ফানাহ্ 🖤 #পর্বসংখ্যা_৩৬ #হুমাইরা_হাসান

0
468

#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৩৬
#হুমাইরা_হাসান

প্রচন্ড রকম থমথমে একটা বাতাবরণ ঘরটা জুড়ে। পিনপতন নীরবতায় শুধু তিনটে মানুষের ফোঁসফোঁস নিঃশ্বাসের শব্দই কানে আসছে।
ভীষণ আতঙ্কে শঙ্কিত বুকটার ধুকপুকানির চিৎকার নিজ কানেই বাজছে মোহরের। এই মুহূর্তে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার মতো কাজটা অতীব দুঃসহ হলেও তাছাড়া আর কোনো উপায় ও নেই৷

গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলো মোহর, বিছানার এক কোণায় মূঢ়মূর্তির ন্যায় স্থবির চিত্তে বসে আছে তাথই। দৃষ্টি, বোধশক্তি সবটাই শূন্যের কোঠায় পৌঁছে এখন স্তব্ধ, নিরেট, স্থূলবুদ্ধির ন্যায় ভাবাবয়বে পরিপূর্ণ করেছে।
আলতো ভাবে হাতটা তাথইয়ের ঘাড়ে রাখলো মোহর, বড়সড় একটা ঢোক গিলে বাচনভঙ্গি স্বাভাবিক রাখার তীব্র প্রচেষ্টায় খসখসে গলায় বলল

– আপা? তুমি এভাবে কেনো বসে আছো?কথা বলো?

তাথইয়ের নিরুত্তর ভাবাব্যক্তি মোহরকে আরও ভীষণ চিন্তায় ফেলছে। শুকনো মুখে একবার সামনের পুরুষাবয়বের দিকে তাকালো। কাঠকাঠ, তীক্ষ্ণতা উপচে পড়ছে চেহারাতে, একটু আগেই দেখা সেই ফরমাল গেট-আপ টার অবিন্যস্ত আর বিধ্বস্ত অবস্থাটা যতটা না, তার চেয়ে বেশি নাজেহাল মুখাবয়ব। স্থির, অনড় দাঁড়িয়ে তাথইয়ের দিকে দৃষ্টিক্ষেপণ করে রেখেছে।
মোহর তাথইয়ের ঘাড়ে রাখা হাতটার চাপ আরেকটু গাঢ় করে বলল

– আপা, তুমি এভাবে চুপ করে থেকো না? কিছু তো বলো?

– কি বলবো আমি? বলার মতো কিছু কি রয়েছে? ওকে কে বলেছিলো আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে মাথা ঘামাতে, ওকে কে বলেছিলো আমার স্বামীর গায়ে হাত তুলতে?

নীরবতা চিরে অস্থির, রেশপূর্ণ কথাগুলো ভীষণ ঘৃণা, আর ক্ষোভ মিশ্রিত শোনালো। তবুও তাতে একচুল অপমানবোধ করলো না পৃথক। বরং আরও কয়েক কদম এগিয়ে এসে বলল

– তুমি কোন স্বামীর জন্যে সাফাই গাইছো আশু যে কি না তোমার সাথে জো’র জব’রদস্তি করছিলো? তোমাকে যা নয় তা বলছিলো?

– হ্যাঁ তো তাতে আপনার কি? সে আমার স্বামী, আমাকে জোর জব’রদস্তি করুক, মা’রুক, কা’টুক সেটা শুধুমাত্রই আমাদের ব্যপার। এখানে আপনাকে আগ বাড়াতে কে বলেছিলো? কে আপনি হ্যাঁ? এটা আপনার বন্ধুর বাড়ি, সেখানে অতিথি হয়ে এসে বাড়ির জামাইয়ের গায়ে হা’ত তোলার সাহস কে দিয়েছে আপনাকে?

– আশু!

