#তুমি_অপরূপা(২২)
সময় কিভাবে যেনো কেটে যায়, রূপা টের পায় না। রত্না পান্না কিভাবে কিভাবে যেনো ওর সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু হয়ে গেছে রূপা বুঝতে ও পারলো না। ওরা দুই বোন রাউপাকে এমনভাবে মায়ায় জড়িয়ে নিয়েছে রূপার মনে হয় যেনো ওরা ওর আত্মার আত্মীয়। অনেক দিন পরে যেনো অন্তরা আর অনামিকাকে ফিরে পেয়েছে রূপা।
রূপা একটা ব্যাপার বুঝে না।ওদের সাথে ওদের মায়ের তেমন কোনো ভালো সম্পর্ক নেই। কেমন গা ছাড়া ভাব মা মেয়েদের সাথে। কিন্তু ওদের দাদার সাথে সম্পর্ক ভীষণ ভালো।
রূপার হিংসে হয় মাঝেমাঝে, কি সুনিপুণভাভে ওদের ভাই ওদের সব আবদার পূর্ণ করে দেয়। তার ও যদি একটা ভাই থাকতো তবে হয়তো এভাবে আদর,ভালোবাসা,শাসনের বেড়াজালে জড়িয়ে রাখতো বোনদেরকে।তাহলে হয়তো অন্তরা,অনামিকা ভুল পথে পা বাড়াবার আগে একবার হলেও ভাবতো।
হয়তো জীবনটা অন্যরকম হতো।
বাবার কাঁধে হাত রেখে বলতো,”আজকে তোমার শরীর ভালো নেই,তুমি বাড়ি থাকো বাবা,আমি দোকানে বসছি।”
অথচ মেয়ে বলে কখনো বাবাকে এই কথাটা বলতে পারে নি।
ভাবতে ভাবতে রূপার হঠাৎ করে মনে হলো, কেনো পারে নি কখনো বাবাকে এই কথাটা বলতে?
কি ক্ষতি হতো যদি বলতো!
লোকলজ্জার ভয়ে?
তাতে কি লাভ হয়েছে এখন?
যেই সমাজের ভয়ে বাবাকে এই কথাটা বলার কথা ও কখনো মাথায় আসে নি,সেই সমাজ কি বাবাকে এক মুহূর্তের জন্য সুখ এনে দিয়েছে?
যে কখনো সুখী করতে পারে না, তার ভয়ে কেনো কষ্ট পাবে তাহলে মানুষ!
রূপা বুঝতে পারে তার মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে। গ্রামের সেই শান্ত, ভীতু রূপা এখন দিন দিন বদলে যাচ্ছে। শহরের হাওয়া গায়ে লাগলে কি এমনই হয়?
রূপা ঠিক করে এবার বাড়িতে গেলে বাবার দোকানে বসবে।ছেলে হলে যেভাবে বাবার দোকানে বসতো,বাবাকে সাহায্য করতো সেভাবেই করবে।
শহরে এসেই রূপা দেখেছে মেয়েরা ও দোকান চালায়।সেই থেকেই মাথায় ঘুরছিলো।
রূপার এসব ভাবনার মাঝেই রত্না এলো।শুক্রবারের এক তপ্ত দুপুর।ভ্যাপসা গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত। এই গরমের মধ্যে ঘেমে বসে আছে রূপা।ভাবনায় মগ্ন থাকায় বুঝতে পারে নি কখন যে ঘেমে তার গোসল হয়ে গেছে।
রত্না এসে বললো, “রূপা,চল তেঁতুল মাখা খাবো।আজকে তুই মাখবি কিন্তু।”
রূপার তখন বড় আপার কথা মনে পড়ে গেলো। বাড়িতে আম,তেঁতুল,বড়ই,পেয়ারা যখন যা-ই মাখানো হতো বড় আপাকে দায়িত্ব দেওয়া হতো মাখানোর।তিন বোন মিলে সব কেটেকুটে রেডি করে দিতো,আপা শুধু তার হাত দিয়ে মাখাতো।ইস,যেনো অমৃত!
