#তুমি_অপরূপা (২১)
শাহেদ বাড়িতে কল দিলো ৭ দিন পর।রোজিনা বেগমের ছোট বাটন ফোন ক্রিংক্রিং করে বেজে উঠতেই অনামিকার বুকের ভেতর একটা সুখের পাখি ডানা ঝাপটাতে লাগলো। পরক্ষণেই সেই সুখ বিষাদে রূপ নিলো।
শাহেদ এখন আর অনামিকার কথা জিজ্ঞেস করে না,বরং রোজিনা বেগম কিছু বলতে গেলেও বিরক্ত হয়ে বলে, “ওর খবর নেওয়ার জন্য কল দিই নাই মা।তোমার, আব্বার খবর নিতে কল দিছি।ওর ব্যবস্থা আমি কিছুদিনের মধ্যে করবো। ”
ছেলেকে আবারও তার আগের মতো হতে দেখে রোজিনার আনন্দ হয়।বিয়ের পর ছেলেরা বদলে যাওয়ার শংকা সব মায়ের থাকে,রোজিনা ও ব্যতিক্রম নয়। বদলে যাওয়া ছেলেটা আবারও আগের মতো হচ্ছে এটাই তো স্বস্তি।
শাহেদদের বাড়ির দুই বাড়ি পরে মিলনদের বাড়ি।গত কয়েকদিন ধরেই ছেলেটাকে বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করতে দেখা যায়,প্রায় সময় অনামিকার দিকে তাকিয়ে থাকে ছেলেটা।
রোজিনা বেগম ও লক্ষ্য করেছেন ব্যাপারটা। প্রথম দিন বুঝতে পেরেই হাসানুজ্জামানকে জানান রাতে।হাসানুজ্জামান ভেবে বললো, “তুমি ওই পোলারে খেদাইও না বুঝলা।এইটাই সুযোগ। তুমি একটু দূরে দূরে সইরা থাইকো।ওগোরে সুযোগ দিও।তাইলে এইভাবেই ওই বেজন্মা মাইয়ারে বাড়ি থেইকা খেদামু।পিরিতি করন আমার পোলার লগে,এমন বদনাম উঠামু আমার পোলা তো ডিফোজ দিবোই,আর অইন্য কোনো পোলা ও বিয়া করবো না।”
স্বামীর যুক্তি রোজিনার পছন্দ হলো। না হলে এই মেয়েকে তাড়ানোর মতো শক্ত কারণ তো দেখাতে পারবেন না।
মিলন কেমন চোরা চোখে অনামিকার দিকে তাকাচ্ছে।
রোজিনা মিলনকে দেখে হাসিমুখে বললেন,”মিলন না-কি! বও বাবা,বও।কি খবর তোমাগো? আহো না তো এহন আর।তুমি একটু বও,আমি একটু আইতাছি রাস্তার মাথা থাইকা। ”
ওদের সুযোগ করে দিতে রোজিনা সরে গেলো। ফিরলো অনেকটা সময় পর। ফিরে এসে দেখে মিলন অনামিকার সাথে রান্নাঘরের সামনে পিড়িতে বসে হেসে হেসে কথা বলছে অনামিকা ও হাসছে।
রোজিনা মনে মনে হাসলেন।বোকা মাইয়া বুঝে নাই ক্যান তারে এতো সুযোগ দিতাছে।
চাচীকে ফিরতে দেখে মিলন কিছুটা অপ্রতিভ হয়ে উঠে গেলো, অনামিকা ও গম্ভীর হয়ে গেলো। রোজিনার থেকে বিদায় নিয়ে মিলন চলে গেলো।
রোজিনা আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো অনামিকার ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির রেশ লেগে আছে।
বিড়বিড় করে রোজিনা বললেন,”নষ্টা মহিলা,উড়তে থাক যত পারস।মুখ থুবরাইয়া এমনভাবে পড়বি,সেদিন আর মুখ তুইলা কারো দিকে চাইতে পারবি না।”
মিলন আসার পর অনামিকার কেমন যেনো আনন্দ আনন্দ লাগছে।এভাবে মুখবন্ধ করে এখানে থাকতে থাকতে অনামিকা মনে হয় দম বন্ধ হয়ে মরে যেতো। এটা বাড়ি নয়,যেনো কোনো শ্মশান।
————–
অন্তরার সাথে জুয়েলের মান অভিমান হয়ে গেলো গতরাতে। ইদানীং রেশমা সবসময় বাসায় শাড়ি পরে, সাজগোজ করে ঘুরঘুর করে। অন্তরা জানে শাড়ি জুয়েলের ভীষণ পছন্দ। রেশমা যে জুয়েলকে ইমপ্রেস করতে এসব করছে তা অন্তরার বুঝতে বাকি নেই।
