#হৃদয়_জুড়ে_তার_ছায়া
#পর্বঃ১৫
#আদওয়া_ইবশার
মেহগনি গাছের ডালে দুটো জোড়া শালিক এসে বসেছে। যত্নসহকারে একে অপরের শরীর খুঁটিয়ে দিচ্ছে। মাঝে মাঝে আবার দুজনে মেতে উঠছে দুষ্টু মিষ্টি ঝগড়ায়। ধারালো ঠোঁটের শক্ত ঠোকর বসিয়ে দিচ্ছে একে অপরের মাথায়। এক ধ্যানে পাখি দুটোর দিকে তাকিয়ে আছে পাপড়ি। এমন একটা ভাব যেন এই মুহূর্তে শালিক দুটোর দুষ্টু মিষ্টি প্রেমের উপাখ্যান দেখা ছাড়া পৃথিবীতে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ নেই। নাহিদ পাপড়ির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে গলা ঝারে। অসল ভঙ্গিতে পাখি দুটোর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নাহিদের দিকে তাকায় পাপড়ি। অত্যন্ত স্বাভাবিক স্বরে জানতে চায়,
“কি যেন জরুরী কথা বলার জন্য ডেকেছিলেন? তা কি সেই জরুরী কথা?”
একটু নড়েচড়ে দাঁড়ায় নাহিদ। কিন্চিৎ ভ্রুঁ কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
” আপনার কি খুব শখ হয়েছে পুরো জাতির কাছে নিজেকে বেয়াক্কল হিসেবে জানান দেওয়ার?”
“মানে?” কিছুই বুঝতে পারেনি এমন একটা ভাব পাপড়ির। ঠোঁট বাঁকিয়ে অল্প হাসে নাহিদ। দূরে ঐশীদের সাথে বসে থাকা লাবিবকে কাছে ডাকে। সাথে সাথেই এক দৌড়ে ছুটে আসে লাবিব। পাপড়ির দিকে তাকিয়ে প্রাণ খোলা হেসে একটা মোড়ানো কাগজ এগিয়ে দেয় নাহিদের দিকে। কয়েক সেকেন্ডে কাজটা করে আবারও এক দৌড়ে চলে যায় সেখান থেকে। নাহিদের ঠোঁটের কোণে এখনো দুষ্টু হাসি লেগে আছে। পাপড়ির দিকে কিছুটা এগিয়ে এসে কাগজটা মেলে ধরে ঝরঝরে কন্ঠে বলে,
” আমি মানুষটা আপনার ভাষায় অভদ্র হলেও কথা রাখতে জানি। বলেছিলাম আমার জবাব না পেলে ছবি সহ বেয়াক্কল নাম দিয়ে পোস্টার ছাপিয়ে দিব! কথা অনুযায়ী কাজ অর্ধেক শেষ। এবার শুধু আনাচে কানাচে লাগিয়ে দেওয়া বাকী। এটাও কি কমপ্লিট করে ফেলবো? বেশি সময় লাগবেনা কিন্তু। সবার আগে না হয় আপনার বন্ধুদের হাতে দিয়ে শুভ উদ্বোধনটা করে ফেলি!”
