#পরিণয়_প্রহেলিকা
#লেখিকা_সিনথীয়া
#পর্ব_১
দুপুর সাড়ে বারোটা। আফিয়া বেগম মাত্রই রান্নাঘর থেকে বের হয়েছেন। গরমে একে বারে যবু থবু অবস্থা তার। আজকাল আবহওয়ার যে কি হলো! মনে হয়ে যেন আগুনের ফুলকি ঝরছে সবখান থেকে। এরকম অবস্থায় রান্নাঘরটা মনে হয় আস্তো এক দোযগখানা। কিন্তু এই চিন্তা করে তো কোন লাভ নেই। বাড়ির মানুষের পেটের চিন্তা করতে হলেতো এই কষ্টটা সহ্য করতেই হবে। আফিয়া বেগমের জন্য অবশ্য এটা কষ্ট না। স্বামী সন্তানদের জন্য রান্না করতে ওনার বেশ ভালোই লাগে। বড় বউ ঝুমা, কতো মানা করে তাকে রান্না ঘরে আসতে, বলে ওই নাকি রান্নাটা দেখে নিতে পারবে, কিন্তু আফিয়া নাছোড়বান্দা! তিনি আসবেনই। আর তাছাড়া ঝুমা অন্তঃসত্বা, ছয় মাস চলছে। ওরই তো বরঞ্চ রেস্টের দরকার এখন, সেখানে ওকে দিয়ে রান্নার কষ্ট করাবেন এমন শাশুড়ি আফিয়া নন। তাই বাসায় রান্নার কাজে সাহায্য করার জন্য রাখা আলেয়া বুয়াকে নিয়ে আফিয়া প্রতিদিনের রান্না শেষ করে মোটামোটি এই সময়ে বের হন। এখন তিনি উপরে নিজের ঘরে যেয়ে তাড়াতাড়ি গোসল করবেন, তারপর নামাজ পরে একটু কোরআন পরবেন। ততক্ষণে বাবুল সাহেব, আফিয়া বেগমের স্বামীও চলে আসবেন অফিস থেকে। নিজস্ব ব্যবসা বলেই দুপুরে বাসায় এসে খেয়ে একটু বিশ্রাম করতে পারেন। মাঝে মাঝে বড় ছেলে মাহিবও আসে লাঞ্চে কিন্তু বাবাকেই বেশির ভাগ সময় আসতে দিয়ে নিজে থেকে যায় অফিসে। অথরিটির সবাই বাসায় চলে গেলে কেমন দেখায় না! তবে আজ মনে হয় মাহিবও আসবে কারণ ঝুমা বললো সকালে ও নাকি আজ লাঞ্চ নিয়ে যায় নি। তাই আফিয়া বেগম ধরে নিয়েছেন ও আজ বাড়িতেই খাবে।
এইসব ভাবতে ভাবতেই সিড়ি দিয়ে উঠছিলেন আফিয়া যখন মাঝ রাস্তায় কলিংবেলের আওয়াজে তার পা থেমে গেল। বড় হলরুমটার এক কোণায় সজ্জিত গ্র্যান্ডফাদার ক্লকের দিকে তাকিয়ে ভুরু জোড়া কুচকে আসলো তার। এই ভর দুপুরে কে আসলো? মাহিব আর ওর বাবা আসবে ২টার দিকে। মেহরাব আর মাহিরা তো ভার্সিটি গেলই ১০টায়, এতো তাড়াতাড়ি তো ফেরার প্রশ্নই আসে না। মালিহা তো গেছে স্টাডি ট্যুরে সোনারগাঁয়ে, ফিরতে রাত। তাহলে এখন কে আসবে?
আফিয়া ততক্ষণে নামতে শুরু করেছেন। ঝুমাও দোতলার রেলিঙে এসে কৌতুহলি চেহারায় প্রশ্ন করলো,
– মা, এই সময় কে আসলো?
আফিয়া ওপরে এক পলক তাকিয়ে বললেন,
– তাইতো আমিও ভাবছি….
এর মাঝেই আবার বেল বেজে উঠলো। আফিয়া এবার একটু তাড়া দিলেন,
-এই রাবেয়া দেখ তো কে?
বাড়ির ১৭ বছরের কাজের মেয়েটা দৌড়ালো এক প্রকার। ততক্ষণে আফিয়াও সিড়ি থেকে নেমে পরেছেন। দরজা খোলার শব্দ পেলেন এবং তার সাথেই কানে আসলো রাবেয়ার চিকন কন্ঠের চিৎকার,
– মেঝ ভাইয়াআআআ
হঠাৎ দুপা থেমে গেল আফিয়া বেগমের। বুকটা ধক্ করে উঠলো। রাবেয়ার ‘মেঝো ভাইয়া’ বলে চিৎকারটা কানের ভেতরে যেয়ে বজ্রপাত করেছে।
-এই মেয়ে মেজো ভাইয়া কাকে বললো? তাহলে কি…কিন্তু কিভাবে…এখন…
আফিয়া বেগমের মাথা কাজ করা বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি জোড়ে পা চালালেন দরজার দিকে কিন্তু এগোতে পারলেন না বেশী। আবার হোচট খেয়ে দাড়িয়ে পরলেন। সামনে যাকে দেখলেন, তাকে তিনি কষ্মিকালেও এখন, এখানে আশা করেননি। চোখ দুটো কোটর থেকে এক প্রকার বের করে, হতভম্বের মতন চেয়ে অস্ফুট সুরে উচ্চারণ করলেন…
– মিহরান…
অপর পাশে দাড়ানো ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি লম্বা, সুঠাম দেহী যুবকটি সরল এক হাসি দিল,
– আম্মু…
একদম থমকে গেলেন আফিয়া। চোখ দিয়ে আপন গতিতেই বারি ঝরতে শুরু করে দিয়েছে। তা দেখে মিহরান, কাধের ব্যাগটা মাটিতে একপ্রকার ফেলে মায়ের কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে হাসতে লাগলো। তারপর সামনে এসে দুহাতের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে মায়ের চোখের অশ্রুধারা মুছে দিয়ে বললো,
-আমি তো ভাবলাম আমার এই সার্প্রাইজ তোমাকে সেইরকম খুশি দিবে, কিন্তু তুমি দেখি রিতিমত শক্ড! আমি কি এসে ভুল করলাম নাকি আম্মু।
এইবার আফিয়ার টনক নড়লো। জাপটে ধরলেন নিজের কলিজার ধনকে আর জোড়ে কান্না করে দিলেন। ভিষণ উত্তেজিত হয়ে পরেছেন তিনি,
– তুই আসছিস, আমার বিশ্বাস হচ্ছে না আব্বু, তুই সত্যি আমার সামনে? আমি স্বপ্ন দেখছি নাতো?