রূপা জানে আপা মেখেছে বলেই এতো বেশি ভালো লাগছে।কেননা চুপি চুপি অনামিকা আর সে ও এক দিন মাখিয়ে খেয়ে দেখেছে কিন্তু বড় আপা মাখালে যেমন স্বাদ হয় তেমন হয় নি।
রূপা হেসে বললো, “আমি মাখালে ভালো লাগে না রে,তোরা মাখাবি।”
রত্না বললো, “হবে না।আজকে তোকেই মেখে খাওয়াতে হবে।চল না,পানা সব রেডি করতেছে।”
ঘেমে জবজবে শরীরে রূপা রত্নাদের বাসায় গেলো। রূপক তখন ল্যাপটপে কাজ করছে। রূপাকে দেখে একবার চোখ তুলে তাকালো।
চোখ নামিয়ে নিতেই পরেরবার আবারও কিসের এক অনিবার্য কারণে তাকালো তা রূপকের জানা নেই।তাকিয়ে দেখলো ঘামে মেয়েটার কপালের চুলগুলো ওর কপা,গালের সাথে আটকে আছে।মোটা করে বিনুনি করা কোমর সমান চুল,কেমন কালো তেলতেলে।
সুতি কচুপাতা রঙের একটা জামাতে মেয়েটাকে কেমন নির্মল লাগছে।
কোনো প্রসাধনী নেই,কোনো চাকচিক্য নেই,কোনো কৃত্রিমতা নেই, তবুও সাধারনের মধ্যে মেয়েটা অসাধারণ।
রূপক অনুভব করে এই মেয়েটার ব্যক্তিত্ব প্রবল ধারালো। সে নিজেও যে দুর্বল হয়ে পড়ছে বুঝতে পারছে।
আশ্চর্য হচ্ছে এই ভেবে,কখনো কি ভেবেছে এরকম সাধারণ একটা মেয়ে ও তার মনে দোলা দিয়ে যাবে?
রূপা তাকালো না রূপকের দিকে। রত্নাদের রুমের বারান্দায় গিয়ে দেখে পান্না তেঁতুল আর টমেটো রেডি করে রেখেছে, ধনেপাতা ও আছে সাথে।বাকি সব উপকরণ নিয়ে পান্না বসে আছে।
বিসমিল্লাহ বলে রূপা মাখতে বসলো। তেঁতুল, টমেটো, ধনেপাতা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। কেমন লাল একটা রঙ এসেছে।
পান্না হামলে পড়লো বাটির উপর। একটু তুলে মুখে দিয়ে আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেললো। এতো স্বাদ,এতো শান্তি লাগছে পান্নার।
কাড়াকাড়ি করার আগেই রত্না একটা ছোট বাটিতে তুলে নিয়ে বললো, “খবরদার, তোরা এখন খাবি না কিন্তু,আমি দাদাকে দিয়ে আসি এটা।দাদা ভীষণ পছন্দ করে এসব খেতে।”
পান্না মিটিমিটি হেসে বললো, “যা,যা আপা।”
রত্না রাগ হয়ে বললো, “না না,আমি জানি আমি এখান থেকে দুই পা যেতেই তুই খাওয়া শুরু করবি।নে,তুই যা।তুই দিয়ে আয় দাদাকে।”
পান্না পিছনে সরে গিয়ে বললো, “অসম্ভব আপা।তুই তো আমাকে দুই পা যাওয়ার ও সুযোগ দিবি না।খাওয়া শুরু করে দিবি তুই।আমি যাবো না।”
দুই বোনের এই তর্কযুদ্ধ দেখে রূপা উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “উফ,ঝগড়া বন্ধ কর।আমাকে দে,আমি দিয়ে আসছি।”
