তুমি_অপরূপা(৩৫)
রূপকের প্রচন্ড জ্বর।মাঝরাতে রূপাকে কল দিলো রূপক।ফ্যাসফ্যাসে স্বরে বললো, “রূপা,একটু আসবে?”
রূপা ঘড়িতে সময় দেখলো।রাতে ১২.৩৪
ইতস্তত করে রূপা বললো, “এখন? ”
রূপক আচ্ছন্নের মতো বললো, “হ্যাঁ। ”
রূপা থম মেরে বসে রইলো কিছুক্ষণ। এতো রাতে রূপকদের বাসায় যেতে রূপার মন সায় দিচ্ছে না। ওদিকে রূপক একা বাসায়। কখন কি লাগে কে জানে?
গা ঝাড়া দিয়ে উঠে গেলো রূপা।এখন ভুল ঠিক ভাবার সময় না।রূপক অসুস্থ এবং একা বাসায়। সেটাই ভাবার বিষয় এখন।
রূপা গায়ে ভালো করে ওড়না জড়িয়ে উঠে গেলো। রূপকদের ফ্ল্যাটের দরজা ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেলো।
রূপা ভেতরে ঢুকে দেখে পুরো বাসায় লাইট অন করা।রূপা সব রুমের লাইট অফ করলো। ডাইনিং এর লাইট রেখে রূপকের রুমে গেলো। রূপক বিছানায় শুয়ে কাৎরাচ্ছে। রূপা রূপকের কপালে হাত দিয়ে দেখলো প্রচন্ড জ্বর।
রূপার মনটা ছোট হয়ে গেলো। তার জ্বরের সময় এই মানুষটা তার অনেক সেবা যত্ন করেছে। অথচ তার জন্য রূপা কিছু করতে পারছে না।
বালতিতে করে রূপা পানি নিয়ে আসলো। তারপর রূপকের মাথায় মগে করে পানি ঢালতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর রূপক বললো, “আমার ভীষণ ক্ষিধে পেয়েছে রূপা।”
রূপা সাথে সাথে উঠে গেলো। কিচেনে গিয়ে দেখে তার জন্য আনা স্যুপের প্যাকেট আছে চারটি। তাই দিয়ে রূপা একটা স্যুপ বানালো রূপকের জন্য।
রান্না শেষ করে রূপকের জন্য নিতে গিয়ে দেখে রূপকের রুমের দরজা বন্ধ।
বাহিরে থেকে রূপা ডাকতেই রূপক বললো, “টেবিলের উপর ঢেকে রেখে তুমি চলে যাও রূপা।”
রূপা বুঝতে না পেরে আবারও জিজ্ঞেস করলো, “কি করবো? ”
রূপক শান্ত স্বরে বললো, “রেখে যাও রূপা,চলে যাও তুমি। ”
রূপা দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে। এদিকে রূপকের আকাশ পাতাল জ্বর, অন্যদিকে রূপক দরজা বন্ধ করে তাকে চলে যেতে বলছে।আগে না হয় জানতো না, এখন তো জানে রূপক তার মামাতো ভাই। একটা দায়িত্ব তো তার আছে এখন রূপকের প্রতি।
সম্পর্কের কি এক অসীম টান!
এই যে দুদিন হলো জেনেছে এরা তার আত্মীয়, এখন মনে হচ্ছে কতো দায়িত্ব তার।নয়তো কখনো কি রূপা এতো রাতে এখানে আসতো?
অসম্ভব!
অথচ এখন রূপক চলে যেতে বলার পরেও যেতে পারছে না।
কিছুক্ষণ পর রূপক ডেকে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি আছো রূপা?”
রূপা চুপ করে বসে রইলো ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে।মিনিট দুয়েক পর খুট করে শব্দ হলো। রূপা তাকিয়ে দেখলো রূপক বের হয়ে আসছে রুম থেকে। ক্লান্ত দেহ,এলোমেলো চুল,টলমল পায়ে রূপক এগিয়ে এসে একটা চেয়ার টেনে ধপ করে বসে পড়লো রূপার সামনে । তারপর মৃদু হেসে বললো, “গেলে না কেনো?”
