#তুমি_অপরূপা(৩৮)
সমুদ্র এগিয়ে গিয়ে মায়ের সামনে দাঁড়ালো। রেখা অপরাধীর ন্যায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সমুদ্রর বুকের ভেতর সমুদ্রের উত্তালতা। টালমাটাল অবস্থা সমুদ্রের।বুকের ভেতর বিশ্বাসের,ভরসার ভীতটা কেউ যেনো এক ধাক্কায় গুড়িয়ে চুরমার করে দিয়েছে।
মা বলে ডাকলে বুকের যেখানে এক রাশ প্রশান্তি এসে জমা হতো সেখানে কেমন কষ্ট জমেছে হঠাৎ করেই।
এমন লাগছে কেনো!
রূপক নিঃশব্দে এসে সমুদ্রের পিছনে দাঁড়ালো।
সমুদ্র অস্থির হয়ে বললো “মা,এসব কি সত্যি মা?”
রেখা অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। তার কাছে ভীষণ অসহ্য লাগছে সবকিছু। ইচ্ছে করছে প্রচন্ড আক্রোশে সালমার গলা চে*পে ধরতে।
কেনো ফিরে এলো এই মহিলা?
না এলে তো কখনো কেউ জানতো না।সালমার অধ্যায় মুছে যেতো পৃথিবীর বুক থেকে।
সমুদ্র ধৈর্য ধরতে পারছে না আর।এজন্যই কি মা সালমা ফুফুকে অপছন্দ করতো!
আর এজন্যই কি রূপাকে মায়ের অপছন্দ!
সেলিম খান কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।এতো কিছু ঘটে গেলো অথচ কেউ-ই টের পেলো না!
তানিয়া এগিয়ে এসে রেখার হাত ধরে বললো, “এই তো রেখা ভাবী আছেন। আমি সব বলবো, দেখি উনি অস্বীকার করতে পারেন কি-না।
কবির তখন আমেরিকায় সেটেল।সমানে টাকা কামাচ্ছে। সালমার প্রেমে পাগল সে।নারী জাতি এরকমই, একে অন্যের ভালো সহ্য করতে পারে না। তেমনই সালমাকে আমার ও হিংসা হতো। তার উপর সালমার প্রতি আমার শ্বশুর শাশুড়ির,তার দুই ভাইয়ের ভালোবাসা, আদর এসব আমার সহ্য হতো না। সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু তাদের কাছে তাদের মেয়ে থাকতো আমি এটা মানতে পারতাম না।আবার কোথাও গেলে সবার চোখ সালমার উপরেই পড়তো এসব কিছুই সহ্য হতো না আমার।
অস্বীকার করবো না, সালমা রূপে,গুণে সবদিক থেকে আমার উপরে ছিলো, তেমনই রেখা ভাবীর ও।
আর এজন্যই আমার মন কিছুতেই সহ্য করতে পারে নি,তাই আমি চাইতাম সালমা যাতে এমন জায়গায় যায় যেখানে এতো সুঝ,সাচ্ছন্দ্য কিছুই পাবে না।
আর রেখা ভাবীর উদ্দেশ্য ছিলো আরেকটা। এই দুনিয়ায় কোনো জা চায় না তার অন্য জা তার থেকে সুন্দরী হোক,গুণবতী হোক বা তার থেকে এগিয়ে থাক।লোকে বলে জা’য়ের শত্রু জা।
রেখা ভাবীও চায় নি সালমা ওই বাড়ির বউ হোক,এতো বিলাসিতা পাক।ওনার ছোট বোনকে উনি কবিরের বউ বানাতে চাইতেন।যাতে কবিরের টাকা পয়সা ভোগ করতে পারেন।কবিরের এতো টাকা পয়সা বাহিরের কেউ ভোগ করবে,সালমা কে নিয়ে কবির আমেরিকায় থাকবে এসব কিছু রেখা ভাবী মানতে পারে নি। তাই উনিও আমার সাথে যুক্ত হলেন।কবিরের থেকে সালমার কথা বলে বলে অনেক টাকা হাতিয়েছেন উনি।কবির জানতো এসব টাকা সালমাকে দেয় ভাবী।সালমা কবিরের প্রতি দুর্বল শুধু মুখে প্রকাশ করে না এসব বলে বলে ভাবী কবিরের থেকে অনেক টাকা মেরে খেয়েছেন।