হতবম্ভ হয়ে পোস্টারের দিকে তাকিয়ে থাকে পাপড়ি। অচল মস্তিষ্ক শুধু একটা কথায় ভাবছে, এ কোন পাগলের পাল্লায় পরল সে! মানুষটা কি আসলেই সুস্থ্য স্বাভাবিক মস্তিষ্কের না কি অর্ধ পাগল? একজন স্বাভাবিক প্রাপ্তবয়স্ক যুবকের দ্বারা কখনো এরকম পাগলামি করা সম্ভব?আর কিছুই ভাবতে পারেনা । মনের মাঝে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। যে ছেলে পোস্টার ছাপানো পযর্ন্ত এগিয়ে যেতে পারে সেই ছেলের দ্বারা কোনো কিছুই অসম্ভব না। ক্রস্ত পায়ে নাহিদের দিকে এগিয়ে যায়। টান দিয়ে হাত থেকে পোস্টারটা ছিনিয়ে নিয়ে কুটিকুটি করে ছিঁড়ে নিচে ফেলে দেয়। খেঁকিয়ে বলে ওঠে,
” আপনি যে চরম লেভেলের অভদ্রের সাথে সাথে একটা বদ্ধ উন্মাদ,পাগল এটা জানা ছিলনা।”
“এখন তো জানলেন! আর হ্যাঁ, একটা ছিঁড়েছেন তো কি হয়েছে? ঐ যে নাজিমের কাধে ব্যাগ দেখছেন। ঐটার ভিতর কিন্তু আরও শত শত এমন পোস্টার ছাপানো আছে। সো বুঝতেই তো পারছেন নাহিদ এতো কাঁচা খেলোয়াড় না।”
কুটিল হেসে জবাব দেয় নাহিদ। রাগ সংবরণ করতে না পেরে পূণরায় তেড়ে আসে পাপড়ি। দাঁতে দাঁতে পিষে হাত দুটো নাহিদের গলার কাছে নিয়ে বলে,
“আর একটা উল্টাপাল্টা কিছু করলে একদম খু’ন করে ফেলব। অভদ্র, অসভ্য,পাগল লোক কোথাকার। একদম অসহ্য লাগে আপনাকে আমার।”
কথা গুলো একদম গায়ে লাগায়না নাহিদ। পাপড়িকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গলা ছেড়ে বন্ধুদের ডেকে বলে,
“আর বসে থেকে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। কাজ শুরু করে দে তোরা। কারো যদি নিজের মানসম্মানের প্রতি মায়া -দয়া না থাকে তাহলে আমার কি করার!”
সাথে সাথেই চেচিয়ে ওঠে পাপড়ি। হরবরিয়ে বলে,
“এই একদম না একদম না। আমি রাজি।”
“কিসের রাজি?” প্রশ্ন করে নাহিদ।
“আপনার শর্তে রাজি।”
না বোঝার ভান করে পূণরায় প্রশ্ন করে নাহিদ,
“কোন শর্তে রাজি?”
নিজেকে যথাসম্ভ শান্ত রেখে চিবিয়ে চিবিয়ে জবাব দেয় পাপড়ি,
” আপনার ফেবিকল হতে রাজি। হয়েছে? এবার অন্তত পাগলামি থামান।”
নাহিদের ঠোঁটের কোণে বিশ্বজয়ের হাসি। হাত দিয়ে চুল ঠিক করতে করতে বলে,
“একেই বলে সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল বাঁকা করতে হয়। এই কথাটা রাতে বলে দিলেই তো হতো। শুধু শুধু আমাকে পোস্টার ছাপানোর পিছনে এতো গুলো টাকা খরচ করতে হতনা। সে যায় হোক।দ্রুত কাছে আসুন।”
হুট করে এমন আহবানে হকচকিয়ে যায় পাপড়ি। বিস্মিত কন্ঠে জানতে চায়,
“কাছে আসব মানে?”
“একটু আগেই না বললেন আমার ফেবিকল হতে রাজি! তো আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরতে হবেনা? তবেই তো বুঝতে পারব আপনি আমার কতটা কাজের ফেবিকল। আর কথা না বাড়িয়ে ঝটপট এসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরুন তো। যেতে হবে আমার তাড়াতাড়ি। আপনার পিছনে সারা দিন পরে থাকলে চলবেনা।”
মানুষ এতোটা ঠোঁটকাটা, লাগাম ছাড়া বেহায়া হতে পারে বুঝি! জানা ছিলনা। ধৈর্য্য হারায় পাপড়ি। অসহ্য কন্ঠে বলে,
“এবার কিন্তু অতিরিক্ত করছেন। আপনার মতো এমন পাগলের গার্লফ্রেন্ড হিসেবে আমি না। মেন্টাল হাসপাতালের কোনো মানসিক ভারসাম্যহীন মেয়েই পারফেক্ট। আপনার এমন মাত্রাতিরিক্ত ফাজলামি কোনো সুস্থ্য মস্তিষ্কের মেয়ের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব না।”
“তাহলে আপনি না হয় বেয়াক্কলের সাথে সাথে আজ থেকে পাগল’ও হয়ে গেলেন। ভালোবাসার জন্য একটু পাগল হতে ক্ষতি কি!”
