হৃদয়_জুড়ে_তার_ছায়া #পর্বঃ২৬

0
160

#হৃদয়_জুড়ে_তার_ছায়া
#পর্বঃ২৬
#আদওয়া_ইবশার

দিনের শেষ প্রহরে পাপড়িদের বাড়িতে এসে উপস্থিত হয় নাহিদ। উষ্কখুষ্ক চুল, এলোমেলো শার্টের বোতাম সব মিলিয়ে বেহাল দশা। এর আগে কখনো নাহিদকে এতোটা এলোমেলো অবস্থায় দেখেনি রওশন আরা। সবসময় গোছানো ছেলেটার আজ এই প্রথম এমন অবস্থা দেখে যথাপরনায় অবাক হন। বিহ্বল দৃষ্টিতে কতক্ষণ নাহিদের দিকে তাকিয়ে থেকে উৎকন্ঠা নিয়ে জানতে চান,

“এ কি অবস্থা তোমার বাবা? তুমি না রাজশাহী গিয়েছিলে! তাহলে এখন আবার এখানে কিভাবে তাও এমন এলোমেলো অবস্থায়! পথে কোনো দুর্ঘটনা হয়নি তো আবার?”

এলোমেলো কদম ফেলেই রওশন আরার দিকে এগিয়ে আসে নাহিদ। ক্লান্ত স্বরে বলে,

“আমাকে একটু পানি দিবেন আন্টি? তৃষ্ণা পেয়েছে।”

হন্তদন্ত হয়ে রওশন আরা ডাইনিং এ ছুটে গিয়ে এক গ্লাস পানি এনে দেয় নাহিদের হাতে। এক ঢোকে পুরো গ্লাস ফাঁকা করে শরীর ছেড়ে সোফায় বসে পরে নাহিদ। অবসন্ন কন্ঠে জানা চায়,

“আঙ্কেল বাসায় আছেন?”

“হ্যাঁ। একটু আগেই বাজার থেকে এসেছে। এখন ঘরেই আছে।”

জবাব দেয় রওশন আরা। নাহিদ পূণরায় পাপড়ির কথা জানতে চায়,

“পাপড়ির কোনো অসুবিধা হয়নি তো আন্টি!”

“না বাবা। ও ভালোই আছে। হাসিখুশি ভাবেই পালকের সাথে সারাদিন কাটিয়েছে। একটু আগেই ঘুমিয়েছে।”

কিছুক্ষণ বিরতি নিয়ে রওশন আরা আবারও বলেন,

“তুমি কিছু বললে না যে, এই অবস্থা কেন তোমার?”

ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে নাহিদ জবাব দেয়,

“এতো দূর জার্নি করে এসেছি তো তাই এমন দেখাচ্ছে। টেনশনের কিছু নেই। আপনি একটু কষ্ট করে আঙ্কেলকে ডেকে দিবেন? আমার আপনাদের সাথে কিছু কথা ছিল।”

বিপরীতে আর কিছুই বলেনা রওশন আরা। চুপচাপ নজরুল ইসলামকে গিয়ে ডেকে নিয়ে আসেন। একটু পর নজরুল সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে এসে উপস্থিত হন রওশন আরা। দুজনেই নাহিদের অপজিট সোফায় বসেন চিন্তিত ভঙ্গিতে। দুজনের মনের মাঝেই একই ভাবনা পাপড়িকে নিয়ে আবার খারাপ কোনো খবর বলবেনা তো! ওনাদের চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে একটু নড়েচড়ে বসে নাহিদ। জ্বিভের ডগায় শুকনো ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে স্বাভাবিক স্বরে বলে,