রত্না রূপার হাতে বাটি দিলো।রূপা যেতেই এক বোন অন্য বোনকে হাই ফাইভ দিয়ে হাসতে লাগলো।
পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে রূপক কাজ করছে। রূপা এসে পাশে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করে বললো, “এটা আপনার জন্য দিয়েছে রত্না।”
রূপক মাথা না তুলে বললো, “একটা চামচ দাও,আমি হাত দিয়ে খেতে পারবো না। ”
রূপা ঠোঁট উল্টে বললো, “চামচ আমি কোথায় পাবো।”
মনে মনে ভাবলো, “এই লোক কি ভাবে সবাইকে?আমাকে সরাসরি আদেশ দিচ্ছে চামচ এনে দিতে! অনুরোধ করতে পারে বড়জোর, তা না একেবারে আদেশ,চামচ এনে দাও।যেনো আমি তার হুকুম তামিল করার অপেক্ষায় আছি।”
রূপক মাথা নেড়ে বললো, “তাহলে নিয়ে যাও।আমার সময় নেই এখন,ব্যস্ত আছি।”
রূপা বিরক্ত হয়ে বললো, “ঠিক আছে নিয়ে যাচ্ছি। ”
রূপা যেতে নিতেই রূপক পেছন থেকে বললো,
“হে আল্লাহ,এক ক্ষুধার্ত মানুষের সামনে থেকে যে খাবার নিয়ে যেতে পারে, তার মনে মায়াদয়া বলতে কিছু নেই তা প্রমাণিত। এজন্যই কবি লিখেছেন, হাশরের দিনে বলিবেন খোদা,হে আদম সন্তান,
আমি চেয়েছিনু ক্ষুধায় অন্ন, তুমি কর নাই দান।
মানুষ বলিবে- তুমি জগতের প্রভু,
আমরা কেমনে খাওয়াব তোমারে, সে কাজ কি হয় কভু?
বলিবেন খোদা- ক্ষুধিত বান্দা গিয়েছিল তব দ্বারে,
মোর কাছে তুমি ফিরে পেতে তাহা যদি খাওয়াইতে তারে।”
রূপা হতভম্ব হয়ে গেলো রূপকের কথা শুনে। এই লোক তো মহা ত্যাঁদড়!
বাটি নিয়ে রূপা রত্নাদের রান্নাঘরে গিয়ে চামচ এনে দিলো। তারপর ঝড়ের বেগে প্রস্থান করলো সেখান থেকে।
রূপক মুচকি হেসে এক চামচ নিয়ে মুখে দিলো।মুখে দিতেই তার চোখ বন্ধ হয়ে গেলো। কতো দিন পর এরকম কিছু খাচ্ছে!
রূপা যেতেই রত্না বললো, “উফ,তাড়াতাড়ি আয়।জিবে পানি এসে তো মহাসাগর হয়ে যাচ্ছে। খেতে পারছি না তোর অপেক্ষায়। নে শুরু কর।”
তিনজন গল্প করতে করতে খেতে লাগলো। ওদের খাওয়ার মধ্যে রূপক গিয়ে হাজির।একপাশে দাঁড়িয়ে বললো, “এই অল্প একটু কি দিয়েছিস আমাকে,বাটি এদিকে দে।”
বাটি তুলে নিয়ে রূপক হাত দিয়ে খেতে শুরু করলো। রূপকের হাত দিয়ে খাওয়া দেখে রূপা মুচকি হাসতে লাগলো। খেয়ে রূপক বললো, “ভীষণ মজা হয়েছে, কি মেখেছিস?তার হাতটা স্বর্ন দিয়ে বাধাই করে দিই।”
পান্না বললো, “রূপা মেখেছে দাদা।”
রূপক সহজভাবে বললো, “রূপা,কাল আবারও মেখো তো।আচ্ছা, শুনো শুধু কাল না,প্রতিদিনই মাখবে আমি বাসায় থাকলে বুঝলে।খবরদার,আমি না থাকলে কখনোই এই দুইজনকে মেখে খাওয়াবে না।আমাকে ছেড়ে যে খাবে তার পেটে অসুখ হবে বলে দিলাম।”