ভাবলেশহীন জবাব নাহিদের। আর কোনো উত্তর দেয়নি পাপড়ি। অসহ্য রকমের বিরক্তিতে চুপ হয়ে যায়। দূর থেকে তাদের এমন বেগতিক অবস্থা দেখে এগিয়ে আসে লাবিব। পিছন পিছন নাজিম রাফিনও ছুটে আসে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নাহিদকে নাজিম। শান্তনা দেবার মতো করে বলে,
“থাক ভাই । আজকে না হয় এই আমারেই নিজের ফেবিকল ভেবে নে! বন্ধুর উষ্ণ আলিঙ্গনেই আপাতত তৃষ্ণা মিটিয়ে ফটাফট কেটে পর এখান থেকে। প্রয়োজনের তুলনায় লেবু বেশি চিপলে কিন্তু তিঁতা হইয়া যায়। কাছে আসার গল্পটা না হয় আরেকদিন অন্য কোনো নিরিবিলি জায়গায় দুজনে চুপিসারে করে নিস। ভদ্র ছেলেরা পাবলিক প্লেসে ঐসব করেনা।”
নাজিমের এমন লাগামছাড়া কথার ধরনের অস্বস্তিতে পরে যায় পাপড়ি।লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলে। নিজ মনেই বিরবির করে বলে ওঠে,
“সব কয়টা একরকম ঠোঁটকাটা স্বভাবের। একটা মেয়ে সামনে রেখে কি ধরনের কথাবার্তা বলে! ছিঃ”
এরকম দুষ্টু মিষ্টি মুহুর্ত গুলোকে সঙ্গী করেই শুরু হয়েছিল নাহিদ পাপড়ির প্রেমের উপাখ্যান। নিয়ম করে ফোনে নাহিদের হাজারটা ফাজলামিপূর্ণ কথা শুনতে শুনতে একটা সময় এই মাত্রাতিরিক্ত অভদ্র ঠোঁটকাটা ছেলেটার প্রতিই বাজে ভাবে দূর্বল হয়ে ওঠে পাপড়ির কোমল হৃদয়টা। নাহিদ নামক বাজে ছেলেটার ভালোবাসার রঙে রাঙিয়েছিল নিজেকে। কেউ কখনো মুখ ফুটে কাওকে বলেনি “ভালোবাসি”। তবুও জানতো তারা একে অপরকে ঠিক কতটা ভালোবাসে। হয়ে ওঠেছিল একে অপরের নতুন এক পৃথিবী। যে পৃথিবীর পুরোটাই ছিল ভালোবাসায় মুড়ানো। চোখে ছিল দুজনের হাজারটা রঙিন স্বপ্ন।মনের মাধুরী মিশিয়ে পাপড়ি একদিন বউ সাজবে নাহিদের। ছোট্ট একটা সংসার হবে দুজনের। যে সংসারের প্রতিটা কোণায় কোণায় সুখ লেপ্টে থাকবে। একে অপরের কাধে মাথা রেখে কাটিয়ে দিবে শত শত নির্ঘুম রাত। যৌবনের রঙিন দিন গুলো পিছনে ফেলে বার্ধক্যে পৌঁছেবে দুজন দুজনার হাত ধরে। এই ছোট ছোট স্বপ্ন গুলোর কথাও কেউ কাওকে কখনো মুখ ফুটে বলেনি। তবে দুটো মানুষ দুই প্রান্তে থেকেও একে অপরকে নিয়ে একই স্বপ্নে বিভোর থাকতো।
***
প্রতিদিনের মতো সেদিনও সকাল থেকে নাহিদের ফোনের অপেক্ষায় ছিল পাপড়ি। বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়। পাপড়ির অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে নাহিদের থেকে কোনো কল আসেনা। চিন্তিত হয় পাপড়ি। ভাবে আবার কোনো বিপদ হলো কি না। শত ব্যস্ততার মাঝেও যে ছেলে সময় করে প্রতিদিন অন্তত দুবার হলেও ফোন দিয়ে ননস্টপ কথার ঝুলি খুলে বসে। হাজারটা লাগামছাড়া, হাসি-ঠাট্টার কথা বলে পাপড়িকে লজ্জা আর হাসির সাগরে ক্ষণেক্ষণে ডুবিয়ে মারে। সেই ছেলে আজ সারাদিন কেটে যাবার পরও একটা ম্যাসেজ পযর্ন্ত দেয়নি বিষয়টা গভীর চিন্তায় ফেলে পাপড়িকে। মনের ভিতর জমা হয় অজানা এক ভয়। আর অপেক্ষায় থাকতে না পেরে নিজেই ফোন করে বসে সন্ধ্যার পর। দুইবার রিং হয়ে কেটে যায়। তৃতীয় বারের মাথায় রিসিভ হয়। সাথে সাথেই পাপড়ি উত্তেজিত কন্ঠে বলে ওঠে,
“কোথায় ছিলেন আপনি? সারাদিনে একটা ম্যাসেজ দেওয়ারও প্রয়োজন মনে করেন নি! একটা মানুষ এতোটা কেয়ারলেস কিভাবে হতে পারে! এই বোধটুকু একবারও মাথায় আসেনি যে সারাদিন কোনো খোঁজ খবর না পেয়ে কেউ হয়তো চিন্তা করতে পারে?”
