পরিণয়_প্রহেলিকা #লেখিকা_সিনথীয়া #পর্ব_২৬

0
507

#পরিণয়_প্রহেলিকা
#লেখিকা_সিনথীয়া
#পর্ব_২৬

মাহিরা মাত্রই শৈলীর সাথে ফোনে কথা শেষ করলো। কথা খুব সংক্ষেপে হয়েছে কারণ এই মুহূর্তে মাহিরা ভয়ংকর পরিমাণে ব‍্যস্ত। বাসায় অনেক মানুষ, তাদের আপ‍্যায়নে দৌড়াতে হচ্ছে ওকে। এই যেমন এখন, মেঝ মামাকে জুস দিতে দিতেই শৈলীর সাথে কথা বলছিল ও। এখন বাকিরাও ডিমান্ড করেছে জুসের জন‍্য।
-শৈলী দোস্ত, এখন আবার কামলা খাটতে কিচেনে যেতে হবে রে। তোর সাথে কালকে কথা বলবো। পিকনিকের সব কিছু ডিটেইল্সে শুনবো, ওকে? এখন রাখি রে। বাই।

এভাবেই নিজের কলিজার বান্ধবীর ফোন ডিসকানেক্ট করে কাজে মন দেয় মাহিরা। হঠাৎ পাশে কারো উপস্থিতি বুঝতে পেরে ঘুরে তাকায়। ঐশ্বর্যকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রুদ্বয় কুচকে যায় ওর,
– এখানে কি করিস?

আমতা আমতা করে ঐশ্বর্য,
– তোমার কোনো হেল্প লাগবে আপি?

মাহিরার চোখ কপালে ওঠে,
– তুই? হেল্প করবি? হঠাৎ?
-না..মানে…এমনেই।

মাহিরার ভ্রুদয় সোজা হয় না। তবে ও কিছু বলেও না। হতেই পারে মেয়েটা সবার ব‍্যস্ততা দেখে সাহায‍্য করতে চাইছে। আফ্টার অল মানুষ তো কম না। হাসান বাড়ির এই এক বৈশিষ্ট্য। কোনো অনুষ্ঠানের প্ল‍্যান করতে বসলেই সেখানেই আরেকটা ছোট খাটো অনুষ্ঠান বসে যায়। এই যেমন আজ, ঝুমা ভাবির সাদের অনুষ্ঠান মা করতে চান বলে প্ল‍্যানিং করতেই তিনি ঢাকাতে থাকাতে সব মামা চাচা খালা ফুফুদের ডেকে বসেছেন। অন্তত পয়ত্রিশ জন তো হবেই এখন। মাহিরা গোণাও বন্ধ করে দিয়েছে, ও জুস বানাতে ব‍্যস্ত।

জুস বানানো শেষ হতেই ঐশ্বর্য তৎপর হাতে মাহিরার দিকে আগায়,
– দাও আমি নিয়ে যাই।

মাহিরা কিছু আর বললো না। চুপচাপ খুশিমনেই দিয়ে দিল ট্রে টা। কিন্তু ড্রয়িং রুমে পৌছতেই সব কাহিনী পানির মতন পরিষ্কার হয়ে গেল। ঐশ্বর্য দুলতে দুলতে প্রথমে মিহরানের কাছেই জুস নিয়ে গেল। মিহরান নেওয়ার পর পাশে ওর বাবা আর বড় মামাকে দিয়ে ট্রে টা রেখে দিল টেবিলে। বাকিদের দেওয়ায় কথা যেন ওর মনেই নেই।

মাহিরা অবাকের চরম সীমানায় পৌছায়,
– এই টুকুন পুচকি মেয়ের মাথায় কি রকম বুদ্ধি বাবা রে বাবা! ভাইয়ার জন‍্য এতো তোড়জোড় করলো আর আমি বুঝলামই না।

