#তুমি_অপরূপা (০৫)
গতকাল রাত থেকে মেঘ ডাকছে।বৃষ্টি হবে যেকোনো সময়। বৃষ্টির জন্য মানুষের আহাজারি চারদিকে, এবার আকাশে মেঘের গর্জন মানুষের মনে প্রশান্তি এনে দিচ্ছে। ধরনী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কখন এক পশলা বৃষ্টি এসে জুড়িয়ে দেবে তার মনপ্রাণ। সেই সাথে অপেক্ষা করছে মানুষ।
অপেক্ষা করছে অন্তরাও।জুয়েলের অপেক্ষায় আছে অন্তরাও।জুয়েলের কথা ভাবতেই গাল লাল হয়ে গেলো অন্তরার।অন্তরার চাইতে তিন ইঞ্চি খাটো জুয়েল। তার এটুকু খুঁতকে আড়াল করতেই যেনো সে অন্তরাকে মন প্রাণ উজাড় করে ভালোবাসে।
জুয়েল একটা এনজিও তে চাকরি করে। এনজিও-র কাজে গ্রামে গিয়ে প্রথম অন্তরার দেখা পায় সে।তারপর কিভাবে কিভাবে যেনো মন দেওয়া নেওয়া হয়ে গেলো নিজেদের অজান্তে।অন্তরার যখন কলেজ থেকে ফেরার সময় হতো জুয়েল তখন দুপুরের খাবার খেতে মেসে যেতো। পথের মধ্যে একটু চোখাচোখি,মুচকি হাসি এটুকুতেই জুয়েল দিওয়ানা হয়ে গেলো। নিঃসঙ্গ জীবনের সঙ্গী হিসেবে স্বপ্ন দেখতে লাগলো অন্তরাকে নিয়ে।
এরই মধ্যে জুয়েলের ট্রান্সপার হয়ে গেলো ঢাকায়।ঢাকায় আসার দুই দিন আগে জুয়েল সর্বপ্রথম অন্তরার সাথে কথা বলে।
অন্তরা তখন বাড়ি ফিরছিলো। জুয়েল পথরোধ করে দাঁড়িয়ে বলে, “আগামী পরশু আমি শহরে চলে যাবো।এই কাগজে আমার ফোন নাম্বার লিখা আছে, যদি কখনো প্রয়োজন মনে করেন তবে কল দিয়েন।আমি চাতকের মতো আপনার অপেক্ষায় থাকবো।”
চাতকের মতো জুয়েলকে দীর্ঘ দিন অপেক্ষা করতে হয় নি।অন্তরা তার পর দিন ফুফুর ফোন থেকে লুকিয়ে জুয়েলকে কল করে।
তারপর ১ মাস কথা বলার পর পরই অন্তরা পালিয়ে আসে জুয়েলের সাথে।
পালিয়ে না এসে অন্তরার উপায় কি ছিলো?
চারবোন হওয়ার জন্য বাবার অনুপস্থিতিতে সারাদিন দাদী,ফুফুর গঞ্জনা শুনতে শুনতে অন্তরার এক প্রকারে কান পঁচে গেলো যেনো।
চোখের পানি মুছতে মুছতে অন্তরা সেসব কথা ভাবতে লাগলো। পর পর দুই দিন অন্তরাকে পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছিলো সেই সময়। পাত্রী সকলেরই পছন্দ হয় কিন্তু পছন্দ হয় না পাত্রীর বাড়িঘর, পাত্রীদের পরিবেশ। তাদেরই বা দোষ কি?
দুইটা থাকার ঘর বাড়িতে।এক ঘরে দুইটা রুম।এক রুমে সিরাজ হায়দার আর সালমা থাকে অন্য রুমে দুটো চৌকিতে চার বোন শোয়।দুটো চৌকি পাতার পর একটা টেবিল দেওয়ার জায়গা আর আলনার জায়গা ছাড়া আর কোনো জায়গা নেই রুমে।নতুন জামাই থাকবে কই?
