তুমি_অপরূপা (০৮)

0
264

#তুমি_অপরূপা (০৮)
সালমার হুঁশ এলো ঘন্টাখানেক পর।ততক্ষণে হাসানুজ্জামান এবং রোজিনা চলে গেছে তবে ভেঙে দিয়ে গেছে সিরাজ হায়দারের মাথা তুলে তাকানোর সাহস।
পাড়াপ্রতিবেশিরা বৃষ্টির মধ্যেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আলাপ আলোচনা করছে।কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসার মতো দুই মেয়ের এই কীর্তি কালাপের জন্য সবাই দোষারোপ করছে সিরাজ হায়দার আর সালমা কে।

সুরাইয়া বেগম এই সুযোগে মজলিস গড়িয়ে ফেলেছেন। সবাইকে পানের খিলি হাতে হাতে দিচ্ছেন আর নিচু গলায় ষড়যন্ত্রের ভঙ্গিতে বলছেন,”আমার সিরাজের কোনো দোস নাই গো সবুজের মা।আমার পোলা কর্মজীবী মানুষ। তার কি সময় আছে ঘরে বইসা থাইকা মাইয়াগো খবর নেওনের?
এক মুখ স্বর্ণ দিয়া ও পূরণ করা যায়, কিন্তু এতো গুলা মুখ যে আমার পোলার ছাই দিয়া ও ভরাইতে পারে না।কই থেইকা এই মহিলা বিয়া কইরা আনছে আমার সিরাইজ্যা গো বুজি,একটা পোলা জন্ম দিতে পারে নাই এই মহিলা।
তার উপর মাইয়াগোরে ও বানাইছে নিজের মতন।গেরামে মুখ দেখানোর জায়গা নাই আমাগো।”

আশপাশের সবাই সায় দিতে লাগলো সুরাইয়া বেগমের কথায়।
সালমা পাথরের মুর্তির মতো বসে রইলো। সিরাজ হায়দারের মনে হচ্ছে মেয়েরা তার মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে।সমাজে মাথা তুলে দাঁড়ানোর সেই শিরদাঁড়া আর তার নাই।

রূপা বসে বসে কাঁদছে।কি থেকে কি হয়ে গেলো। কিছুই মাথায় ঢুকছে না তার।

————–

সকাল বেলা রূপা স্কুলের জামা গায়ে দিয়ে রেডি হতে লাগলো স্কুলের জন্য। সালমা হঠাৎ করে ছুটে এসে রূপার স্কুল ড্রেস নিয়ে টানতে লাগলো আর পাগলের মতো চিৎকার করে বললো, “লাগবো না স্কুল যাওন,লাগবো না পড়ালেখা করন আর।মুখে আর চুনকালি দিস না তোরা।ঘরে থাকবি আমার লগে কাম করবি।স্কুল যাইতে দিমু না আমি আর কাউরে।স্কুল যাইয়া যাইয়া সবগুলো ** হইবি।ভালা হইবি না,বোইনেগো মতই হইবি।”

সিরাজ হায়দার এসে সালমা কে সরিয়ে দিয়ে বললো, “সালমা চুপ কর।রূপারে স্কুলে যাইতে দাও।”

সালমা শুনলো না।সিরাজ হায়দারের হাত থেকে ছুটে এসে রূপাকে একটা ধাক্কা দিয়ে বললো, “না যাবি না তুই।স্কুল যাইতে পারবি না।”

মায়ের ধাক্কা খেয়ে রূপা গিয়ে পড়লো পড়ার টেবিলের উপর। টেবিলের কোণের সাথে লেগে রূপার ঠোঁট কে/টে গেলো। জিহবায় নোনা স্বাদ পেতেই রূপা বুঝতে পারলো ঠোঁট কে/টে গেছে তার। মায়ের মনের অবস্থা রূপা বুঝতে পারলো। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ঠোঁট মুছে রূপা বের হয়ে গেলো।
পিছনে সালমা চিৎকার করে বললো, “আল্লাহ যাতে তোরে ও আর ফিরাইয়া না আনে রূপা।আমি মনে করমু আমি বাঁজা মহিলা।আমার কোনো সন্তান নাই।আমার কেউ নাই।আমার কিচ্ছু নাই এই দুনিয়ায়। ”