রূপকের কথায় তিনজনই হাসতে লাগলো। রূপক ফিরে গেছে অনেক বছর আগের স্মৃতিতে।যখন সবাই একসাথে ছিলো। ফুফু এভাবে দুপুর হলে বড় এক ডিশ নিয়ে বসতো।বাড়ির সবাই মিলে কি আনন্দ করে খেতো। তারপর ফুফু হারিয়ে গেলো। সেই সাথে হারিয়ে গেলো রূপকের সব আনন্দ। হারিয়ে গেলো যৌথ পরিবার।
রূপার রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাস্তা দেখা যায়। রুমে এসে গায়ের জামা পালটে রূপা বারান্দায় এসে দাঁড়ালো।
সমুদ্রকে দেখতে পেলো দাঁড়িয়ে আছে। রূপা এখন জানে ওর নাম সমুদ্র,এ ও জানে এই ছেলেটা রূপাকে ভীষণ বিরক্ত করতে চায়।
দেখতে ভীষণ ইনোসেন্ট যেনো ভাজা মাছ ও উলটে খেতে জানে না অথচ মনে মনে এসব অসভ্যতা!
বিরক্ত হয়ে রূপা রুমে চলে গেলো। রুমের মেয়েরা রূপার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।রূপা দুচোখ সবার উপর ঘুরছে।
একজন হেসে বললো, “কেমন পাগলা, দিওয়ানা হয়ে আছে ছেলেটা রে রূপা,কিভাবে এমন পাগল করলি?”
রূপা কঠিন স্বরে বললো, “বাজে কথা না বললে খুশি হবো।”
মাহি এসে বললো, “কেনো,ভালো লাগছে না সত্যি কথা শুনতে? রাগ করছো কেনো এতে?আমাকে ও একটু শেখাও না কিভাবে শহরের ভালো ঘরের ছেলেদের পটাতে হয়?দেখো না,এতো দিন ধরে চেষ্টা করে ও রূপকের মন পেলাম না অথচ তুমি এসে দু দিনেই সমুদ্রের মন কেড়ে নিলা।”
মাহির কথা শুনে মাহির দুই বন্ধবী হেসে উঠলো। রূপা দমে গেলো না তাতে।তীর্যক হাসি হেসে বললো, “অবশ্যই আপা,তবে আমি তোমাকে আগামীকাল প্রাকটিক্যাল দেখাবো কিভাবে ছেলেদের ইমপ্রেস করতে হয়।”
মাহি কিছুটা থমকে গেলো রূপার এরকম চটপট জবাব শুনে।সে ভেবেছিলো রূপা লজ্জা পাবে।
পরদিন দুপুর বেলা রূপা পেয়ারা, কাঁচাপেপে,লেবু মেখে ভর্তা বানালো।
মাহি ‘কে হেসে বললো, “মাহি আপা,আমার সাথে এসো।”
রূপক গ্যারেজে গাড়ির বনেট খুলে কাজ করছিলো। মাহি হতভম্বের মতো রূপা পিছু পিছু এসেছে। কেনো এসেছে সে নিজেও বুঝতে পারছে না।
মাহি নিচে এসে রূপকের পাশে দাঁড়িয়ে বললো, “আপনার জন্য এনেছি,নিন।”
রূপকের দুই হাতে কালি লেগে আছে।পেছনে মাহিকে দেখে বললো মাহিকে জ্বালানোর জন্য বললো , “আমার হাতে তো কালি,খাইয়ে দিতে পারো যদি তবে খাবো।”
রূপা মুচকি হাসলো, তারপর হাতে তুলে রূপককে খাইয়ে দিলো। মাহি অবাক এই দৃশ্য দেখে। রূপা মনে মনে বললো, “খুব জ্বলছে এবার?আবারও লাগতে আসবে আমার সাথে? ”
চলবে…..
রাজিয়া রহমান