ছেলেকে অজস্রবার চেহারায়, মাথায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে বারবার প্রশ্ন করছেন আফিয়া। মিহরান মায়ের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে কিছুই বলছে না। ততক্ষণে পেছন থেকে বাসায় ঢুকলো মাহিব। মা-ছেলের মিলন দেখে হেসে ফেললো,
– না আম্মু, মোটেও স্বপ্ন দেখছো না তুমি। তোমার মেজো ছেলে সুদুর অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রকট হয়েছে তোমার সামনে।
আফিয়া মিহরানের পেছনে দাড়ানো তার বড় ছেলের দিকে প্রশ্নচক্ষু ছুড়লেন,
– তুই জানতি যে মিহরান আসবে?
মাহিব মুচকি হেসে মায়ের কাছে এলো,
– জি মাতাজি, আমি জানতাম। মিহরান আমাকে গত সপ্তাহেই জানিয়েছে যে ও আজ আসছে, কিন্তু তোমাদের বলতে মানা করেছিল সার্প্রাইজ দেওয়ার জন্য।
মাহিব এটা বলেই হাসতে শুরু করলো আর তার সাথে তাল মেলালো মিহরান। আফিয়ার মুখেও সেই হাসি ছোয়াছে রোগের মতন ছড়িয়ে গেল। দুই ছেলের কাধে আলতো হাতে মারলেন তিনি,
– বড় হয়েছিস তাও তোদের দুষ্টামি গেল না। হ্যা রে মাহিব, কয়দিন পর নিজে বাচ্চার বাবা হচ্ছিস, সেই খেয়াল আছে?
-এখানে বাবা হওয়ার সাথে এই মজার কি সম্পর্ক মা? আমি বাবা কেন, দাদা/নানা হয়ে গেলেও মজা করবো, কি বলিস মিহরান।
– একদম।
আফিয়া বড় ছেলের কথায় হাসতে হাসতে শেষ হচ্ছেন। আসলে মেজো ছেলেকে সামনে পেয়ে হাসির ছোয়া মলিন হওয়ার নামই নিচ্ছে না অধরযুগল থেকে।
ততক্ষণে তার পাশে এসে দাড়িয়েছে ঝুমা। মিহরানকে ওপর থেকেই দেখেছিল সে। তাই রুমে যেয়ে জামা ঠিক করে ওড়না ভালো করে পেঁচিয়ে আস্তে ধীরে নেমে এসেছে ও। ঠোটে বিস্তর হাসি নিয়ে শাশুড়ির পাশে এসে দাড়ালো। ওকে দেখে মিহরান এগিয়ে আসলো,
-কি খবর ঝুমা? শরীর কেমন তোমার এখন?
-ভালো স্যা…মানে ভাইয়া।
এই মুহূর্তটার অপেক্ষাতেই ছিল মাহিব। ঝুমা জিহ্বা কাটার সাথেই সাথেই হো হো করে হেসে দিল ও। আসলে ঝুমা মিহরানের ভার্সিটির ছাত্রী এবং এই সম্পর্কটাকেই সে দেবরের থেকে বেশী প্রাধান্য দেয়, তাই মিহিরানকে ভাইয়া ডাকার আগেই মুখে স্যার চলে আসে। এই নিয়ে ওকে অনেক বোঝালেও ও ভুলটা করেই!
মাহিবের মতন পেট ফেটে না হাসলেও ঝুমার কান্ডে মিহিরানও মুচকি হেসে দিল। ঝুমার মাথায় হাত ঝাকিয়ে বললো,
– নিজের বেশী বেশী খেয়াল রাখো। আর রেস্টে থাকবা।
ঝুমা মুচকি হাসে। সম্পর্কে মিহরানের বড় ভাবী হলেও মিহরান ওকে একদম নিজের ছোট বোনের মতন আদর করে। মালিহা, মাহিরার থেকে কোনো অংশে কম হয় না সেই আদর।
পাশে মায়ের দিকে তাকিয়ে মিহরান বললো,
-বাসা এতো চুপচাপ কেন মা? আমাদের সদস্যবহর কই? বাড়িতে নেই নাকি?
– এখন কি কেউ বাড়িতে থাকে? তোর বাবা তো অফিসে। মালিহা গিয়েছে স্টাডি ট্যুরে, ফিরতে রাত হবে। মেহরাব আর মাহিরাও ভার্সিটি। তুই জানিয়ে আসলে আজ কেউই যেত না কোথাও।
-ওওও।
মাহিব মাঝখান থেকে বললো,
– বাবাকে ফোন দিয়েছিলাম। বললেন বাসায় আসছেন। তোর কথা আর আগ বাড়িয়ে বললাম না, দেখা যাবে হুড়োহুড়ি করতে গিয়ে আবার কি হয়।
মিহরান ভুরু জোড়া কুচকায়,
-কেন? আব্বুর বুকের ব্যাথা কি বেড়েছে নাকি আবার? ঔষুধ ঠিক মতন খাচ্ছেন তো?