নামটুকু বলে আর কোনো শব্দ বের হতে পারলো না পৃথকের কণ্ঠনালি ভেদ করে। তাথইয়ের মুখ হতে নিঃসৃত কটাক্ষবাণী গুলো তী’রের মতো বিঁধলো ওর বুকে। প্রচন্ড রকমভাবে বেদনাদায়ক একটা পীড়া টনটন করে উঠলো বুকের ভেতর।
মোহর তাথইয়ের এরূপ অস্থিরতা দেখে ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল

– আপা, একটু শান্ত হও প্লিজ। যেটা হয়েছে ওটা তো কারো স্বেচ্ছায় হয়নি…

মোহরকে সম্পূর্ণ করতে না দিয়েই ওর মুখের কথা ছিনিয়ে নিয়ে তাথই আবারও বলল

– স্বেচ্ছায় ই হয়েছে, ও তো এটাই চেয়েছিলো। আমার সংসার ভাঙতেই তো চাই ও। কি ভাবছো মোহর, অরুণ মাহমুদ এভাবে ছেড়ে দেবে? ওকে চেনো? ও যে মা’র খেয়ে চুপচাপ বেরিয়ে গেলো কি মনে করেছো ও দমে গেছে? কখনোই নাহ ও এবার তোলপাড় করবে, আমার জীবনটা তছনছ করে ফেলবে। আর তার জন্য দায়ী শুধুমাত্র এই বাইরের লোকটা

বলে আঙুল তুলে ধরলো পৃথকের দিকে। অশ্রুভরা, অগ্নিঝরা দৃষ্টিটা দেখে ধক্ করে উঠলো পৃথকের বুকটা। এটা কি সেই চোখ যা দেখে ওর যৌবনে প্রথম প্রেম এসেছিলো? এটা কি সেই মুখটাই যেটা ওর চেহারা টা দেখলেই লজ্জায় লুকিয়ে পরতো! কিশলয়ের পাপড়িবৃত চোখটা যে সারাক্ষণ পৃথকের মুখটা দেখার জন্য উতলা,উদগ্রীব,অস্থির হয়েই থাকতো সেই চোখেই আজ এতো ক্রোধ, এতো ঘৃণা?
ভূমিকম্পের তান্ডবের ন্যায় অন্তরস্থলের সমস্ত ভীত, অনুকংপা চুরচুর করে উঠলো যেনো। কণ্ঠে টন খানেক আঘা’তের বান এসে ভর করলো পৃথকের, তবুও জিহ্ব ঠেলে কোনো মতে অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করলো

– আমি তোমার সংসার ভাঙতে চাই? আমি বাইরের লোক?

– হ্যাঁ তাই। বেরিয়ে যান আপনি, এক্ষুনি বেরিয়ে যান। আপনার ওই মুখটা আমি দ্বিতীয় বার দেখতে চাই না।

আর এক মুহূর্ত স্থির দাঁড়াতে পারলো না পৃথক। পা দুটোর নিচের ভিত্তটা কেমন নড়বড়ে হয়ে গেলো যেনো। চোখ দুটি নিমিষেই ঝাপসা হয়ে এলো। অতি দ্রুতপায়ে দরজার চৌকাঠ মাড়িয়ে বেরিয়ে এলো। বিদ্যুতের গতিতে সিড়ি বেয়ে নেমে ঘর, বাড়ি, সমস্ত আব্রাহাম ম্যানসনটাকে পেছনে ফেলে আসলো৷ বুকের ভেতর কেমন জ্বলন ধরেছে, অদ্ভুত রকমের যন্ত্রণা ক্রমেই গ্রাস করছে ওকে। সমস্ত শরীর টা ঝিম ধরে আসলো।

পৃথক বেরিয়ে যেতেই তাথই ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়লো। দুহাত মুখে চেপে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। ওর কান্নার আহাজারিতে মোহরের ভেতরটা কেঁপে উঠলো, ও দুহাতে আগলে ধরলো তাথইয়ে, বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল

– আপা, আপা গো তুমি কেঁদো না। দোহাই তোমার কিচ্ছু হবে নাহ

– তুমি জানো না মোহর,আমার জীবন টা নিঃশেষ করে দেওয়া জা’নোয়ার ওই অরুণ। ও এতো সহজে ছেড়ে দেবে মনে করো না। নিজের দোষ ঢাকতে আমার গায়ে মিথ্যে কলঙ্কের দাগ লাগাতেও ওর বাঁধবে না।

তাথইয়ের চোখ ভরা অশ্রু আর এমন মর্মান্তিক কথাগুলো হৃদয় কাঁপিয়ে তুললো মোহরের। তাথইয়ের মুখটা দু’হাতে মুছিয়ে দিয়ে বলল