“আমি পাপড়িকে বিয়ে করতে চাই। আমরা দুজন যে দুজনকে ভালোবাসি এই সম্পর্কে নিশ্চয়ই আপনারা আরও আগে থেকেই অবগত! তাই আশা করছি এখন আবার নতুন করে আপনাদের কিছুই বোঝাতে হবেনা। আর একটা কথা। দয়া করে এই অযুহাতটা দিবেন না যে পাপড়ি অসুস্থ। এই মুহুর্তে এসব হবেনা। সে যদি অসুস্থ না হতো, তাহলে আমি নিজেও এতো তাড়াতাড়ি বিয়ের কথা তুলতাম না। ওর অনার্স কমপ্লিট হবার পরই বলতাম। কিন্তু ভাগ্য তো আর সেটা হতে দিবেনা। তাই ওর হাতে যে সময় টুকু আছে আমি সেই সময় টুকুর জন্যই ওকে একটা সংসার উপহার দিতে চাই।সাধ্য অনুযায়ী আমাদের দুজনের স্বপ্ন গুলো পূরণ করতে চাই। এবং সেটাও আপনাদের অনুমতি নিয়েই। আশা করি আপনারা আমাকে নিরাশ করবেন না।”

নজরুল ইসলাম, রওশন আরা দুজনেই স্তব্ধ হয়ে আছে। নাহিদ যে এমন একটা কথা বলতে তাদের ডেকেছে এটা ভাবেওনি। রওশন আরা চোখ দুটো মুহুর্তের মাঝেই অশ্রুজলে ভরে ওঠে।মেয়েটাকে নিয়ে তো তাদেরও কম স্বপ্ন ছিলনা। কিন্তু সেই স্বপ্ন গুলো যে পূরণ হবার আগেই এমন একটা ঝড় বয়ে যাবে তাদের জীবনে ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারেনি কেউ। কিছুক্ষণ বিমূঢ় দৃষ্টিতে নাহিদের দিকে তাকিয়ে থেকে নজরুল সাহেব রাশভারী কন্ঠে বলেন,

“যা বলছো ভেবে বলছো তো! আজকে যে সিদ্ধান্তটা জানালে আমাদের এটার জন্য ভবিষ্যতে কি কোনো অনুশোচনা হবেনা তোমার? মনে হবেনা যে জীবনে এটাই সবথেকে বড় ভুল সিদ্ধান্ত ছিল তোমার?”

“আপনার কেন মনে হচ্ছে ভবিষ্যতে আমার এমন ভাবনা হতে পারে? আমি তো অনুশোচনায় ভুগতে এই সিদ্ধান্ত নেইনি। বরং অনুশোচনা থেকে মুক্তি পেতেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছি। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে যখন দুজন দুজনকে ভালোবাসে।তখন তারা একে অপরকে নিয়ে হাজারটা স্বপ্ন বুনে। আমি আর আপনার মেয়েও কিন্তু তেমন ছোট ছোট কিছু স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্ক্ষা বুকের ভিতর সম্পর্কের শুরু থেকেই লালন করে আসছি আঙ্কেল। এই স্বপ্ন গুলো যদি একটাও পূর্ণতা না পায় তাহলে আফসোস করে করে সারাটা জীবন অসহ্য এক পীড়া নিয়ে কাটাতে হবে আমার। অনুশোচনাটা আজকের এই সিদ্ধান্তের জন্য হবেনা। হবে যদি এই সিদ্ধান্তটাকে বাস্তবায়ন করতে না পারি।”

নাহিদের কথা শেষ হতেই কাল বিলম্ব না করে রওশন আরা বলে ওঠেন,

“কে রাজি আর কে রাজি না এসব আমি জানিনা আর জানতেও চাইনা। কিন্তু আমি রাজি। তোমার এই সিদ্ধান্তের ফলে যদি আমার মেয়েটা মৃত্যুর আগে তার অপূর্ণ ইচ্ছে গুলোকে পূরণ করে সুন্দর কিছু মুহুর্ত কাটাতে পারে তবে আমার আর কিছুই লাগবেনা। আমি আমার মেয়েটাকে একটু সুখী দেখতে চাই। তৃপ্তির হাসি দেখতে চাই আমি তার মুখে।”