ছেলের দুশ্চিন্তায় আফিয়া হেসে দিলেন,
-আরে সবই ঠিক আছে তোর আব্বুর। কেমন হুড়োহুড়ির মানুষ সে তুই জানিস না? তাই মাহিব এটা বললো। ওসব বাদ দে। তুই আগে ফ্রেশ হয়ে নে। আমি রান্না চড়াচ্ছি।
-এখনো রান্না বসাওনি আম্মু? তোমার তো এসময়ের মধ্যে রান্না শেষ হয়ে যাওয়ার কথা।
আফিয়া হাসলেন। ছেলেটা দূরে থাকলেও পরিবারের সবার খবর রাখে।
-রান্না তো শেষই আব্বু, কিন্তু তোর জন্য একটু স্পেশাল কিছু বানাই। তুই গোসল সেরে ফ্রেশ হয়ে নে, আমার হয়ে যাবে ততক্ষণে।
বলেই আফিয়া ঘুরতে গেলেই মিহরান মায়ের বাহু ধরে নেয়,
– আম্মু এখন আর নতুন কিছু করতে যেও না। যা আছে তাই দাও। রাতে মালিহারা সবাই ফিরুক, তখন নাহলে কিছু বানিও, একসাথে সবাই মজা করে খাবো। এখন আমি ফ্রেশ হয়ে খেয়ে একটু ঘুমাবো, মাথা ব্যাথা করছে একটু। আমার বাসার চাবিটা দাও।
আফিয়া ছেলের কষ্ট শুনেই ব্যতি ব্যস্ত হয়ে গেলেন,
– আব্বু তোর বাসাটাতো পরিষ্কার করা নেই, তুই থাকিস না বলে বন্ধ করে রাখা থাকে সবসময়। এখন আপাতত মেহরাবের রুমে ফ্রেশ হয়ে ঘুম দে। কালকে ওখানে চলে যাস।
মিহরান না সূচক মাথা নাড়লো, গম্ভীর সুরে বললো,
– আম্মু তুমি জানো, আমি ঘুমের সময় আওয়াজ একদম নিতে পারি না। তাহলে মাথা আরও ব্যাথা করবে। আমি গোসল করে খেয়েই আমার বাসায় যাব। তুমি ওটা ঠিক করানোর ব্যবস্থা করাও।
আফিয়া আর ঝুমা আর দেরী করলো না। আফিয়া চাবি দিয়ে আলেয়া বুয়া আর রাবেয়াকে দ্রুত পাঠালেন ওপরে মিহিরানের এ্যাপার্টমেন্ট টা পরিষ্কার করতে। এই বাড়িটা বাবুল সাহেবদের পৈত্রিক জমিতে নির্মাণ করা। বাবুল সাহেবরা দুই বোন, এক ভাই। সাত তলা বিশিষ্ট এই বিল্ডিং এর দুই ইউনিট করে বারোটা ফ্ল্যাটের মাঝে বাবুল সাহেব পেয়েছেন ছয়টা আর তার দুই বোন পেয়েছেন তিনটা তিনটা করে। ছয়টার মাঝে দুই টা ইউনিট নিয়ে ডুপ্লেক্স বানিয়ে বাবুল সাহেব ও তার পরিবার থাকেন। বাকি চারটা ফ্ল্যাটের মধ্যে দুটো ভাড়া দেওয়া এবং ষষ্ঠ তলায় দুই ইউনিটকে একত্র করে তিন ভাগের এক ভাগে বানানো হয়েছে একটা স্টুডিও এ্যাপার্টমেন্ট যেটায় থাকে মিহরান একা। আর দু ভাগ জুড়ে বানানো হয়েছে ছাঁদ যেটার একাংশ খোলা এবং সেখানে একটা সুইমিংপুল নির্মিত। বড় ছাদটা সপ্তম তলায়।
মিহরান গোসলে যেতেই আফিয়া ঢুকলেন রান্নাঘরে। ছেলেটা নতুন কিছু খাবে না বললো ঠিকই কিন্তু মায়ের মন কি আর মানে সেটা! অন্তত ছেলের পছন্দের তার হাতের লাচ্ছা সেমাইটাতো এইটুকু সময় বানানো যেতেই পারে। সেই দুই আড়াই বছর আগে খেয়েছে। আহারে!
ঝুমাও শাশুড়ির সাথে রান্নাঘরে যাচ্ছিলো যখন মাহিব আল্তো হাতে স্ত্রীকে নিজের কাছে টেনে নিল। কানে ফিসফিস করে বললো,
– সরি বউপাখি, আজ সকালে ভাই আসার এক্সাইটমেন্টে তোমাকে ঔষুধও খাইয়ে যেতে পারিনি। তুমি খেয়েছিলা ঠিক মতন?
ঝুমা আস্তে করে খিলখিলিয়ে হাসে। স্বামীটা তার বড্ড খেয়াল রাখে।
– আমি খেয়েছি ঔষুধ। তুমি চিন্তা করোনা, আমি ভালো আছি।
– হমম, দেখছি তো কতো ভালো আছো তুমি। সবার এদিকে নজর থাকলেও তোমার সিড়ি দিয়ে নেমে আসা আমি দেখেছি। এতো দ্রুত নামছিলা কেন হ্যা? পরে টরে গেলে কি হতো?
ঝুমা হা হয়ে গেল। এই না মানুষটা ওকে আদর করছিল? বউপাখি বলে ডাকলো? আবার মুহূর্তে রঙ পাল্টে বকাও দেওয়া শুরু করলো? গিরগিটিও তো রঙ বদলাতে সময় নেয় এর থেকে বেশি। আর কি বললো সে? ঝুমা দ্রুত নেমেছে সিড়ি দিয়ে? কই? কখন?
– আমি কখন দ্রুত নামলাম? আস্তে আস্তে নেমেছি বলেই তো দেরী হলো নিচে আসতে। স্যারকে…আই মিন ভাইয়াকে তো আগেই দেখেছি ওপর থেকে। অন্য সময় হলে আরও আগেই সামনে চলে আসতাম হুহ! তুমি খালি সুজোগ পেলেই আমাকে বকো। ধুর, আর ভালো লাগে না!