– তুমি চিন্তা কোরো না আপা। ওর এই ভালো মানুষীর মুখোশ টেনে ছি’ড়ে ফেলবো আমি। তুমি শুধু সকাল হতে দাও।

বলে উঠে দাঁড়ালো। তাথইয়ের হাত ধরে তুলে দাঁড় করিয়ে বলল

– আজ এই ঘরে যা হলো এটা ভুলেও যেনো দরজার বাহিরে না যায়। সকাল হতে দাও তারপর সবটা উন্মোচন হবে

– তুমি কি করবে মোহর? ওকে তুমি তো ঠিক করে চেনোও না!

– চিনি আপা, খুব ভালো মতন চিনি। উনি আমাকে চিনতে না পারলেও আমার একটুও ভুল হয়নি উনাকে চিনতে। এই সুযোগটার অপেক্ষায়ই তো ছিলাম।

কথা গুলো অত্যন্ত বিড়বিড়িয়ে বলল মোহর। তাথইয়ের কানে অস্ফুটস্বরে কয়েকটা শব্দই শুধু গেলো। তাতে আর যাই হোক মোহরের মস্তিষ্কে যে অন্যকিছু ঘুরছে তা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে। আচানকই বুকটা ধক্ করে উঠলো তাথইয়ের, যেই মান সম্মানের দায়ে এতদিন, বছর মুখ বুজে সবটা সয়ে গেছে সেটাকেই রাত পোহালে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে না তো!

.

বাড়িভর্তি মেহমান, লোক সমাগমের ভিড় কমে অনুষ্ঠানের ইতি পর্যন্ত পৌঁছাতে প্রায় রাত এগারোটা বেজে গেলো। কাকলি,আম্বি বেগম, আজহার, আরহাম মুর্তজা ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরলেন। তাথই তারপর আর ঘর থেকেই বের হয়নি, তাথইয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকেরাও জানে না যে অরুণ হুট করেই চলে গেছে।যাওয়ার আগ দিয়ে তাথইয়ের সাথে দেখা করতে এলে শরীর খারাপ বলে তাথই কাটিয়ে দিয়েছে। অরুণের ব্যাপারে তারাও জিজ্ঞাসা করেনি, কারণ এমন হুটহাট ওর উধাও হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা সম্পর্কে পরিবারের লোকের ও খুব ভালো মতই জানা।

মোহর সন্ধ্যা থেকে পুরোটা সময় তাথইয়ের সাথেই ছিলো ওর ঘরে৷ অতঃপর তাথই ঘুমিয়ে গেলে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো মোহর, নিজের ঘরের দিকে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে এগোতে নিলে পেছন থেকে মাঝবয়েসী নারীর কণ্ঠের ডাকে ঘুরে তাকালো।

– এই যে মোহর না কি, এদিকে আসো তো।

মোহরকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সিড়ি বেয়ে খোরাতে খোরাতে নামলো মোটাসোটা গড়নের মহিলাটি। মোহর প্রতিক্রিয়া দেখালো নাহ, বরং সেও নিঃশব্দে নিচে নামতে লাগলো। ডাইনিং এ এসেই ধপ করে সোফার উপরে বসে টি-টেবিলের উপরে পা তুলে দিলো রুকাইয়া বেগম। কোঁকাতে কোঁকাতে বললেন

– বাবারে বাবা, এতো লোকজনের ভিড়ে ঘুরে আমার পা দুটো শেষ হয়ে গেছে। এই জন্যে এতো লোকসমাগম একেবারেই পছন্দ না আমার।

মোহর কোনো শব্দহীনা এসে পাশে দাঁড়ালো। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে রুকাইয়া বেগম বলেন

– এই মেয়ে এমন খাম্বার মতন দাঁড়িয়ে থাকার জন্যে তোমাকে ডাকিনি আমি। যাও একটু তেল গরম করে এনে আমার পা টা মালিশ করে দাও তো। পা টা নড়াতে পারছিনা বাবাগো