ঠোট টেনে বিরক্তি প্রকাশ করে মাহিরা যেয়ে একটা সোফায় বসলো। যাদের যাদের আসার মোটামুটি সবাই এসে গেছে দেখে আফিয়া বেগম কথা শুরু করলেন। ঝুমার সাথে বসে আগেই প্রাথমিক পরিকল্পনা সেরেছেন, এখন সেগুলোই একে একে উপস্থাপন করা হলো। সব আলোচনার পর যেটা ঠিক হলো যে অতিথির সংখ‍্যা যেহেতু প্রচুর তাই বাসায় ঝামেলা নেওয়া যাবে না। প্রোগ্রামটা কোন একটা কনভেনশন হলেই হবে। আর মেয়েরা মেয়েরা মিলে যদি কোনো মজা করতে চায় সেটা সাত তলার ছাদেই এ‍্যারেঞ্জ করা যাবে। খাবারের মেন‍্যুও ঠিক করে ফেলা হলো। তবে সমস‍্যা ঘটলো অতিথিদের থাকার ব‍্যবস্থা নিয়ে। এইটা আফিয়া বেগমকেও টেনশনে ফেলছিল আগে থেকেই।

মিহরানের ছোট ফুফু নিশাত বললো,
-ভাবি আমার বাসায় দুটো বেডরুম ফাঁকা। সেখানে সেতু আপা,দুলাভাই আর মৃধা আর ওর জামাইকে দেই, কি বলো?
-আচ্ছা তা না হয় দিলি। কিন্তু বাকিরা? আমাদের বাসায় উঠবে বড় ভাই ভাবী, ঝুমার বাবা মা, খালা খালু, আর ঝুমার বড় বোন। কিন্তু এখনো সন্ধ‍্যা আপার পরিবারকে রাখার জায়গা দিতে হবে। তার তো দুই মেয়ে। এদের জন‍্য দুই রুম লাগবে। সেটা কোথায়?

হঠাৎ মাহিরা বলে ওঠে,
-আম্মু রেহানা আন্টিকে বলে দেখতে পারো। আন্টির বাসায় সন্ধ‍্যা খালারা থাকতে পারে।

আফিয়া বেগমের মুখে হাসি ফুটলো, তবে সে কিছু বলার আগেই মাহিরার ছোট ফুফু মুখ কোচকালেন,
-না না। ওনারা ভাড়াটিয়া মানুষ, ওনাদের এভাবে ডিস্টার্ব করার দরকার নেই। নিজেদের সমস‍্যা নিজেরাই দেখি, বাইরের মানুষকে টানার কোন মানে হয় না।

ফুফুর কথায় মাহিরার বেশ রাগ ওঠে। আগেও দেখেছে, ফুফু এই বাসায় যারা ভাড়া থাকেন তাদের সাথে তেমন একটা ভালো ব‍্যবহার করেন না। তাদের নিচু চোখে দেখেন, দূরত্ব মেইনটেইন করেন। বাড়ির মালিক হওয়ার অহমিকা তার মাঝে স্পষ্ট দেখা যায়।
এসব বুঝেই মাহিরা মুখ ফুলিয়ে আপত্তি জানালো,
– রেহানা আন্টিরা এতোটাও বাইরের কেউ না আমাদের। সুখে দুঃখে তারা এর আগেও আমাদের কতো সাহায‍্য করেছেন। মনে আছে মা, গত বছর বাবা কি একটা জ্বরে পরেছিল? বড় ভাইয়াও ভাবীকে নিয়ে ঢাকার বাইরে তখন। বাসায় ছেলে বলতে শুধুই মেহরাব, একা ওর ওপরও সব দায়িত্ব দেয়া যাচ্ছিলো না। তখন আজাদ আঙ্কেলের পরিবারই তো আসলো আমাদের পাশে। শৈলী সারা রাত আমার সাথে বসে আব্বুর মাথায় জলপট্টি দিল। রেহানা আন্টি তোমার সাথে পুরো সময়টা থাকলেন। আঙ্কেল সেই গভীর রাতেও এ‍্যাম্বুলেন্স স্ট‍্যান্ড বাই রেখেছিলেন নিচে, যাতে আব্বুর একটু খারাপ লাগলেই আমরা যাতে হাসপাতালে নিতে দেরী না করি। এতো কিছু যারা করে তারা আবার পর হয় নাকি?