বউ যে রাগ করেছে বুঝলো মাহিব। তাড়াতাড়ি টুপ করে ওর গালে একটা চুমু এঁকে দিল। পেটে কোমল ভাবে হাত দিয়ে বললো,
– আমার রাণী আর আমার রাজ কন্যার খেয়াল তো আমাকেই রাখতে হবে তাই না? সেই খেয়াল রাখতে একটু বকলে সেটা ধরতে নেই। এখন চলো রেস্ট নিবে।
ঝুমার তো রাগ চুমু খেয়েই শেষ। ও হেসে বললো,
– না, তুমি যাও ফ্রেশ হতে। আমি বরং একটু মা র কাছে যাই। আলেয়া, রাবেয়াও তো কাছে নেই। আর ওপরে গেলে আবার খাবারের সময় নামতে হবে। তাই আর না যাই।
মাহিব বুঝলো ব্যাপারটা,
– ঠিক আছে, তবে চুলার বেশী কাছে যেও না। রান্না ঘরে বসানো ফ্যানটার পাশেই থেকে। ঘেমো না যেন।
ঝুমা চমৎকার একটা হাসি দিয়ে বললো,
– তোমার মনে হয় মা আমাকে কিছু করতে দিবেন? আমাকে ওই ফ্যানের পাশেই বসিয়ে রাখবেন উনি, দেখে নিও।
মাহিবও স্ত্রীর কথায় সন্তুষ্ট হয়ে চলে গেল উপরে ফ্রেশ হতে। আর ঝুমা আস্তে ধীরে অগ্রসর হলো রান্না ঘরের পথে।
……………
মেহরাবের রুমে ঢুকে, প্রথমে ফ্রেশ হতে গেল মিহরান। জার্নিটা আসলেই ধকলের ছিল। দুবাই ট্রান্সিটের সময়টা এতো বাজে ছিল যে বসে দম ফেলাবারও সময় পায় নি। এখন একটা লম্বা গোসল দিতে পারলে শান্তি লাগবে।
গোসল সেড়ে এসে নিজের ফোন বের করলো মিহরান। বাংলাদেশের সিমটা এয়ারপোর্ট থেকে বের হওয়ার সময়েই মোবাইলে ভরে নিয়েছিল। প্রথমে মালিহা কে কল দিল।
মালিহা মাত্র বন্ধুদের সাথে পানামনগরীর জাদুঘরের সামনের ঘাসে বসে লাঞ্চ শুরু করবে তখনই ওর ফোনটা বেজে উঠলো। খাবারের বক্সটা পাশে রেখে ফোন বের করেই ভুরু জোড়া কুচকে গেল ওর,
– মেঝো ভাইয়ার বাংলাদেশের নাম্বার দিয়ে কে কল করলো?
চরম কৌতুহল নিয়ে ফোনটা কানে ধরতেই ওপর পাশের কন্ঠটা ওকে রীতিমতো চমকে দিল। শিওর হওয়ার জন্য কান থেকে ফোনটা সরিয়ে আরও একবার নাম্বার দেখলো ও।
– ভভাইয়া এটা ততুই?
মিহরান গাম্ভীর্য নিয়ে বললো
– তো আর কে হবে স্টুপিড?
এইবার মালিহা জোড়ে হেসে উঠলো,
– তা অস্ট্রেলিয়াতেও বুঝি গ্রামিন ফোন নিজের নেটওয়ার্ক পৌছে দিয়েছে? একদম বাংলা সিমে কথা বলছিস দেখি?
– তোর মতন স্টুপিডই এই কথা বলার যোগ্যতা রাখে। গাধি কোথাকার! অস্ট্রেলিয়ায় বাংলা সিম চলবে কিভাবে?
মালিহার পিঠ টান টান হয়ে পরলো,
-তাহলে?
– আমি দেশে এসেছি, এখন বাসায়।
ভাইয়ের এতো বড়বড় অপমানে, অন্য সময় হলে এতোক্ষণে মালিহা চন্ডি মাতায় রুপ নিত। কিন্তু মিহরানের শেষ দুই বাক্যে বাকি সব ভুলে গেল ও,
– তুই দেশে আসছিস? কখন, কিভাবে?
বোনের বোকা বোকা প্রশ্নে এবার নিঃশব্দে হাসলো মিহরান,
– সাধে তোকে গাধি ডাকি? দেশে আবার কিভাবে আসে? পায়ে হেটে?
মালিহা পাত্তা দিল না এসব কথায়, উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– ওসব ছাড় ভাইয়া, আসলেই বল্ তুই সত্যি ফিরসিশ? আমরা তো কিছুই জানি না।
– আরে বাবা, আসলেই ফিরসি। কাউকে জানাইনি, ভাইয়া বাদে। সবাইকে সার্প্রাইজ দিতে চাচ্ছিলাম। আর আসার পর থেকে এক একজনের এমন এমন কথা শুনে বুঝতে পারছি যে আমার সার্প্রাইজ সার্থক।
মালিহা খুশি তে কি করবে বুঝে উঠতে পারলো না।
-ভাইয়া, তুই আসলেই দেশে? ইশ! আজকেই আমার এই ফালতু ট্যুর টা হওয়ার লাগলো? আমি কেন আজ আসলাম? ধুর! দাড়া দেখি আমি আগেই চলে আসতে পারি নাকি। তোকে দেখার আর তর্ সইছে না ভাইয়া।
মিহরানের হাসি বিস্তৃত হলো। বোনকে শান্ত স্বরে বললো,
– আমি কোথাও পালিয়ে যাচ্ছি না, বাসাতেই আছি তাই তাড়াহুড়ো করিস না। গ্রুপের সাথে সাবধানে ফিরে আয়। রাতে জমিয়ে আড্ডা দিবো।
খিলখিলিয়ে হাসলো মালিহা,
-ওক্কে ডান।
হেসে মিহরান ফোন কেটে এবার ফোন লাগালো মেহরাব কে।
মালিহা ফোন রাখতেই পাশে তাকালো। দেখলো ওর বেস্ট ফ্রেন্ড তুরিন চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। কিছুক্ষণ আগেই পাশে এসে বসেছে ও তাই মালিহার সব কথা শুনতে পারেনি,
– এই ট্যুর হঠাৎ ফালতু হয়ে গেল তাই না? এতোদিন এই ট্রিপের জন্য তোর থেকে বেশি লাফাতে তো কাউকে দেখিনি মালিহা, আর আজ এখানে আসারই আফসোস জোগাচ্ছিস? মির জাফর কোথাকার!
মালিহা হেসে দিল তুরিনের কথায়। চোখ মুখ নাচিয়ে বান্ধবীর কাছ ঘেষে বসলো,
– এমন এক খবর দিব যে তোর কাছেও আজকে এই ট্রিপ পুরাই ফালতু লাগবে।
তুরিনের প্রশ্নবোধক চোখের দিকে চেয়ে মালিহা বড় করে হাসলো,
– মেঝো ভাইয়া ইস ব্যাক ফ্রম অস্ট্রেলিয়া।
ঝট করে তুরিনের চেহারায় রক্তিম আভা ফুটে উঠলো। কোটর থেকে বের হয়ে আসা চোখে এখনো অবিশ্বাস। মালিহার হাসি থামছেই না।
– কি? বল্লাম না খবর টা তোকেও নাড়িয়ে দিবে? কি এখনো এই ট্রিপ ভালো লাগছে?