সালমা কাঁদতে কাঁদতে উঠানের কাদামাটিতে গড়াগড়ি খেলো।তার বুকের ভেতর কি যে বেদনা তা কেউ বুঝবে না।অল্প সময়ের ব্যবধানে যার দুই মেয়েই ঘরে ছাড়ে সেই মায়ের ব্যথা বুঝার সাধ্য কারো নাই।

সিরাজ হায়দার এসে সালমাকে তুলে ঘরের বারান্দায় নিতেই সালমা সিরাজ হায়দারের শার্ট চেপে ধরে বললেন,”ক্যান দিলেন আপনি?
ক্যান দিলেন ওরে যাইতে?
ও যদি একই কাম করে তাইলে বাঁচতে পারবেন?গলায় রশি দেওন ছাড়া আর উপায় থাকবো?এরা সব এক।এ ও একই পথেই হাটবো।কেনো যাইতে দিলেন?”

সিরাজ হায়দার সালমার দিকে তাকিয়ে বললো, “মনে করো আমি জুয়া খেলায় নামছি সালমা।আমার রূপা হচ্ছে আমার প্রাণ। জীবনের এই জুয়া খেলায় আমি এই বার আমার প্রাণ বাজি ধরছি।আমার রূপার চোখে আমি আমার লাইগা ভালোবাসা দেখছি সালমা।এই ভুল ও করবো না।”

সালমা বিশ্বাস করতে পারলো না। বিড়বিড় করে বললো, “আমি বিশ্বাস করি না।আমি ওরে পড়তে দিমু না আর।কিছুতেই না।”

সিরাজ হায়দার বুঝলেন সালমা এটা নিয়ে দীর্ঘ দিন ঝামেলা করবে।

সুরাইয়া বেগম বারান্দায় বসে পানের খিলি সাজাচ্ছেন। ছেলেকে ডেকে বললেন,”বহুত হইছে সিরাজ।দুই মাইয়ারে দিয়ে তো মুখে চুনকালি ছাড়া অন্য কিছু পড়ে নাই। এবার সময় থাকতেই ওরে সামলানোর চেষ্টা কর।আর লাগবো না রূপার স্কুল যাওন।তুই ওরে বিয়া দিয়ে দে।”

সিরাজ হায়দার হাসলেন মায়ের কথা শুনে। তারপর বললেন,”মা আমার মাইয়া যতটুকু পড়ালেখা করতে চায় আমি ওরে সেই সুযোগ দিমু।দরকার হইলে শরীলের রক্ত বিক্রি করমু।হাতের ৫ আঙুল যেমন সমান অয় না,সব সন্তান ও সমান অয় না।আর যদি কোনো দিন রূপা ও ওর বোইনেগো দেখানো পথে হাটে তাইলে আমি তা আমার ভাগ্যের লিখন বইলা মাইন্না নিমু।কিন্তু আমার মাইয়ারে আমি ডানা কাটা পাখির মতো খাঁচায় আটকায়া রাখমু না।”

সুরাইয়া বেগম বিরক্ত হলেন ছেলের কথা শুনে।

————–

জুয়েল ফিরলো আটদিনের মাথায়।তবে একা ফেরে নি সাথে নিয়ে এসেছে ৬ বছরের একটা ছেলেকে।
অন্তরা তখন টেবিলে মাথা রেখে স্মৃতিচারন করছিলো বাবা মায়ের।আজ কতো দিন হলো বাবা মা’কে দেখে না!

