#তুমি_অপরূপা(২৪)
রাতের আকাশে উজ্জ্বল তারারা কেমন মিটিমিটি হাসছে আজ।রূপক অস্থির হয়ে পায়চারি করছে।
মন অশান্ত হয়ে আছে।কিছুতেই নিজেকে শান্ত করতে পারছে না সে।
বারবার বিবেকের দংশনে দংশিত হচ্ছে। বিবেক বারবার বলছে,সে ভুল করছে।প্রিয় বন্ধুর ভালোবাসা ছিনিয়ে নেওয়ার মতো ন্যাক্কারজনক কাজ দ্বিতীয় কিছু নেই।
কিন্তু বেহায়া মন কিছুতেই তা মানতে চাচ্ছে না।মন বারবার বুঝাতে চাচ্ছে যে না এটা কোনো ভুল না।এমন তো নয় রূপা সমুদ্রকে ভালোবাসে,যদি এমন হতো রূপাও সমুদ্রকে চায় সেখানে রূপক মাঝখানে ঢুকে পড়ছে তাহলে মন মেনে নিতো।কিন্তু এখন ব্যাপারটা তেমন তো নয়।রূপা পদ্মবিলের কাঁটাযুক্ত পদ্ম,কাঁটার আঘাত সহ্য করে যে তাকে তুলতে পারবে সে-ই পাবে তাকে।সেখানে সমুদ্রের অগ্রাধিকার কিসের!
রূপকের অসহ্য লাগছে সব।কি করবে সে?এতো টানাপোড়েন কেনো তার!
সমুদ্র কে তার?কেউ না সমুদ্র।প্রাণের বন্ধুত্ব বলতে কিছু হয় না এই দুনিয়ায়, সবাই স্বার্থপর।
সবাই নিজেকে নিয়ে ভাবে।অযথা সে কেনো সমুদ্রের কথা ভাবতে যাবে!
সমুদ্র কি ভেবেছিলো সেদিন রূপকের কথা?
————–
পাশের মতো মহল্লার সাথে ফুটবল খেলে ফিরছিলো রূপকদের টিম। ৩-১ গোলে রূপকেরা জিতেছে। এর মধ্যে ২ টা রূপক দিয়েছে। টিমের বেস্ট খেলোয়াড় না শুধু,আশেপাশের মহল্লার মধ্যে বেস্ট খেলোয়াড়ের নাম জিজ্ঞেস করলে সবার আগে সবাই রূপকের নাম নিবে।ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন,বাস্কেটবল,ক্যারাম সব কিছুতেই রূপক সেরা।
সমুদ্র এসবের মধ্যে নেই।তার শুধু একটাই প্রিয় খেলা।তা হচ্ছে দাবা।
সেদিন ও সমুদ্র দর্শকের আসনে বসে প্রিয় বন্ধুকে উৎসাহ দিচ্ছিলো।চশমা পরা শান্তশিষ্ট, গোলগাল ছেলেটা যখন দর্শকের আসনে বসে বন্ধুকে উৎসাহ দিচ্ছে সেই মুহুর্তে তার সাইলেন্ট থাকা ফোনটা বেজেই চলেছে। একবার, দুইবার, তিনবার….
