে চমকে যাবেন তাই আগেই বললাম। ”
রূপক সব শুনে কিছুক্ষণ ভেবে বললো, “আচ্ছা বুঝলাম।একটা অনুরোধ করি?”
অন্তরা জিজ্ঞেস করলো, “কি?”
“আপনি বাড়িতে গিয়ে কোনো কথা বলবেন না।যা বলার আমি বলবো, আপনি শুধু হ্যাঁ তে হ্যাঁ আর না তে না মিলাবেন।”
অন্তরা বুঝতে পারলো না রূপক কি বলবে।
রূপকের বুকটা ব্যথায় ছেয়ে গেলো। রাজকন্যার জীবন ছেড়ে ভালোবেসে ফুফু সব ছেড়ে চলে এসেছিলো। অথচ তার মেয়েদের নিয়ে এতো অভাব অনটনে ছিলেন তবুও বাবার বাড়ির সাহায্য নেন নি তিনি!
রূপক বুঝতে পারলো রূপার এতো আত্মসম্মান, ব্যক্তিত্ব কোথা থেকে এসেছে।
মায়ের মতো হয়েছে মেয়েটা।
অন্তরা রূপককে নিয়ে বাড়ি ফিরলো যখন তখন অনিতা উঠান ঝাড়ু দিচ্ছিলো। আহারে,তার আদরের ছোট্ট বোন!
অন্তরা ছুটে গিয়ে বোনকে জড়িয়ে ধরলো। অনিতা প্রথমে অবাক হয়ে গেলো তারপর অন্তরাকে চিনতে পেরে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো।
অন্তরার দাদী,ফুফু,ফুফাতো বোন সবাই চলে এলো। এসে সবাই মিলে চিৎকার চেচামেচি এমনভাবে করতে লাগলো যে আশেপাশের সব মানুষ ছুটে এলো।মুহুর্তে ছড়িয়ে গেলো অন্তরা ফিরে এসেছে এই খবর।
রূপক চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো সবটা।একেকজনের একেক কথা, একেক মন্তব্য সব শুনে রূপক বুঝতে পারলো অন্তরা কার সাথে পালিয়েছে সেটাই কেউ জানে না।
অবাক হয়ে রূপক সবার কথা শুনতে লাগলো। সবসময় ভাবতো গ্রামের মানুষ সহজ সরল, অথচ এখন রূপকের মনে হচ্ছে গ্রামের মানুষের মতো জঘন্য মানসিকতা শহরের মানুষের হয় না।
নয়তো এরা কিভাবে মুহুর্তের মধ্যে এরকম একটা জটলা তৈরি করে তারপর অন্তরার সামনে দাঁড়িয়ে অন্তরাকে নিয়ে বাজে কথা বলতে পারে!
সব ছাপিয়ে রূপক এদিক ওদিক চারদিকে একজনকে খুঁজতেছিলো।
অথচ তাকেই দেখতে পেলো না।
সিরাজ হায়দারের দোকানে ও খবর চলে এলো অন্তরা একটা ছেলের সাথে বাড়িতে এসেছে।
একটা চিনচিনে ব্যথা সিরাজ হায়দার অনুভব করতে লাগলেন।
দ্রুত দোকান বন্ধ করে বাড়ির দিকে ছুটলেন তিনি।কেননা তিনি জানেন এখন সারা এলাকার মানুষ বাড়িতে এসে মেয়েকে কথা শুনিয়ে যাবে।সন্তান যতই অপরাধ করুক,অন্য লোকে সন্তানকে কটু কথা বলবে এটা কোনো বাবা মা সহ্য করতে পারে না।
তানিয়া অফিস থেকে ফিরে দেখে রত্না পান্না দুজনেই মুখ শুকনো করে বসে আছে। রূপক কে দেখা যাচ্ছে না কোথাও।
এরকম তো হয় না।একটু কটাক্ষ করে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমাদের দাদা কোথায়?”
পান্না বললো, “ফুফুর কাছে গেছে দাদা।”
তানিয়ার মুখ শুকিয়ে গেলো শুনে।জিজ্ঞেস করলো, “ফুফুর কাছে মানে?”
রত্না বললো, “দাদার ফুফুর সন্ধান পেয়েছে। ”
হঠাৎ করেই তানিয়ার মুখমন্ডলে ভয় ফুটে উঠলো। দ্রুত পায়ে রুমে গিয়ে তানিয়া রেখাকে কল দিলো।
সমুদ্রের মা রেখা তখন ছেলেকে কড়াভাবে জিজ্ঞেস করছিলো তার এরকম ছন্নছাড়া হয়ে যাওয়ার কারণ কি।
তানিয়া কল করে বললো, “রূপক সালমার খোঁজ পেয়ে গেছে। তার কাছে গেছে রূপক।”
আৎকে উঠে রেখা বললো, “কি বলছো ভাবী,এবার কি হবে?”
তানিয়া জবাব দিতে পারলো না।ভয়ে তার মুখ শুকিয়ে গেছে। রেখার মুখমণ্ডল কেমন রক্তশূণ্য হয়ে গেলো মুহূর্তে। সমুদ্র মা’য়ের এরকম অবস্থা দেখে উঠে দাঁড়িয়ে মা’কে জড়িয়ে ধরলো। রেখা কোনো কথা বলতে পারলো না।গলা শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেছে তার।
চলবে….
রাজিয়া রহমান