জুয়েলেকে দেখে অন্তরা ঝাঁপিয়ে পড়লো জুয়েলের বুকে।নাকের জল চোখের জল মিশিয়ে কান্নায় যখন অন্তরা মগ্ন জুয়েল বিব্রত হয়ে বললো, “রানা দেখছে অন্তরা।”

প্রথমে অন্তরা বুঝতে পারলো না জুয়েলের কথা।মাথা তুলে জুয়েলের পেছনে তাকাতেই দেখতে পেলো বছর ছয়েকের একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে জুয়েলের পিছনে। ছেলেটার ভ্রুকুটি বলে দিচ্ছে অন্তরা কে সে প্রত্যাশা করে নি এখানে।
চমকে অন্তরা জিজ্ঞেস করলো, “কে ও?”

জুয়েল সহাস্যে জবাব দিলো, “আমার ছেলে রানা।”

অন্তরার মাথায় যেনো বাজ পড়লো। মাথা ঘুরতে লাগলো অন্তরার।কিছুতেই বিশ্বাস হলো না জুয়েলের কথা।অন্তরা ভাবলো জুয়েল মজা করছে।তাই আবারও জিজ্ঞেস করলো, “সত্যি করে বলো জুয়েল,কে ও?”

জুয়েল হেসে বললো, “ও আমার ছেলে অন্তরা।আমার ছেলে রানা।আমার প্রথম পক্ষের স্ত্রীর ছেলে।”

অন্তরা সত্যি সত্যি জ্ঞান হারালো জুয়েলের কথা শুনে তখন।

কিছুক্ষণ পর অন্তরার জ্ঞান ফিরতেই জুয়েল বললো, “আমাকে ভুল বুঝো না অন্তরা।আমি তোমার কাছে রানার মায়ের কথা লুকিয়েছি।তোমাকে দেখার পর আমার ভালো মন্দ বিচার বিবেচনার ক্ষমতা হারিয়ে গিয়েছিল। আমার শুধু মনে হয়েছিলো যে কোনো মূল্যে হোক আমার তোমাকে চাই।তাই আসলে আমি রেশমার কথা তোমাকে বলি নি।আমার প্রথম স্ত্রীর নাম রেশমা।আরো এক বছর আগে রেশমা ওর ফুফাতো ভাইয়ের হাত ধরে আমার ছেলেকে রেখে পালিয়ে যায়। এতো দিন রানা আমার মা বাবার কাছে ছিলো কিন্তু ওনারা ওকে এখন আর রাখতে পারতেছে না।মা মা বলে ছেলেটা সবসময় কান্না করে। তাই আমি গিয়ে নিয়ে আসছি। তুমি আমার স্ত্রী অন্তরা,আমার ছেলেটার মা কি তুমি হবে না?”

অন্তরা ভেবে পেলো না কি করবে সে আর কি বলবে।তার সবকিছু মিথ্যে বলে মনে হচ্ছে। জুয়েলের আগে একটা সংসার আছে তা জানলে কি অন্তরা কখনো আসতো জুয়েলের কাছে? কখনো না।

রানা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখি অন্তরার দিকে।জুয়েলের প্রতি অভিমান নিয়ে অন্তরা রানার হাত ধরলো। তারপর নিজেদের বেডরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো।
বাহিরে থেকে জুয়েল স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ভাবলো, “যাক,কোনো মতে সামলানো গেছে।”

রানাকে একটা আপেল খেতে দিয়ে অন্তরা শূন্যে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো, “দু’দিন আগেও মনে হয়েছে সে সবচেয়ে সুখী অথচ আজ মনে হচ্ছে সবচেয়ে জনমদুঃখী বুঝি যে নিজে।”

মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো, খুব সহজে জুয়েলকে সে ক্ষমা করবে না এই প্রতারণার করার জন্য।
কিছুতেই না।

জুয়েল রানা কে রেখে বাজারে ছুটলো। ছেলে জুয়েলের প্রাণ। মা ফোন করে যেদিন জানিয়েছে রানা কান্না করছে মায়ের জন্য সেদিন আর এক মুহূর্ত ও দেরি করে নি জুয়েল।
ছেলের জন্য সবকিছু করতে রাজি আছে জুয়েল।ছেলের পছন্দ মতো খাবার দাবার কিনে নিলো জুয়েল।

চলবে

রাজিয়া রহমান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here