কথা গুলো বলতে বলতেই কান্নায় লুটিয়ে পরেন রওশন আরা। নজরুল ইসলাম কিছুক্ষণ মৌন থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নাহিদের দিকে তাকিয়ে বলেন,

“ঠিক আছে! আমারও কোনো আপত্তি নেই। তবে হ্যাঁ! যদি তোমার মা-বাবা চায় বিয়েটা তবেই হবে। তোমার মা-বাবা’কে নিয়ে এসো।”

বিধ্বস্ত নাহিদ মুহুর্তে অস্থির হয়ে ওঠে। অধৈর্য হয়ে বলে,

“বিয়েটা আমি করব। পাপড়ি আমার সাথে গাজীপুর আমার ফ্ল্যাটে থাকবে। সেখানেই আমাদের সংসার হবে। এখানে শুধু শুধু বাবা-মা’কে কেন টেনে আনছেন? ওনারা রাজ থাক বা না থাক। আমি তো রাজি!”

নজরুল ইসলামের রাশভারী, গম্ভীর মুখটাতে অল্প শ্লেষাত্বক হাসির দেখা মিলে। বিদ্রুপাত্বক স্বরে বলেন,

“আমি জানতাম এমন কিছু একটাই বলবে। রাজশাহী নিশ্চয়ই গিয়েছিলে তাদের রাজি করানোর জন্য! কিন্তু তাদের রাজি করাতে না পেরে এভাবে পরাজিত সৈনিকের মতো বিধ্বস্ত রূপ নিয়ে আমার কাছে এসেছো। কিন্তু আমিও যে পারবনা তোমার মা-বাবার অমতে এই বিয়েতে রাজি হতে। আমার মেয়েটা এমনিতেই অসুস্থ নাহিদ। ক্যান্সার নামক ঘাতকটা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে মেয়েটাকে। আমি এক ব্যর্থ বাবা হয়ে শুধু দু-চোখ মেলে মেয়েকে একটু একটু করে নিঃশেষ হতে দেখে যাচ্ছি। হাজার ইচ্ছে থাকার পরও কিছুই করতে পারছিনা। এর মাঝে আবার তোমার বাবা-মায়ের অমতে তোমাদের বিয়ে দিয়ে একটু সুখের আশায় মেয়েটাকে নতুন করে অশান্তির আগুনে ঠেলে দিতে পারি না। তুমি তোমার বাবা-মায়ের বড় সন্তান। যেমনটা পাপড়ি আমাদের বড় সন্তান। সব বাবা-মায়ের অন্য সন্তানদের থেকেও বেশি বড় সন্তানকে নিয়ে আশা-ভরসা থাকে। আলাদা একটা টান থাকে। তোমার বাবা-মায়েরও আছে।আজকে হয়তো তাদের কাছে একটা অবান্তর আবদার করেছো দেখে তারা তোমার সাথে রেগে কথা বলেছে। তোমার আবদার না রেখে হয়তো অনেক কটুক্তি করেছে। যার কারণে তোমার মনেও হয়তো অনেক আশ্লেষের জন্য হয়েছে। রাগে-ক্ষুবে তুমিও তাদের দু-চারটা কথা শুনিয়ে চলে এসেছো। মনে মনে ভেবেও নিয়েছো তার যাবেনা তাদের কাছে। পাপড়িকে নিয়ে এখানেই আলাদা সংসার গড়বে। কিন্তু দুদিন পর যখন তোমার বাবা-মায়ের মন থেকে রাগ-অভিমান দূর হবে। তোমাকে ডাকবে। তখন কি তুমি তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারবে? নিশ্চয়ই পারবেনা। কারণ আমার জানামতে তুমিও তোমার বাবা-মা’কে অনেক ভালোবাসো। সেই ভালোবাসার স্থান থেকেই কখনো বাবা-মায়ের ডাক উপেক্ষা করতে পারবেনা। তাদের ডাকে সারা দিয়ে যাবে তুমি তাদের কাছে। বিয়ে হয়ে গেল তোমাদের তাই নিরুপায় হয়ে তোমার মা-বাবা মেনে নিল ঠিক আছে। কিন্তু তোমার আড়ালে বা সামনে ঠিকই আমার মেয়েটার উপর রাগ ঝারবে তারা। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশি সবাই আমার মেয়ের উপর আঙুল তুলবে,” নিজের কথা চিন্তা করে দুদিনের সুখ কুড়াতে এসে পাপড়ি তোমার জীবনটাকে নষ্ট করেছে।” তখন ঐ কথা গুলো আমার মেয়েকে কতটা সুখ দিবে? বাঁচতে দিবে তাকে কথার আঘাত? মেয়েটা যে তখন অসুখের কারণে ম’রা’র আগেই মানুষের কথার বিষবাণে ম’রে যাবে।তোমার বাবা-মা মুখ ফুটে আমার মেয়েটাকে অভিশাপ না দিলেও মন থেকে যে কোনো শাপ দিবেনা এটা কি নিশ্চিত হয়ে বলতে পারো তুমি? সব দিক ভেবেই তোমার কাছে আমি হাত জোর করে অনুরোধ করছি এমন কথা আর মুখে এনো না। আমার মেয়েটা যে কয়দিনই বাঁচে ওকে একটু সুস্থ্যভাবে বাঁচতে দাও। বিয়ে করেই যে ওর স্বপ্ন পূরণ করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। বিয়ে ছাড়াই যেটুকু পারো আমার মেয়েটার পাশে থেকে ওকে একটু আগলে রেখো। ওকে সাথে নিয়ে কিছু সুখের স্মৃতি কুড়িয়ে নিও।”

