#তুমি_অপরূপা(৩৭)
নিরব,নিস্তব্ধ পরিবেশ। সবাই চুপ করে বসে আছে। সালমা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে শুধু। এই বাড়ি ছেড়ে একেবারেই তো চলে গিয়েছিলো, ভাগ্য আবারও তাকে এই বাড়িতে ফিরিয়ে এনেছে।
ভাগ্য যখন ফিরিয়ে আনবেই তাহলে কেনো আরো আগে আনলো না?
তাহলে তো বাবা মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে পারতো।
সমুদ্র এসে রূপকদের খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে এসে দাঁড়ালো। আজকে একটা হিসেব মেলাতে হবে তার।
সময় কেটে যাচ্ছে, সালমার কান্না শেষ হচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর রেখা ও এসে হাজির হলো। একটু আগে রূপক তাকে কল দিয়ে বলেছিলো সমুদ্র এই বাসায় এসে পাগলামি করছে তাই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো রেখা।
কিছুক্ষণ পর রূপকের ছোট চাচা,চাচী ও এসে হাজির হলো।
সালমা ফিরে এসেছে এই খবর শুনে তারা ও ছুটে এসেছে সালমাকে দেখতে।
ছোট ভাইজানকে দেখে সালমা কান্নায় ভেঙে পড়লো আবারও। সিরাজ হায়দার অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে আছে বিব্রত হয়ে।
সেদিন যদি তিনি সালমাকে নিয়ে পালিয়ে না যেতেন তবে এই মুহূর্ত আসতো না।আচ্ছা, সালমা কে কি তিনি সুখী করতে পেরেছেন?
হয়তো পারেন নি।কখনো মুখ ফুটে কিছু বলে নি সালমা।তবুও তিনি বুঝেন অনেক কমতি ছিলো, অনেক না পাওয়া ছিলো।
অনেক সময় রাগে,ক্রোধে অন্ধ হয়ে সালমার গায়ে হাত তুলতে ও দুই বার ভাবেন নি তিনি।
আজ এতো লজ্জা লাগছে কেনো তার এসব ভেবে?
রাজকন্যাকে নিয়ে মাটির ঘরে রেখেছেন অথচ তার যাওয়ার কথা ছিলো অন্যের রাজপ্রাসাদে।
এসব ভেবে সিরাজ হায়দার লজ্জায় নত হয়ে রইলেন।
রূপকের ছোট চাচা সেলিম খান দোদুল্যমানতায় ভুগছেন।একদিকে বোন ফিরে এসেছে বলে যেটুকু আনন্দ হচ্ছে অন্যদিকে ভেতরে ভেতরে রাগ ও হচ্ছে একটা সোনার টুকরো জমি হাতছাড়া হয়ে যাবে বলে। রূপক ঠিকই জমিটা ফুফুর নামে করে দিবে।
এরকম একটা জমির মালিকানা হারিয়ে ফেলার কষ্টে হারানো বোনকে ফিরে পাবার আনন্দ ও ফিকে হয়ে এলো তার।
সেলিম খান বুঝতে পারলেন না কেনো এমন হচ্ছে। অথচ এক সময় এই ছোট বোনটার জন্য দুনিয়া এফোঁড়ওফোঁড় করে দিতে ও দ্বিতীয় বার ভাবতেন না।অথচ আজ তার সম্পদের জন্য মন কেমন করছে।
নিরবতা ভেঙে তিনি বললেন, “কিভাবে পারলি তুই এভাবে আমাদের মান ইজ্জত নষ্ট করে পালিয়ে যেতে সালমা?
একবারও মনে পড়লো না আমাদের কথা? আব্বার কথা ও কি তোর মনে পড়ে নি?”
এতো গুলো বছর পর,সন্তানেরা যখন এতটা বড় হয়ে গেছে সেই সময় তাদের সামনে এসব প্রশ্ন ভীষণ বিব্রতকর। রূপক এগিয়ে এসে বললো, “চাচা কি হয়েছে না হয়েছে সেসব এখন বলে লাভ নেই।ফুফুর যা ঠিক মনে হয়েছে তাই করেছেন।এখন সেসবের বিচার করতে যাওয়ার মতো বোকামি দ্বিতীয় কিছু নেই।বড় কথা হচ্ছে দাদা দাদী দুজনেই ফুফুকে ক্ষমা করে দিয়েছেন, মন থেকেই ফুফুকে মেনে নিয়েছেন সেই সময়। দুর্ভাগ্য এটাই যে ফুফুর সন্ধান দাদা পান নি।”
সেলিম খান বললেন, “এখন ফিরে এসেছে কেনো তাহলে? আব্বা মা ওর জন্য যেই কষ্ট পেয়েছেন তা আমরা জানি।সবার কাছে আমাদের ছোট হতে হইছে।এখন কি সংসার চালাতে পারে না?