ছোট ফুফুর মুখটা পুরো চুপশে যায়। এভাবে এতোটুকুন একটা মেয়ে তার কথার কাউন্টার করবে সে চিন্তাই করে নি। গাল ফুলিয়ে চুপ হয়ে যান তিনি।

এদিকে মাহিরা যখন এসব বলে ওদের মা কে কনভিন্স করছিল তখন মিহরান চুপচাপ বসে সব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। শৈলী আর ওর পরিবার এভাবে ওদেরকে সাহায‍্য করেছে এটা ও আগে জানতোনা। ভীষণ রকম এক ভালো লাগা খেলে গেল ওর মাঝে। প্রতিদিন মেয়েটাকে এক এক ধাপ নতুন করে চিনতে পারছে ও, জানতে পারছে। এবং সব ভাল দিকগুলোই সামনে আসছে ওর। এটা কি নিয়তিরই ইচ্ছা?

শেষ মেষ সিদ্ধান্ত হলো আফিয়া বেগম মিসেস রেহানার সাথে কথা বলবেন। অন্তত দুটো রুম দেওয়ার অনুরোধ জানাবেন।
মিহরান আলোচনার মাঝেই উঠে মেহরাবের রুমের দিকে পা বাড়ালো। ছেলেটার নাকি মাথা ব‍্যাথা করছে বলে তখন নিচে নামেনি। দেখে আসা দরকার একবার।

আলোচনায় বসলেও ঐশ্বর্যর মন‍, ধ‍্যান তো তার প্রিয় মিহরান ভাইয়ার ওপর। তাকে যখন সিড়ি বেয়ে উঠতে দেখলো তখন ও নিজেও আর মজলিশে থাকলো না। ওর আর এখানে কাজ কি? বরং একলা যদি মিহরান ভাইয়ার সাথে একটু কথা বলা যেত….

দোতলায় উঠে মিহরানকে এদিক ঔদিক ঐশ্বর্য খোজে। আরে আজিব তো? গেল কই মানুষটা? কোন রুমে ঢুকলো? ওনার রুম তো এই বাসাতেই নেই, তাহলে কার রুমে গেলেন তিনি? ডান পাশ দিয়ে একে একে রুম খুলে ভেতরে উঁকি দিতে লাগলো ও, কিন্তু প্রতিবারই হতাশ হতে হলো ওকে। শেষে যখন মাহিবের রুমের নব ঘোরাতে যাবে তখনই পেছন থেকে গমগমে আওয়াজে চমকে উঠলো ঐশ্বর্য ,
– কাকে খুজছিস?

ঐশ্বর্য চকিতে ঘোরে। মিহরানের গম্ভীর মুখশ্রী দেখে ভীষণ ঘাবড়ায়,
– নননা ভভাইয়া। কাউকে না।
স্বল্পভাষী মিহরান ভ্রু কুচকে চায়। ঐশ্বর্যর তাই দেখে অবস্থা বেগতিক। কি একান্তে কথা বলবে ও মিহরানের সাথে? ওর সামনে দাড়াতেই তো হাটু কাঁপছে। এতো গম্ভীর, মেজাজী কেন মানুষটা?

মিহরান একটু পর নিজে থেকেই হাটা ধরে নিচে যাওয়ার জন‍্য,
-ভাইয়া।

মিহরান থেমে পাশে তাকায়। ঐশ্বর্র আমতা আমতা করে প্রশ্ন করে,
-মানে বলছিলাম যে…জুস খেয়েছ?

