#তুমি_অপরূপা (৩০)
অন্তরা আর রেশমা একা বাসায় আজ তিন দিন হলো। জুয়েল গ্রামের বাড়ি গিয়েছে। অন্তরার মনে মনে খুশির জোয়ার।জুয়েল রেশমাকে ডিভোর্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এজন্যেই তার গ্রামে যাওয়া।
জুয়েক বাড়ি গিয়ে বাবা মায়ের সাথে কথা বললো । জুয়েলের মা জমিলা বানু ভীষণ হিসেবি মানুষ। ছেলের কথা শুনে তিনি আর্তনাদ করে উঠলেন।শেষে কি-না জায়গাজমি বেচে বউ বিদায় করতে হবে?
জুয়েলের বাবা কিছু বলার আগে তিনি বললেন,”অসম্ভব এইডা।আমি কিছুতেই এরকম কিছু হইতে দিমু না।মগের মুল্লুক নি? এই জায়গা জমি করতে শরীরের রক্ত পানি করছি আমি।আমি কিছুতেই এসব করতে দিমু না।তাছাড়া ভুল মানুষেই করে। শয়তান আছেই তো মানুষরে দিয়া ভুল করানোর জন্যে। যা হইবার হইছে।ওরে তো ঘরে তুলছস।তাইলে এখন আবার এতো নাটক কিসের?তাছাড়া তোর পোলার কথা ও তো ভাবতে হইবো। পোলার মুখের দিকে তাকাইয়া হইলেও এখন এমন কিছু করিস না যাতে পোলার কাছে তুই অপরাধী হইয়া যাস।
এই বয়স সারাজীবন থাকবো না।তারপর আমাগো মতো বয়সে আইলে পোলাপানের কাছে যাওন লাগবো। তখন যদি তোর পোলা মুখ ফিরাইয়া নেয়?
নতুন যারে বিয়া করছস তার তো সন্তানাদির কোনো খবর নাই।আল্লাহ নারাজ হইয়া যদি তোরে আর সন্তান না দেয় তখন বুড়াকালে তোর কি হইবো জুয়েল,?
তোরা ভাইয়েগো সবার ৩-৪ টা পোলাপান, তোর তো এই একজনই।তারে যদি তুই এখন খেদাইয়া দেস,আল্লাহ তোরে মাফ করবো না।”
জুয়েলের মাথা ঘুরতে লাগলো এসব শুনে। মা যা বলেছে তা শুনতে খারাপ লাগলেও সত্যি।অন্তরাকে তো রানার জন্যই আনা হয়েছে মূলত। সেখানে যদি রানাকেই ত্যাগ করতে হয় তবে জুয়েল কিভাবে থাকবে?
অন্তরার মোহে পড়ে কিভাবে ছেলেকে ভুলে গেলো সে!
চোখের সামনে রানার সহজ সরল মুখখানা ভেসে উঠলো । জুয়েলের সিদ্ধান্ত বদলে গেলো সেই মুহুর্তে। না,কিছতেই সে রেশমাকে ডিভোর্স দিবে না।দু’জনকে রাখবে সে।কতো মানুষের তো দুই বউ একসাথে থাকে।তার থাকলে কি অসুবিধা!
জুয়েল সিদ্ধান্ত নিলো একটু কঠোর হবে দুজনের সাথে। তাহলে দুজনেই মিলেমিশে থাকবে ভয়ে।
————–
রূপকের দুই চোখে জিজ্ঞাসা। রূপা থম মেরে আছে। কিছুতেই হিসেব মিলাতে পারছে না সে।
একটা জীবন যেই নানাবাড়ি, মামাবাড়ির গল্প শুনেছে তা তাদের ও আছে?
এটা স্বপ্ন নয়তো!
মাথা ঝিমঝিম করছে। রূপক উৎকণ্ঠিত হয়ে বললো, “বলো রূপা,আমার ফুফুর ঠিকানাটা আমাকে বলো প্লিজ।আমার আর ধৈর্যের পরীক্ষা নিও না।”
রূপা কিছুটা ভেবে বললো, “আমি আগে তাদের অনুমতি নিতে হবে তারা আপনার কাছে তাদের পরিচয়, ঠিকানা দিতে অনুমতি দিলে তারপর আমি আপনাকে বলবো।তার আগে আমি কিছুতেই বলতে পারবো না। ”
রূপক অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। এই মেয়েটা এতো কঠোর!