এতো গুলো কথা শোনার পর মুখ দিয়ে আর একটা শব্দও উচ্চারণ হয়না নাহিদের। অসহায়ের মতো শুধু ছলছল নয়নে তাকিয়ে থাকে নজরুল সাহেবের দিকে। সময়ের সাথে সাথে চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে। ঘোলাটে দেখায় নজরুল সাহেবের প্রতিচ্ছবি। অসাড়ে পরিণত হয় হাত-পা। বারকয়েক ঢোক গিলে কিছু একটা বলার চেষ্টা করে। একটু গলা দিয়ে একটা শব্দ’ও বের হয় না। বারবার চেষ্টার পরও কোনো আওয়াজ বের করতে না পেরে হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেয়। চোখে টলমল অশ্রু গুলো টুপটাপ করে ঝরে পরে কোলের উপর। দূর্বল শরীরটুকু কোনোমতে টেনেটুনে ওঠে দাঁড়ায় নাহিদ। অনেক দেখানো হয়ে গেছে মানুষজনকে নিজের দূর্বলতা। আর না। সবাই শুধু তার দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাকে কষ্টই দিয়ে যাচ্ছে। এক একটা শব্দবাণে বুকের বা পাশটা এফোঁড়-ওফোড় করে ফেলছে। সাত আসমানের উপর বসে থাকা ঐ সৃষ্টকর্তাও তার ব্যতিক্রম নই। কিভাবে তার বুকের ভিতর একটা মেয়ের জন্য ভালোবাসার জন্ম দিয়ে সেই ভালোবাসা আবার কেড়ে নিচ্ছে। তার জন্য কি ঐ বিধাতার’ও একটু দয়া হয়না?