বলেই আবারো বিলাপ করার ন্যায় কোঁকাতে শুরু করলো। মোহর স্থুল দৃষ্টিতে তাকালো আপাদমস্তক রুকাইয়ার দিকে। পুরো পার্টির সময় টা জুড়ে উনাকে শুধু এক জাগায় বসে খেতে দেখেছে ও, বসে থেকে মাজা ব্যথা হলেও যুক্তিযুক্ত মানা যেতো, পায়ে ব্যথার হেতু টা বুঝতে পারলো না মোহর।
তবুও মুখ চালালো না, চুপচাপ রান্নাঘর থেকে বাটিতে করে তেল গরম করে আনলো। মোহরকে দেখে পায়ের উপর পা তুলে আরাম করে বসলো রুকাইয়া। আয়েশী ভঙ্গিতে বললেন

– একটু ভালো করে মালিশ করো, পুড়িয়ে দিও না আবার

মোহর কথা বলল না কোনো। গায়ের শাড়িটা এখনো ছাড়তে পারেনি। এটা পড়ে দীর্ঘক্ষণ থাকায় বেশ অস্বস্তি হচ্ছে, তবুও কোনো রকম গুটিয়ে বসলো। গরম তেলে ফুঁ দিয়ে হাতের সাথে লাগিয়ে খুব সাবধানে রুকাইয়ার পায়ে লাগিয়ে দিলো। বেশ কিছুক্ষণ ওভাবে মালিশ করার পর হুট করেই রুকাইয়া বেগম পা ঝারা দিয়ে চিৎকার করে উঠলো

– ওরে বাবা গো। আমার পা পু’ড়িয়ে দিলো। এই মেয়ে তোমার মনে মনে এতো কুটনামি।একটু পায়ে তেল কি ঘষে দিতে বলেছি আর তুমি পা-ই পু’ড়িয়ে দিতে চাইলে

আকস্মাৎ পা ঝারা দেওয়ার তেলের গরম বাটিটা ছিটকে মেঝেতে পরে তার থেকে দুয়েক ছেটা মোহরের হাতে পরলো। জ্বলে উঠলো চামড়া টা।
ততক্ষণে রুকাইয়ার চেঁচামেচি শুনে আম্বি বেগম ছুটে এসেছেন, তার পিছে পিছে কাকলিও এলো।

– কি হয়েছে আপা। চেঁচামেচি করছেন কেনো?

– চেঁচামেচি কি আর সাধে করছি। আচ্ছা ছেলেবউ এনেছো আম্বি, আমার পায়ে একটু তেল ঘষে দিতে বলেছিলাম, ও কি না আমার পা-ই পুড়িয়ে দিলো

মোহর নিজেও বুঝতে পারলো না কয়েক মুহুর্তের মধ্যে কি থেকে কি হলো। তবে এতটুকু অবশ্যই বুঝতে পেরেছে যে এই মানুষটা ওর প্রতি তীব্র ঘৃণা পোষণ করেই এসব করছে।

– তুমি যদি দিতে নাই চাও তাহলে মানা করে দিতে, এইরকম কাজ কেনো করলে?

মোহর স্থিরতা নিয়ে তাকালো কাকলির দিকে। আবারও ঘাড় ঘুরিয়ে রুকাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলল

– আমি কারো পা পুড়ি’য়ে দিতে চাইনি। তেলটা আমি ফুঁ দিয়ে ঠান্ডা করে নিয়েছিলাম

– এই মেয়ে তো দেখছি খুব মিথ্যেবাদী ও।
ছি ছি এমন ও দেখার ছিলো। মেহরাজ এই মেয়েকে বউ করে রেখেছে, মাথা ভরা যতসব ষড়যন্ত্র।

রুকাইয়া বেগমের ফ্যাসফ্যাসে গলার আওয়াজে তখন ডাইনিং স্পেস টা গমগমে। বেশির ভাগ সদস্যই ঘুমিয়ে পড়েছে ক্লান্ত শরীরে। তিয়াসা হাঁটু সমান কালো রঙের একটা ফ্রক জাতীয় পোশাক পড়ে দাঁড়িয়ে আছে এক কোণায়। ঠোঁট জুড়ে ক্রুর হাসি। তবে এসব সকলের চক্ষুগোচর না হলেও অবিলম্বেই একটা গম্ভীর স্বর ঠিকই কর্ণগোচর হলো।

– কি হয়েছে?

