#তুমি_অপরূপা (১৪)
শুক্রবারের এক অলস দুপুর।জুয়েল ছেলের সাথে রুমের মধ্যে ক্রিকেট খেলছে ছোট প্ল্যাস্টিকের খেলনা বল এবং ব্যাট দিয়ে।
বাচ্চাদের নিয়ে কোথাও যাবার কথা ভাবলেই প্রথমে মাথায় আসে চিড়িয়াখানার কথা অথবা শিশু পার্কের কথা।
জুয়েলের ও ব্যতিক্রম নয়।খেলতে খেলতে জুয়েল রানাকে বললো, “বাবা,ঘুরতে যাবা?”
রানা উৎসুকভাবে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কোথায়? ”
জুয়েল হেসে বললো, “চিড়িয়াখানা? ”
রানার মুখে হাসি ফুটে উঠলো সাথে সাথে। ছেলের মুখে হাসি দেখে জুয়েলের ও মন হালকা হয়ে গেলো। বুকের ভেতর কেমন আনন্দের জোয়ার বইতে লাগলো। অন্তরাকে ডেকে জুয়েল বললো, “অন্তরা তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও,আজ ঘুরতে যামু আমরা।”
অন্তরা তখন রাতের রান্নার জন্য আলু কা/টছে।জুয়েল রানাকে বললো, “যাও বাবা,তোমার মা’রে গিয়ে বলো তৈরি হইতে।”
রানা মুখ কালো করে বললো, “উনি কি আমার মা?না তো।মা তো এরকম দেখতে ছিলো না। ”
ছেলের কথা শুনে জুয়েলের বুকের ভেতর দুঃখের আগুন আবার ও জ্ব/লে উঠলো। ছেলেটা এখনো নিজের মা’কে ভুলতে পারছে না।কি অদ্ভুত পৃথিবী!
পৃথিবীর মানুষ এমন কেনো?
কেউ একটা সন্তানের জন্য দিনরাত আল্লাহর কাছে আহাজারি করে আবার কেউ সেই সন্তানকে ফেলে রেখে অন্য কারো হাত ধরে সব ছেড়ে দেশান্তরি হয়।
জুয়েলের মনে পড়ে যায় রানার মা রেশমা যেদিন চলে যায় তার ফুফাতো ভাই জাবেদের সাথে সেই দিনের কথা।জুয়েল অফিসের কাজে বের হবার আগে ছেলে এবং ছেলের মা দুজনের কপালেই চুমু খেলো।রানার মায়ের থুতনির ছোট কা/টা দাগে হাত বুলিয়ে দিয়ে যাবার আগে জিজ্ঞেস করলো কিছু লাগবে কি-না ফেরার সময় আনার জন্য।
তখনও তো সে বুঝতে দেয় নি তার মনে কি চলেছে। কতো নিখুঁত অভিনয় ছিলো তার!
একটুও টের পেলো না জুয়েল।কি দুর্দান্ত অভিনয় দক্ষতা দিয়ে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো সবাইকে।জুয়েলকে বলেছিলো রানার জন্য ফেরার সময় কালো আঙুর নিয়ে আসার কথা এবং তার জন্য ছোট এক পাতা কালো টিপ।
জুয়েল অফিসে যাবার পথে আগেই টিপ কিনলো।
রেশমা ছেলেকে দুপুরে খাইয়ে দিয়ে ঘুম পাড়ালো।তারপর নিজের ব্যাগ গুছিয়ে নিলো।বিকেলে ছেলেকে নিয়ে বের হয়ে গেলো। বাড়ির পাশের দোকান থেকে ছেলেকে একটা চিপস কিনে দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে রেশমা নিরুদ্দেশ হয়ে গেলো।
সন্ধ্যা থেকে রানার কান্না শুরু হলো তার মায়ের জন্য। এক প্যাকেট চিপস আর কতোক্ষণ মায়ের চিন্তা থেকে তাকে দূরে রাখতে পারে!