“বাড়ি যাচ্ছি আমি।”
অত্যন্ত শীতল কন্ঠের জবাব নাহিদের। নিরব হয়ে যায় পাপড়ি। কিছুক্ষণ চুপ থেকে জিজ্ঞেস করে,
” হঠাৎ বাড়িতে কেন? কোনো কিছু হয়েছে কি? আঙ্কেল-আন্টি, নাদিয়া, নাফিস ঠিক আছে তো সবাই!”
“জানিনা।”
অবাক হয় পাপড়ি এমন জবাবে। কন্ঠে বিস্ময়টুকু ধরে রেখেই বলে,
“জানিনা মানে কি? এসব কি ধরনের স্বভাব আপনার বলুন তো? একটা সিরিয়াস মুহূর্তে এসেও আপনার মাঝে কোনো হেলদুল থাকেনা!”
একটু বোধহয় বিরক্ত হয় নাহিদ। গলার স্বর আগের থেকে উচু করে কিছুটা গম্ভীর হয়ে জবাব দেয়,
“আশ্চর্য! আমি কি বাড়ি পৌঁছে গেছি নাকি? গাড়িতে থেকে ওরা কেমন আছে না আছে জানব কিভাবে? এসব লজিকলেস কথাবার্তা শোনার ইচ্ছে আমার এই মুহূর্তে একদম নেই। ফোন রাখছি।”
কথাটা বলতে দেরি কিন্তু সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে দেরি হয় না। বিস্ময়ে জড়ীভূত হয়ে ফোন কানে নিয়েই ঠাই দাঁড়িয়ে থাকে পাপড়ি। হঠাৎ নাহিদের এমন আচরণের কোনো মানে খোঁজে পায়না। ভালোবাসার মানুষের থেকে এটুকু কটূক্তিও যেন সহ্য হয় না। টুপ করে এক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরে চোখের কার্ণিশ বেয়ে নিজের অজান্তেই। গাল বেয়ে উষ্ণ জলের ধারা গড়িয়ে পরছে অনুভব হতেই সাথে সাথে হাত দিয়ে মুছে নেয় অশ্রু টুকু। হাওয়ায় মিলিয়ে দেয় বেদনার্থ অনুভূতিটাকে। অবুঝ মনকে বুঝায় নিশ্চয়ই কোনো ঝামেলা হয়েছে বাড়িতে। যার কারণে মন মেজাজ ভালো নেই নাহিদের। খিটখিটে মেজাজটা হয়তো অন্য কারো কাছে প্রকাশ করতে না পেরে তার সাথেই মিটিয়ে দিয়েছে ঝাঝটুকু। রাগ-অভিমান, ভালোবাসা এই সবকিছুই তো প্রিয় মানুষ গুলোর কাছেই প্রকাশ করা যায়। পাপড়ি যদি নাহিদের ভালোবাসার ভাগ নিতে পারে তাহলে রাগের ভাগ কেন নিতে পারবেনা?ভালোবাসার সাথে না হয় প্রিয় মানুষটার রাগটুকু মিষ্টি মধুর যন্ত্রণা হিসেবে গ্রহণ করে নিল। কোনো ক্ষতি নেই তো তাতে।
চলবে…