বৃষ্টি_শেষে_রোদ (পর্ব ১৬) #মেহেদী_হাসান_রিয়াদ

0
297

#বৃষ্টি_শেষে_রোদ (পর্ব ১৬)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ

বেলকনিতে বসে কলেজের মেসেন্জার গ্রুপে বন্ধুদের সাথে চ্যাট করছিল আরশি। এমন সময় রিদের কল আসলে ক্ষনিকটা কপাল কুচকে ফোন হাতে নিয়ে বসে থাকে সে। দেখতে দেখতে কেটে গেলো কল। অতঃপর আবার আসলো এবার নিজে থেকেই কেটে দিয়ে ছোট একটা ট্যাক্স পাঠায়,
“গ্রুপ স্টাডি করছি। একটু পর কল দিচ্ছি।”

এক সময় মায়ের ফোন হাতে নিয়ে কলের অপেক্ষায় বসে থাকতো যে মেয়ে, সে আজ গ্রুপ স্ট্যাডির কথা বলে এড়িয়ে যাচ্ছে কল। স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ মেসেজটার দিকে চেয়ে রইল রিদ। গ্রুপ স্ট্যাডি করছে আরশি। অথচ সে যেই গ্রুপে ছেলে ও মেয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মেতে আছে সেখানে রিদেরও একটা ভিন্ন নামের আইডি এড আছে, এটা হয়তো আরশির অজানাই ছিল।

আধা ঘন্টা পর কল দিল আরশি। এই প্রসঙ্গে কিছু বললো না রিদ। স্বাভাবিক ভাবে জিজ্ঞেস করে,
“গ্রুপ স্ট্যাডি শেষ?”
আরশি একটু হেসে বলে,
“না, আপনি কল দিয়েছিলেন তাই আমি কিছুক্ষণ পর বের হয়ে গিয়েছি।”
কিছু বললো না রিদ। পিচ্চিটা দেখি আজ মিথ্যে বলাও শিখে গেছে। একটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে রিদ। বিকেলে পাওয়া ছবিটার কথা মনে পড়তেই স্বাভাবিক ভাবে বলে,
“কোথায় ছিলি আজ?”
“কলেজে।”
“কলেজ শেষে?”
“বাড়িতে।”
“কিন্তু ফারুক বললো, তার সাথে ছিলি?”

কিছুটা ইতস্তত বোধ হলো আরশির। নিজেকে স্বাভাবিক করে বলে,
“সে এটা বলেছে আপনাকে?”
চুপ রইল রিদ। আরশি পূনরা বলে,
“ওহ্ হ্যাঁ। ফারুক ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড এর সাথে দেখা করেছিলাম। তাও কয়েক মিনিটের জন্য।”
“তোকে বলেছিলাম না, কোনো ছেলের সাথে মিশবি না?”
“ফারুক ভাই আমার ভাইয়ের মতোই।”
আর কিছু বললো না রিদ। অবুঝকে বোঝানো যায়। আর যারা বুঝেও অবুঝের মতো আচরণ করে, তাদের কখনোই বোঝানো যায় না। তাই কথা না বাড়িয়ে শান্ত গলায় বলে,
“আচ্ছ, পরে কল দিব। এখন ব্যস্ত আছি একটু। ভালো থাকিস।”

যে পিচ্চিটা এক সময় আমার সামনে দাড়ালেও কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে থাকতো, এখন তার সাথে কথা বলতে আমাকেই কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যেতে হয়। দুরুত্বের এই দু’এক বছরের ব্যাবধানে মনে হয় খুব বড়ো হয়ে গেছে সে। অথচ আমি তার বাচ্চাসুলভ আচরণেরই প্রেমে পড়েছিলাম। আমরা মানব জাতি যখন মূল্যবান কোনো কিছুও নিজের করে পেয়ে যাই, তখন ধীরে ধীরে এক সময় সেটাকে খুবই সস্তা কিছু মনে হতে শুরু করে।