****

রাত আনুমানিক দশটা। এখনো বেঘোরে ঘুমাচ্ছে পাপড়ি। বাড়ির প্রতিটা সদস্যের কপালে চিন্তার বলিরেখা। সেই বিকেল থেকে এখনো ঘুমাচ্ছে মেয়েটা। অসুস্থ হবার পর থেকে কড়া ডোজের মেডিসিনে মেয়েটা তো ঠিকমতো রাতেও ঘুমাতে পারেনা। তাহলে আজকে এটা কোন ধরনের ঘুম ঘুমাচ্ছে সে? পাপড়ির মাথার কাছে বসে আছে রওশন আরা। নজরুল ইসলাম, পালক দুজন দাঁড়িয়ে উৎসুক নজরে তাকিয়ে পাপড়ির ঘুমন্ত মুখের দিকে। রওশন আরা আস্তে করে তার মাথায় হাত বুলিয়ে নরম স্বরে বারকয়েক ডাকে। ক্ষানিক পর চোখ পিটপিট করে তাকায় পাপড়ি। এক ধ্যানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ধাতস্থ হয়ে ওঠে বসে। মেয়ের কপালে স্নেহভরে চুমু খেয়ে নজরুল ইসলাম বলেন,

“এতোক্ষণ এভাবে কেউ ঘুমায় আম্মা! কয়টা বাজে খবর আছে তোমার? খেয়ে মেডিসিন নিতে হবে তো!”

বাবার কথায় শুকনো হাসে পাপড়ি। নিচু স্বরে বলে,

“স্যরি বাবা। আসলে ঘুম পাচ্ছিল অনেক তাই ঘুমিয়ে গেছিলাম। এখন কয়টা বাজে?”

পাশ থেকে পালক জবাব দেয়,

“দশটার উপরে বাজে।”

“ওহ্!” ছোট্ট করে বলে পাপড়ি। এরপর চুপচাপ ওঠে যায় ফ্রেশ হতে। পিছন পিছন রওশন আরা এগিয়ে যায়।পাপড়িকে ফ্রেশ হতে সাহায্য করে। নিজ হাতে তুলে খাইয়ে দেয় একসাথে দুই মেয়েকে। এরপর পাপড়ির মেডিসিন দুজনকেই চুপচাপ ঘুমাতে বলে চলে যায়।

বিকেল থেকে একটানা এতোক্ষন ঘুমানোর ফলে এই মুহূর্তে পাপড়ির চোখে ঘুম নেই। নিস্তেজ চোখ দুটো মেলে সিলিং এর দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে। পাশ থেকে পালক সেই কখন থেকেই রাজ্যের গল্প বলে যাচ্ছে। একটাতেও বোনের কোনো হেলদুল না পেয়ে একটু মন খারাপ হয় পালকের। হঠাৎ কিছু একটা মাথায় আসতেই হাসিমুখে আবারও বলে,

“এই আপু ! জানো বিকেলে কি হয়েছে?”

“কি?” শান্ত কন্ঠে জানতে চায় পাপড়ি। পালক আগের থেকেই অধিক উত্তেজনা নিয়ে বলে,

“নাহিদ ভাই এসেছিল বিকেলে। রাজশাহী থেকে সরাসরি এখানে এসেছিল। বাবা-মা’র সাথে কথা বলছিলো তখন একটু একটু শুনেছিলাম নাহিদ ভাই তোমাকে বিয়ে করবে বলেছে। ওফফ! আমার যে কি আনন্দ লাগছে এখনই। তোমার বিয়েতে খুব মজা হবে। আমার পুরো ফ্রেন্ড সার্কেলকে দাওয়াত দিব। যত ধরনের আয়োজন আছে বাবা’কে বলব সব করতে। আমার একমাত্র বোনের বিয়ে সবথেকে ইউনিক ওয়ে তে হবে।”