তুরিন ভীষণ লজ্জা পেল। অন্যপাশে তাকিয়ে লাজুক হেসে ফেললো ও। মালিহা তা দেখে নিজের খোচানো আরও বাড়িয়ে দেয়,
-হায়রে আমার লাজুকলতা! মেঝো ভাইয়াকে যে তুই সেই কবে থেকে পছন্দ করিস, তা শুধু লজ্জার আঁচলে ঢেকে রাখলে হবে? বলতে হবে না?
তুরিন করুণ চোখে তাকায় বান্ধবীর দিকে,
– তুই পাগল হইসিশ মালিহা। তোর গুরুগম্ভীর মিহরান ভাইয়ার সামনে গেলেই আমার হাত পা তথা সর্বাঙ্গে কাপুনি ধরে। ওনার ভরাট গলার আওয়াজেই আমার মুখের তালা বন্ধ হয়ে যায়। আর সেই আমি নাকি মুখ ফুটে তাকে বলবো ভালোবাসার কথা! তার আগেই হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি হতে হবে আমাকে।
বান্ধবীর অসহায় কন্ঠ মোটেও মালিহার মনে সাহানুভুতি জাগালো না। বরঞ্চ মালিহা হাসতে হাসতে প্রায় ঘাসে লুটুপুটি খাওয়ার জোগাড় হলো। দমকে দমকে হাসির বান ছুটছে ওর ঠোট দিয়ে। এই অবস্থাতেই থেকে থেকে বললো,
– এই আইসিইউ আর জেনারেল ওয়ার্ডে ভর্তি হওয়া নিয়ে তুই বসে থাক। এর মাঝে কেউ এসে আমার ভাইকে নিয়ে পগার পাড় হোক! তখন বুঝবি মজা।
তুরিন হুড়মুড়িয়ে মালিহার হাত ধরলো,
– এই ধ্যাত! কি সব আজে বাজে কথা বলছিস! এরকম কিছু যাতে না হয় বোন! তুই কিছু কর্ না!
মালিহা বান্ধবীর আঁকুতিতে হাসি থামিয়ে নড়ে চড়ে বসলো,
– হমম.. আমারই কিছু করতে হবে বুঝতে পারছি। ঠিক আছে, এবার দেখি কি করা যায়, তবে যদি ভাইয়ার নিজের কোনো পছন্দ থাকে, তাহলে?
তুরিন আঁতকে উঠে,
– না না, তা কেন হবে?
মালিহা এক ভুরু উঠালো,
– আরে? কেন হবে মানে? থাকতেই তো পারে তাই না?
– প্লিস মালিহা, আর আমাকে ভয় দেখাইস না। শুভ্ শুভ্ বল!
মালিহা হেসে বান্ধবীর হাতের ওপর হাত রাখলো,
– আচ্ছা দেখি কি করি। তুই মন খারাপ করিস না আগেই। এখন চল্, লাঞ্চ টাইম প্রায় শেষই হয়ে গেল।
তুরিনও হেসে মালিহার সাথে খাওয়াতে মন দিল।
…………………
দুপুরের কড়া রোদে ক্যান্টিন পার করে একাডেমিক বিল্ডিং এ আসতে শৈলীর জানটা বের হয়ে যাচ্ছিল। এতো গরম কেন রে বাবা? বৃষ্টির দেখা নেই আজ কতো দিন। গতকাল রাতে যদিও খুব জোড়ে জোড়ে বিদ্যুত চমকেছিল, কিন্তু ওইযে কথায় আছে না ‘গর্জে তবু বর্ষে না’? ঠিক তাই। সকালে উঠেই আবার কড়া রোদ। উফফ্!
কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই হাটছিল শৈলী, পেছন থেকে মাহিরার ডাক শুনলো একটু পরে।
-এই শৈলীর বাচ্চা, কখন থেকে ডাকছি। দাড়া না।
শৈলী পেছনে তাকিয়ে মাহিরাকে দেখে দাড়ায়। ততক্ষণে মাহিরা ওর একদম পাশে এসে দাড়িয়ে সমান তালে হাপাচ্ছে। শৈলী ভুরু জোড়া কুচকে বললো,
– আমার বাচ্চা হলো কবে রে? আর এতো তাড়া কিসের তোর? এভাবে দৌড়াচ্ছিস কেন?
মাহিরার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে ভীষণ উত্তেজিত। শৈলীর কাধে হাত পেচিয়ে চকচকে চেহারায় বললো,
– সেইরকম খবর আছে রে দোস্ত। মেঝো ভাইয়া দেশে এসেছে। আমার তো খুশিতে তাকধিনাধিন নাচতে ইচ্ছা করছে রে।
শৈলীর ভ্রুজোড়া তখনো কুচকানো,
– মেঝো ভাইয়া মানে?
– মিহরান ভাইয়া? কেন তোকে তো ভাইয়ার কথা বলেছিই।
শৈলী মনে পরার ভানে বললো,
– ও হ্যা হ্যা, বলেছিলি। তো তোর এই ভাইয়া না অস্ট্রেলিয়াতে থাকেন?
মাহিরা শৈলীকে নিয়ে হাটতে হাটতে বললো,
– থাকে না, পিএইচডি করতে গিয়েছিল। এখন ফিরে এসেছে। জানিস, লকডাউনের কারণে ভাইয়া প্রায় দুই বছরের মতন দেশে আসতে পারেনি। আমরা কেউ জানতাম না ও আজ আসবে। সার্প্রাইজ দিয়েছে। আমার যে কি মজা লাগছে শৈলী। ভাইয়া কে কখন দেখব?
মাহিরার প্রশ্ন শুনে শৈলী হেসেই ফেললো,
– তোর ভাইয়াকে কখন দেখবি এটা আমাকে প্রশ্ন করছিস কেন? চাইলে এখনই যেয়ে দেখতে পারিস।
– না রে। এখন পারবো না। আমার একটা কুইজ আছে এখন। উফ্ এই কুইজ শালার আজই হতে হলো। ধ্যাত! তোর তো ক্লাস শেষ তাই না?