মিহরানের কপালে কয়েকটা ভাজ পরে,
– হ‍্যা খেয়েছি।
-ভালো লেগেছে?
– হ‍্যা কেন?

ঐশ্বর্য লজ্জায় পারছেনা শুধু মাটিতে মিশে যেতে,
– না…মানে আমি ববা…বানিয়েছিলাম তো তাই?
-ওওও।

এবার কপাল কুচকায় ঐশ্বর্যর। ‘ওওও’? এটা আবার কি ধরনের কম্প্লিমেন্ট হলো? ও তো ভেবে বসেছিল এটা শুনে মিহরান আর কিছু না হোক, একটা প্রাণ জুড়ানো হাসি দিবে, বলবে জুস টা অনেক মজা হয়েছে। কিন্তু সেগুলো কিছুই হলো না। বরং বড় বড় পা ফেলে মানুষটা ওকে একা রেখেই ওখান থেকে চলে গেল?

ঝামটা মেরে জিদ্দে পা ঝাড়া দেয় ঐশ্বর্য। ভালো হইসে মিথ‍্যা বলসে, নিজে থেকে বানায়নি সেই জুস। আসলেই বানিয়ে দেওয়ার পর এই রিয়‍্যাকশন হলে গ্লাসটাই ভেঙে ফেলতো ও।
……………………..

মাহিরার সাথে গল্প হওয়ার পরপরই ফোন এসেছিল কেয়ার। উত্তেজনায় মেয়ে ফোনে কথাই বলতে পারছিল না শুনে শৈলী কৌতুহলী হয়,
– তোর হইসে কি বলতো?
– জানিস….কি…হইসে শৈলু?
– না বললে জানবো কেমন?
-প্রিতির…
– প্রিতির কি?

কেয়ার চিৎকারে শৈলীর কান বন্ধ হওয়ার যোগাড়,
– প্রিতির এ‍্যাফেয়ার হইসে।

বিশাল ঝটকা খায় শৈলী। ও নিশ্চিত ভুল শুনেছে।
-কি বললি? কার কি হইসে?
– যা বলসি তুই তাই শুনসিশ। আওয়ার প্রিতি ইজ হ‍্যাভিং এ‍্যান এ‍্যাফেয়ার।

শৈলী খুশি হবে না তাজ্জব তাই বুঝতে পারলো না,
– এই খবর তুই পাইলি কেমনে? আই মিন আমরা তো গত দুইদিন একসাথেই ছিলাম। তখন কিছু জানলাম না, এখন হঠাৎ? কিভাবে?
– না না বান্ধবী, তোমার কথায় একটু ভুল আছে। গত দুই দিন আমরা না, আমি আর প্রিতি একসাথে ছিলাম। তুমি তো না জানি কোন খেয়ালের দুনিয়ায় মত্ত ছিলা। মাথা ব‍্যাথা, মাথা ব‍্যাথা করে আমাদের সাথে সময়ই কাটিসনি তুই। তাহলে এসব জানবি কেমনে বল?

শৈলী বোকা একটা হাসি দেয়। আসলেই ও তো বেশি সময় বান্ধবীদের দিতেই পারেনি। নিজের জীবনের নতুন মোড় গোছাতেই ব‍্যস্ত ছিল যে। অনুতপ্ততার সুর ভেসে আসে ওর কন্ঠে,
– সরি দোস্ত। আচ্ছা বলনা, কেমনে কি হলো? প্রিতি তোকে কিছু বলেছিল?

