#তুমি_অপরূপা (৩১)
জুয়েল গ্রাম থেকে বাসায় ফিরলো যখন তখন প্রকৃতিতে সন্ধ্যা নামি নামি করছে।সাঁঝের মায়াবী আকাশের তাকিয়ে অন্তরা ভাবছে ভবিষ্যতের কথা। জুয়েল বলেছে আজ ফিরবে। তারপর?
তারপর জুয়েল ফিরে এলে শুধু ভালোবাসা আর ভালোবাসা থাকবে দুজনের মধ্যে। তৃতীয় কেউ থাকবে না।অন্তরার দিবা স্বপ্ন বেশি সময় দেখার সুযোগ হলো না।হয়তো এই স্বপ্ন পূর্ণ হবে না বলেই শুনতে পেলো বাহিরে রানার হুটোপুটি।
এতোক্ষণ অন্তরা তার রুমের জানালা দিয়ে আকাশ দেখছিলো আর ভাবছিলো।
রানার জন্য মন খারাপ করবে ভীষণ। অন্তরা বাহিরে বের হতেই দেখলো জুয়েল এদেছে।ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসে আছে।
রেশমা জুয়েলের জন্য লেবুর শরবত করছে।
অন্তরার কেমন যেনো লাগলো এই দৃশ্য দেখে। বুকের ভেতর চুরমার অথব মুখে রাজ্যের শীতলতা।
রেশমা গলায় মধু ঢেলে বললো, “আব্বা,আম্মা কেমন আছেন?
ভাই,ভাবী,বড় আপা ওনাদের সবার অবস্থা কেমন? ”
জুয়েল স্বাভাবিক স্বরে বললো, “ভালো আছে সবাই।”
অন্তরার মন আর মানলো না।সে যে পেছনে দাঁড়িয়ে আছে জুয়েল দেখে নি,রেশমা দেখেছে।রেশমা দেখে ও না দেখার ভান করে আছে।যাতে জুয়েল তার সাথে এরকম সহজভাবে কথা বলে। অন্তরা শুনুক ভালো করে যে,যতই রূপসী হোক অন্তরা, রেশমার প্রতি জুয়েলের দুর্বলতা থাকবেই।
রেশমা আবারও জিজ্ঞেস করলো, “আব্বার কি এখনো শ্বাসের সমস্যা হয়?ইনহেলার নেন নাই এবার?”
জুয়েল জবাব দিলো, “নিছি,আব্বার ইনহেলার, মা’র জন্যে শান্তিপুরি জর্দা ছাড়া কি বাড়িত যাওন যায়!”
রেশমা হেসে বললো, “আপনের মনে আছে, একবার আম্মার জন্যে শান্তিপুরি জর্দা নেন নাই, সেই বার আম্মার সে কি রাগ আপনের উপরে!”
জুয়েল হেসে ফেললো। সেবার মায়ের জন্য জর্দা নিতে ভুলে যাওয়ায় দুই দিন তিনি ছেলের সাথে রাগ করে কথা বলে নি। পরে জুয়েল ঢাকায় এসে এক বন্ধুকে দিয়ে ১০টা জর্দা পাঠায়।
অন্তরার হাত পা কেমন অসাড় হয়ে এলো।অন্তরার মন কু ডাক ডাকতে লাগলো। ধীর পায়ে অন্তরা রুমের দিকে এগিয়ে যায়।
জুয়েল রুমে এলো বেশ কিছুক্ষণ পর। অন্তরার মন ততক্ষণে বিমর্ষ। গায়ের কাপড় পালটে জুয়েল বললো, ”
কি হইছে,এভাবে বসে আছো কেনো?”