মাহিরার করুণ মুখ দেখে শৈলী মুচকি হাসলো।
– হ্যা আমার ক্লাস শেষ। এখন বাসায় যাবো।
মাহিরার মন এতে আরও খারাপ হয়ে যায়,
-যা তাহলে বাসায়। দেখ কি দুর্ভাগ্য আমার, আমরা দুইজন একই বিল্ডিংয়ে থাকি, তাও তুই আগে চলে যাচ্ছিশ আর আমি যাব আরও এক ঘন্টা পর। ভালো লাগে এইসব বল্? এই মেহরাবের বাচ্চা টা গেল কই? ও তো কুইজের পড়াও পড়ে নাই। যাই ওকে খুজে আনি। বাই রে দোস্ত।
শৈলী তার চকচকে দাঁতে হেসে মাহিরাকে বিদায় জানিয়ে বের হয়ে গেল ভার্সিটি থেকে। দেড় বছর হলো শৈলীর পরিবার মাহিরার বড় ফুফু বাবলির বাসায় পঞ্চম তলায় ভাড়া থাকতে এসেছে। ওদের পাশের ইউনিটটাই মাহিরাদের ডুপ্লেক্সের ওপর তলাটা। নিজেদের বাসা ধানমন্ডিতে থাকলেও বসুন্ধরায় এসে থাকার মূল কারণ শৈলী আর ওর ছোট বোন নিপুণ । দুজনেরই ভার্সিটি আর কলেজ এই এরিয়াতেই। শৈলী অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পরছে। কাকতলীয় ভাবে মাহিরা আর মেহরাব, এই জমজ দুই ভাই বোনও ওর সমবয়সই এবং একই ভার্সিটিতে পড়ে। আলাদা ডিপার্টমেন্ট হলেও, একই বাসায় থাকার দরুণ তিনজনের ভাব বেশ।
………….
দুপুরে বাসায় এসে বাবুল সাহেব এতো বড় চমক পাবেন আগে বোঝেননি। সিড়ি দিয়ে তার বিদেশ পড়ুয়া ছেলেকে নামতে দেখে প্রথমে মনে করলেন হ্যালুসিনেইট করছেন। কিন্তু চেহারাটা যখন চোখের সামনে থেকে না সরার বদলে আরও প্রকট হয়ে সামনে দাড়ালো তখন তারও আক্ষি কোটর বের হওয়ার জোগাড়। বাবুল সাহেব কিছু বলার আগেই মিহরান হেসে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো,
– আব্বু আমি সত্যি তোমার সামনে। তুমি হ্যালুসিনেইট করছো না।
ছেলের কথায় ওকে জোড়ে জড়িয়ে ধরলেন বাবুল সাহেব
– Welcome back my boy. তুমি আসছো, আমি জানিই না? কেউ আমাকে জানায়নি কেন?
– তুমি কেন? আমরা কেউই জানতাম না মাহিব বাদে। দুই ভাই মিলে আমাদের সার্প্রাইজের প্ল্যান করেছিল।
স্ত্রীর কথা শুনে হেসে দিলেন বাবুল সাহেব। তার খুশিতে ভেতরটা ভরে যাচ্ছে। ছেলেটাকে দীর্ঘ দুই বছরের বেশী সময় ধরে দেখেননি। করোনার জন্য দেশে ফিরতে পারেনি মিহরান। ভিডিও কলে যদিও কথা হতো তবে তাতে কি আর মনের সেই খায়েশ মিটে?
ছেলেকে কাধে জড়িয়েই ডাইনিং টেবিলে গেলেন বাবুল সাহেব। নিচের বেসিনেই হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসলেন। ইতিমধ্যে মাহিবও চলে আসলো। ঝুমাকে আফিয়া জোর করে বসিয়ে দিলেন মাহিবের পাশে। খাবার বাড়তে বাড়তেই বাবুল সাহেব মিহরানকে জিজ্ঞেস করলেন,
– তো বাবা, পিএইচডি কেমন চলছে তোমার? শেষ হওয়ার পথে না?
– এবার থিওরির কাজ শেষ করেই এসেছি। আসলে স্টুডেন্ট ভিসা আমার প্রায় শেষ। কাজ সব কম্প্লিট, ডিফেন্সটা অনলাইনে দেশ থেকেই করবো ভাবছি। আর এইদিকে ভার্সিটিতে চাকরি থেকে যে স্টাডি লিভ নিয়ে গিয়েছিলাম সেটাও শেষ। আগামী সপ্তাহে জয়নিং আমার।
ছেলের উত্তর শুনে আফিয়া-বাবুল উভয়ই প্রশন্ন হলেন। ছেলেটাকে আর দূরে যেতে হবে না ভেবেই ভালো লাগছে তাদের। আরও টুকটাক কথার মাঝেই খাওয়া শেষ হলো। মায়ের হাতের বানানো লাচ্ছা দেখে মিহরানের অধর জুড়ে হাসি ছুয়ে গেল। পেট ভরে গেলেও মায়ের কষ্টের কথা চিন্তা করে বাটি ভরেই লাচ্ছা নিল ও।
আফিয়ার চোখ এড়ালো না। ছেলে এক চামচ মুখে পুরতেই উৎসুক নয়নে শুধালেন,
-কেমন হয়েছে আব্বা! মিষ্টি ঠিক হয়েছে? খেতে ভালো লাগছে?
হাল্কা ঠোট নেড়ে হাসলো মিহরান। তার স্বল্পভাষী স্বভাব বজায় রেখে মায়ের দিকে তাকালো,
-আম্মু বেশ মজার হয়েছে লাচ্ছা টা। ওখানে এটা অনেক মিস করতাম।
আফিয়া বেগমের চোখে কান্না আসার জোগাড়। আহারে! ছেলেটা একা একা কতই না কষ্ট করতো ওখানে। তার পাঁচ ছেলে মেয়ের মাঝে এই মিহরানটাই খুবই চাঁপা স্বভাবের। নিজেকে কখনোই উজাড় করে উপস্থাপন করে না। সবসময়ই এক আলাদা গাম্ভীর্য বহন করে তার মুখমন্ডলে। বাবা মা, নিজের ভাইবোন আর কিছু খুব কাছের বন্ধু ছাড়া কারো সাথেই তেমন মন খুলে মেশে না ও। মাঝে মাঝে আফিয়া বেশ চিন্তায় পরে যান তার এই মেঝ পুত্রকে নিয়ে। এর সঙ্গে যেই মেয়ের বিয়ে হবে তার ভবিষ্যৎ কি?