রূপা জবাব দিলো না।
রূপক কাতর চোখে বললো, “আমার ভীষণ কষ্ট হয় রূপা।তুমি জানো না,এই দুনিয়ায় কেউ জানে না আমার ভীষণ যন্ত্রণা। আমার বোন দুটো না থাকলে আমি বোধহয় সব ছেড়ে সন্নাসী হয়ে যেতাম।এই সংসার, এই জীবন সবই কঠিন রূপা।
জীবন আমাকে বারবার, বারবার আঘাত দিয়েছে, কষ্ট দিয়েছে। আমার প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির হিসাব করতে গেলে দেখেবে প্রাপ্তির খাতায় লিখা আছে অনাদর, আবহেলা,আঘাত,প্রতারণা।অথচ আমি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা প্রদান করেছি সবাইকে।
কেউ তা ফিরিয়ে দেয় নি রূপা।
এই বুকের ভেতর কি ঘূর্ণিঝড় বয়ে বেড়াই কেউ খবর নেয় নি।
আমিও তো মানুষ। একটা মানুষকে ঠিক কতটা কষ্ট দেওয়া যায় রূপা?”
রূপার চোখ টলমল করছে অশ্রুতে।নরম গলায় বললো, “কিসের এতো কষ্ট রূপকদা?”
রূপক হেসে বললো, “বালিকা,কি হবে সেসব জেনে?
তুমি বরং জেনে নিও এক বুক যন্ত্রণা আর আঘাতের ভীড়ে তোমার জন্য সন্তপর্ণে ভালোবাসা জমিয়ে রেখেছিলাম।
তুমি বরং জেনে নিও আরেকবার স্বপ্ন দেখার সাহস পেয়েছি তোমার হাসি দেখে।
বালিকা, তুমি বরং জেনে নিও, তুমি আমার সেই শখ,যাকে পাওয়ার জন্য আমি আমাকে বাজি ধরতে পারি।”
রপা জড়সড় হয়ে গেলো রূপকের এসব কথা শুনে। তার মাথা কাজ করছে না। কেমন আচ্ছন্নের মতো লাগছে তার।
রূপক উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “যাও,তোমার বাসায় যাও।”
রূপা আর দাঁড়ালো না। ছুটে পালিয়ে এলো।রুমে এসে রূপা কাঁদতে লাগলো। কেনো কাঁদছে সে জানে না।শুধু জানে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার।
মায়ের ভালোবাসা না পেলে কেমন লাগে তা তো রূপা জানে,অথচ সেখানে রূপক এতো বছর মায়ের ভালোবাসা পায় নি।কিভাবে আছে রূপক?
সকালে কলিং বেল বাজতেই রূপক বিছানায় উঠে বসলো। শরীর এখন কিছুটা ভালো লাগছে।ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে গেছে। তবে শরীর দুর্বল।
উঠে এসে দরজা খুলতেই দেখে রেখা দাঁড়িয়ে আছে।
রূপকের ভীষণ অবাক লাগলো। রেখাএখানে?
সমুদ্র বললো, “তোমার মা কোথায়?”
রূপক গম্ভীর হয়ে বললো, “কেনো এসেছেন?”
রেখা বিরক্ত হলো। কঠিন গলায় বললো, “তোমার মতো বেয়াদব মনে হয় দ্বিতীয় কেউ নেই। না হলে নিজের ফুফাতো বোনকে লেলিয়ে দিতে না আমার ছেলের পেছনে। কি ভেবেছ,সমুদ্রর চাচার ছন্নছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয়ে আমি সমুদ্রের সব আর্জি মেনে নিয়ে সালমার মেয়েকে ছেলের বউ বানাবো?
সমুদ্র আমার একমাত্র ছেলে,আমি বেঁচে থাকতে অন্তত কিছুতেই তা হবার নয়। যতই তোমরা ওই মেয়েকে লেলিয়ে দাও না কেনো!”
রূপকের মাথায় রক্ত উঠে গেলো শুনে। লেলিয়ে দিয়েছে তারা রুপাকে?
রূপা কে নিয়ে এভাবে কেউ বলতে পারে কখনো?
রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়লো রূপক।চেঁচিয়ে বললো, “কি ভেবেছেন আপনি, আমার ফুফাতো বোন বানের জলে ভেসে আসা কেউ?
আপনার ছেলের পেছনে আমরা লেলিয়ে দিই নি বরং আপনার ছেলে ওর জন্য দিওয়ানা হয়ে ঘুরছে।আর একটা কথা কান খুলে শুনে রাখুন,রূপাকে আমি ভালোবাসি।
আমার সবটা দিয়ে রূপাকে আমি ভালোবাসি। আমি যদি রূপাকে না ও পাই না তবুও জেনে রাখবেন, কিছুতেই রূপা সমুদ্রের হবে না।
দরকার হলে নিজে দাঁড়িয়ে রূপাকে অন্যত্র বিয়ে দিব।আপনার আঁচল ধরে ঘুরঘুর করা ছেলের কাছে রূপার বিয়ে হবে না। ”
রূপা নিজের বাসার মেইন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সবটা শুনলো।
নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না রূপা।
রেখাকে দেখার বড্ড ইচ্ছে হলো তার। কে সেই মহিলা যিনি তাকে এতো অপছন্দ করেন?