অতি পরিচিত গলাটা শুনে অস্থির চোখে ফিরে তাকালো মোহর। এতক্ষণ কঠোর গম্ভীর অভিব্যক্তি দিয়ে রাখা মুখাবয়ব টা নিমিষেই অতিরঞ্জিত হলো বিষন্নতায়। না চাইতেও ঠাঁই পাওয়ার জায়গাটাকে পেয়ে চোখ ভরে এলো মোহরের।
একজোড়া উৎসুক চাহনি মুখিয়ে আছে মোহরের বিরুদ্ধে অভিযোগ শোনাতে মেহরাজকে। কিন্তু সে সকলের দৃষ্টি আর মনোবাসনাকে ধৃষ্টতার সাথে অগ্রাহ্য করে মেহরাজের মন, মস্তিষ্ক আর চোখ দুটো আঁটকে গেলো মোহরের অশ্রুপূর্ণ ছলছল চোখের দিকে। এক মুহূর্ত ব্যায় না করে দ্রুতপায়ে এগিয়ে এলো, মোহরের সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে বিচলিত গলায় বলল

– মোহ? কি হয়েছে? ঠিক আছেন আপনি?

মেহরাজের এতটুকু স্নেহপূর্ণ গলায় মোহরের বাকি সত্ত্বাটুকুও ক্ষীণ হয়ে গেলো। একফোঁটা জল চোখের আব্রু ছাপিয়ে গড়িয়ে পড়লো। মেহরাজ মোহরের অশ্রুসিক্ত চোখটা দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে তাকালো উপস্থিত মানুষ গুলোর দিকে।, নীরবতা ভেঙে রুকাইয়া বেগম প্যানপ্যানে গলায় বললেন

– এভাবে তাকাচ্ছো কেনো? তোমার বউ দোষ করবে আবার তুমিই চোখ রাঙানি দেবে।

মেহরাজের ভ্রু দুটো কুচকে এলো, রুকাইয়া তোতাপাখির বুলির মতো একইভাবে সেই মিথ্যে কথাটা আওড়ালো। সবটুকু শুনেও মেহরাজের অভিব্যক্তি শুন্যের কোটায়। স্থির নেত্রে তাকালো মোহরের দিকে, ওর একটা হাত মুঠোয় পুরে খুব স্পষ্টভাষার কাঠকাঠ গলায় বলল

– প্রথমত আমার বউকে দিয়ে পা মালিশ করানোটা ভীষণ অন্যায় হয়েছে, মোহর আমার বউ, পায়ে হাত দেওয়ার জন্যে এবাড়িতে আরও অনেকে আছে, স্টাফ’স আছে। তার উপর এরকম লেইম একটা অভিযোগ করছেন যে ও করেনি তা আমার মুখে বলতে হবে না।

বলে অপরপক্ষের মতামতের অপেক্ষা হীনায় অকপটে আবারও বলল

– আমার বউকে আমি খুব আদর যত্নে রাখি ফুপি, ওর প্রতি করা কোনো অসমীচীন আচরণ আমি সহ্য করবো না। ও যতটা নরম আমি ততটাই কঠোর, তাই এরপর থেকে এধরণের ভিত্তিহীন নাটক করবেন না আশা করছি।

বলে মুঠোয় পুরে রাখা হাতটা আরও শক্ত করে চেপে ধরে উপরের দিকে হাঁটা ধরলো। এতক্ষণ ক্রুর হাসি বিচরণ করা তিয়াসার মুখটায় আমাবস্যা নামলো নিমিষেই। মেহরাজের বউকে নিয়ে এতো উৎকণ্ঠা, আদিক্ষেতা এসব দেখলে ওর মাথাটা গরম হতে থাকে। ফিসফিস করে বলে

– খুব প্রেম হয়েছে না দুজনের? সব ঘুচিয়ে দেবো, ভেবো না চুপ করে আছি বলে দমে গেছি।খেলা তো এখনও শুরুই হয়নি। মেহরাজকে তো আমারই হতে হবে হোক আজ হোক কিছুদিন পর।