বোনের উত্তেজনা দেখে পাপড়ি মুচকি হাসে। কিছুক্ষণ নিরব একই ভাবে শুয়ে থেকে ভাবে কিছু কথা। দুপুরের পর পরই পাপড়ির ফোনে নাদিয়ার নাম্বার থেকে কল এসেছিল। ভাইয়ের চিন্তায় মেয়েটার নাজেহাল অবস্থা হয়েছিল সেটা ফোনের এপাশ থেকেও পাপড়ি ঢের বুঝতে পেরেছে। অত্যধিক চিন্তায় দিকবিদিক হারিয়ে পাপড়িকে সব গড়গড় করে বলে দেয় শাহিনূর আর সাইদুর রহমানের সাথে হওয়া নাহিদের বাকবিতন্ডতার কথা। সেই থেকেই পাপড়ি একেবারে নিস্তেজ হয়ে আছে। অবুঝ নাদিয়া বুঝতেও পারেনি তার কথা গুলো পাপড়িকে ঠিক কতটা ক্ষতবীক্ষত করেছে। আঘাত গুলো সইতে না পেরে সকলের আড়ালে দুটো ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঐভাবে বিকেল থেকে মরার মতো পরে ছিল পাপড়ি। কথা গুলো আবারও স্বরণ হতেই বুকের ভিতরটাই প্রচন্ড চাপ অনুভব করে পাপড়ি। শ্বাস ফেলতেও কষ্ট হয় তার। ঘনঘন নিশ্বাস নিয়ে বারকয়েক ঢোক গিলে নিজেকে শান্ত রাখার প্রয়াস চালায়। লহু স্বরে পালক’কে ডেকে বলে,

“আমার একটা কথা রাখবি পালক?”

“কি কথা?” জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বোনের দিকে তাকিয়ে জানতে চায় পালক।,

“আগে বল রাখবি আমার কথা!”

এবার একটু অবাক হয় পালক। কি এমন কথা ! যার জন্য পাপড়ি তাকে এভাবে বলছে। ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ ভেবে বলে,

“আচ্ছা রাখব। বলো এবার কি কথা!”

কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে চোখের পলক ঝাপটায় পাপড়ি। ভারী হয়ে আসা কন্ঠে বলে,

“আমার যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে নাহিদকে তুই সবসময় আগলে রাখিস। আমি চাই আমার অবর্তমানে নাহিদের সাথে তোর বিয়ে হোক। তুই ভাবতেও পারিস না পালক সৃষ্টিকর্তা আমার মনে নাহিদের জন্য কতটা ভালোবাসা সৃষ্টি করেছেন। ঐ ছেলেটাও যে আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। মুখে সেটা কখনো উচ্চারণ না করলেও আমি ঠিক জানি। আমার কিছু হয়ে গেলে ও নিজেকে ঠিক রাখতে পারবেনা। ওকে তুই আগলে নিস। তোর মনে ভালোবাসার সৃষ্টি করিস ওর জন্য। বিশ্বাস করে আমি নাহিদকে ভালোবাসি বলে বলছি না। ও অনেক ভালো একটা ছেলে। প্রথম প্রথম আমাকে ভুলতে না পেরে হয়তো তোকে অবহেলা করবে। কিন্তু তোর ভালোবাসা যদি খাঁটি হয় তবে ঠিক একদিন তার মনে তোর জায়গা হবে। নাহিদের পাশে আমি তোকে ছাড়া অন্য কোনো মেয়েকে সহ্য করতে পারবনা। আমাদের অপূর্ণ ভালোবাসার সংসারটাকে তুই পূর্ণতা দিস।”

বোনের মুখের এমন কথায় স্তব্ধ, বিমূঢ়, বাকহারা পালক। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ পাপড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে,

“এসব কি আবোলতাবোল বলছো তুমি? কিচ্ছু হবেনা তোমার। তুমি শুনোনি আমি তোমাদের বিয়ে নিয়ে কত কত প্ল্যান করেছি! নাহিদ ভাই আর তোমার বিয়ে হবে আপু। তুমি দেখো তোমাদের সংসার হবে। শুধু শুধু এসব কথা আর বলো না। আমার খুব কষ্ট হয় শুনতে। তোমার কিছুই হবেনা। তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেলে আমার কি হবে? আম্মুর বকা থেকে কে আমাকে বাঁচাবে? কে আমার সব আবদার পূরণ করবে? তোমাকে বাঁচতে হবে। আমার জন্য হলেও তোমাকে বাঁচতে হবে।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here