অন্তরা জবাব দিলো, “এমনি ভালো লাগছে না।”
জুয়েল বিরক্ত হলো। বাসায় এসেছে, কোথায় অন্তরা আনন্দে জ্বলজ্বল করবে তা না মনমরা হয়ে বসে আছে। অথচ রেশমা কেমন স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে কথা বলছে।
বিরক্ত হয়ে বললো, বাসায় আসলাম, কোথায় হাসিখুশি হয়ে কথা কইবা তা না এমনভাবে কথা কইতাছো যেনো তোমারে তিন দিন খাইতে দেয় নাই।”
অন্তরার ভীষণ রাগ হলো। একে তো তাকে প্রতিনিয়ত ঠকাচ্ছে তার উপর আবার উল্টো রাগ দেখাচ্ছে।
রেগে গিয়ে অন্তরা বললো, “হাসিমুখে কথা বলার মানুষের তো অভাব নাই।আমি না বললেও চলবে।”
কে জানে কেনো জুয়েলের ও মেজাজ বিগড়ে গেলো। হয়তো বাড়িতে গিয়ে মায়ের ব্রেইন ওয়াশ,বাসায় এসে রেশমার আন্তরিকতা, অন্তরার গোমড়া মুখ।সব মিলিয়ে অত্যন্ত কঠোর স্বরে বললো জুয়েল বললো, “সোজা কথা সোজা ভাবে বলতে পারো না না-কি? দিন দিন ব্যবহার এতো বাজে হচ্ছে ক্যান?”
“বাসায় ঢুকেই তো মধুর ব্যবহার দিয়ে তোমার প্রাণ জুড়িয়ে দিয়েছে একজন, আমার ব্যবহার এজন্য এখন খারাপই লাগবে।”
জুয়েলের কি হলো কে জানে।অন্তরার হাত মুচকে ধরে বললো, “দিন দিন পাংখা গজাইতেছে না?
না-কি এতোদিন নরম ব্যবহার করছি দেইখা ভাবছস আমারে হাতের মুঠোয় কইরা নাচাবি?এসব স্বপ্ন দেইখা থাকলে ভুইলা যাইও।আর আরেকটা কথা মন দিয়া শুইনা রাখো,যারে ইংগিত কইরা এসব কথা কইতেছো,তার সাথেই থাকতে হইবো।আমি কোনো কোটিপতি না যে টাকাপয়সা খরচ কইরা বড় বউরে বিদায় দিমু।বিয়ে হইছে এতো দিন হইছে এখনো একটা সুখবর শুনাইতে পারলা না।তার আবার চ্যাটাং চ্যাটাং কথা! ”
জুয়েল ভেবেছিলো আস্তে ধীরে অন্তরাকে শান্ত মাথায় বুঝিয়ে বলবে সব।কিন্তু হটাৎ কি হলো বুঝতে পারলো না। হুট করেই মাথা গরম হয়ে উল্টো পাল্টা কথা বলতে লাগলো। যার ফলস্বরুপ অন্তরাকে এসব বলে ফেললো।
অন্তরার মনে হলো বুকের উপর কেউ একটা দশমণি পাথর তুলে দিয়েছে। এই কোন রূপ দেখছে সে জুয়েলের!
এই তার ভালোবাসার মানুষ!
অন্তরা কাঁদলো না। সবার জন্য চোখের জল ফেলতে নেই। বিশেষ করে যারা এর মূল্য জানে না।
জুয়েল রাগান্বিত হয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। অন্তরা রুমে বসে রইলো। রাতটা এভাবেই কেটে গেলো । জুয়েল রুমে আসে নি রাগ করে, অন্তরা ও ডাকে নি জুয়েলকে।
পরদিন কাক ডাকা ভোরে অন্তরা উঠে বের হয়ে গেলো একটা ছোট চিরকুট লিখে।জুয়েল তখন ফ্লোরে একপাশে শুয়ে আছে। রেশমা ছেলেকে নিয়ে অন্যখানে।
অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হতে জুয়েল রুমে গিয়ে দেখে অন্তরা নেই।একটু অবাক হলো জুয়েল।অন্তরা কোথায় গেলো।বিছানার উপর ছোট একটা কাগজ ভাঁজ করে রাখা।জুয়েল খুলে দেখে লিখা,”ভালোবাসা ছাড়া কোনো কিছু চাই নি তোমার কাছে ,যতদিন আমার জন্য ভালোবাসা ছিলো ততদিন তুমি একান্ত আমার ছিলে।আজ ভালোবাসা ভাগ হয়ে গেছে, আজ তুমি ও তাই আমার নেই। ভাগ করে তো ভালোবাসি নি,তাই ভাগের সংসার করতে পারলাম না।ক্ষমা করে দিও। ভালো থেকো স্ত্রী সন্তান নিয়ে।”