কেয়া আবার উত্তেজিত হয়,
-সরাসরি গতকাল ফাজিলটা কিছুই বলে নি। তবে রাতে ওর কথার হাবভাবে একটু সন্দেহ হচ্ছিল আমার। মনে নেই মিহরান স‍্যারের ওপর ক্রাশ খাওয়া নিয়ে কথা বললো ও। তারপর বললো ক্রাশ খেলেও প্রেম করবে না কখনো? আমি কেন জিজ্ঞেস করাতে অনেক এদিক ওদিকের কথা বলেছিল, কিন্তু আমার কেন যেন মনে হচ্ছিলো আসল কথা এড়িয়ে যাচ্ছে ও। তাই রাতে আবার ধরেছিলাম, ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করেছিলাম। কিন্তু তখনো কিছুই বের করতে পারিনি শাকচুন্নির মুখ থেকে।

এতটুকু বলে একটা দম নিল কেয়া,
– এরপর আজ দুপুরে ক‍্যাম্পাস থেকে যখন ফিরছিলাম দেখি ও একটা গাড়িতে উঠলো। আমি আর পিয়াল তখন রিকশায়। প্রিতির পাশে ড্রাইভিং সিটে ছেলেটাকে চিনতে পারলাম না। কিন্তু ওর ঠোটের এপার ওপার হাসি দেখেই বুঝলাম কোনো ঘাপলা তো আছে। এটা নরমাল কোনো ভাই ব্রাদার হতেই পারে না।
তারপর বাসায় এসে সন্ধ‍্যায় ফোনে জোর দিতেই ম‍্যাডাম সব বলে ফেলসে।
শেষ বাক‍্যে কেয়ার গর্বিত হাসি শুনে শৈলীও হেসে দিল। যাক্ তার এই টমবয় টাইপ বান্ধবীটারও একটা গতি হলো তাহলে।
…………………..

পরদিন সকাল। একদম সতেজ এক আবহাওয়ায় ঘুম ভাঙে শৈলীর। আড়মোড়া ভেঙে উঠে চোখ খোলে। রুমের পর্দা গুলো বাতাসের দোলায় একতালের নৃত‍্য দেখে কিছুক্ষণ। তারপর খাট ছেড়ে উঠে দাড়ায়। সকালটা সুন্দর। দিনটাও সুন্দর যাওয়া উচিত। যাবেই তো। আজ মনের মাঝেই এক নতুন উদ্দিপনা কাজ করছে ওর। মিহরান আজ নিজের কোর্স শুরু করবে। ওকে পড়াবে। ভাবতেই শিহরণ বয়ে গেল সারা গায়ে। দুই হাটুতে ভর করে থুতনি রাখলো শৈলী। চোখের চঞ্চলতা নিয়ে চিন্তা করলো আজ দেখবে জামাই মশাই টিচার হিসাবে কেমন পার্ফরম‍্যান্স দেখান।

খিলখিলিয়ে হেসে উঠে শৈলী। চিন্তাটা তার মজার লেগেছে। ভেবেই নিয়েছে মিহরানের ক্লাসে একটু হলেও দুষ্টুমি করবে ও। জ্বালাবে তার স‍্যার তথা বর কে।

নিজেকে পরিপাটি ভাবে সাজিয়ে শৈলী রুম থেকে বের হলো। একটা হাল্কা আকাশি রঙের মাঝে সাদা আর গাঢ় নিলের ওপর ব্লকের কাজের লঙ কুর্তি পরেছে ও। নবাবি ডিজাইনের কুর্তিটায় ডান পাশে কাপড়ের টার্সেল ঝুলানো। থ্রী কোয়াটার হাতার নিচে দুহাতের কব্জিতে আকাশি রঙের কাঁচের রেশমি চুরির টুংটাং শব্দ চলছে ওর চলার সাথে। দীঘল চুলের গোছা আজ সাজিয়েছে বেণী করে। সেটাও একপাশ দিয়ে সামনে এনে রেখেছে। জর্জেটের ওপর ব্লকের ওড়নাটা ফেলে রেখেছে এক পাশে। পায়ে পরেছে নাগড়া। ব‍্যাস তৈরী সে।