_________________________

আকাশ জুড়ে ফুটফুটে তুলোর মতো মেঘের বিচরণ, বাতাসে অদূর থেকে আসা বেনামি ফুলের মিঠা সুবাস। ছোট ছোট টুকরো রোদের লুকোচুরির মিষ্টি খেলায় মন মাতানো সকালের পরিবেশ টা হলেও আসলে তা কেবলই এগিয়ে আসা ঝড়ের পসরা সাজাচ্ছে তা বাড়ির ভেতরে না আসলে বোঝা যাবে নাহ।
একাধিক চেহারায় উপস্থিত গাম্ভীর্য, দুশ্চিন্তা আর অপমানের কুঞ্চিত ছাপ তার প্রবলতা স্পষ্ট ভাবে জানান দিচ্ছে।

– আপনি চুপ করে আছেন মুর্তজা সাহেব? এই দিনই কি দেখার ছিলো? আমিতো ভাবতেও পারছিনা আমার ছেলেকে আপনার বাড়িতে এসে মা’র খেতে হয়েছে। তাও কি না এমন একজনের হাতে যে আদতে এই বাড়ির কেও ই না!

ভ্রুযুগল আরো জড়ো হয়ে আসলো। গতদিনের এতো সুসজ্জিত অভিজ্ঞতার শেষে রাত পেরিয়েই এরূপ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সম্মুখীন হতে হবে তাও কস্মিনকালেও কেও ভাবতে পারেনি। এতক্ষণ চুপ করে থাকলেও নিজেকে আর শান্ত রাখতে পারলেন না কাকলি বেগম। বিস্ময়ের রেশ কাটিয়ে উঠতেই মেয়ের উপরে অসহনীয় ক্রোধ উতলে পড়লো, ক্ষ্যাপাটের মতো ছুটে এসে তাথইয়ের বাহু জোরে চেপে ধরে বললেন

– এসব কি শুনছি আমি? তুই কি আমাদের মান সম্মান ডুবাতে চাস? কাল এতো কিছু হয়ে গেছে আর আমরা জানি পর্যন্ত নাহ? কি করেছিস তুই? কি না শেষে অরুণকে..

বাকিটুকু বলার আগেই মুখের কথাটা প্রচন্ড ক্রুদ্ধতার সহিত ছি’নিয়ে নিলেন অরুণের মা মিসেস রূপালী। ছ্যানব্যান করে উঠে বললেন

– স্বামী স্ত্রীর মাঝে ঝামেলা হবে এটা তো বড়ো ব্যাপার নাহ। কিন্তু এর মাঝে তৃতীয় ব্যক্তি কেনো আসবে? ওই ছেলে আপনার মেয়ের কি হয় কাকলি আপা? সে কেনো আমার ছেলের গায়ে হা’ত তুলেছে

কাকলি বেগমের অপমান, লজ্জায় মাথা হেট হয়ে এলো। ভাবতেও পারেনি এমনটা। তাথই পাথরের মতো নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে, আড়চোখে একবার শুধু তাকালো বাবা মায়ের মাঝে অতি ভদ্রলোকের মতো বসে থাকা ঘৃণ্য চেহারাটার দিকে। তাচ্ছিল্য হাসলো, মনে মনে বলল

– আমি কি চিনি না তোমাকে? আমি তো জানতাম ঠিক এমনটাই চাও তুমি

– তাথই, এভাবে চুপ করে আছো কেনো? তোমাকে কি জিজ্ঞাসা করা হয়েছে? কালকে এতো বড়ো একটা ঘটনা ঘটে গেলো আর তুমি এখনো এমন চুপ করেই দাঁড়িয়ে আছো?

আরহাম মুর্তজার ধমকানিতে তাথই মুখ তুলে তাকালো। অকপটে বলল

– উনারা বললোই তো। আমি আবার নতুন করে কি বলবো।

– সম্পর্ক টাকে কি ছেলেখেলা পেয়েছো? কিছু মনে করবেন না বেয়াই সাহেব। এতদিন ধরে আপনার মেয়ের এতো দেমাগ, অপরাধ সহ্য করেছি কিন্তু এবার মাত্রা ছাড়িয়েছে। এমন তো না যে বিয়ে দেওয়ার জন্য আপনাদের পায়ে পড়েছিলাম আমরা। আমাদের ছেলে কি ফেলনা নাকি? এই মেয়ে নিজের স্বামীর সাথে শ্বশুরবাড়ির কারো সাথে সম্পর্ক ঠিক রাখেনি। আবার কাল এতো ভালোবেসে আমার ছেলে দেখতে এলো আর ওকে কি না একটা বাইরের ছেলে দিয়ে মা’র খাইয়েছে। ভাবতেও লজ্জা লাগছে যে আমরা এমন বাড়ির সাথে আত্মীয়তা করেছি।