পরপর ১৬ টা কল এলো সমুদ্রের মা রেখার ফোন থেকে।
অত্যন্ত রাগান্বিত হয়ে রেখা ছেলেকে বারবার কল দিয়ে যাচ্ছে। আজকে সমুদ্রকে বাসায় ভীষণ প্রয়োজন তার।
কবির কল করেছিলো বহুদিন পর।প্রায় ৭ মাস পর কবিরের কল পেয়ে রেখা ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়ে। এক কথা, দুই কথায় রেখা জানতে পারে কবিরের নানে থাকা সব সম্পদ কবির একটা বৃদ্ধাশ্রমে দান করতে চায় এবং শেষ বয়সটাও সেই বৃদ্ধাশ্রমে কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
কবিরের একমাত্র দুর্বলতা সমুদ্র।কেননা এই ছেলেটাকে তিনি কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন।
সমুদ্র ফোন হাতে নেয় খেলা শেষ হবার পর।মায়ের এতো কল দেখে কিছুটা ভড়কে যায় সমুদ্র।
ঘেমে-নেয়ে রূপক এসে শক্ত করে সমুদ্রকে জড়িয়ে ধরে বললো, “জিইত্তা গেছি দোস্ত! ”
সমুদ্র মুখ পাংশু করে বললো, “আমার খবর আছে দোস্ত। আজকে বাসায় গেলে মায়ের হাতের মার মিস হবে না।দেখ,কতো কল দিয়েছে। নিশ্চয় ইমারজেন্সি কিছু ছিলো। ”
রূপক নিজের মুখের ঘাম মুছতে মুছতে বললো, “তাড়াতাড়ি বাসায় যা তাহলে। ”
সমুদ্র একটু চুপ থেকে বললো, “তুই ও আয় না আমার সাথে। মনে হচ্ছে কোনো ঝামেলা হয়েছে। ”
রূপকদের টিম সহ সবাই নিজেদের মহহল্লার দিকে গেলো বিজয় উল্লাস করতে করতে।সমুদ্রের চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে রূপক হেসে মনে মনে বললো, “বেচারা,এখনো স্কুলে পড়ে ছোট বাচ্চা রয়ে গেছে। এখনো মা’কে কেমন ভয় পায়!”
বাসায় গিয়ে দেখলো রেখা অস্থির হয়ে পায়চারি করছে। সমুদ্রের কেমন যেনো পরিস্থিতি থমথমে মনে হলো। রূপকের ও মনে হলো কিছু একটা হয়েছে।
রেখা ছেলেকে দেখে রেগে বললো, “কোথায় ছিলে তুমি সমুদ্র!তোমাকে আমি কতোবার কল করেছি তোমার কোনো আইডিয়া আছে?
বাউন্ডুলে ছেলেদের সাথে সবসময় ঘুরে বেড়াও,তোমার এতো অধঃপতন কিভাবে হলো! ”
রেখার কথাগুলো রূপকের গায়ে ভীষনভাবে বিঁধলো।বাউন্ডুলে কাকে বলছে উনি!
তবুও হেসে রূপক বললো, “আসলে আন্টি,আমাদের ফুটবল ম্যাচ ছিলো তাই সমুদ্র ও ওখানে গিয়েছিলো। আর এতো হইহট্টগোল ছিলো যে ও শুনতে পায় নি রিংটোন।”
রূপকের কথা শুনে রেখার মেজাজ সপ্তমে উঠে গেলো। ভীষণ রেগে গিয়ে বললো, “বেয়াদব ছেলেদের সাথে ঘুরাঘুরি করে বেড়াও বলেই এতো অধঃপতন হচ্ছে দিনদিন তোমার। আমার এতো কল দেখে তুমি কল ব্যাক করার প্রয়োজন ও মনে করলে না!
করবে কেনো,চলাচল তো করো সেইসব থার্ডক্লাশ ছেলেদের সাথে যারা নিজের বাবা-মাকে রেস্পেক্ট করে না।তোমার থেকে রেস্পেক্ট আশা করাও বৃথা।”
মায়ের কথা শুনে সমুদ্রের কান ঝাঁঝাঁ করে উঠলো লজ্জায়।রূপককে যে উদ্দেশ্য করে মা এসব বলছে তা সমুদ্র বুঝতে পারছে।হঠাৎ কি হল মায়ের!
রূপককে এভাবে কথা বলছে কেনো মা!
ভেবে পেলো না সমুদ্র।
রেখার ততক্ষণে ঠিক বেঠিক চিন্তাভাবনা লোপ পেয়েছে। আগের মতো উত্তেজিত হয়ে বললো, “আর তুমি, তোমার সাথে তো আমি কথা বলছি না।আমি আমার ছেলেকে আস্ক করছি তুমি মধ্যে ইন্টারফেয়ার কেনো করছো!
তোমাদের জন্য আমাদের একটা ফ্যামিলি শেষ হয়ে গেলো। ”
রূপকের এসব অপমান হজম করতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।কিন্তু প্রিয় বন্ধুর দিকে তাকিয়ে এসব হজম করা তার জন্য কোনো ব্যাপার না।
কিবতু রেখার শেষ কথাটা কেমন খটকা লাগলো রূপকের।তাই জিজ্ঞেস করলো, “আমাদের জন্য মানে?আমরা কি করেছি আপনাদের?”