নাস্তা সারতে সারতেই দুইবার মাহিরার ফোন এসেছে। শৈলী বুঝতে পেরেছে ওরা বাইরেই দাড়ানো। তড়িঘড়ি করে মাকে বিদায় দিয়ে শৈলী বের হলো। তবে শ্বাসটাও বোধহয় ঠিক ভাবে নিতে পারলো না, তার আগেই কেউ ওর ওপর ঝাপিয়ে পরলো। শৈলী ছোট্ট একটা চিৎকার দিল। কিন্তু মাহিরা সেটা থোরাই কেয়ার করে। সে তো জড়িয়েই অস্থির,
– দোস্তওওওও তোকে কতোদিন দেখি নাই। আমার কেমন কেমন যেন লাগছিল জানিস।

শৈলী মাহিরার এমন কথায় হেসেই খুন। পাশে দাড়ানো মেহরাবও সেই হাসিতে ভাগ বসালো। বোনের মাথায় চাটি মারলো একটা,
– তুই তো আচ্ছা ড্রামাকুইন রে মাহি। শৈলী মাত্র দুদিন ছিলনা বলে তুই এইভাবে রিয়‍্যাক্ট করবি?

মাহিরা মুখ ভ‍্যাঙ্গায়,
– আমার বান্ধবী, আমার রিএ‍্যাকশন। আমি যাই করি তাতে তোর কি?
-বান্ধবী এক তোর? আমার না?
-তো তোর ইচ্ছা হইলে তুইও এক্সপ্রেশন দে ইচ্ছা মতন, নিষেধ করসে কে?

দুই জমজের ঝগড়ার মাঝেই লিফ্টের দরজা খুলে গেল। শৈলী ছিল লিফ্টের সামনে পিঠ দিয়ে। দুই ভাইবোনের ওকে নিয়ে ঝগড়া এতোই উপভোগ করছিল যে লিফ্ট খোলাটা ও বুঝতে পারেনি প্রথমে। পরে অবশ‍্য মাহিরা হঠাৎ চুপ হয়ে যাওয়াতে ওর চোখ অনুসরণ করে শৈলী পেছনে তাকায়। সোজাসোজি দৃষ্টি আটকায় মিহরানের অক্ষিযুগলে। অপর পাশের চাহনীও যে ওর ওপরেই আটকা।

পেছন থেকে মাহিরার ধাক্কায় শৈলী সামনে এগোয়। ভেতরে ঢুকে ইচ্ছা করেই সেন্টার রেলিংএর এক পাশে দাড়ায় ও যা মিহরানের থেকে একদম উল্টা পাশে। তবে লিফ্ট খুব বড় না হওয়ায় এতোটা দূরেও যেতে পারে না। শৈলী খুব সংক্ষিপ্ত সময়ের জন‍্য তাকিয়েছিল মিহরানের দিকে। তখনই দেখেছিল মিহরান একবার ওকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখেছে। তারপর মাহিরার দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়েছে নিজের মোবাইলের দিকে।

মাহিরা আর মেহরাবকেও শৈলী পর্যবেক্ষণ করেছে। এবং ভেতর ভেতর ওর হাসি পাচ্ছে খুব। দুই সাধা সিধা চেহারা নিয়ে খোশ গল্প করতে করতে প্রবেশ করা কিশোর কিশোরীকে দেখে কে বলবে কয়েক সেকেন্ড আগেও কোমড় বেধে ঝগড়ায় মেতেছিল তারা?

সবাই উঠতেই লিফ্টের গেট বন্ধ হয়। মাহিরা প্রথমে দুই একটা কথা বললো ওর মেঝ ভাইয়ের সাথে। মেহরাবের মাথা ব‍্যাথারও খোজ নিল মিহরান। তারপর আবার মোবাইলে মনোনিবেষ করলো। মিহরান ছাড়া বাকি তিনজনই সামনে তাকানো। মাহিরা কি একটা জোক বলছে আর মেহরাব তা নিয়ে হাসছে। শৈলীও তাল মিলাচ্ছে তাতে।