এজন্য বাবার বাড়িতে ফিরে আসছে?”
রূপক চমকে গেলো চাচার কথা শুনে। আজকের দিনে,এরকম আনন্দের দিনে চাচা এভাবে কথা বলছেন!
এতো লোভ তার!
রূপক চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। সেলিম খান আর কি বলে সেসব শোনার জন্য, তারপর জবাব দিবে।ফুফুও বুঝুক এই জগৎ সংসারে তার জন্য কেউ আপন নেই আর। যাতে ভাইয়ের মিষ্টি কথায় পরে জমি ভাইয়ের নামে লিখে দেওয়ার মতো ভুল না করে।
সালমার চেহারা থমথমে হয়ে গেলো লজ্জায়। কি বলছে এসব তার আপন ভাই?
সেলিম খান আবারও বললো, “বড় ভাবী ঠিকই বলতো।একদিন ঠিকই ফিরে আসবো জায়গা জমির লোভে।কথা তো আজ দেখি সত্যি।”
তানিয়া নিজেই চুপ হয়ে রইলো। কেঁচো খুড়তে গিয়ে সাপ যাতে বের না হয় তার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করছে।
সিরাজ হায়দার এবার আর চুপ রইতে পারলো না। এগিয়ে এসে বললো, “আমার টাকা পয়সা না থাকতে পারে কিন্তু মান ইজ্জত আছে।আল্লাহ আমারে টাকা পয়সা দেয় নাই সেই সাথে লোভ ও দেয় নাই।তাই এসব নিয়ে ভাবিয়েন না আপনি। ”
সেলিম খান হেসে বললো, “গরীবের আবার নীতিজ্ঞান!
তুমি তাইলে সেই লোক!তোমারে তো আমি পুলিশে দিমু।”
অন্তরার ভীষণ রাগ হলো এবার।এগিয়ে এসে মামার সামনে দাঁড়িয়ে বললো, “মুখ সামলে কথা বলিয়েন। আমার বাবার দিকে আঙুল তুলে কথা বলার আগে একবার ভালো করে ভেবে নিয়েন।নয়তো পরে দেখবেন হাতে আঙুলই থাকলো না।”
সেলিম খান থতমত খেয়ে গেলেন অন্তরার কথা শুনে। এইটুকু মেয়ের এতো বড় বড় কথা!
নিজেকে সামলে সেলিম খান প্রসঙ্গ বদলে বললেন, “তোর বাবার কথা শুনে তোর যেমন খারাপ লাগছে আমাদের ও সেই সময় এরকম লাগছে আমাদের আব্বার জন্য। আব্বা মৃত্যু শয্যায় কতো খুঁজেছে সালমাকে।কখনো একটা চিঠি ও কি লিখতে পারিস নি?”
সালমা চকিতে তানিয়ার দিকে তাকালো। তানিয়া পারে না এখান থেকে পালিয়ে যায়। মাথা নিচু করে তানিয়া দাঁড়িয়ে আছে।
সালমা তানিয়ার সামনে গিয়ে বললো, “বড় ভাবী,তোমার কাছে আমি কতো চিঠি পাঠাইছি তুমি কি জানাও নাই বাড়িতে? ”
তানিয়ার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়লো। চুপ করে মাথা নিচু করে রইলো তানিয়া।সেলিম খান,সেলিম খানের স্ত্রী রুবি,রত্না,পান্না,সমুদ্র,রূপা,অন্তরা সবাই বিস্মিত হলো এই কথা শুনে।
রূপক হাসতে লাগলো মুচকি মুচকি।
সেলিম খান আচমকা তানিয়ার সামনে গিয়ে বললো, “সালমা কি বললো এটা ভাবী?ও কি তোমাকে চিঠি পাঠাইছিলো?”
তানিয়া ঘামতে লাগলো। জিব দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো, “না,কখনোই না।সালমার সাথে কখনোই আমার যোগাযোগ হয় নি।ও কোনো দিন ও আমারে চিঠি দেয় নি,মিথ্যা কথা বলতেছে।চিঠি দিলে কি আমি সবাইরে জানাতাম না বলেন ছোট ভাই?আপনার মনে নাই আমি সহ তো কতো খুঁজছি ওরে জায়গায় জায়গায়। আমার সাথে যোগাযোগ থাকলে তো আমি নিজেই সবাইকে জানিয়ে দিতাম।”
সালমা হতভম্ব হয়ে গেলো ভাবীর কথা শুনে। তারপর বোমা ফাটানোর মতো বললো, “তুমি আমাকে খুঁজছ ভাবী?
