#তুমি_অপরূপা (০৪)
২৩ বছর পর আজ সালমা ঢাকা শহরে যাচ্ছে। গাড়ি যতো সামনে যাচ্ছে সালমা বুক তত ধুকপুক করছে । বুকের ভেতর চাপা আনন্দ,উত্তেজনা, ভয় সব অনুভূতি বিদ্যমান। ২৩ বছর আগে দেখে যাওয়া শহরের সাথে আজকের শহরের কোনো মিল নেই।এই সেই শহর যেই শহরে সালমা জন্মেছে। যেই শহর তার নিজের শহর ছিলো। যেই শহরের পিচঢালা পথ ও তার চিরচেনা ছিলো। সময়ের ব্যবধানে সেই শহরের সাথে জন্ম জন্মান্তরের দূরত্ব হয়ে গেলো।
বাসের সিটে হেলান দিয়ে বসে সালমা ভাবতে লাগলো ২৩ বছর আগের কথা।
সালমা তখন অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে আর সিরাজ হায়দার ফাইনাল ইয়ার।সালমাদের বাসায় ৩ বন্ধুর সাথে ভাড়া থাকতো সিরাজ হায়দার। আর ওভাবেই পরিচয়। পরিচয় কখন প্রণয়ে রূপ নিলো তা টের পেলো না কেউ-ই। তবে প্রণয়ের পরিণতি কারোরই সুখকর ছিলো না। সিরাজ হায়দার গ্রামে এসে মা’কে সালমার কথা জানাতেই সুরাইয়া বেগম তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেন।ছেলের বউ করবেন তিনি গ্রামের ১২-১৩ বছর বয়সী একটা মেয়ে,এরকম বুড়ি,ধামড়ি,শহরের লেখাপড়া করা মাইয়া কিছুতেই বউ করবেন না বলে সাফ জানিয়ে দিলেন।
ছেলেকে বশ করতে ওঝার শরণাপন্ন হতেও বাদ রাখেন নি।কিন্তু ভালোবাসার শক্তির কাছে কোনো বিধিনিষেধ কিছুই টিকলো না।
বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে সালমা।দুই ভাইয়ের আদরের বোন।সালমার বাবা সিকান্দার খান সালমার বিয়ে ঠিক করলেন প্রতিবেশী, বন্ধু হাশেম চৌধুরীর ছেলে কবির চৌধুরীর সাথে।
বাবা মা ভাই কারো পায়ে ধরতে সালমা বাদ রাখে নি সিরাজ হায়দারের জন্য। অথচ কারো মন এতটুকু টলে নি তাতে।উপায়ন্তর না পেয়ে বিয়ের তিন দিন আগে সিরাজ হায়দারের হাত ধরে সালমা শহর ছেড়ে যায়।
যদিও তার পর বাবা ভাই সবাই সালমাকে খুঁজেছে কিন্তু সালমা কোনো ঠিকানা রেখে আসে নি।
স্টেশনে বাস থেকে নেমে সালমা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। এই সেই চেনা স্টেশন যেখানে সালমা আর সিরাজ হায়দার বাসের জন্য অপেক্ষা করতো। সেই স্টেশন আজ চেনাই যাচ্ছে না। বুকের ভেতর কেমন কেঁপে উঠলো সালমার।বাবা মা ভাইদের খুঁজে পাবে তো সালমা?
যদি না পায় তবে?
সিরাজ হায়দারের হাত ধরে সালমা হাটতে লাগলো। এই সেই হাত,যেই হাত ধরে একদিন এই শহর ছেড়ে চলে গিয়েছে আজ আবার সেই হাত ধরেই শহরে ফিরেছে। যাদের ছেড়ে গিয়েছে এক সময় আজ তাদের খুঁজতে এসেছে। শুধু মাঝখানে কেটে গেছে অনেক বছর।
পথে পথে ঘুরতে ঘুরতে কেটে গেছে অনেক সময় কিন্তু যেই উদ্দেশ্যে শহরে এসেছে সেই উদ্দেশ্য পূরণ হয় নি। সারাদিন পথে পথে ঘুরে সন্ধ্যায় দুজনে শাহবাগে একটা হোটেলে উঠলো।
হোটেলের সাদা বিছানায় শুয়ে সিরাজ হায়দার চিন্তা করতে লাগলেন জীবনের কতো রঙ হতে পারে!