রেখা তখন ভেবে চিনতে কথা বলার সিচুয়েশনে নেই,এতো টাকার প্রপার্টির চিন্তায় সে মশগুল। তাই ক্রুদ্ধ স্বরে বললো, “কেনো তুমি জানো না?তুমি জানো না সমুদ্রের চাচা কবির যে কেমন ছন্নছাড়া হয়ে গেছে। কার জন্য হয়েছে এরকম ছন্নছাড়া ও?
কে করেছে তাকে এইরকম?
তোমার ফুফু সালমা করেছে। কবির শুধু ওকে ভালোবেসেছে। আর সেই এক তরফা ভালোবাসা তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সালমার সাথে ওর বিয়ে ও ঠিক হয়।কিন্তু সালমা পালিয়ে যায়। এরপর থেকে কবির গৃহত্যাগী হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কতো বড় দুশ্চরিত্র হলে একটা ছেলের সাথে পালিয়ে যাওয়ার সাহস করে তোমার ফুফু।আমি যদি জীবনে কোনো দিন ওই মহিলার দেখা পাই তবে ওর মুখে থুঃ দিয়ে বলবো, ভীষণ অহংকার ছিলো রূপের,রূপ দিয়ে আমার দেবরের মাথা খেয়েছিস সেই রূপে আমি থুঃ ফেলি।”
রূপকের কাছে তার ফুফু শব্দটা একটা ইমোশন।এক সময় ফুফুর ভীষণ আদর পেয়েছে সে।যদি খুবই ছোট্ট ছিলো কিন্তু তার সাক্ষী দেয় বাসার পুরনো ছবির এলবাম। সব ছবিতে দেখা যায় রূপক তার কোলে।যখন রূপক বুঝতে শিখেছে ততদিনে ফুফু হারিয়ে গেছে, ভীষণ মিস করে রূপক ফুফুকে।রূপকের ফুফুর প্রতি এই অগাধ মায়া, ভালোবাসা দেখেই রূপকের দাদা সালমার ওয়ারিশি সম্পদ রূপকের নামে দিয়ে যায়। তিনি জানতেন তার নাতি কখনো বেইমানি করবে না।
না রূপক করে নি বেইমানি। কার সাথে করবে?নিজের রক্তের সাথে!
নিজের রক্তের সাথে যে বেইমানি করে, নিঃসন্দেহে পৃথিবীর নিকৃষ্ট মানুষ সে।
রেখার কথায় রূপকের ততক্ষণে মাথা গরম হয়ে গেছে। রেখার কথার জবাবে রূপক ও নিজেকে সংযত করে বললো, “আন্টি,আমার ফুফুকে নিয়ে আর একটা যদি বাজে কথা বলেছেন তবে ভীষণ খারাপ হবে।আমার ফুফু তো কাউকে মাথার দিব্যি দেয় নি যে তাকে না পেলে সব ছেড়েছুড়ে যেতে হবে।যে গিয়েছে সেটা তার ব্যাপার।আমার ফুফুর না।
আপনি সমুদ্রের মা বলে আমি এখনো চুপ করে আছি আন্টি,তা না হলে আপনার জায়গায় অন্য কেউ হলে আমি এতক্ষণে তার জিহবা টেনে ছিড়ে ফেলতাম।আমার মাথা গরম করবেন না আন্টি প্লিজ।”
রূপক যে এরকম বেয়াদব রেখা আগে বুঝেন নি,তার মুখেমুখে তর্ক করছে এই ছেলে!