হঠাৎ কি হলো বুঝে ওঠার আগেই শৈলী টান খেল ওর ব‍্যাগে। পরমুহূর্তেই ও টের পেল ওর স্থান পরিবর্তন হয়েছে মিহরানের পাশে, খুব কাছে। কিংকর্তব‍্যবিমূড় শৈলী ঝট করে মিহরানের দিকে তাকায়। দেখে মানুষটা নিজের মোবাইলেই চোখ টেকানো। এমন ভাব যেন কিছুই হয়নি। কিন্তু শৈলী স্পষ্ট দেখতে পারছে তার বাম হাত এখনো শৈলীর ব‍্যাগের ফিতায় আটকানো।

ভয়ে শৈলীর আত্মা কাঁপে। চোরের মন পুলিশ পুলিশ ভাব নিয়ে তাড়াতাড়ি সামনে তাকায়। মাহিরা, মেহরাব কিছু দেখে ফেললো না তো? বুঝলো না তো কিছু? এতো ছোট লিফ্টে একটু হলেও তো নড়ার অনুভূতি পাওয়ার কথা ওদের। কিন্তু দেখেই বোঝা যাচ্ছে, জমজ দুটো নিজেদের আড্ডাতেই মত্ত। পেছনে কি হচ্ছে কিছুই বোঝেনি।

শৈলী তখন তৎপর হয় নিজের ব‍্যাগ মিহরানের আঙ্গুলের নট থেকে সরানোর জন‍্য। কিন্তু বদ্ লোকটা এমন ভাবে ধরেছে, ও কোনো ভাবেই সরাতে পারছে না। শৈলী ফিতা ধরে অনেক খোঁচাখোচি করেও এক ইঞ্চিও নড়াতে পারলো না। একটু চোখে রাগ নিয়ে তাকায় পাশে। দেখে মিহরানের ঠোটে বাঁকা হাসি, তবে চোখ সেই মোবাইলের দিকেই। অসহায় চাহনি পরে শৈলী। ও কি করবে এখন? লিফ্টের দরজা খুললো বলে। তখনই মাহিরা যদি পেছনে চায় তাহলে কি হবে?

ওর চিন্তা করতে করতেই লিফ্ট খুলে যায়। এবং একদম শৈলীর অনুমান মতই মাহিরা পেছনে তাকায়। আপনাতেই শৈলীর হাত ঝট্ করে উঠে আসে ব‍্যাগের ফিতার কাছে। জাপ্টে ধরে মিহরানের আঙ্গুল নিজের হাতের মাঝে ঢেকে দেয়। শরীর সোজা করে দাড়িয়ে ব‍্যাগের ওইটুকু স্থান নিজের পেছনে ঢেকে দেয়। মাহিরা অবশ‍্য এদিকে তেমন একটা খেয়ালই করে না,
– আয় শৈলু।
– হমম চল্।

মাহিরা মেহরাব বের হতেই শৈলী ফিসফিসিয়ে মিহরানকে শাষণের সুরে বলে,
– ব‍্যাগ ছাড়ুন।

মিহরান এবার চোখ তোলে। দুষ্টুমির সুর ওর কন্ঠে,
– আমার আঙ্গুল আপনি ধরে আছেন শৈলী। আপনি ছেড়ে দিলেই আমি ব‍্যাগ ছাড়তে পারবো।

শৈলী ঝট্ করে নিচে তাকায়। এখনো মিহরানের হাত ঝাপ্টে ধরে থাকা দেখে ওর আত্মা দ্বিতীয়বার কাঁপে। সাথে সাথে হাত সরায়। মিহরান মুচকি হেসে ব‍্যাগ থেকে হাত সরিয়ে সামনে আগায়। শৈলীও তাড়াতাড়ি পা বাড়ায় নয়তো মাহিরা আবার সন্দেহ করতে পারে ভেবে। কিন্তু দু কদম যাওয়ার আগেই হোচট খায়, কানের কাছে দুটি শব্দ শুনে,

– সুন্দর লাগছে।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here