খাওয়া শেষেই মিহরান উঠে দাড়ালো,
– আব্বু, ভিষণ টায়ার্ড লাগছে। মালিহা, মাহিরা আর মেহরাব আসতে আসতে আমি একটু রেস্ট নিয়ে আসি। ওরা আসলে আমাকে একটা কল দিও।
বাবুল সাহেব বুঝলেন ছেলের ধকল, তাই আর থামালেন না।
……………………
ওর বাসা ততক্ষণে পরিষ্কার করা শেষ তাই মিহরান আর দেরী করলো না। লাগেজ আগেই নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তাই খালি হাতেই ওপরে চলে গেল। নিজের বাসায় ঢুকে স্মিত এক হাসি ছড়ালো ওর অধরে। দু বছর আগে যেভাবে রেখে গিয়েছিল সেরকমই আছে। শুধু বিছানার চাদরটা নতুন। চোখ ঘুমে ভেঙে যাচ্ছে বলে আর সময় নিলো না মিহরান। সোজা খাটে যেয়ে শুয়ে পরলো। পাড়ি দিলো ঘুমের দেশে।
শৈলী বাসায় এসে খেয়ে দেয়ে একটা গল্পের বই নিয়ে খাটে হেলান দিয়ে বসেছে। ওর হাটু সমান লম্বা চুলগুলো বিছিয়ে দিয়েছে খাটে সুখানোর জন্য। কিছুক্ষণ পরেই হঠাৎ গত রাতের মতন আবার বিদ্যুত চমকানোতে শৈলী ঘাবড়ে গেল। পর্দা ভেদ করে জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে আকাশের দিকে তাকায়। আকাশে দুপুরের মতন এখন তেজ নেই। কালো, গুমোট হয়ে আছে। আবার বিদ্যুত চমকালো, তবে এবারও শৈলীর মনে হলো আকাশ আজ ভাঙবে না। এই বছর বৃষ্টির দেখা সেরকম পাওয়াই যায় নি। অথচ বৃষ্টি শৈলীকে ভীষণ রকমের আনন্দ দেয়। তাই তো আজ ওর মন খারাপ হচ্ছে। এই বিদ্যুত চমকে চমকে বৃষ্টি না এসে যে ধোকা টা দিচ্ছে, এটা কি ঠিক?
কোনোমতে গল্পে আবার মন বসানোর চেষ্টা করলো শৈলী। তবে বেশিক্ষণ এভাবে বসে থাকতে পারলো না। হঠাৎ ঝুম মেরে বৃষ্টি নামায় মনটা খুশিতে লাফিয়ে উঠলো ওর। তড়াক করে খাট থেকে নেমে দৌড় লাগালো রুমের বাইরে। পথিমধ্যে নিজের গিটার টা নিতে ভুললো না।
ডাইনিং হলে মিসেস রেহানা জানালা লাগাচ্ছিলেন। আকস্মাত বৃষ্টি আসাতে আগের থেকে এদিকের জানালা বন্ধ না থাকায় অনেকটা ভিজে গেছে। এরই মধ্যে পেছনে মেয়ের দৌড়ের আওয়াজ শুনে ফিরে তাকালেন তিনি,
-এই শৈলী, কই দৌড়াচ্ছিস এমন ভাবে?
একটু থামলো শৈলী,
– মা, ঝুম ধরে বৃষ্টি নেমেছে, আমি ছাদ থেকে দেখবো। গেলাম মা।
-আরে গিটার নিয়ে কই…..
রেহানা কি বলতে চাইলেন তা শোনারো সময় নেই তার মেয়ের। ঘন চুল গুলো দুলতে দুলতে দরজা দিয়ে হাওয়া হয়ে গেল। মুচকি হাসলেন তিনি। এমন বৃষ্টি পাগল মেয়ে রেহানা তার জীবনে দেখননি। বৃষ্টি আসলেই শৈলী বৃষ্টিবিলাশে মেতে উঠবে, গান গাবে, এই ওর আনন্দ।
রিনরিন সুরে নুপুরের তাল তুলে শৈলী ছাদে উঠে এলো। ছয় তলার ছাদেই বসলো সে। কিছুক্ষণ আগেই গোসল করেছে বলে আজ বৃষ্টিতে ভিজবে না। এই লম্বা লম্বা চুল শুকাতে লাগে একশ বছর! তাই সাত তলার খোলা ছাদে গেল না ও। বরং ছয় তলার ছাদের সান শেডের নিচে যেয়ে বসলো । সান শেড বললেও এই ছাদের প্রায় দুই তৃতীয়াংশই ওপরে আবৃত। বাকি খোলা একভাগে সুইমিং পুল। আবৃত জায়গাটায় দুটো বিচ চেয়ার আর একটা গোল টি টেবিল চেয়ারের সেট রাখা যেখানে একসাথে পাঁচ জন বসতে পারবে।
শৈলী একদম পুলের কাছের যে বিচ চেয়ারটা, তার ওপর যেয়ে বসলো। ঝমঝম করে বৃষ্টি পরছে পুলের পানিতে। গোলাআকার ধারণ করে আবার তা পানিতেই মিশে যাচ্ছে। বৃষ্টির এই শব্দ ওকে এতো বেশী বিমোহিত করে যা ও ব্যাখ্যা করে বোঝাতে পারবে না।
তৃপ্তি নিয়ে বৃষ্টি উপভোগ করতে করতে শৈলী বিচ চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো কিছুক্ষণ। পেছনের দেওয়ালটা হলো ছাদের পাশের ইউনিটের। পুলটা লম্বাটে হওয়ায় ওপাশের ফ্ল্যাটেরও সীমানা ছুয়েছে। শীমানা ঘেষে একটা থাই গ্লাসে মোড়ানো দরজাও আছে। শৈলীর ঐ বাসাটা দেখার খুব ইচ্ছে। ইশ! না জানি কতো সুন্দর লাগে দরজার ওপাশ থেকে পুলটা উপভোগ করতে। একে বারে মালদ্বীপেয সেই ওয়াটার রিসোর্টস গুলোর মতন দেখতে হবে নিশ্চয়ই।
চোখ ঘুড়িয়ে আবার বৃষ্টি বিলাশে মনোযোগ দেয় শৈলী। উঠে এক পাশ হয়ে বসে হাতে নিজের গিটার নেয়। এই সময় একটা বৃষ্টির গান না গেলে যেন প্রকৃতিও রাগ করবে ওর ওপর। মুচকি হেসে গিটারে টুংটাং সুর তুলে গান ধরলো শৈলী…
অসময়ি এ বৃষ্টিতে আমি,
অসময়ি এ বৃষ্টিতে তুমি,
কিছু না বলা কথা দিলাম ভাসিয়ে,
ধুয়ে যাক না এ মন অভিমানী।
মেঘলা আকাশ, হাল্কা হাওয়া,
যাই ভিজে আর নিজেকে ফিরে পাওয়া।
আধখোলা কাঁচ, বৃষ্টি ছোঁয়াচ,
তোমার নামে মেঘের খামে চিঠি দিলাম আজ।
আধভেজা প্রহর, আধভেজা শহর,
আধভেজা তুমিও আর আধভেজা আমার সফর।
হালকা পায়ে রঙ ধোয়ানোর আবদার,
মেঘ বলেছে বৃষ্টি আনবে বারবার।
রাস্তা বেয়ে এক ছাতায় প্রেমের ঢল,
রঙিন সাজুক আমার শহর অনর্গল।
মেঘেরা ক্লিপ খুলেছে মন জুড়োয় খুশিতে,
হাল্কা হাওয়ার সিম্ফোনিতে,
কাটছে আজ অবসর।
আধভেজা প্রহর, আধভেজা শহর,
আধভেজা তুমিও আর আধভেজা আমার সফর।
…………….