জুয়েল রাতে ফিরলো যখন তখন শুনলো রেশমা বিকেলে বের হয়েছে এখনো ফিরে নি।সেই রাতেই খুঁজতে বের হলো জুয়েল।পাশের গ্রামে শ্বশুর বাড়ি, সেখানে গিয়ে ও খোঁজ নিলো।কারো ভাবনাতেও ছিলো না ৭ বছরের বিবাহিত জীবন, ৫ বছরের ছোট ছেলে,অন্ধের মতো ভালোবাসতে পারা স্বামীকে ফাঁকি দিয়ে রেশমা ঘর ছেড়ে চলে যাবে কখনো।
রাত ধরে এখানে সেখানে খোঁজাখুঁজির পর সকালে রেশমার বড় ফুফু হামিদা রুদ্রমূর্তি হয়ে রেশমাদের বাড়িতে এলো।তখনই সবাই জানতে পারলো জাবেদ গতকাল বিকেলে তার মায়ের আলমারি থেকে ২৪ হাজার টাকা নিয়ে বের হয়েছে। রাতের ১ টায় কল দিয়ে হামিদা বেগমকে বলেছে সে আর রেশমা এই মাত্র বিয়ে করেছে।সবাইকে জানাতে, সবাই যেনো তাদের জন্য দোয়া করে।
উদভ্রান্তের মতো হয়ে গেলো জুয়েল এই খবর শুনে।বাড়ি এসে আলমারি হাতড়ে দেখে রেশমার কোনো গহনা আলমারিতে নেই,সেই সাথে নেই জুয়েলের মায়ের গহনা,ক্যাশ টাকা।
পরকীয়া!
মানুষকে এমনভাবে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায় যে সেই মানুষ তার ভালো, মন্দ,সুখ,দুঃখ কোনো কিছুই মাথায় রাখতে দেয় না।খনিকের মোহে পড়ে মানুষ একটা হালাল সম্পর্ককে অবমাননা করে।
কাউকে কখনো বলতে পারে নি জুয়েল এক বছর আগে কেনা সেই ছোট একটা টিপের প্যাকেট আজও জুয়েলের মানিব্যাগে বিভিন্ন কার্ডের ভেতরে সযত্নে লুকিয়ে রাখা আছে। কাউকে বলা হয় নি অন্তরার আর রেশমার থুতনির কে/টে যাওয়া দাগটা প্রায় একই রকম দেখতে।
যদি কখনো দেখা হয় সেই বেঈমানীর সাথে তবে জুয়েল সেই টিপের প্যাকেট তার হাতে তুলে দিয়ে বলবে,”আমার কাছে করা তোমার শেষ আবদারের জিনিস। ঠিক ততটা ঘৃণার সাথে তোমাকে দিচ্ছি এই টিপ,যতটা ভালোবেসে কিনেছিলাম তোমার জন্য। ”
অন্তরা একটা সুতির মিষ্টি কালার জামা এবং নেটের ওড়না গায়ে জড়িয়ে নিলো। জুয়েল তখন ভাবনার রাজ্যে ছিলো,ততক্ষণে অন্তরা নিজে তৈরি হয়ে নিয়ে রানাকেও তৈরি করে দিলো।
কোনো প্ল্যান ছাড়াই বাহিরে বের হওয়ার মজাই আলাদা। চিড়িয়াখানায় যেতে প্রায় আধাঘন্টা সময় লেগে গেলো। ভেতরে গিয়ে রানা যতটা অবাক তার চাইতে বেশি অবাক হলো অন্তরা।।জীবনের প্রথম বার সে এই চিড়িয়াখানায় এসেছে। কেমন উত্তেজনা কাজ করছে ভেতরে!