যেখানে তার ছেলে তার দিকে তাকিয়ে কথা ও বলে না। রাগান্বিত হয়ে হাত তুললেন রূপককে থাপ্পড় দেওয়ার জন্য। রূপক ও রেখার হাত ধরে ফেললো, রাগের মাথায় রেখার হাত ঝাড়া দিতেই রেখা দুই পা পিছনে চলে গেলেন তাল সামলাতে না পেরে।
সমুদ্র কখনো মায়ের সাথে তর্ক করার সাহস ও করে নি, সেখানে রূপককে তার মায়ের সাথে এরকম অভদ্রতা করতে দেখে সমুদ্রের ভীষণ রাগ হলো। রূপকের শার্টের কলার চেপে ধরে বললো, “তোর এতো বড় সাহস রূপক,আমার মায়ের সাথে বেয়াদবি করছিস?”তোর এতো সাহস কিভাবে হলো রূপক?তুই তোর মা’কে অসম্মান করিস বলে ভাবিস না আমি ও আমার মা’কে অসম্মান করি।সবাইকে তোর মতো গুন্ডা, বদমাস ভাবিস না-কি তুই?
এতো দিন বাহিরে গুন্ডামী করতি আর আজ আমার সামনে আমার মায়ের সাথে? তোর জায়গায় অন্য কেউ হলে আমিও এই হাত ভেঙে দিতাম।”
রূপক ভীষণ অবাক হলো সমুদ্রের কথা শুনে। সমুদ্র তাকে গুন্ডা বলছে!
অথচ রূপক সবচেয়ে বেশি গুন্ডামী করেছে সমুদ্রকে প্রটেক্ট করতে গিয়ে। স্কুলের ছেলেরা যখন সহজ সরল, শান্ত সমুদ্রকে নিয়ে মজা করতো, ক্ষেপাতো তখন কে দাঁড়াতো ওদের সামনে বুক ফুলিয়ে?
রূপক-ই তো দাঁড়িয়েছে বুক ফুলিয়ে। কি করে নি সে সমুদ্রের জন্য? পরীক্ষায় সেকেন্ড পজিশন হলে সমুদ্রের মন খারাপ হয়,বাসায় মায়ের বকাবকি শুনতে হয় বলে নির্দ্বিধায় কতো পরীক্ষা রূপক খারাপ দিয়েছে তা কেউ কি জানবে কখনো?
সমুদ্র তো জানতো রূপক ফুফুর জন্য সবসময় কতো আফসোস করে, সমুদ্র কি বুঝে নি তার মায়ের কথাগুলো রূপকের বুকের কতো গভীরে গিয়ে লেগেছে!
শান্ত স্বরে রূপক বললো, “আজকের পর থেকে তোর সাথে আমার কোনো বন্ধুত্ব নেই।আমি জেনে নিবো আমার কোনো বন্ধু ছিলো না। ”
সমুদ্রের ও রাগ হলো। সেও বলে দিলো,”আমার মা’কে যে সম্মান করতে পারে না, আর যাই হোক আমার বন্ধু হবার যোগ্যতা তার নেই।আমার আফসোস হচ্ছে আমি এতো দিন ধরে যাকে বন্ধু ভেবেছি তার আসল রূপটা আরো আগে দেখি নি বলে। আর যেনো তোকে আমার আশেপাশে না দেখি।”
————–
রূপকের চোখ জ্বালা করছে। কেনো ভাবছে এসব সে!
কেনো সে রূপাকে ভালোবেসে ও সরে যাবে!
কেনো সবসময় তাকেই স্যাক্রিফাইস করতে হবে?
না পারবে না। কিছুতেই না।
বিবেক যতোই বলুক,যতোই খারাপ লাগুক,নিজের ভালোবাসা রূপক এভাবে ছেড়ে দিবে না।সে রূপাকে সত্যি ভালোবাসে।
চলবে…..
রাজিয়া রহমান
(রিচেক দিই নি,বানান ভুল,টাইপিং মিস্টেক থাকতে পারে। একটু কষ্ট করে পড়ে নিয়েন।আর আজকের পর্বে সব কনফিউশান ক্লিয়ার করে দিলাম।শুধু নায়ক কে তা বাকি আছে ক্লিয়ার করা।তা আপনারা গল্প পড়তে পড়তে বুঝবেন।
সবার এতো দিনের অপেক্ষা ছিলো ওদের ঝামেলা কেনো হয়েছে, রূপকের ফুফু কে তা জানার জন্য। যদিও অনেকেই বুঝতে পেরেছেন কে রূপকের ফুফু।
আজকের পর্ব কেমন লেগেছে সবার,অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন।সবার মতামতের অপেক্ষায় রইলাম।)