সালমার ভালোবাসায় কবির এতো অন্ধ ছিলো যে রেখা ভাবী যেভাবে বুঝিয়ে বলতো সেভাবেই বুঝতো।
উনি আর আমি যুক্তি বুদ্ধি করে ঠিক করলাম সালমা কে কবিরের বউ হতে দিবো না।
আর তাই আমি সালমাকে ইন্ধন দিতাম।বানিয়ে বানিয়ে কথা বলতাম অনেক কিছু। শুনে সালমা ভয়ে তটস্থ হয়ে যেতো।
আর সালমা পালিয়ে যাওয়ার পর আমার বাবার বাড়ির ঠিকানায় চিঠি দিতে বলতাম,যাতে এই বাড়ির কেউ কখনো সালমার সাথে আমার যোগাযোগের কথা জানতে না পারে।
সালমা কে আমি উত্তর দিতাম না বেশি একটা। দুই একটা চিঠি যা দিয়েছি তাতে সবসময় বলতাম বাড়িতে অনেক ঝামেলার কথা, আব্বা আম্মার রাগের কথা।
তারপর সালমা ভেবে নিলো আব্বা ওকে মেনে নিবে না।তাই আর সালমার আসা হয় নি এই বাড়িতে।”
সমুদ্রের মাথা ঘুরে উঠলো। এতো নোংরা মানসিকতা তার মা’য়ের?
রূপক তার মা’কে কেনো ঘৃণা করতো সমুদ্র বুঝতো না কিন্তু আজ বুঝতে পারছে এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে ঘৃণ্য ব্যক্তি তার মা।
একজন মানুষের ভালোবাসা নিয়ে এভাবে খেললো?
এতো লোভ!
সমুদ্র টলতে লাগলো। মাথা ঘুরে পড়তে গিয়ে পেছনে কারো কাঁধ পেলো।তাকিয়ে দেখে রূপক নিজের কাঁধ এগিয়ে দিয়েছে। সমুদ্র আর সহ্য করতে পারলো না। রূপককে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। সমুদ্রের হাউমাউ করে কান্না করা দেখে রেখার বুকের ভেতর কেমন হুহু করে উঠলো।
তার কোমল মনের ছেলে,নরম মনে আজ এতো বড় আঘাত পেলো!
রেখার আবারও রাগ হলো সালমার উপর। সব কিছুর জন্য এই মহিলা দায়ী।
সমুদ্র রূপককে জড়িয়ে ধরে বললো, “আমি ভুল করে ফেলেছি ভাই,অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি তোর সাথে খারাপ ব্যবহার করে।
আজ নিজের উপর নিজের প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। আমাকে ক্ষমা করে দিস তুই।কিভাবে পারিস তুই সব যন্ত্রণা চেপে রাখতে?এতগুলো বছর ধরে কিভাবে সব সহ্য করে এসেছিস?
আমি যে আজ একদিনেই মনে হচ্ছে দমবন্ধ হয়ে মা,,রা যাবো।
কখনো তোর যন্ত্রণা কি তা বুঝি নি। আজ বুঝতে পারছি তুই বুকের ভেতর কতো আঘাত সযত্নে লুকিয়ে এসেছিস!
কেনো এমন হলো বল তো!
চাচা যদি এসব জানতে পারে তবে হয়তো আজীবনের জন্য সবার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিবে।
ওনাদের দুই জনের লোভের জন্য কতগুলো মানুষ এলোমেলো হয়ে গেছে!
রূপক চুপ করে রইলো। রেখা প্রতিবাদ করে যে মিথ্যা কিছু বলবে সেই সাহস পেলো না। ছেলের সামনে আর কতো ছোট হবেন!
কেমন থমথমে হয়ে গেলো পরিস্থিতি। সবাই নিশ্চুপ।
সালমা বাকরুদ্ধ হয়ে আছে।তাকে ঘিরে এতো কিছু ঘটেছে?
অথচ তিনি কিছুই জানতে পারেন নি।
হায়রে মানুষ!
এতো নিচু মনের ও মানুষ হতে পারে!
