তুমি_অপরূপা(৪০)

0
388

#তুমি_অপরূপা(৪০)

রাতে সমুদ্র আর সিরাজ হায়দার একসাথেই ফিরে এসেছে। সিরাজ হায়দারের মুখ থমথমে। আষাঢ়ের মেঘ জমেছে যেনো তার মুখে।
রূপক সমুদ্র কে কিছু জিজ্ঞেস করতে চেয়েও করলো না। তবে রূপক বুঝলো সমুদ্র হয়তো রূপার কথা বলেছে রূপার বাবাকে তাই উনি এরকম গম্ভীর হয়ে আছেন।

রূপক ঠিক করলো ওকে যদি কেউ এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে তবে অবশ্যই সে সমুদ্রর কথা বলবে।
এতো ভালোবাসা বৃথা যেতে দিবে না।
তার না হোক,তবুও রূপা ভালো থাকুক।এমন কাউকে পাক যে কি-না এক আকাশ ভালোবাসতে জানে।

অন্তরা খাবার সাজাচ্ছিল বারান্দায়।বারান্দার আবছা আলোয় খেয়াল করলো কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে উঠানে।

অন্তরা ভয় পেয়ে সেদিকে তাকালো। তাকিয়েই চমকে উঠলো। জুয়েল দাঁড়িয়ে আছে উঠানে।
আর্তচিৎকার করে অন্তরা ঘরের দিকে গেলো ছুটে।

অন্তরার চিৎকারে সবাই ছুটে এলো। সমুদ্র আর রূপক দুজনে এসে দেখে অন্তরা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে আছে।

সিরাজ হায়দার এগিয়ে গিয়ে মেয়ের মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন,”কি হইছে রে মা?”

অন্তরা মাটির দিকে তাকিয়ে বললো, “বাহিরে জুয়েল আসছে আব্বা। ”

চমকে সিরাজ হায়দার সালমার দিকে তাকালেন।রূপা রূপকের দিকে তাকিয়ে দেখলো রূপকের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে।
সমুদ্র চিনতে না পেরে রূপকের দিকে তাকাতেই রূপক বললো, “অন্তরার হাজব্যান্ড। ১ম স্ত্রীর কথা গোপন করে ওকে বিয়ে করেছে। ওর ১ম স্ত্রী আরেক লোকের সাথে পালিয়ে গিয়েছিলো, ব্যাটা ১ম স্ত্রী আবার ফিরে আসার পর ভোল পাল্টে ফেলে। তাই অন্তরা চলে আসে।ডিভোর্সের কথা চলছে ওর সাথে। ”

সমুদ্র বললো, এখন কেনো এসেছে তাহলে? ”

রূপক সিরাজ হায়দারের দিকে তাকিয়ে বললো, “ফুফা,আপনি আসুন।আপনি আগে জিজ্ঞেস করুন কি জন্য এসেছে। ”
সিরাজ হায়দার দৃঢ়তার সাথে বাহিরে গেলেন।সাথে রূপক,সমুদ্র দু’জনেই গেলো।

জুয়েল বারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে উসখুস করছে।
সিরাজ হায়দার বের হয়ে এসে বললো, “কে আপনি? ”

জুয়েল ইতস্তত করে বললো, “জি আমি জুয়েল।”

“জুয়েল কে?আমার চেনা জানা কেউ তো জুয়েল নাই।”

“আমি অন্তরার হাজব্যান্ড চাচা।অন্তরাকে একটু ডেকে দেন।”

সিরাজ হায়দার বললেন, “আমি অন্তরার বাবা। অন্তরা এখন বাহিরে আইবো না।এইখানে আইছেন ক্যান আপনি? ”

জুয়েল কি বলবে ভেবে পেলো না। তার মাথা কাজ করছে না কিছুতেই।কিভাবে রেশমার ফাঁদে পা দিলো ভেবে পাচ্ছে না।
১ সপ্তাহ আগে রেশমা টাকা পয়সা,গহনা যা ছিলো সব কিছু নিয়ে আবারও সেই আগের ছেলেটার সাথে পালিয়ে গেছে রানাকে রেখে।
অফিস থেকে বাসায় এসে জুয়েল দেখে বাহিরে থেকে দরজায় ছিটকিনি দেওয়া। ছিটকিনি খুলে ভেতরে যেতেই দেখে রানা কান্না করছে।
জুয়েলকে দেখে রানা ছুটে এসে কাঁদতে লাগলো। অনেকবার জিজ্ঞেস করে জুয়েল জানতে পারলো সকালে একটা লোক এসেছে বাসায় জুয়েল অফিসে যাওয়ার পর। অন্তরা ব্যাগ গুছিয়ে, আলমারি খুলেছে। তারপর কি সব নিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে রানাকে একটা চিপস এনে দিয়ে বলেছে চিপস খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তে।রেশমা কিছুক্ষণ পর ফিরে আসবে।
রানা ও মায়ের কথা শুনে ঘুমিয়ে গেলো। কিন্তু এখনো মা এলো না।
জুয়েল আলমারি খুলে দেখে সব ফাঁকা।আলমারিতে অফিসের দেড় লাখ টাকা রাখা ছিলো। রেশমার কাপড় তো নেই সেই সাথে অন্তরার কাপড় ও নেই।

