#তুমি_অপরূপা (১৯)
অন্তরার সকাল হলো বুকে পাথর চাপা কষ্ট নিয়ে। রেশমাকে কিছুতেই তাড়িয়ে দেওয়া যায় নি তার এক কথা, হয় রানাকে দিতে হবে তা না হলে সে ও এখানেই থাকবে।
কিন্তু রানা চলে গেলে অন্তরা কিভাবে বাঁচবে!
জুয়েল অফিসে গেলে অন্তরার সময় কেটে যায় রানাকে নিয়ে। রানা যদিও তাকে মা বলে ডাকে না,তবুও অন্তরা বিশ্বাস করে একদিন রানা তাকে মা বলে ডাকবে।
এক দিন রানা আসায় অন্তরার ভীষণ রাগ হয়েছিলো অথচ এখন রানাকে ছাড়া একটা মুহূর্ত ও অন্তরা ভাবতে পারে না। কিছুতেই রানাকে যেতে দিতে পারবে না অন্তরা।রানা চলে গেলে জুয়েল ও ভেঙে পড়বে অন্তরা জানে।
কিন্তু এভাবে কিভাবে চলবে!
রেশমাকে যদি এখানে আবারও জায়গা দিতে হয়!
না,ভেবে পায় না অন্তরা।
দরজা খুলে বাহিরে এসে দেখে রেশমা রান্নাঘরের গতরাতের সব ধুয়েমুছে রেখেছে। ঝুড়িতে থাকা জুয়েলের ময়লা কাপড় ও রেশমা ধুয়ে রেখেছে।
অন্তরার ভীষণ কষ্ট হলো এসব দেখে। এটা তো তার সংসার। রেশমা এতে হস্তক্ষেপ করছে কেনো!
রেশমা নিজের প্ল্যানমতন আগাচ্ছে। অন্তরাকে দেখে মিষ্টি করে হেসে বললো, “আমার উপর রাগ করে থেকো না বোন।আমার মতো অসহায় আল্লাহর দুনিয়ায় আল্লাহ আর কাউকে না করুক।ভাইবো না,তোমার সংসার আমি কাইড়া নিমু না।তোমার স্বামী, সংসার তোমারই থাকবো।আমি শুধু আমার পোলাটারে লইয়া যাইতে চাই। এই পোলার লাইগা আমি সব ছাইড়া ফিরা আইছি।”
অন্তরার চোখ টলটলে হয়ে গেলো শুনে।রানাকে কিভাবে দিবে সে!
আস্তে করে বললো, “রানার বাবা যে বাঁচবে না রানাকে ছাড়া। ”
রেশমা হাউমাউ করে কেঁদে বললো, “আমি কি করমু বইন তুমি কও,তুমি আমার মায়ের পেটের বইন মানলাম,আমার আর কেউ নাই এই দুনিয়ায়। নিজের বাপ মা ও জায়গা দেয় না,যাওয়ার জায়গা নাই। এই পোলা ছাড়া এতো বড় দুনিয়ায় আমার কেউ নাই। তুমি রানার বাপেরে একটু বুঝাও। আমি তোমাগো কাম কইরা খামু,কামের বেটির মতো থাকমু। শুধু আমারে মাথা গোঁজার ঠাঁই দাও, এই খানেই ফ্লোরে থাকমু আমার পোলারে বুকে লইয়া। কোনো ঝামেলা করমু না।তুমি আমার ধর্মের বইন,তোমার দুই পায়ে ধরি আমি।”
অন্তরাকে হতভম্ব করে দিয়ে রেশমা সত্যি সত্যি ওর দুই পা চেপে ধরে কেঁদে উঠলো।
অন্তরা নিজেও বুঝতে পারলো না সে এখন কি করবে।
রেশমার কান্নায় অন্তরার ও কষ্ট হতে লাগলো। আবেগের বশে অন্তরা সবচেয়ে বড় ভুল করলো। দ্রবীভূত মনে জুয়েলকে বুঝিয়ে বলার সিদ্ধান্ত নিলো।
আজকের আকাশ স্বচ্ছ কাঁচের ন্যায়। একেবারে ঝকঝকে তকতকে একটা সকাল।রোদের ও তেমন একটা তেজ নেই।এই নরম আলোরএকটা আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। নিজেকে কেমন স্বাধীন স্বাধীন আত্মবিশ্বাস এনে দেয়।মনে হয় যেনো মুক্ত পাখি,যেখানে ইচ্ছে উড়ে যেতে পারবে।
রূপার কেমন জানি আজকে খুব ঘুরাঘুরি করতে ইচ্ছে করছে। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছে কি করা যায়।
কিছুতেই মন টানছে না আজ কলেজে যাবার জন্য।
রূপাকে বের হতে দেখে উপরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা পান্না ছুটে গেলো বোনের কাছে,উত্তেজিত হয়ে বললো, “ভাবী নেমেছে আপা,যাচ্ছে উনি।”
ব্যাগ কাঁধে নিয়ে দুই বোন পড়িমরি করে ছুটে গেলো। এতো দিনে তাদের দাদা একটা মেয়েকে পছন্দ করেছে, তার সাথে বন্ধুত্ব করতে বলেছে বোনদেরকে।দুই বোনের কাছে দাদার আদেশ যে শিরোদার্য।
গতকাল রাতে রুপক বোনদের রুমে যায় এক বক্স চকলেট নিয়ে।
দুই বোন তখন পড়া শেষ করে সবেমাত্র উঠেছে। রূপক চকলেট নিয়ে বললো, “নে মিষ্টি মুখ কর।একটা সুখবর আছে। ”
দুই বোন লাফিয়ে বিছানায় উঠে দাদার দুই পাশে বসে বললো, “কি সুখবর দাদা,বল না।”
রূপক হেসে বললো, “তোদের জন্য তো ভাবী ঠিক করে ফেলেছি আমি। তোরা তোদের ভাবীর সাথে আগামীকাল থেকে একইসাথে কলেজে যাবি,আবার একই সাথে ফিরবি।”
রত্না,পান্না একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো দাদার কথা শুনে।
এতোটা ছাড় দিচ্ছে দাদা তাদের!