এতো পশু,পাখি দেখে কেমন লাগছে অন্তরার।
অন্তরার এক্সাইটমেন্ট দেখে জুয়েলের কিছুটা খারাপ লাগলো। বিয়ের এতো দিনে এই প্রথম সে অন্তরাকে নিয়ে ঘুরতে এসেছে।
বিশাল এড়িয়া জুড়ে গড়ে ওঠা চিড়িয়াখানা দেখে অন্তরার চক্ষু কপালে উঠে গেলো। আজীবন জেনে এসেছে বাং লাদেশের জাতীয় চিড়িয়াখানা মিরপুরে অবস্থিত।ওখানে বিভিন্ন ধরনের পশুপাখি আছে কিন্তু তা নিজের চর্মচক্ষু দিয়ে দেখার সৌভাগ্য হয় নি কখনো।
উল্লুকের খাঁচার সামনে গিয়ে রানা ভীষণ আনন্দ পেলো।ওদের চিৎকার,চেচামেচি মায়হা ধরিয়ে দিচ্ছে যেনো।
সবার দেখাদেখি রানা ও বায়না করলো বানপ্রকে কলা খাওয়াবে সে।অগত্যা তাই হলো।
সিংহ,বাঘ,ভাল্লুক সবাই কেমন অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে সবার দিকে।
শিকলে বাঁধা পড়লে এরকম হিংস্র পশু ও ভীষণ অসহায়, মানুষের হাতের পুতুল হয়ে যায়। অথচ যদি এরা সবাই নিজ নিজ জায়গায় থাকতো তাহলে এই চোখে অসহায়ত্ব নয়,বরং ফুটে উঠতো অন্যরকম একটা তেজ।
সব কিছু ছাড়িয়ে অন্তরার চোখে পড়লো ময়ুর।রূপার ভীষণ পছন্দ ময়ুর।সবসময় বলতো,আপা আমার যদি কখনো অনেক টাকা হয় তবে আমি হাঁস,মুরগী পালবো না মায়ের মতো। আমি ময়ুর পালবো।
কেমন রাজকীয় এক ভাবভঙ্গি নিয়ে হাটাহাটি করছে ময়ুর।
সারা অঙ্গে এক স্বর্গীয় রূপ নিয়ে প্রচন্ড অহংকারীর ন্যায় হাটছে কেউ,কেউ বা বসে আছে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে।
গায়ের উজ্জ্বল নীল আর সবুজ রঙের কাছে পৃথিবীর সব রঙ যেনো ম্লান হয়ে যায়। বেশ খানিকটা জটলা ময়ুরের খাঁচার সামনে। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে সেই বিস্ময়কর দৃশ্য দেখার,কখন ময়ুর তার পেখম মেলে তার রূপের ১৬ আনা প্রকাশ করবে।
চিড়িয়াখানা থেকে বের হওয়ার সময় অন্তরার ভীষণ মন খারাপ হলো। ছোট বোনদের কথা ভীষণ মনে পড়তে লাগলো। যদি চার বোন মিলে একসাথে এই সময়টা কাটাতে পারতো!
জুয়েলের অলক্ষ্যে চোখের জল মুছে নিলো অন্তরা।স্ত্রী, সন্তানকে নিয়ে জুয়েল বাসার উদ্দেশ্যে বাসে উঠে গেলো। সেই সাথে বাসে উঠলো চিড়িয়াখানা থেকে তাদেরকে ফলো করে আসা এক জোড়া চোখ।
————–
সকালে অপরূপা বের হলো কলেজের উদ্দেশ্যে। বাসা থেকে কলেজ খুব একটা বেশি দূরে না।হেঁটে যেতে প্রায় মিনিট বিশেক লাগে তবে আজ রূপার ঘুম থেকে উঠতে দেরি হওয়ায় অন্য দিনের মতো হেঁটে চলে যেতে পারলো না।
রিকশার জন্য রূপা অপেক্ষা করছিলো যখন সেই মুহুর্তে দেখতে পেলো রূপক বাইকে করে তার বোনদেরকে নিয়ে যাচ্ছে।
রূপককে দেখে বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে ফেললো রূপা। বাইকের গ্লাসে দৃশ্যটা দেখে রূপকের ইগো হার্ট হলো।
এরকম একটা সুপুরুষ, হ্যান্ডসাম যেখানে মেয়েদের ক্রাশলিস্টের টপে থাকে সেখানে কি-না গ্রামের একটা মেয়ে তাকে দেখে নাক মুখ কুঁচকে ফেলছে!