জুয়েল একেবারে ভেঙে পড়লো। এতো গুলো টাকা!
রেশমাকে দ্বিতীয় বার বিশ্বাস করা অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে জুয়েলের।এখন আর শুধরাবার ও উপায় নেই।

জুয়েল পাগলের মতো হয়ে গেলো। বাড়িতে মা’কে কল দিয়ে বললো রানাকে তার কাছে রেখে আসবে,জুয়েলের মা সোজাসাপটা জানিয়ে দিলেন তার বয়স হয়েছে, এখন রানাকে পেলেপুষে বড় করার মতো শক্তি তার নেই।
বাধ্য হয়ে জুয়েলের অন্তরার কাছে আসতে হলো আবারও।
যেই কাজ অন্তরার সাথে করেছে সে তার কোনো উপায় নেই আবারও ফিরে আসার অন্তরার কাছে।
কিন্তু উপায় নেই।অন্তরা ছাড়া কেউ নেই যে রানাকে নিজের সন্তানের মতো মানুষ করবে।

অন্তরার বাবার এই অযথা রাগারাগি জুয়েলের পছন্দ হলো না। মানসিকভাবে সে বিপর্যস্ত এখন।অন্তরাকে ভীষণ দরকার এই মুহূর্তে । একবার অন্তরার কাছে কান্নাকাটি করে যদি সবটা বুঝিয়ে বলা যায়,দরকার হলে মাফ ও চাইবে সে।এতেই অন্তরা গলে যাবে জুয়েল জানে।

অন্তরার বাবার পেছনের ছেলে দুটোকে জুয়েলের বিরক্ত লাগলো। এরা কারা?
অন্তরার তো ভাই নেই।

সিরাজ হায়দার আবারও বললেন,”চুপ কইরা আছেন ক্যান?”

জুয়েল বিরক্তি নিয়ে বললো, “আপনি অন্তরাকে ডেকে দেন,যা বলার অন্তরাকে বলবো আমি।আপনাকে বললে আপনি বুঝবেন না।এতো কথা বাড়ানোর সময়
আমার নেই।”

ঘরের ভেতর থেকে অন্তরা কান পেতে শুনতে লাগলো বাহিরের সবকিছু। জুয়েলের এরকম রুক্ষ কথাবার্তা অন্তরার অন্তরে লাগলো । প্রথম বারের মতো জুয়েল অন্তরার বাবার সাথে কথা বলছে অথচ এ কেমন ব্যবহার তার!
এতো অধঃপতন!
কাকে ভালোবেসেছে সে!

ঘৃণায় মন বিষিয়ে গেলো অন্তরার।এক প্রকার চাপা ক্ষোভ নিয়ে বের হয়ে এলো বাহিরে।
রূপক চোখের ইশারায় অন্তরাকে সামনে আসতে বললো ।
অন্তরা বাবার পাশে দাঁড়িয়ে বললো, “কি বলতে চান?”

এদের সবার সামনে কিভাবে কথা বলবে জুয়েল বুঝতে পারলো না। সে ভেবেছিলো অন্তরাকে একা পেলে সব বুঝিয়ে বলবে।তাই বললো, “আমি তোমার সাথে একা কথা বলতে চাই।”

রূপক এগিয়ে এসে বললো, “আপনার যদি কিছু বলার থাকে এখানে সবার সামনে বলবেন।আর তা না হলে চলে যেতে পারেন।অযথা দাঁড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট করবেন না।অন্তরা এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলবে,আলাদাভাবে না।”

জুয়েল রাগান্বিত হয়ে রূপকের দিকে তাকালো। এই ছেলে কে এখানে মাতাব্বরি করছে!

উপায় না পেয়ে জুয়েল বললো, “রেশমা আবারও পালিয়েছে রানাকে রেখে।রানা ভীষণ কান্নাকাটি করছে অন্তরা।মা মা বলে ছেলেটা কাঁদছে। তুমি প্লিজ ফিরে চলো।আমি জানি আমি অন্যায় করেছি,তার জন্য আমাকে ক্ষমা করে দাও।রানাকে রাখার মতো তুমি ছাড়া আর কেউ নেই।”
অন্তরার এই প্রথম ভীষণ আত্মসম্মানে লাগলো। শুধু মাত্র রানাকে রাখতে হবে বলে জুয়েল এসেছে এখানে?

অন্তরার প্রতি ভালোবাসা থেকে আসে নি?