কুটুমপক্ষ হতে এতগুলো কটাক্ষপূর্ণ কথা শুনে উপস্থিত সকলের মাথা হেট হয়ে এলো। মেহরাজ এখনও নিশ্চুপ বসে। পুরোটা বুঝতে ওর ও বেশ অসুবিধা হচ্ছে। ওদের সম্পর্ক টা টানাটানির পর্যায়ে আসবে তা হয়তো ওর মাথায় এসেছিলো, কিন্তু হুট করেই এমন কিছু শুনতে হবে তা ওর ভাবনার বাহিরে। উপস্থিত সকলের হয়ে তখন শাহারা বেগম দূর্বল গলায় বললেন

– দেখুন আমার মনে হয় কিছু একটা ভুল হয়েছে। আমার মেয়েরা এমন নয়। তাথই বনু একটু রাগচটা হতে পারে তা বলে কি

– সেটা আপনার তাথইয়ের কাছেই জিজ্ঞাসা করুন দিদা। আমি একটাও মিথ্যা বলেছি কি না!

অরুণের কথাতে মুখটা থমথমে হয়ে এলো শাহারা বেগমের। অরুণের বাবা এবার গুরুগম্ভীর ভাবে আরহাম মুর্তজাকে উদ্দেশ্য করে বললেন

– আপনাদের মেয়ের যদি এতই আপত্তি থাকে তাহলে বলে দিন আমরা খুব শীঘ্রই আইনি ব্যবস্থা নেবো। জোর করে আর যাই হোক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যায়না।

অরুণের বাবার মুখে এরূপ কথা শুনে বিচলিত হয়ে উঠলো কাকলি বেগম। অনুনয়ের সুরে বললেন

– না না এমন কথা বলবেন না ভাই। ওদের বিয়ে হয়েছে, সন্তান আছে ছাড়াছাড়ির কথা কেনো আসছে। আমি বুঝতে পারছি অনেক বড়ো একটা ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু ভুল যখন হয়েছে সমাধান ও হবে। তবুও এভাবে বলবেন না

বলে তাথইয়ের হাত ধরে টেনে অরুণের সামনে এনে বলল

– অরুণের কাছে ক্ষমা চা তুই। এতো বড়ো একটা অনাচার করার আগে তোর বুক কাঁপলো না মুখপু’ড়ি! এক্ষুণি তুই ক্ষমা চাইবি সকলের কাছে।

বলে ওদের দিকে ফিরে বলল

– ওর ভুল হয়েছে ও ক্ষমা চাইবে। আর যে অরুণের সাথে বেয়াদবি করেছে তাকে আমি নিজে আনবো আপনাদের সামনে, ও নিজেও ক্ষমা চাইবে।

তাথই চোখ ভরা ক্রোধের আগুন নিয়ে একবার অরুণের দিকে তো আরেকবার মায়ের দিকে তাকালো। কাকলি আবারও ওকে দিয়ে ক্ষমা চাওয়ার কথা বললে সকল আদব কায়দা ভুলে তাথই ক্ষুব্ধ স্বরে চেঁচিয়ে বলল

– কক্ষনো নাহ, এই শয়তান টার কাছে আমি ক্ষমা দূর কথাও বলতে চাইনা। মা’র খেয়েছে বেশ হয়েছে। এটা আরও আগে খাওয়া উচিত ছিলো ওর।