মেহমান আসলে কই থাকবে?
অন্য ঘরে তিনটি রুম যদিও আছে তবে সেটা সুরাইয়া বেগমের দখলে। সেই ঘরে আসবাবপত্র ও আছে।
তার উপর পাত্রপক্ষের দাবি নগদ দুই লক্ষ টাকা যৌতুক।
দুই জায়গা থেকে যখন অসম্মতি জানালো সুরাইয়া বেগম আর সুরভি মিলে অন্তরার জীবন যেনো বি/ষিয়ে দিতে লাগলো। উঠতে, বসতে, খেতে সবসময় বলতে লাগতো চারটা মেয়ে জন্ম দিয়ে সিরাজ হায়দারের জীবন ধ্বং/স হয়ে গেছে। এখন এদের বিয়ে দিতে আরো ২০ লাখ টাকা লাগবে।
এক দিন,দুই দিন,তিন দিন শুনতে শুনতে অন্তরার খুব জিদ উঠলো একদিন সইতে না পেরে দাদীর দিকে তেড়ে গিয়ে বললো, “খাইলে আমার বাপের কামাই খাই আমরা। তোমরা মা মেয়ে নাতনি তিন জন যে আমার আব্বার ঘাড়ে চেপে বসে আছো তার বেলায়?
শরম করে না তোমাগো? ”
সুরাইয়া বেগম মরাকান্না জুড়ে দিলেন অন্তরার কথা শুনে। তার দুই দিন পরে পুরো পাড়া হয়ে গেলো যে অন্তরা তার দাদী আর ফুফুর গায়ে হাত তুলেছে তার বাপের কামাই খায় দেখে।
সিরাজ হায়দারকে লোকে দোকানে গিয়ে বলে আসলো মেয়ের ব্যবহার এরকম হলে তো বিয়ে দিতে পারবেন না।
এরপর পাত্রপক্ষ এলেও কথাবার্তা আর এগুতো না এই অপরাধে যে অন্তরা তার দাদী আর ফুফুর গায়ে হাত তুলেছে।তাহলে বিয়ের পর এই মেয়ে শ্বশুর শাশুড়িকে ভাত দিবে না।
অন্তরার কি ভীষণ লজ্জা লাগতো যখন তাদেরই ঘরে বসে নাশতা খেতে খেতে পাত্রপক্ষ এসব কথা শুনিয়ে যেতো। বাবার দিকে তাকালে দেখতে পেতো বাবা মাথা নিচু করে রেখেছে।
বাবার নিচু করে রাখা মাথা দেখলে অন্তরার ইচ্ছে করতো লজ্জায় নদীতে ঝাঁ/প দিতে।
অনামিকা,অপরূপা ও বড় হয়ে উঠেছে। অন্তরার ইচ্ছে করলো পালিয়ে যেতে বাড়ি থেকে। বাবা মা’কে আর লজ্জা দিতে ইচ্ছে করলো না অন্তরার।
সেই সময় জুয়েলের সাথে দেখা হতো। তারপর যেদিন জুয়েল অন্তরাকে জানালো সে অপেক্ষায় থাকবে অন্তরার মনে হলো এই সর্বোত্তম উপায় বাবা মা’কে চিন্তামুক্ত করার।
জুয়েলের সাথে কথা বলতো অল্প অল্প।
একদিন রাতে শুনলো বাবার দীর্ঘশ্বাস। তিনটা মেয়েই বিয়ের উপযুক্ত হয়ে উঠেছে, অথচ হাতে টাকা পয়সা ও নেই।কিভাবে কি করবেন এসব ভেবে তিনি ঘুমাতে পারেন না।মায়ের কাছে শুয়ে শুয়ে এসব নিয়ে আলোচনা করছিলেন।
সেদিন রাতেই অন্তরা ঠিক করলো সে জুয়েলের কাছে চলে যাবে।তাতে যদি একজনের বোঝা কমে বাবার।
বাবার উপর এক প্রকার অভিমান নিয়েই তারপর দিনই অন্তরা চলে গেলো। এসব ভাবতে ভাবতে অন্তরার বুকের ভেতর ভারী হয়ে উঠলো। বাবার একটা শার্ট বের করে জড়িয়ে ধরে বললো, “বাবা,এই যে আমি চলে এলাম তোমাকে চিন্তামুক্ত করে,তোমার কাঁধ থেকে বোঝা নামিয়ে দিলাম।এবার খুশি তো তুমি?