তুমি?
অথচ তুমি নিজেই আমারে পালাইয়া যাওনের বুদ্ধি দিছিলা।তুমি আমার ঠিকানা ও জানতে, চিঠির খামে তো ঠিকানা লেখাই থাকতো।”
পুরো ঘরের সবাই থম মেরে আছে। সেলিম খান ভেবে পাচ্ছে না কি বলবে?
বড় ভাবী নিজে এই বুদ্ধি দিয়েছিলো?
তানিয়া আমতাআমতা করে বললো, “কি বলো এসব তুমি সালমা?”
সালমা এবার শক্ত হলো। কঠোর স্বরে বললো, “হ,এতো দিন আমি সব কথা নিজের মধ্যে লুকাই রাখছি।আমি কোনো দিন চাই নাই বড় ভাবী আমার জন্য ঝামেলায় পড়ুক।এখন যখন বড় ভাবী নিজেই অস্বীকার করতেছে তখন আমি সব সত্যি বলে দিমু।আমাদের সম্পর্কের কথা যখন বাড়িতে সবাই জেনে যায় তখন আব্বা,বড় ভাই,ছোট ভাই কেউ-ই রাজি হয় নাই।
কবিরের লগে আমার বিয়া ঠিক কইরা ফালায় তখন ওনারা।
আমি নিজেও জানতাম না আমার বিয়ে যে ঠিক হয়ে গেছে। বড় ভাবী সেদিন রাইতে আমার রুমে আইসা আমারে কইলো আগামী কাইল আমার বিয়া দিবো জোর কইরা কবিরের লগে।আমি তখন দিশেহারা হয়ে গেছি।বড় ভাবী আমাকে বুদ্ধি দিলো যাতে পালিয়ে যাই।আমি যখন আব্বার কথা কইলাম,ভাবী কইলো কিছুদিন পর সব ঠিক হয়ে যাইবো।এদিক ভাবী সামলাইবো আমি যাতে চিন্তা না করি।আমি তখন ভাবীর কথায় ভরসা করে আমি সেদিন ঘর ছেড়ে যাই।
আমি ভেবেছিলাম ভাবী সবাইকে বুঝিয়ে নিবে।
কিন্তু পরে যখন ভাবীকে চিঠি দিই ভাবী আমাকে বললো যে আব্বা না-কি বলেছেন আমি কোনো দিন যদি ফিরা আসি তাইলে আমারে আব্বা ত্যাজ্য করবেন।আর নয়তো নিজে আত্মহত্যা করবেন।
আমি তখন পুরোপুরি নিজেরে গুটাইয়া নিছি।তারপর আর কারো খোঁজ রাখার দরকার মনে করি নাই।”
সবাই হতভম্ব হয়ে আছে।পুরো বাসায় পিনপতন নীরবতা।
একটা মানুষের জন্য এতো কিছু ঘটে গেলো, বাবা তার আদরের মেয়ের খোঁজ পেলো না,মেয়ে পারলো না বাবাকে শেষ দেখা দেখতে। সবাই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো শুধু একজনের জন্য।
তানিয়া আবারও মিথ্যা বলতে চাইলো কিন্তু রূপকের রক্তচক্ষুর দিকে তাকিয়ে আর সাহস পেলো না।রূপক বজ্রকঠিন স্বরে বললো, “মিথ্যা বলে লাভ হবে না,ফুফুর লিখা দুইটা চিঠি আমার হাতে এসে পড়েছে। তাই ফুফু যে মিথ্যা বলছে না তা পরিষ্কার। ”
তানিয়া উপায় না পেয়ে বললো, “আমার একার দোষ না,আমার সাথে রেখা ভাবী ও ছিলো। উনি আর আমি মিলে এই প্ল্যান করেছি।তাই একা আমাকে কেনো সবাই কথা শোনাবে?”
রেখা আৎকে উঠলো শুনে।সে এসেছিলো ছেলের জন্য, নিজে এভাবে ফেঁসে যাবে তা ভাবে নি।এখন মনে হচ্ছে না আসাই ভালো ছিলো। কিন্তু এসে যখন পড়েছে তখন আর ফেরার পথ নেই।
সমুদ্র অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকালো। তার মা ও এরকম নোংরা চক্রান্তে যুক্ত থাকতে পারে তা কখনোই ভাবনাতেও আসে নি সমুদ্রের। হতবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো সমুদ্র।
চলবে……
রাজিয়া রহমান