ভরা আসরে তাথইয়ের দুঃসাহসিক এই কাজটা উপস্থিত সকলকে হতবাক করে দিলো। পরিস্থিতি আওতার বাইরে যাচ্ছে এর পূর্বাভাস পেয়ে এতক্ষণ চুপচাপ উপরে দাঁড়িয়ে থাকা মোহর ব্যস্ত পায়ে ছুটে নেমে এলো। তবে ততক্ষণে মোহরের শঙ্কাকে ঠিক প্রমাণিত করে কাকলি বেগম সজোরে ঠা’স করে একটা চ’ড় বসিয়ে দিলো তাথইয়ের গালে। অকস্মাৎ ধাক্কা সামলাতে না পেরে ধুপ করে মেঝেতে পরে গেলো তাথই।
বড়ো বোনের এই অবস্থা দেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সাঞ্জে, কিন্তু বড়োদের নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে এগিয়ে যেতে পারলো নাহ।
ক্ষুব্ধ হয়ে কাকলি তাথইয়ে আবারও টেনে তুলে হাত তুললেও পেছন থেকে খপ করে হাতটা ধরে ফেললো মোহর, তাথইকে নিজের কাছে সরিয়ে নিয়ে কাঠকাঠ গলায় বলল

– সম্পূর্ণ সত্যটা যাচাই করার আগেই নিজের মেয়েকে আঘা’ত করতে বিবেকে বাঁধলো না আপনার? উনারা এসে যা বলল তাই মেনে নিলেন? মেয়েকে আবারও সেই জাগায় ঠেলে দেওয়ার জন্যে মরিয়া হয়ে যাচ্ছেন? আদও সেই জাগাটা মেয়ের জন্য সঠিক কি না তা ভাববার প্রয়োজন বোধ হলো না আপনার?

একসাথে এতগুলো কথা উচ্চস্বরে বলেও হাফিয়ে গেলো না মোহর। বরং ভেতরটা যেনো রাগে, যেদে জ্বলে উঠলো আরও। আম্বি বেগম এগিয়ে এসে মোহরকে উদ্দেশ্যে করে বলল

– তুমি এখানে কেনো এসেছো? আগামাথা না জেনে বুঝেই কথা বলতে কে বলেছে তোমাকে?

– শুধু আগামাথা নয়, বরং পুরোটাই জানি আমি

বলেই অরুণের দিকে ফিরে ক্রুর চেহারায় রহস্যময়ী গলায় বলল

– তাই না অরুনাভ ব্যানার্জি?

চোখ দু’টো ক্রমশ নিষ্পলক, বৃহত্তাকার হয়ে এলো অরুণের। ঠিক কতটা তকমা লেগেছে সেটা ওর মুখাবয়বে ব্যক্ত করা সম্ভব নাহ। গতরাতে ধস্তাধস্তির সময় দেখেছিলো এক পলক। কিন্তু অন্যরকম সাজ আর মেকাপের আবৃত চেহারাটাকে অতটা ঠাওর করতে পারেনি। মোহরের চেহারাটা মস্তিষ্কে ধরতে পেরেই না চাইতেও মুখ ফসকে অরুণের বেরিয়ে এলো

– মোহর? তুমি!

– হ্যাঁ আমি। কাল তো রাতের অন্ধকারে টের পাননি আজ নিশ্চয় চিনতে অসুবিধা হচ্ছে নাহ!

অবিলম্বেই উত্তর দিলো মোহর। ওদের কথপোকথনের কোনো অংশই কারো বোধগম্যে আসলো নাহ। মেহরাজ এগিয়ে এসে মোহরকে বলল

– আপনি আর অরুণ কি পূর্বপরিচিত মোহ?

মোহর স্মিত হাসলো। খুবই সহজতর গলায় বলল

– হ্যাঁ চিনি তো। আপনাকে একটা কাজ করতে বলেছিলাম, সেটা হয়েছে?

মেহরাজ বিব্রত মুখেও ঘাড় উপর নিচ করে হ্যাঁ বোধক উত্তর দিলো। মোহর অদ্ভুত ভাবে অরুণের দিকে তাকিয়ে বলল

– আপনার জন্য সারপ্রাইজ আছে অরুনাভ ব্যানার্জি, একটু দাঁড়ান।

বলে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো।
.
.
.
চলমান

#হীডিংঃ বৃহৎ, বিশাল পর্ব দিয়েছি। আশা করছি এতগুলো প্রহরের অপেক্ষাটার যথার্থ মূল্যায়ন করতে পেরেছি? এবার ফটাফট পড়ে মন্তব্য করে ফেলুন, অপেক্ষারত!

©Humu_❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here