রূপকের এই ব্যাকুলতা, এই অনুরোধ কিছুই তাকে কাবু করতে পারছে না। সে এখনো তার কথায় স্থির।
রূপা ফোন নিয়ে বারান্দায় উঠে গেলো। বাবাকে কল দিলো। সিরাজ হায়দার দোকানে বসে ঝিমাচ্ছে। বিক্রি বাট্টা নেই তেমন একটা। তাই ঝিমানো ছাড়া উপায় নেই।
রূপার ফোন আসতেই তাড়াতাড়ি রিসিভ করলেন।সালাম দিয়ে রূপা বললো, “আব্বা,আমি একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম তাই আপনার কল রিসিভ করতে পারি নি।এখন ঠিক আছি।”
সিরাজ হায়দারের চিন্তা হলো মেয়ের অসুস্থতার কথা শুনে। জিজ্ঞেস করলেন, “ঔষধ খাচ্ছিস তো মা?”
রূপা হেসে বললো, “হ্যাঁ আব্বা।খাচ্ছি।আব্বা একটা কথা বলতাম?”
“কি কথা?”
আমি মায়ের বাবার বাড়ির সন্ধান পেয়েছি বাবা।মা’য়ের বাবার বাড়ির দিক থেকে মা’কে খোঁজার অনেক চেষ্টা তারা করেছে, এখনো করছে।আমি কি জানাবো মা’য়ের কথা? ”
সিরাজ হায়দার চুপ থেকে বললেন,”না।বলবি না মা।আমি তাদের সুস্থ মেয়ে এনেছি।তোর মা’কে ওরা এখন দেখলে আমি সবার কাছে ছোট হয়ে যাব।ওরা সবাই জানবে আমি তোর মায়ের যোগ্য না।আমি আসলেও তো তোর মায়ের যোগ্য না রে মা।আমাকে আর ছোট করিস না ওদের কাছে।”
রূপা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, “ঠিক আছে আব্বা।”
ভেতরে আসার সাথে সাথে রূপক বললো, “কি বললো রূপা?এবার তো বলো ঠিকানা। ”
রূপা মাথা নিচু করে বললো, “আমি পারবো না রূপকদা।আমি কিছুতেই তাদের খোঁজ দিতে পারবো না।আমাকে ক্ষমা করবেন।”
রূপক হতবাক হলো। আশার প্রদীপ জ্বলে এভাবে নিভে যাবে রূপক তা ভাবে নি।রূপক যেভাবেই হোক ফুফুর সন্ধান চায়।যেই দায়িত্ব তাকে দাদামশাই দিয়ে গেছেন তা তাকে সঠিকভাবে পালন করতেই হবে।
রূপক কিছু বলার আগেই রূপা চলে গেলো নিজেদের রুমে।
রূপা এখনো ভেবে পাচ্ছে না এরকম কাকতালীয় ঘটনা ও ঘটে!
কখনো কি ভেবেছে রূপা কোনো দিন এভাবে তাদের সন্ধান পাবে!
রূপা চলে আসতেই রূপক উঠে দাঁড়ালো। মাথায় রোখ চেপেছে তার।রূপা জানে তার ফুফুর খবর। রূপার কথা শুনে যতটা বুঝেছে অবশ্যই রূপার বাড়ির সাথে সম্পর্কিত কেউ।কিছুক্ষণ চুপ করে ভেবে রূপক পান্নাকে ডেকে পাঠালো।তারপর বললো রূপার রুমে গিয়ে এক সুযোগে দেখে নিতে রূপা কাকে কল করেছিলো কিছুক্ষণ আগে।সেই নাম্বারটাও টুকে নিয়ে আসতে।
দাদার কথামতো পান্না রূপার রুমে গেলো। রূপা ততক্ষণে গোসল সেরে চুল শুকাচ্ছে।এদিক ওদিক তাকিয়ে পান্না রূপার ফোন খুঁজলো।রূপা পান্নাকে দেখে মুচকি হেসে বললো, “তুই রুমে বস,আমি একটু চুল শুকিয়ে নিই।”
পান্না বললো, “একটু তোর ফোনটা দে তো রূপা।আপাকে একটা কল দিবো।আপা একটু বাহিরে গিয়েছে। ”
ফোন দিতে গিয়ে রূপার সন্দেহ হলো। রূপকদা বাসায় থাকতে রত্না বাহিরে বের হবে?
এটা তো অসম্ভব!
তাছাড়া যদি বের হয় ও,রূপকদা থাকতে পান্না রূপার ফোন থেকে কল দিতে এলো কেনো!
তাহলে কি?