কেটে গেলো আরো কয়েক দিন। ফারুকের সাথে এখন পুরোপুরি বন্ধুর মতোই মিশতে থাকে আরশি। হয়তো সে ফারুককে ভাই মনে করেই মিশে। কিন্তু সে ক্ষনিকের জন্যও বুঝতে পারেনি এগুলো সবই তাদের দুজনকে আলাদা করতে ফারুকের পরিকল্পনা ব্যতিত আর কিছুই ছিল না।

আজ আরো কিছু ছবি আসলো রিদের কাছে। যেখানে ফারুক ও আরশি একটা রেস্টুরেন্টে বসে গল্প করছে। আজ আর না দেখার মতো করে থাকতে পারলো না রিদ। ইদানিং বুকের ভেতর টায় তীব্র ব্যাথা অনুভব হয় তার। আরশির পরিবর্তন যেন মেনে নিতেই পারছে না। এসব মাথায় পিড়া দেওয়ার কারণে পড়াশোনায়ও মন বসছে না আজকাল। অথচ এক বুক স্বপ্ন নিয়েই দেশ ছেড়েছিল সে। না এভাবে চলতে থাকলে এই স্বপ্ন কখনোই পূরণ হবে না। আজ হয়তো আরশি এ সবকিছু ছাড়বে, নয়তো রিদকে। দুটো অপশন থেকে যে কোনো একটা বেছে নিতে হবে তাকে।

আজ অনেকটাই কড়া গলায় কথা বলেছে রিদ। ভেবেছিল একটু কঠোর হলেই আরশি সব কিছু বুঝতে শিখবে। কিন্তু হলো তার উল্টো। শাসন টা এক প্রকার ঝগড়ায় রুপ নিল। আজ শুধু অবাক হয়ে আরশির কথা গুলো শুনলো রিদ। আরশি কখনো তার সাথে এভাবে কথা বলবে তা ধারণারও বাইরে ছিল হয়তো। আরশি আজ খুব ক্ষিপ্ত হয়ে বলে,
“পেয়েছেন টা কি আপনি আমাকে? আপনি যেভাবে বলবেন, আমি সব সময় সেভাবেই চলবো? আপনার কারণে আমার বন্ধুরা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে এখন। তারা সবাই এখন আমাকে প্রেমিকের পুতুল বলে ডাকে। আর ফারুক ভাইয়ার কথা বলছেন তো? সে আমার আপন ভাইয়ের মতোই। আর সেও আমাকে নিজের ছোট বোনই মনে করে। আপনি কিভাবে তাকে নিয়ে এসব ভাবতে পারেন? আপনার এত সন্দেহ হয় আমাকে নিয়ে? এগুলো সবই আপনার চিন্তা ভাবনার দোষ। আর আমি এখন আপনার কথা মতো সবকিছু করতে বাধ্য নই। আমারও ব্যক্তিগত একটা স্বাধীনতা আছে। আগের মতো ছোট নেই আমি। এখন বড়ো হয়েছি। এখন নিজের ভালোমন্দ নিজেই বুঝতে শিখেছি। আমি ভালো করেই জানি কোনটা ভালো ও কোনটা খারাপ।”

অবাক হয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল রিদ। যেন কথা বলার ভাষাই হারিয়ে ফেলেছে আজ।
শান্ত গলায় ছোট করে একটা কথা বলে,
“পিচ্চিটা আজ খুব বেশিই বড়ো হয়ে গেছে।”
আরশিও পাল্টা বলে,
“মানুষ সারা জীবন পিচ্চি থাকে না।”
অবাধ্য চোখের জল এক হাতে মুছে নিয়ে বলে,
“হুম তোরও ব্যাক্তিগত স্বাধীনতা আছে। বুঝতে পারিনি এতটা বড়ো হয়ে গেলি। আর কখনোই তোর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবো না। বিরক্তিকর মানুষটাকেও আশেপাশে আর কখনো খুঁজে পাবি না। নিজের মতোই ভালো থাকিস। আর হ্যাঁ, তুই তো আবার খুব বেখেয়ালি। নিজের যত্ন নিতে ভুলবি না। আল্লাহ্ হাফেজ।”

বলেই ফোন কেটে দিলো রিদ। যেন জোয়ারের মতো বুক ভাঙা কান্না আসছে আজ। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। নিরবে চোখের পানি ঝড়ছে টপটপ করে।