প্রথম দিন অফিস থেকে ফিরে জুয়েল চমকে গেলো রেশমাকে আগের সাজে দেখে।বুকের ভেতর কেমন ধড়ফড় করতে লাগলো ওর। এই বিশেষ সাজ কিসের জন্য জুয়েল জানে।মাঝেমাঝে মধ্যরাতে রেশমা এভাবে সাজতো।বিশেষ মুহুর্তের আগে এভাবেই সেজে দাঁড়াতো জুয়েলের সামনে।
সেভাবে অনেক দিন পরে রেশমাকে দেখে জুয়েলের বুকের ভেতর ধুকপুক করতে থাকে।রেশমা মুচকি হেসে সরে যায় সামনে থেকে।
জুয়েল খেয়াল করলো টিপ পরে নি রেশমা।পরক্ষণেই মনে পড়ে তার ওয়ালেটে রেশমার জন্য কেনা এক পাতা টিপ আছে।
ফ্লোরে একটা কাথার উপর বিছানার চাদর বিছিয়ে রেশমা ঘুমায়।জুয়েল জানে না কেনো সে তখন এমন বিহ্বল হয়ে টিপের পাতাটা বের করে রেশমার বিছানার উপর রেখেছিলো। তারপর মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় রুমে ঢুকে যায়।
অন্তরা এই টিপের পাতাটা আসার পর থেকেই জুয়েলের ওয়ালেটে দেখছে।হঠাৎ গতকাল রাতে জুয়েলের ওয়ালেটে না দেখে জিজ্ঞেস করলো জুয়েলকে।
বিব্রত হয়ে জুয়েল বললো, “রানার মায়ের জন্য কেনা,তাই তাকে দিয়ে দিয়েছি।”
মুহূর্তেই অন্তরার হাসিমুখে আষাঢ়ের মেঘ জমে গেলো, দুচোখ জলে ভরা নদীর ন্যায় ভরে উঠতে লাগলো।
এতটা তো আশা করে নি অন্তরা।জুয়েলের রেশমার প্রতি এখনো পিছুটান রয়ে গেছে!
ভালো মন্দ,ঠিক ভুল কোনো কিছু না ভেবেই যার আশায় সব ছেড়ে এসেছিলো সে ও অন্তরাকে ঠকাচ্ছে!
পরমুহূর্তে অন্তরার মনে পড়লো সে জুয়েলের জন্য নয়,বরং বাড়ি থেকে মুক্তি পেতে,আব্বাকে চিন্তা থেকে মুক্তি দিতেই জুয়েলের সাথে এসেছে। তখন জুয়েলের প্রতি ভালোবাসার চাইতে মুক্তি পাওয়া বেশি দরকার ছিলো অন্তরার।কিন্তু সে কি জুয়েলকে ভালোবাসে নি!
এই যে এতো দিন সংসার করছে,জুয়েল অফিসে যাওয়ার আগেই উঠে গরম ভাত তরকারি রান্না করে দেয় দুপুরে লাঞ্চের জন্য, সকালের নাশতা করে। রাতে জুয়েল আসার আগেই গরম ভাত রেঁধে ফেলে। জুয়েল ঠান্ডা ভাত খেতে পছন্দ করে না বলে। এসব কি ভালোবাসা নয়!
শুধুই কি দায়িত্ব?
ভালোবাসার কি ছিঁটেফোঁটা ও দেখে নি জুয়েল!
সে হয়তো রেশমার মতো পরিপাটি হয়ে থাকে না,শাড়ি পরে ঘরের কাজ করতে পারে না বলে শাড়ি পরে না।
তাছাড়া অন্তরার শাড়ি মোটে দুটো। একটা শাড়িতে তেলাপোকা কেটেছে।
ভালো শাড়ি একটাই আছে,তুলে রাখা।একটা মাত্র শাড়ি দিয়ে তো এসব রংঢং করা যায় না।
বাবার বাড়িতে বাবার আর্থিক অবস্থার দিকে তাকিয়ে কতো শখ আহ্লাদ ত্যাগ করেছে। একটা ভালো জামা গায়ে দিতে গেলে ১০ বার ভেবেছে অন্তা,,অপরূপা,অনিতার কথা।
বাবার টাকা পয়সার সংকটের কথা।
আর এখন স্বামীর স্বল্প বেতনের টাকা থেকে সেভিংসের কথা চিন্তা করে নিজের একেবারে খুব প্রয়োজনীয় কিছু কিনতে হলে তবেই কেনে।এমনকি চেষ্টা করে প্রতি মাসে ন্যাপকিনের টাকা জমিয়ে রাখছে।
অথচ সেই স্বামী কি-না প্রথম স্ত্রীর প্রতি মুগ্ধ হচ্ছে।
অন্তরা সেই রাতে জুয়েলের সাথে আর কথা বললো না, খাবার বেড়ে দিয়ে বসে রইলো টেবিলে। জুয়েল খেতে বসে একবার আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো রানা আর রেশমাকে।
রেশমার অনাবৃত পিঠের দিকে না চাইতে নজর গেলো। নিজেকে সংবরণ করলো জুয়েল।কি করছে সে!