সন্দেহ ঘনীভূত হলো রূপার। ডায়াল থেকে আজকের সকল নাম্বার ডিলিট করে দিলো।তারপর ফোনটা দিলো পান্নাকে।
রূপা বারান্দায় যেতেই পান্না কললিস্ট চেক করতে লাগলো। ডায়ালে ঢুকে পুরোপুরি হতাশ হলো পান্না।আজকে কারো কাছে কল দেয় নি রূপা।আজকের লিস্টে কারো নাম নেই।নাম্বার ও নেই। তাহলে কি রূপা নাম্বার ডিলিট করে দিয়েছে?
মন খারাপ হয়ে গেলো পান্নার। দাদা এখন কি বলবে তাকে!
একটা কাজ সে করতে পারলো না দাদার জন্য। কার নাম্বার নিবে এখন সে?
অগত্যা রূপার ফোনটা নিয়েই দাদার কাছে চলে গেলো।
রূপক কল লিস্ট ঘেঁটে দেখলো আজকের সব নাম্বার ডিলিট করা। আশাহত হয়ে বসে রইলো রূপক। মাথার মধ্যে ঝড়েরবেগে হিসেবনিকেশ চলছে।
হঠাৎ করেই রূপকের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো।
পান্না দাদাকে হাসতে দেখে বললো, “কি হলো দাদা?”
রূপক হেসে বললো, “রূপা ভীষণ স্মার্ট বুঝলি।তবে আমি ও ছেড়ে দেবার মানুষ না।কষ্ট হবে একটু আমার তবে ঠিক বের করে ফেলবো।এই দেখ।
এখানে আজকে ছাড়া অন্য সব দিনের নাম্বার আছে।তার মানে এখানের এই নাম্বারগুলোতে আজকে রূপা কল দেয় নি। সিরিয়ালে সব নাম লিখে ফেল তো।”
পান্না লিখে নিলো।রূপক এবার বললো, “এই দেখ, রূপার কন্টাক্ট লিস্ট। অল্প কয়েকটা নাম্বার। ওর বাবার নাম্বার, ওর ফুফুর নাম্বার, রত্নার নাম্বার, আমার নাম্বার। এগুলো ওর মেসের মেয়েদের নাম্বার। আর দেখ,এগুলো হচ্ছে ওর কলেজের ক্লাসের মেয়েদের নাম্বার। সবার নামের সাথে কলেজ লিখা আছে। ওর কললিস্টে ওর বাবা,ফুফু ছাড়া সবার নাম্বার আছে যাদের সাথে ও আজকের দিন ব্যতীত আগে কথা বলেছে।এবার বল,রূপা বাড়ি গেলো, বাড়ি থেকে আসলো। ওর তো নিশ্চয় বাড়িতে কথা বলা হয়েছে। অন্তত ও যে এসেছে ঠিকঠাকভাবে অথবা ও অসুস্থ এসব তো জানানোর ছিলো কাউকে।তাহলে নিশ্চয় জানিয়েছে তাই না?
কিন্তু দেখ ওর কললিস্টে কোথাও নেই বাড়ির নাম্বার। তার মানে কি?
এবার ভেবে বল,রূপা তো এই শহরে নতুন এসেছে। আর আমাদের বাসার আগে অন্য কোথাও ওর বেশি দিন থাকা হয় নি।তাছাড়া ওর এক্সপ্রেশন দেখে মনে হয়েছে ফুফু ওর ভীষণ চেনা কেউ।
ওর গ্রামে যেতে হবে আমার। সব রহস্য রূপার গ্রামে।”
পান্নার মাথা ঘুরতে লাগলো। আসলেই তো দাদার এক্সপ্লেইন তো ঠিক।
রূপক ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠলো। মুচকে যাওয়া পা নিয়ে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে ব্যথা পেলো ভীষণভাবে।তবুও উঠলো। রূপার গ্রামের বাড়ির ঠিকানা জোগাড় করতে হবে এবার।
পান্না বললো, “দাদা,রূপাদের বাড়ি কিভাবে খুঁজে পাবি?আমার তো মনে হয় না ও ওর ঠিকানা আমাদের দিবে।”
রূপক হেসে বললো, “সেই ব্যবস্থা আমি করে নিবো।ওর থেকে ঠিকানা নেওয়া লাগবে না।”
রূপক ফুরফুরে মনে উঠে গেলো। ফোনে রূপার বাবার আর ফুফুর নাম্বার সেভ করে নিয়েছে। এবার আগামীকাল ওদের গ্রামে যাবে।
চলবে…..
রাজিয়া রহমান