“”””””””””””””””””””””””””””””””

সন্ধার পর ফোন হাতে বেলকনিতে এসে বসে আছে আরশি। পড়ায় মন বসছে না আজ। সারাদিন ধরে একটা চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়, আজ রাগের বসে কি খুব বেশিই বলে ফেলেছিলাম?
ভাবতে ভাবতে ফোনটা বেজে উঠে তার। দেখে ফারুকের ফোন। কিছুটা বিরক্ত হলো আরশি। মনে মনে বিড়বিড় করে বলে,
“এই বা’লটাকে নিয়েই যত ঝামেলা।”

ফোন রিসিভ করলো না সে। আবার কল দিল ফারুক। আরশি কেটে দিল। ফারুক এবার ছোট করে একটা নক দিল,
“মন খারাপ?”
আরশি মেসেজ দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস নিল। ফারুকেরও তো কোনো দোষ নেই। সে তো আমাকে নিজের ছোট বোনের মতোই মনে করে। ভেবেই রিপ্লাই দিল,
“না।”
“মনে হচ্ছে।”
আরশি সিন করে রিপ্লাই দিল না। ফারুক পূনরায় বলে,
“তো কি নিয়ে মন খারাপ হলো আমার বোনটার?”
“কিছু না এমনি।”
“রিদ ভাইয়া বকেছে নিশ্চই?(সাথে মুখে হাত দেওয়ার একটা ইমোজি)
আরশি এবার একটা সেড রিয়েক্ট দিয়ে বলে,
“ও আমার সাথে আর কথা বলবে না।”
“কেন?”
“আমি খুব খারাপ ব্যাবহার করে ফেলেছি আজ।”

ফারুকও কিছুটা ইমোশন দেখিয়ে জেনে নিল সবটা। সবটা শুনে বলে,
“একটুও ভুল করোনি তুমি। তোমারও একটা স্বাধীনতা আছে, এটা বুঝতে হবে তাকে। সব সময় যে তার কথা মত চলতে হবে এমনটাও তো নয়। আমি নিজেরও তো ভালোবাসার মানুষ আছে। আমি তো কখনো ইয়াশার স্বাধীনতায় বাধা দিই নি। সে যেমন ইচ্ছে চলুক, সমস্যা কোথায়। প্রত্যেক মানুষেরই নিজস্ব স্বাধীনতা আছে। এখানে দোষটা তার। তোমার মন খারাপ করে থাকার কিছুই নেই। তুমি তোমার জায়গা থেকে ঠিক কাজটাই করেছো। এখন এসব আবেগ ইমোশন বাদ দিয়ে নিজের লাইফে ফোকাস করো। জীবনটাকে উপভোগ করো নিজের মতো।”

কিছু বললো না আরশি। ফারুক সত্যটাই তো বলেছে। যেগুলো আরশির চিন্তা ভাবনার সাথে সবটুকুই মিল। একজন ছেলের চিন্তা ভাবনা এমনই হওয়া উচিৎ। ভেবেই বিদায় নিয়ে ফোন এক পাশে রেখে দিল আরশি।

ওপাশ থেকে একটা প্রশান্তির হাসি হাসলো ফারুক। ফাইনালি তার এতদিনের চেষ্টা সফল হতে চললো। তবে এখনো পুরোপুরি না। হয়তো আরশি ক্ষমা চেয়ে কান্নাকাটি করে আবার সব ঠিক করে নিতেও পারে। এমনটা কখনোই হতে দেওয়া যাবে না। তার সাথে আরো ভালো ভাবে মিশতে হবে। তার মন খারাপের দিনে পাশে থেকে শান্তনা দিতে হবে। সোজা কথা তার মাথায় একটা কথা ভালো ভাবেই ঢুকিয়ে দিতে হবে, সে যা করেছে সব ঠিকই করেছে৷।

“”””””””””””””””””””””””””””””””

রিদের রুমে প্রবেশ করে সাজ্জাদ। দেখে রিদ সব সময় যত্ন করে রাখা ছবির ফ্রেমটা ভাঙা অবস্থায় পড়ে আছে নিচে। আর সেই কাচের টুকরোয় কেটে রক্ত ঝড়ছে রিদের হাত দিয়ে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, অনেক রাগ ঝেড়েছিল রিদ। ক্ষনিকটা আফসোসের হাসি হেসে দু দিকে মাথা নাড়িয়ে রিদের পাশে গিয়ে বসে সে।