রেখা দুপদাপ পা ফেলে চলে গেলো সেখান থেকে। সালমা সিরাজ হায়দারের হাত ধরে বললেন, ” আমারে বাড়ি নিয়া চলেন।এই বাড়ি আমার না,আপনার হাত ধরে সব কিছু ছাড়ছি একদিন সবার অলক্ষ্যে, আইজ সবার সামনে দিয়া সব ছেড়ে একেবারে চলে যামু।এই শহরের মানুষ ভীষণ স্বার্থপর। এরা দূষিত বাতাস, দূষিত পরিবেশে থাকতে থাকতে এগো মন ও দূষিত।
আর এক মুহূর্ত ও এইখানে থাকমু না।
ভাইজান, আপনে ভাবছেন জায়গা জমির লোভে আমি আবারও আইছি?
না ভাইজান।আমি যে মানুষটার কাছে গেছি তার অনেক কিছুর অভাব আছে।সেই সঙ্গে লোভ লালসার ও অভাব আছে।আপনাগো মতো হয়তো তিন বেলা ভালো খাইতে পারি না,কিন্তু দুই বেলা হইলেও আমার স্বামী শাকপাতা দিয়া খাওয়াইতে পারে,সেই তৌফিক আছে।আমার কিছু লাগবো না।
সেই ২৩-২৪ বছর আগেও যারে চাইছি,আইজ ও আমি তারেই চাই।আমার সবচাইতে সব সম্পদ সে-ই। ”
অন্তরা,রূপাকে নিয়ে সালমা সিরাজ হায়দারের হাত ধরে বের হয়ে এলো বাসা থেকে।
রূপক বাঁধা দিলো না,নিজেও বের হয়ে এলো। এতো দিন ধরে মনে যেসব সন্দেহ ঘুরপাক করছিলো সেসব আজ সত্যি বলে প্রমাণিত হলো।
বিড়বিড় করে রূপক বললো, “তুমি আমার মা,আমার সবচেয়ে আপন মানুষ। অথচ তোমাকেই আমি সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করি মা।তুমি সবচেয়ে ঘৃণ্য ব্যক্তি।
অথচ হওয়ার কথা ছিলো সবচেয়ে ভালোবাসার ব্যক্তি তুমি। ”
স্টেশনে গিয়ে সবার জন্য টিকিট কাটলো রূপক।
অন্তরা রূপকের হাতে টিকিট দেখে বললো, “আমরা তো ৫ জন,টিকিট ৬ টা কাটলেন কেনো?”
রূপক জবাব না দিয়ে মুচকি হাসলো।
বাস চলে এসেছে কিছুক্ষণ পর। রূপক অস্থির হয়ে তাকাচ্ছে এদিক ওদিক।
একে একে মানুষ উঠছে বাসে।শেষ মুহূর্তে দেখা গেলো সমুদ্র দৌড়ে আসছে কাঁধে একটা ব্যাগ নিয়ে।
রূপক হাত ইশারা করে বললো বাসে উঠে আসতে।
দেরি না করে সমুদ্র বাসে উঠে এলো।
তারপর রূপকের পাশের সীটে বসে বললো, “টিকিট তো কাটা হলো না!”
রূপক হেসে একটা টিকিট বের করে সমুদ্রের হাত দিলো।
হেসে ফেললো সমুদ্র,তারপর রূপকের গলা জড়িয়ে ধরে বললো, “আজও আগের মতোই আছিস তুই,সব বুঝে যাস তুই।কিভাবে বুঝলি আমি যে আসবো?কিভাবে আগেই টিকিট কেটে ফেললি!”
রূপক জবাব না দিয়ে হাসলো।সমুদ্র মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলো সেই হাসি।কতো দিন,কতো ঘন্টা, কতো মিনিট, কতো সেকেন্ড পর এই হাসি দেখছে সে!
পাশের সীটে রূপা আর ওর বোন বসেছে।সমুদ্র সেদিকে তাকালো না।আজ শুধু সে তার বন্ধুকে নিয়ে ভাবতে চায়।সবকিছু আজ ভীষণ তুচ্ছ তার কাছে।
চলবে
রাজিয়া রহমান
(আরেকটা টুইস্ট আছে 🤐🫣)