তাকে দেখে কি নর্দমার মতো লাগছে যে মেয়েটা এরকম করলো!
পান্না ফিসফিস করে বললো, “আপা,মেয়েটা আমাদের কলেজেই পড়ে। আর্টসের স্টুডেন্ট। ”
রিকশার অপেক্ষা করতে করতে অবশেষে সোনার হরিণের দেখা পেলো রূপা।রিকশায় উঠে বসলো। কিছুটা যেতেই রাস্তার মোড় ঘুরার সময় রিকশা আর একটা চলন্ত বাইক মুখোমুখি লেগে গেলো। ধাক্কা লেগে রূপা রিকশা থেকে রাস্তায় পড়ে গেলো।
মাথায় হেলমেট থাকায় রূপকের তেমন একটা লাগে নি।তবে উঠে দাঁড়িয়ে দেখলো দোতলার সেই মেয়েটা রাস্তায় পড়ে আছে। হাতের চামড়া বেশ অনেকটা উঠে গেছে পিচঢালা রাস্তার সাথে ঘষা লেগে।
কিছুটা মায়া হলো রূপকের মেয়েটার এরকম দুরবস্থা দেখে।এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলো রূপাকে তোলার জন্য।
রূপা রূপকের দিকে এক নজর তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো তারপর নিজে নিজেই উঠে দাঁড়ালো।
রূপকের ততক্ষণে ইগো আরো হার্ট হচ্ছে।
এই মেয়েটা তাকে পাত্তাই দিচ্ছে না!
মেয়েটা কি তাকে উপেক্ষা করতে চাইছে? কেনো উপেক্ষা করতে চাইছে?
সবসময় সবার এটেনশান পাওয়া মানুষকে যখন কেউ তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে তখন তার ইগোতে সবচেয়ে বেশি আঘাত লাগে। তাদের একটা সহজাত ভাবনা থাকে যে সে সবসময় সবার আগ্রহের কারণ হবে,সবাই তার প্রতি আকৃষ্ট হবে,এবং এটাই যেনো চিরন্তন সত্য।তার একটু এদিক ওদিক কখনো হতে পারে,কেউ তাকে অগ্রাহ্য করতে পারে এটা কখনো রূপকের ভাবনায় ছিলো না।
যার কারণে রূপা চোখে মুখে ফুটে ওঠা বিরক্তি ভাব রূপক কে ভীষণ ভাবে পোড়াতে লাগলো। হৃদয় যেনো পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে, নিজের আত্মসম্মানে কেমন একটা তীক্ষ্ণ তীরের ফলা এসে বিঁধেছে।
কেমন যেনো লাগলো রূপকের!
নিজেকে সামলে সে বাসার দিকে গেলো। মনে মনে ঠিক করলো আবার দেখা হলে মেয়েটাকে বেশ কিছু কথা শুনিয়ে দেবে।
একটা পায়ে রূপা ভীষণ চোট পেয়েছে, কিছুটা খুড়িয়ে খুড়িয়ে যখন বাসার দিকে যাচ্ছিলো, সমুদ্র তখন বের হচ্ছে ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে। হলুদ জামা পরা মেয়েটার পাশ কাটিয়ে কিছুটা যেতেই আচমকা সমুদ্রের মনে পড়লো মেয়েটাকে সে আগে কোথাও দেখেছে।
কোথায় দেখেছে কিছুতেই মনে করতে পারছে না।
চলবে……
রাজিয়া রহমান
(রেগুলার হওয়ার চেষ্টা করছি,কিন্তু কিছুতেই পারছি না।তবুও ইচ্ছে করে আগের মতো প্রতিদিন গল্প দিতে।ইনশাআল্লাহ আবারও আগের মতো একটিভ হবো।
বানান ভুল,টাইপিং মিস্টেক থাকলে ক্ষমা করবেন।)