কাঁধে হাত রেখে বলে,
“মন খারাপ করো না ব্রো। এক সময় আমার সাথেও এমনটা হয়েছিল। তাই আমি বুঝতে পারছি তোমার অবস্থা টা। এক সময় দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। পড়াশোনা করতে এসেছো, ওসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দাও। নিজের স্বপ্ন পূরণ করে দেশে ফিরে দেখো, ওর চেয়েও ভালো সুন্দরী শত শত মেয়ে তোমার পেছনে লাইন দিয়ে দাড়াবে।”

রিদ নিচের দিকে চেয়ে থাকা অবস্থায় বিষণ্ন মনে বলে,
“হাজার মেয়ে আসলেও ওর শূন্যতা কখনো পূরণ হবে না। আমার মনে দাগ কেটে দিয়ে গেছে সে।”
কিছুটা মুচকি হাসে সাজ্জাদ। রিদের হাতটা ধরে বলে,
“ভালোবাসা এমনি ব্রো। একজন খুব সিরিয়াস হয়, আর অন্য জন মূল্য দিতে জানে না। এখন ওসব ছাড়ো। হাত থেকে র’ক্ত ঝড়ছে। আসো, পরিস্কার করে বেধে দিই।”

আজকাল বেশির ভাগ ছেলের ভালোবাসার সমাপ্তি ঘটে এই একটা কারণেই। কিছু ছেলে আছে যারা প্রিয় মানুষটাকে মন থেকে এতটাই ভালোবাসে, সব সময় তাকে হারানোর ভয় কাজ করে মনে। এই ছেলে গুলো খুবই আবেগি। এরা ভালোবাসার মানুষটার সাথে অন্য কোনো ছেলেকে সহ্য করতে পারে না। তাই বলে এরা সন্দেহ করে, এমন টা না। এদের খুবই হিংসা হয় মনে। ভাবে, আমার ভালোবাসার মানুষটা শুধু আমার, অন্য কেউ কেন তার সাথে মিশবে। হয়তো এর জন্য নিষেধাজ্ঞাও দেয়। যা প্যারা মনে হয় অনেকের কাছে। তবে একটা চরম সত্য হলো, এসব ছেলেরা আর যাই করুক কখনো তার ভালোবাসার মানুষটাকে ছেড়ে যাবে না।

আবার কিছু ছেলে আছে, যারা রিলেশনকে খুব একটা সিরিয়াসলি নেয় না। প্রেমিকার কোনো কিছুতেই তারা খুব একটা চিন্তিত হয় না। তাদের ধারনাটা হয় এমন, থাকলে থাকবে, না থাকলে নেই। তাই প্রেমিকা যাই করুক, কখনো তারা কোনো প্রশ্ন করে না। দিন শেষে একটা ছেড়ে দিয়ে বা চলে গেলে অন্য কাউকে খুঁজে নিতেও খুব এমটা সময় নেয় না তারা।

একটা ছেলে যদি একটা মেয়েকে মন থেকে ভালোবাসে, তাহলে তার প্রতি অবশ্যই তার হিংসে থাকবে। অন্যের সাথে মিশলে বুকে চিনচিন ব্যাথা অনুভব হবে তার। কারণ সে তার ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে ভাবে। স্বপ্ন বুনে তাকে নিয়ে। যাকে সে হারাতে চায় না কখনোই।
,

সাজ্জাদ এক হাত ধরে উঠাতে চাইলেও চুপচাপ বসে থাকে রিদ। হাতের সামান্য আঘাতে তার কি এমন ক্ষতি হবে। ভেতরটায় যে এর চেয়েও বেশি র’ক্ত ক্ষরণ হচ্ছে। যা দেখার সাধ্য কারো নেই। এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে, পৃথিবীতে কোনো ভয়ঙ্কর কিছু থেকে থাকলে তা হলো প্রিয় মানুষটার বদলে যাওয়া রুপ।

To be continue………………….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here