কখনো কি ভেবেছেন তিনি স্ত্রীকে সাথে নিয়ে পথে পথে ঘুরবেন নিজের শ্বশুরালয় খোঁজার জন্য?
সালমা তখনও বিছানায় পিঠ লাগান নি।এতো গুলো বছর বুকের ভেতর সযত্নে যেই কষ্ট লুকিয়ে রেখেছেন, আজ তা প্রকাশ হতে চলেছে। বাবা মায়ের সাথে দেখা করার জন্য মনটা অস্থির হয়ে থাকতো কিন্তু ভয় ছিলো বাবা মা’কে খুঁজতে এলে যদি না পান খুঁজে।
আজ সেই ভয় সত্যি হতে চলছে।
————–
অনামিকা কলেজের উদ্দেশ্যে বের হয়েছে সকাল সকাল।বাবা মা বাড়িতে নেই আজ।এই সুযোগ অনামিকার শাহেদের সাথে দেখা করার।শাহেদের দেওয়া ফোনটা লুকানো স্থান থেকে বের করে অনামিকা কল দিলো শাহেদকে।
কলেজের সামনে দোকানে বসে শাহেদ চা খাচ্ছিলো।মন মেজাজ বিগড়ে আছে তার ভীষণ। সকাল সকাল বাবার সাথে একচোট লেগে গেছে তার।
সকালে ঘুম থেকে উঠে শাহেদ খেতে বসছিলো।হাসানুজ্জামান তার চালের দোকানে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে বের হচ্ছিলেন সেই মুহুর্তে ছেলেকে দেখে তার রাগ উঠে গেলো। শাহেদের হাত থেকে খাবার প্লেট উঠানে ছুড়ে ফেলে গালি দিয়ে বললেন,”..*র পোলা,আজাইরা বাপের হোটেলে বইসা বইসা খাইতে খুব ভালা লাগে?নিজে গতরে বাতাস লাগাইয়া ঘুরে।দা/মড়া পালতেছি আমি।নিজে কামাই কইরা যেদিন টাকা দিতে পারবি সংসারে সেদিন খাবার খাবি।পড়ালেখা করবো সে,আমি বিদ্যাশ পাঠাইতে চাইছি গেলো না।পাশের বাড়ির ইদ্রিসের পোলা কুদ্দুস সৌদি গেছে সেই সময়। এখন সে প্রত্যেক মাসে ৩০ হাজার টাকা বেতন পায়।ইদ্রিসের দুই চালার ঘর এখন চারচালা হইছে।
আর আমার জন লেখাপড়া করবো,চাকরি করবো।তোর চাকরির মায়েরে আমি **।”
বাবা ছেলের ধুন্ধুমার ঝগড়া শুনে শাহেদের মা রোজিনা এসে ছেলেকে টেনে ঘরে নিয়ে গেলো। শাহেদ ঘরে আর দাঁড়ালো না। বের হয়ে গেলো ঘর থেকে।
অনার্স পাস করে বেকার ঘুরে বেড়াচ্ছে বলে ছেলের উপর হাসানুজ্জামানের প্রচন্ড ক্ষোভ।ইন্টার পাস করার পর হাসানুজ্জামান শাহেদকে সৌদি আরব পাঠিয়ে দিতে চেয়েছেন।শাহেদ আর তার মা রোজিনা কিছুতেই রাজী হয় নি তার সিদ্ধান্তে। শাহেদ পড়তে চেয়েছিলো,একমাত্র ছেলেকে রোজিনা ও দূরে যেতে দিতে চান নি।যার কারণে সময়ে অসময়ে হাসানুজ্জামান কথা শোনান তাদের।রোজিনা ও কম কথা শোনান না এখন ছেলেকে।
ঘরে তিন মেয়ে উপযুক্ত হয়ে উঠছে অথচ সংসারে উপার্জন নেই।আদর করে ছেলেকে দেশে রেখে দিয়ে এখন নিজেও পস্তাচ্ছেন।