রেশমা একটা মোহ জুয়েল জানে।রেশমা এসব তাকে ভুলানোর জন্য করছে,পুরোটা একটা ফাঁদ।তবু কেনো জুয়েল জেনে শুনে ফাঁদে পা দিতে যাচ্ছে!
মনে মনে ঠিক করলো যেভাবেই হোক রেশমাকে বের করে দিবে।নয়তো অন্তরার প্রতি অবিচার হবে।
সেই রাতে অন্তরা আর জুয়েলের গা ঘেঁষে ঘুমালো না।অন্তরার কোঁকড়া এলোমেলো চুল পিঠের উপর ছড়িয়ে আছে,উপুড় হয়ে শুয়ে আছে অন্তরা।
জুয়েল কি করবে!
অন্তরাকে ডাকতে ও পারছে না অপরাধবোধের কারণে। কেনো সে রেশমাকে টিপের পাতাটা দিতে গেলো!
পানি বেশি খাওয়ায় জুয়েলের প্রস্রাবের বেগ পেলো।একটাই কমন ওয়াশরুম বাসায়,যেতে হলে বাহিরে যেতে হবে।কিন্তু না গিয়েও পারছে না জুয়েল।
তাই কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা বের হয়ে ওয়াশরুমে গেলো।
বের হয়ে আসার সময় ছেলের দিকে তাকিয়ে চমকে গেলো জুয়েল।রেশমার পরনের শাড়ি-ব্লাউজের কোনো কিছুই ঠিক নেই।মুগ্ধতা নয়,চিন্তা হলো জুয়েলের।রানা উঠে যদি মা’কে এভাবে দেখে তবে ব্যাপারটা খুব খারাপ হবে।
রেশমাকে ডাকতে ও ইচ্ছে করছে না। উপায় না পেয়ে জুয়েল রেশমার শাড়ি নামিয়ে দিলো। রেশমার মুখের দিকে তাকালো জুয়েল।এই মুখ দেখে কেউ কি বুঝবে এই মুখের আড়ালে লুকিয়ে আছে কতো কদর্য!
রেশমা ঘুমাচ্ছে, রানা ঘুমাচ্ছে,অন্তরা ঘুমাচ্ছে। জুয়েল পারছে না ঘুমাতে। কি করবে সে!
রেশমাকে তাড়িয়ে দিলে তো রানা কে ও হারিয়ে ফেলবে। কিন্তু রানার কথা ভাবতে গেলে অন্তরাকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।
অন্তরা রুমের দরজার সামনে এসে দেখলো জুয়েল কেমন করে তাকিয়ে আছে রেশমার দিকে। অন্তরা তীর্যক হাসি হেসে বললো, “প্রিয়তমার প্রিয় মুখ!
গভীর রাতের মধুর সব স্মৃতিচারণ!”
জুয়েল চমকে উঠলো অন্তরার কথা শুনে। কিন্তু অন্তরাকে বুঝাইয়া গেলো না কিছু।অন্তরা এখন কিছুই বুঝবে না,অযথা অশান্তি হবে ভেবে জুয়েল চুপ করে রইলো।
জুয়েলের এই মৌনতা অন্তরাকে আরো বেশি কষ্ট দিতে লাগলো। বিছানার এক কোণে বসে ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে লাগলো অন্তরা।
অন্য দিকে ফিরে জুয়েল ভাবছে কোন দিকে যাবে!
এতো জটিলতা সহ্য করতে পারছে না জুয়েল।
রেশমা শুয়ে শুয়ে হাসলো। ভয়ংকরভাবে আঘাত দিবে সে অন্তরা কে,সংসার ফিরে পেতে হলে অন্তরাকে ভেঙে চুরমার করে দিতে হবে।
চলবে…..
রাজিয়া রহমান
(বি দ্র:সব গল্প সুখের হয় না,সবার জীবনে ও সুখ আসে না।তাই গল্পকে গল্পের মতো নিন।)