খুব বেশি ভার ছিলো তোমার উপর বাবা?মেয়ে সন্তানের ভার কি সব বাবা মায়ের কাছে এরকমই বেশি থাকে?”
জুয়েল এলো বৃষ্টিতে ভিজে।পলিথিন থেকে একটা প্যাকেট বের করে দিয়ে বললো, “এতে খিচুড়ি আছে।একটু গরম করে খেয়ে ফেলো।এই বৃষ্টির দিনে খিচুড়ি না হলে কি আর জমে না-কি? ”
অন্তরা দেখলো প্যাকেট একটা।অন্তরা উঠে গিয়ে খিচুড়ি গরম করে দুই প্লেটে নিলো।জুয়েল নিজের প্লেট দেখে বললো, “আরে আমি খাবো না অন্তরা।আমার খুব গ্যাস হয়েছে পেটে।না হলে তো দুই প্যাকেট ই নিতাম।”
অন্তরা হাসলো মিষ্টি করে। অন্তরা জানে জুয়েলের পকেটে টাকা নেই। এজন্যই এক প্যাকেট এনেছে।জুয়েল এক প্লেটে সবটা ঢেলে দিয়ে একটা শসা কেটে দিলো।
অন্তরা এক লোকমা নিয়ে জুয়েলের মুখের সামনে ধরলো। জুয়েল হেসে বললো, “এতো মায়াবী কেনো তুমি? ”
অন্তরা হেসে বললো, “আগে খান,পরে কথা।”
জুয়েল এক লোকমা খেলো এরপর আর এক লোকমা ও নিলো না মুখে।অন্তরাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিলো নিজে।তারপর অন্তরার খাওয়া শেষ হলে বললো, “এবার আমাকে ভাত দাও।”
অন্তরার চোখে পানি চলে এলো। এরকম যত্ন করার মানুষ তার কপালে থাকবে কেউ কি ভেবেছে কখনো?
————–
অনামিকার মোবাইলটা অপরূপার হাতে পড়ে গেলো রাতে।অনামিকার বালিশের ভেতর ভাইব্রেট হতেই অপরূপা চমকে উঠলো ঘুম থেকে। কিসের এতো কম্পন বুঝতে না পেরে হাতাতে লাগলো চারদিকে।
হাতাতে হাতাতে অনামিকার বালিশের ভেতর হাত দিয়ে দেখলো একটা মোবাইল।চমকে উঠে মৃদু আর্তনাদ করে উঠলো অপরূপা। স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে “জান” লিখা।
অপরূপা ফোনটা যথাস্থানে রেখে দিয়ে আবারও শুয়ে পড়লো।
উঠানে টয়লেটে গিয়েছিল অনামিকা।টয়লেট থেকে এসে কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো অনামিকা। অপরূপা অন্য চৌকি থেকে লক্ষ করলো কাঁথার ভেতর দিয়ে হালকা আলোর বিচ্ছুরণ দেখা যায়।
উপুড় হয়ে শুয়ে অপরূপা ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো বাবার কথা ভেবে।
বাবা যদি শুনে মেজো আপা ও কারো সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে তবে বাবার বুকটা ভেঙে যাবে।বাবার হেরে যাওয়া মুখটা ভেসে উঠছে অপরূপার চোখের সামনে।
চলবে….?
রাজিয়া রহমান
জয়েন করুন আমার ফেসবুক গ্রুপ রাজিয়ার গল্প কুটির এ