অনামিকার কল পেয়ে শাহেদ বললো, “আমি কলেজের সামনেই আছি,তুমি আসো।”
অনামিকা দুরুদুরু বুকে গেলো কলেজের উদ্দেশ্যে। দূর থেকে শাহেদকে দেখে অনামিকার মন খুশিখুশি হয়ে উঠলো। ফর্সা,গোলগাল ছেলেটাকে দেখলেই অনামিকার মন খুশিতে ভরে উঠে ।
শাহেদ আগে আগে হাটছে,পিছন পিছন অনামিকা হাটতে হাটতে কথা বলতে লাগলো। থু করে এক দলা থুথু ফেলে শাহেদ বললো, “বিদেশে চইলা যাওনের সিদ্ধান্ত নিয়া নিছি অনামিকা।কি কও তুমি? এই দ্যাশে থাইকা কি করমু?কোনো ভবিষ্যৎ নাই।চাকরির পিছনে তো কম ছুটি নাই।মামু খালু ও নাই আমার, চাকরিও আমার ভাগ্যে নাই।”
অনামিকা মন খারাপ করে বললো, “আপনি বিদেশ চলে গেলে আমাদের সম্পর্কের কি হইবো?”
শাহেদ বিরক্ত হয়ে বললো, “ক্যান?সম্পর্ক কি বিদ্যাশ চলে গেলে থাকে না?”
অনামিকা চুপ করে থেকে বললো, “আপনি একবার গেলে আসতে তো অনেক দেরি হইবো।তো,ততদিনে যদি আমারে আব্বায় অন্য কোথাও বিয়ে দিয়ে দেয়?”
শাহেদ হেসে বললো, “এই চিন্তা নি করো?সেই চিন্তা আমি করে রাখছি।সেসব তোমার ভাবা লাগবে না।চলো নাশতা করবা।”
অনামিকা আৎকে উঠে বললো, “না না,আমার বাড়িতে যাওন লাগবো। আমি যাই।”
শাহেদ হেসে বললো, “ভয় পাও না-কি আমারে?ভয় পাইও না।আজকে আর চুমু খামু না।”
অনামিকা লজ্জায় লাল হয়ে গেলো শাহেদের কথা শুনে। গতবার শাহেদ আচমকা চুমু খেয়ে বসেছে অনামিকার ঠোঁটে।
আমতাআমতা করে অনামিকা বললো, “না তা না।বাড়িত আব্বা মা নাই,অনিতা একলা আছে।আমার যাওন লাগবো। ”
শাহেদ হেসে বললো, “রিকশা ঠিক কইরা দিই চলো।”
একটা রিকশা ডেকে শাহেদ অনামিকাকে উঠিয়ে দিলো।রিকশা ভাড়া দিয়ে বললো, “কাকা,সাবধানে নিয়া যাইয়েন।আপনাগো বৌমা কিন্তু,আস্তেধীরে গাড়ি চালাইয়া নিয়েন।”
লজ্জায় অনামিকা মুখ লুকালো।এই ছেলেটার এসব কথা অনামিকাকে ভালো লাগায় ভাসিয়ে দেয়।এতো ভালো লাগে কেনো?
সেই ভালোবাসার কাছে,ভালো লাগার কাছে মুহুর্তেই বিলীন হয়ে গেলো বাবার কান্না।অথচ অন্তরা পালিয়ে যাওয়ার পর অনামিকা ভেবেছিলো আর যোগাযোগ করবে না শাহেদের সাথে। এই সম্পর্ক ভেঙে দিবে শীঘ্রই। বাবাকে দ্বিতীয় বার যাতে এই কষ্ট পেতে না হয়
সব কিছু ভুলে শাহেদকে ভাবতে লাগলো অনামিকা।
চলবে…..
রাজিয়া রহমান
জয়েন করুন আমার ফেসবুক গ্রুপ রাজিয়ার গল্প কুটির এ।