অবশ্য এটা অন্তরার আরো আগেই বুঝা উচিত ছিল। ভালোবাসা থাকলে তো অন্তরা যেদিন চলে এসেছে সেদিনই ছুটে আসতো অন্তরার জন্য। এতো দিন পর যখন এসেছে তখন বিপদে পড়ে এসেছে সেখানে ভালোবাসা নেই।
অথচ একটু ভালোবাসা পেলেই অন্তরা সব আঘাত ভুলে যেতে পারতো । এখন উল্টো আরো সব আঘাত তাজা হয়ে উঠেছে। বুকের ভেতর দগদগে ঘা জানান দিচ্ছে অন্তরা জুয়েলের কাছে শুধুমাত্র প্রয়োজন, প্রিয়জন নয়।
কখনো প্রিয় ছিলো না। জুয়েল মূলত রানার দেখাশোনা নিশ্চিত করতেই অন্তরাকে বিয়ে করেছে।
আর আজও তা-ই প্রমাণ করে দিলো।

অট্টহাসি দিয়ে অন্তরা বললো, “অন্তরা কি মুশকিল আসান না-কি!
রানা আমার সন্তান না। রানা আপনার আর আপনার স্ত্রীর সন্তান। আমাকে তো শুধু কাজের মেয়ে হিসেবে রেখেছেন। ন্যাড়া বেল তলায় এক বার যায়। বারবার না।
আপনি চলে যান।”

জুয়েল হতভম্ব। এই কাকে দেখছে সে!
সেই গ্রাম্য,সহজ মেয়ে,যার মনে শুধু ভালবাসা ছিল। যার কথায় গ্রাম্য টান ছিলো। সেই মেয়ের কতো পরিবর্তন।
এভাবে ফিরিয়ে দিবে জুয়েলকে!

অন্তরা থেমে বললো, “ডিভোর্স পেপার আমি পাঠিয়ে দিবো।আর আমার দেনমোহরের টাকা লাগবে না।মাফ করে দিলাম।”

রাগে জুয়েলের বুকের ভেতর ঝড় উঠলো যেনো। রূপক সমুদ্র দু’জনে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।

সমুদ্র এগিয়ে এসে বললো, “কথা শেষ, এবার রাস্তা মাপেন।”

জুয়েল ক্রুদ্ধ স্বরে বললো, “অন্তরারে না নিয়া আমি যাবো না।অন্তরা যাইবো, ওর চোদ্দগুষ্টি যাইবো।”

রূপক হেসে বললো, “এতো সোজা!অন্তরা এক পা যাওয়ার আগে আপনার লাশ পড়ে যাবে এখানে।”

জুয়েলের মাথা এলোমেলো হয়ে গেলো। এতো অপমান!
সে ও কম যায় না।
শান্ত স্বরে বললো, “যাবে না যে তা তো বুঝতেই পারছি।ঘরে এরকম পুরুষ মানুষ নিয়ে সময় কাটানোর সুযোগ পেলে স্বামীর সংসারে কে যেতে চায়!
আমোদ ফুর্তি সব তো ভালোই চলে। ”

অন্তরার গা শিউরে উঠলো ঘৃণায় জুয়েলের কথা শুনে। এতো নোংরা মন ওর!
অন্তরাকে এরকম ভাবে সে!

অন্তরা চোখের পলক না ফেলতেই দেখে রূপক উড়ে গিয়ে হামলে পড়েছে জুয়েলের উপর। জুয়েলের ছোটখাটো শরীরটাকে উপরে তুলে একটা আছাড় মারলো।তার পরপরই নাক বরাবর একটা ঘুষি মেরে বসলো।

রূপককে অবাক করে দিয়ে সমুদ্র একটা ডাল এনে জুয়েলের পায়ে জোরসে আঘাত করলো।
জুয়েল মাটিতে পড়ে গেলো।

অন্তরার একটু ও কষ্ট হলো না। দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে রূপা সবটা দেখতে লাগলো।
রূপকের এরকম লাফিয়ে গিয়ে জুয়েলকে আঘাত করা দেখে রূপা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। সবসময় শুনেছে রূপকের মারামারির কথা, আজ নিজ চোখে দেখলো।

সিরাজ হায়দার এগিয়ে গিয়ে বললো, “ছেড়ে দাও ওরে।তুমি এইখান থাইকা চইলা যাও।আর কোনো দিন যাতে না দেখি।”

সমুদ্র বললো, “আবারও যদি অন্তরার আশেপাশে দেখি,এই বাড়ির আশেপাশে দেখি তবে দুই চোখ উপড়ে ফেলবো।”

জুয়েল খোঁড়াতে খোঁড়াতে বের হয়ে গেলো।

রূপক মাথানিচু করে বললো, “আমি দুঃখিত ফুফা।আসলে এরকম নোংরা কথা শুনে মাথা ঠিক রাখতে পারি নি।আমার আপন মানুষদের কেউ বাজে কথা বলবে সেটা আমি সহ্য করতে পারি না।”

সিরাজ হায়দার হেসে উঠলেন শুনে।

চলবে….

রাজিয়া রহমান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here