পান্না দাদার হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললো, “মেয়েটা কে দাদা বল না?নাম কি?”
“অপরূপা, তার নাম অপরূপা। যেই মেয়েটি পাশের ফ্ল্যাটে নতুন এসেছে, মনে আছে তোদের?
সে-ই। দেখ,আমাদের নামের ও কতো মিল!
ও রূপা আর আমি রূপক!”
দুই বোনের আনন্দ আর ধরে না।ফাইনালি কেউ ওদের ভাবী হবে।দাদা কাউকে পছন্দ করেছে মানে সে ই হবে দাদার বউ।রগচটা, ঘাড়ত্যাড়া রূপককে সবাই জানে,সে যা চায় তা তারই হয়।
রত্না পান্না ছুটে গিয়ে রূপার দুই পাশে দাঁড়িয়ে বললো, “হ্যালো, আমি রত্না আর ও পান্না।”
রূপা এদের চেনে,সবসময় দেখে আসা যাওয়ার সময়। কখনো কথা হয় নি।
আজ ওরা আগ বাড়িয়ে কথা বলায় কিছুটা অবাক হলো । আস্তে করে বললো, “আমি অপরূপা। ”
পান্না বললো, “তোমার নামটা খুব সুন্দর। একেবারে তোমার মতো সুন্দর একটা নাম।”
রূপা বিব্রত বোধ করলো।
রত্না বললো, “তুমি আমাদের বন্ধু হবে?আমরা একই সাথে কলেজে আসা যাওয়া করবো তাহলে। যদিও আমি সেকেন্ড ইয়ারে আর পান্না ফার্স্ট ইয়ারে তোমার সাথে । ”
এদের এই আগ বাড়িয়ে বন্ধু হতে চাওয়া রূপার কেমন যেনো লাগলো। বিড়বিড় করে বললো, “না মানে,তোমরা তো প্রতিদিন তোমাদের ভাইয়ের সাথে যাও,আসো।উনি কিছু বলবে না?”
পান্না উত্তেজিত হয়ে বললো, “আরে,দাদাই তো আমাদের বলেছে তোমার সাথে….। ”
রত্নার চোখ রাঙ্গানির দিকে তাকিয়ে পান্না আর কথা শেষ করতে পারলো না। আমতাআমতা করে বললো, “মানে দাদা বলেছে আর কি আমাদের যদি কোনো মেয়ে বান্ধবী থাকতো, এক সাথে আসা যাওয়ার সুযোগ থাকতো তাহলে আর তার যাওয়া লাগতো না।”
শুনে রূপা আশ্বস্ত হলো। তারপর রত্না বললো, “চলো যাই কলেজে,সময় হয়ে যাচ্ছে ক্লাসের।”
কোথাও যাওয়ার প্ল্যান বাদ দিয়ে রূপা ওদের সাথে হাটতে লাগলো। কিছুটা যেতেই দেখলো সমুদ্র দাঁড়িয়ে আছে হাতে একটা সাদা গোলাপ ফুল।
রূপা বিরক্ত হলো। তবে খুশি ও হলো এই ভেবে যে আজকে এই দুজন সাথে থাকলে সমুদ্র আর কিছু বলতে পারবে না।
হলো ও তাই।সমুদ্র যখন দেখলো রত্না আর পান্না রূপার সাথে যাচ্ছে, কিছুটা লজ্জা পেলো সে।রত্না পান্না দুজনেই তার কাছে ছোট বোনের মতো। তাদের সামনে একটা মেয়েকে ফুল দেওয়ার মতো সাহস তার নেই।
অগত্যা ফুল হাতে নিয়ে অসহায়ের মতো পেছন থেকে তাকিয়ে রইলো সমুদ্র।
সমুদ্রের থেকে কিছুটা দূরে ঠোঁটে বিজয়ীর হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখছে রূপক। সে তো এটাই চেয়েছিলো।
সমুদ্রের ভাঙা মন রূপকের উল্লাসিত হবার কারণ।
মনে মনে রূপক বললো, “কেমন লাগছে এবার সমুদ্র! প্রেম কি কঠিন জ্বালার জিনিস, কতো ছটফটিয়ে ম/রার জিনিস তোমাকে আমি বুঝাবো। খুচরো পয়সার মতো একটা একটা করে তোমাকে আমি বুঝাবো।
তারপর বুঝবে তুমি, যেই আঘাত আমাকে দিয়েছিলে সবটা হাড়ে হাড়ে টের পাবে।সামান্য কারণ নিয়ে বন্ধুত্ব ছিন্ন করেছিলে,আরো কষ্ট পাওয়া বাকি আছে। ”
চলবে……
রাজিয়া রহমান