হঠাৎ হিমশীতল আবহাওয়ায় মিহরানের ঘুমটা বেশ জমেছিল, তার সাথে যাত্রার ধকলও যোগ হয়েছিল। কিন্তু কোথাও থেকে গানের সুর কানে আসতেই সেটা পাতলা হয়ে গেল। চোখ বুজে ভ্রু কুচকে মিহরান বুঝতে চাইলো আসলে হচ্ছে কি। আস্তে আস্তে গানটা স্পষ্ট হতে লাগলো ওর কর্ণকুহরে। ঝটপট চোখ খুলে ফেললো মিহরান। উঠে বসলো খাটে। উষ্কোখুষ্কো চুলগুলোয় হাত দিয়ে ব্রাশ করতে করতে শুনলো গিটারের ধ্বনি আর একটা মিষ্টি আওয়াজ। বাইরের জোরে হওয়া বৃষ্টির আওয়াজকেও ছাপিয়ে যাচ্ছে এই কন্ঠ। তার মানে যেই গানটা গাচ্ছে সে খুব কাছেই আছে। ভীষণ ভাবে অবাক হয়ে মিহরান খাট ছেড়ে উঠে রওনা দিলো খাটের পাশের কিছুটা দূরে অবস্থিত থাই গ্লাসটার দিকে। পর্দা সরিয়ে বন্ধ দরজা দিয়েই প্রথমে আশপাশে তাকালো। কই? কেউ তো নেই। কিন্তু গান তো এখনো শোনা যাচ্ছে। কৌতুহল আরও বাড়িয়ে থাই গ্লাসের দরজাটা খুলে শরীর বের করলো মিহরান। ডানে চোখ পরতেই বুকটা ধ্বক করে উঠলো ওর।
ঝুম বৃষ্টির মাঝেই পুলের পাশে বসে এক রমণী সুর তুলছে গিটারে।
মিহরানের প্রথমেই এক প্রশ্ন মস্তিষ্কে হানা দিল,
-এই মেয়েটা কে?
নিজের চোখ ঝাপটায় মিহরান। সিক্ত পরিবেশ ও অপরিচিত কারও উপস্থিতি মিলিয়ে কেমন যেন ঘোলাটে লাগছে ওর সবকিছু। বাস্তব গুলিয়ে ফেলছে মনে হচ্ছে। নিজেকে ধাত্বস্ত করে মনোযোগ দিল চোখের সামনের দৃশ্যে। একটু কাত হলো একপাশ, মেয়েটার মুখশ্রি দেখার আশায়। তবে তা পারলো না, ওর চেহারা আবৃত করে রাখা, মাটিতে লুটিয়ে পরা ঘন চুলের আস্তরেই প্রথমে চোখ আটকে গেল মিহরানের। হঠাৎ রুপানজালের গল্পটার কথা মনে পরে গেল। সেই মেয়েটারও তো বড় চুল ছিল তাই না? আর ও তো গানও গাইতো। মিহরানের মনে হলো জলজান্ত রুপানজালকেই দেখছে সে। আর কি মধুর সুর! যেন পরিবেশের সাথে এই ধ্বনিটা মিশে গেছে। আজ এই কন্ঠ না শুনলে এই বৃষ্টি ভরা অপরাণ্হ হয়তোবা জমতো না।
বুকের ওপর দু হাত ভাজ করে দরজার কার্নিশের একপাশে বাহুতে হেলান দিয়ে দাড়ালো মিহরান। নিঃশব্দে মেয়েটার গান শুনতে লাগলো। এভাবে বিনা অনুমতিতে কারো গান শোনা ঠিক না জেনেও কেন যেন আজ নিজেকে আটকালো না ও।
আধভেজা প্রহর, আধভেজা শহর,
আধভেজা তুমিও আর আধভেজা আমার সফর।
মেয়েটার গানের ইতি হচ্ছে শুনে মিহরান সোজা হয়ে দাড়ালো। মেয়েটার দিকে এবার নিজের তীক্ষ্ম দৃষ্টি দিল ও। আরেকটাবার চেহারাটার দেখার কৌতুহল জাগলো মনে।
শৈলী গান গাওয়ার পুরোটা সময় মিহরানের ফ্ল্যাটের দিকে পিঠ দিয়ে ছিলো বলে মিহরানকে ও টেরই পায় নি। এমনকি বৃষ্টির আর ওর গিটারের ধ্বনিতে দরজা খোলার শব্দটাও চাপা পরে গিয়েছিলো। গান শেষ হতেই গিটার টা পাশে রেখে এবার সামনে তাকালো শৈলী। হেসে উঠলো বৃষ্টির বেগ দেখে। হাত বাড়িয়ে অম্বর বারি ছুতে গেল। অথচ খেয়ালই করলো না ওকে অবলোকন করা এক জোড়া চোখের গভীর দৃষ্টি।
চলবে…….
শুরু হলো নতুন যাত্রা। সবার সহযোগিতা আমাকে আরও অণুপ্রাণিত করবে।