জুয়েল বিরক্ত হয়ে বললো, “যতসব নাটক।দুই দিন ঠিকই ফিরে আসবো। ”
কাউকে কিছু না বলে জুয়েল চলে গেলো অফিসে। অন্তরা বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হলো। এটুকু বুঝেছে অন্তরা এই নির্মম পৃথিবীতে বাবা মা ছাড়া কেউ নেই স্বার্থহীন ভাবে ভালোবাসার।
————–
পরদিন খুব সকালেই স্টেশনে গিয়ে রূপক বাসের খোঁজ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো রূপা সেদিন কোন জায়গার টিকিট কেটেছে।
একা সুন্দরী মেয়ে ট্রাভেল করলে সবাই একটু বেশি মনযোগ দেয়।তেমনই অপরূপার কথা ও কাউন্টারে বসা ছেলেটার মনে ছিলো। রূপক জিজ্ঞেস করতেই একটূ ভেবে বলে দেয়।রূপক ও টিকিট কেটে অপেক্ষা করে বাসের।
কিছুক্ষণ পর বাস এলো। নিজের সীট খুঁজতে খুঁজতে এগিয়ে গিয়ে দেখে তার সীটে একটা মেয়ে বসে আছে । ওড়না দিয়ে মুখটা ঢেকে রাখা।
রূপক গলা খাঁকারি দিয়ে বললো, “ওই সীটটা আমার। ”
অন্তরা উঠে বের হয়ে দাঁড়িয়ে রূপককে ভেতরে যাওয়ার জায়গা দিলো।নিজের সীটে বসতে গিয়ে রূপক থমকে দাঁড়ালো। তারপর বললো, “আপনার মনে হয় জানালার পাশের সীট পছন্দ। তাহলে আপনি বসতে পারেন।”
অন্তরা কথা বাড়ালো না। বসে পড়লো আগের জায়গায় ধপ করে। রূপক কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো সেদিকে। কিছুক্ষণ পর ব্যাগ থেকে একটা জয়ট্রিপ ঔষধ বের করে, পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বললো, “আপনার মনে হয় বমির সমস্যা আছে বাসে উঠলে।এখান থেকে একটা ঔষধ খেয়ে নিন তাহলে ভালো লাগবে।”
অন্তরার আসলেও ভীষণ খারাপ লাগছে।তাই দ্বিধা করে নি আর।রূপকের থেকে ঔষধ নিয়ে খেয়ে নিলো। অন্তরা মুখ ঢেকে রাখতে চাইছে দেখে রূপক ও অন্তরা ঔষধ খাওয়ার সময় অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো।
অনেকক্ষণ পর বাস চলতে লাগলো। সারারাত না ঘুমানোয় অন্তরা ঘুমিয়ে গেলো।রূপক কিছুটা দূরত্ব রেখে বসলো। হাতে থাকা পেপারটা আবারও মনোযোগ দিয়ে পড়তে লাগলো।
বুকের মধ্যে অস্থিরতা। পাবে তো শেষ পর্যন্ত ফুফুকে?
দেরি হয়ে যাবে না তো!
কোনো অসুবিধা হবে না তো!
দাদা যেই দায়িত্ব দিয়ে গেছেন তা পালন করতে পারবে তো?
বেশ অনেকক্ষণ বাস চলার পর অন্তরার ঘুম ভেঙে গেলো হঠাৎ করে। আচমকা অন্তরা ভেবে পেলো না সে কোথায়,যাচ্ছে কোথায়।
ধরমড়িয়ে উঠে বসে বললো, “কোথায় আমি?কোথায় যাচ্ছি? ”
রূপক অন্তরার দিকে তাকিয়ে বলতে গিয়ে থেমে গেলো। এ কাকে দেখছে সে!
এ-তো রূপা বসে আছে যেনো।একই রকম নাক,চোখ।
বিড়বিড় করে রূপক বললো, “রূপা তুমি? ”
অন্তরা চমকে উঠে বললো, “রূপা?অপরূপা? আমার ছোট বোন?আপনি চেনেন কিভাবে?”
রূপকের হাসি পেলো। সেই সাথে স্বস্তি ও লাগলো। যাক বাবা,এবার আর চিন্তা নেই।রূপার বোনকে যখন পাওয়া গেছে তখন ফুফুকে বের করা টাফ হবে না রূপা যেহেতু চিনে রূপার বোন ও ফুফুকে চিনবে।
চলবে…..
রাজিয়া রহমান