কোন অপরাধে?
দরজা খুলে রূপা বাহিরে বের হলো। রেখা পেছনে তাকিয়ে দেখলো ছিপছিপে মিষ্টি দেখতে একটা মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। রূপকের ততক্ষণে মাথায় আগুন জ্বলছে দাউদাউ করে।
রেখার সামনে রূপার হাত টেনে ধরে বললো, “এই যে রূপা,কান খুলে শুনে রাখ আজকে।আমি তোকে ভালোবাসি।আমার জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসি।তুই ভালোবাসিস বা না বাসিস তোর ইচ্ছে সেটা। তবে এটুকু মনে রাখবি দুনিয়ার যেকোনো ছেলেকে তুই ভালোবাসতে পারিস নির্দ্বিধায় শুধু সমুদ্রকে ছাড়া। ”
রূপা চুপ করে রইলো। চোখের সামনে ভাসছে সহজ সরল দেখতে, একটা ছেলের মুখ।যার দুই চোখ ভর্তি ভালোবাসা।
রূপা মনে মনে ভাবলো, কি কপাল তার!
মানুষ ভালোবাসা পায় না,আর সে পেয়েও গ্রহণ করতে পারছে না।
কতো দ্বিধা, কতো জটিলতা,কতো বাঁধা!
রেখা আড়চোখে রূপার দিকে তাকিয়ে বললো, “গাই ভালো তার বাছুর ভালো, দুধ ভালো তার ঘি।বাপ ভালো তার বেটা ভালো, মা ভালো তার ঝি।
মায়ের মেয়ে, মায়ের মতো ছোঁকছোঁকানিতে ওস্তাদ। এজন্যই তো আমার ছেলের মাথা খেয়ে নিয়েছে, যেভাবে মা খেয়েছিলো আমার দেবরের মাথা। ”
রূপক তেড়ে যেতে নিলো রেখার দিকে,রূপা হাত ধরে থামালো রূপককে।
রেখা আর দাঁড়ালো না। লিফট দিয়ে নামতে নামতে মুচকি হাসতে লাগলো। আজকের ডোজ কাজে লাগবে। ওই মেয়ের যদি সমুদ্রের জন্য কোনো টান থাকে ও তাও আজকে রেখার ব্যবহার দেখে কেটে যাবে।
তার কিছু করতে হবে না আর।এবার ছেলের হ্যাঁ তে হ্যাঁ মিলাবেন আর না তে না।ছেলের কথাতে রাজি হয়ে যাবেন।এখনই বাসায় গিয়ে জানাবেন তিনি রাজি রূপাকে ছেলের বউ বানাতে।
আচমকা রূপা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। রূপার কান্নায় রূপক হতভম্ব হয়ে গেলো। তারপর এগিয়ে গিয়ে রূপাকে নিজের বাহুর উপর টেনে নিলো।
রূপা বিড়বিড় করে বললো, “প্রয়োজন হলে আজীবন চিরকুমারী থাকবো রূপকদা,তবুও সমুদ্রর ছায়া ও মাড়াবো না।আমার মায়ের কি দোষ, কেনো আমার মা’কে এভাবে অপমান করলো উনি?”
রূপক চোয়াল শক্ত করে বললো, “এর জবাব সমুদ্রের থেকে নিবো আমি। আল্লাহ আল্লাহ করে ফুফু সুস্থ হয়ে উঠুক আগে রূপা,তারপর জানা যাবে অনেক কিছু। অনেক কিছুই আমি সন্দেহ করি সব নিশ্চিত হব ফুফুর থেকে জানার পর।
ফুফুকে দেখতে যাবি?”
রূপা মাথা নিচু করে বললো, “না,মা আমাকে দেখলে আরো উত্তেজিত হয়ে যাবেন।মা সুস্থ হয়ে নিক।তারপর যাবো।”
রূপক চুপ করে রইলো। বুকের ভেতর জ্বলতে থাকা সব আগুন যেনো নিভে গেছে রূপাকে বুকে পেয়ে।এভাবেই থাকবে তো রূপা?
চলবে…..
রাজিয়া রহমান