হৃদয়_জুড়ে_তার_ছায়া #পর্বঃ৭ #আদওয়া_ইবশার

0
100

#হৃদয়_জুড়ে_তার_ছায়া
#পর্বঃ৭
#আদওয়া_ইবশার

দেখতে দেখতে দিন পেরিয়ে মাস কেটেছে। জরাজীর্ণ পৃথিবীর বুকে আগমন ঘটেছে ঋতুরাজ বসন্তের। চারিদিকের মাতাল হাওয়া ফিসফিসিয়ে জানন দিচ্ছে প্রকৃতি নতুন যৌবন ফিরে পেয়েছে। সাজিয়ে নিয়েছে নিজেকে বাহারি রঙের পুষ্পপল্লবে। কোনো এক কারণ বসত জীবনের পথচলায় মানুষ থমকে গেলেও থমকায় না কখনও সময়। সে তার নিজ গতিতে এগিয়ে যায় বর্তমানকে অতীতে ফেলে ভবিষ্যতের দিকে। প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী মানুষকে ধাবিত করে একটু একটু করে জীবনের অন্তিম মুহূর্তের দিকে। নাহিদের পরীক্ষা শেষ হয়েছে সপ্তাহ খানিক আগেই। চার বন্ধু একসাথেই ঢাকা শহরের মতো ব্যস্ত নগরীকে সাময়িক বিদায় জানিয়ে ফিরে গেছে আপন নীড়ে শেকড়ের টানে। নাজিম, রাফিন আর লাবিবের বাড়ি ঢাকা বিভাগে হওয়াই কয়েক ঘন্টার ব্যবধানেই ফিরে গেছে তারা আপন নীড়ে। দীর্ঘ পথ পারি দিতে হয়েছে শুধু নাহিদকে। প্রায় আট ঘন্টার লম্বা জার্নি শেষে পা দিয়েছে জন্মস্থানে। গায়ে মেখেছে চিরচেনা শহরের ধুলোবালি। প্রাণ ভরে নিঃশ্বাসের সাথে টেনে নিয়েছে নির্মল বাতাস। যে বাতাসে নাহিদ এখনো খোঁজে পায় শৈশবের মিষ্টি গ্রাণ। দুই চোখের দৃষ্টি যতদূর যাচ্ছে শহরের আনাচে কানাচে সব জায়গায় যেন খোঁজে পাচ্ছে ফেলে আসা রঙিন শৈশবের মধুর স্মৃতি। সেই সাথে মনের কোণে উঁকি দিচ্ছে আফসোস মিশ্রীত একটা প্রশ্ন।”কেন বড় হলাম? কেন হারিয়ে ফেললাম জীবন থেকে সুখের চাদরে মোড়ানো স্মৃতিবিজড়িত শৈশবটাকে? জীবনটা যদি সেই শৈশবেই থমকে যেতো তাহলে আজ আর হয়তো মায়ের কোল ছেড়ে সুনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভাবনায় ছুটতে হতনা অচিন শহরে।” কথা গুলো যতই ভাবছে ততই যেন নষ্টালজিক হয়ে পরছে নাহিদ। আপন মনে বিরবির করে যাচ্ছে বুকের ভিতর তোলপাড় সৃষ্টি করা শৈশবের স্মৃতিবজড়িত গানের কিছু লাইন,

এক হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর সাথে
সকাল-বিকেল বেলা
কত পুরোনো-নতুন পরিচিত গান
গাইতাম খুলে গলা
কত এলোমলো পথ হেটেছি দু’জন
হাত ছিলো না তো হাতে
ছিল যে যার জীবনে দু’টো মন
ছিল জড়াজড়ি একসাথে

কত ঝগড়া-বিবাদ, সুখের স্মৃতিতে
ভরে আছে শৈশব
তোকে স্মৃতিতে স্মৃতিতে এখনও তো
ভালোবাসছি অসম্ভব

কেন বাড়লে বয়স ছোট্ট বেলার
বন্ধু হারিয়ে যায়
কেন বাড়লে বয়স ছোট্ট বেলার
বন্ধু হারিয়ে যায়
কেন হারাচ্ছে সব, বাড়াচ্ছে ভীড়
হারানোর তালিকায়

আপন ভাবনায় বিভোর হয়ে বেখেয়ালে হেঁটে যাওয়ার সময় হঠাৎ নাহিদের কানে ভেসে এলো চিরচেনা একটা কন্ঠের চিৎকার,

‘ভাইয়া!’

চেনা কন্ঠের ডাক শুনে এলোমেলো ভাবনা গুলোকে একপাশে রেখে দৃষ্টি ঘুরিয়ে তাকায় নাহিদ। দেখতে পেল হাতে ব্যাট-বল নিয়ে ছোট ভাই নাফিস বাড়ির রাস্তার দিক থেকে এগিয়ে আসছে। বন্ধুদের সাথে আজকে একটা চূড়ান্ত ম্যাচ খেলার কথা ছিল নাফিসের। কিন্তু রাস্তায় বের হতেই এতোদিন পর প্রাণপ্রিয় বড় ভাইকে আসতে দেখে খেলার কথা যেন বেমালুম ভুলে গেল ছেলেটা। ঠোঁটের কোণে চমৎকার হাসি টেনে ছুটে এলো ভাইয়ের কাছে। ছোট ভাইটাকে এতোদিন পর দেখে নাহিদের ঠোঁটের কোণেও খেলে গেল মুচকি হাসি। হাতের ব্যাট-বল রাস্তায় ফেলেই এক প্রকার হামলে পরল ভাইয়ের বুকে নাফিস। ছোট ভাই-বোন দুটোর সাথে সেই ছোট বেলা থেকেই নাহিদের গলায় গলায় ভাব। ভাই-বোন দুটো যেন তার দুই চোখের মণি। প্রতিটা পরিবারেই সন্তানদের শাসন করার পাশাপাশি আদর করে কাছে টেনে নেওয়ার জন্যও একজন অভিভাবক থাকতে হয়। নাহিদের পরিবারে বাবা-মা ভাই-বোন গুলোকে শাসনের দায়িত্ব নিলেও নাহিদ নিয়েছে আদর দিয়ে আগলে রাখার দায়িত্ব টুকু। নাফিস, নাদিয়ার যত আবদার, ভালোবাসা, খুনশুটি সব কিছুর উৎসই যেন বড় ভাই। ছোট বেলা থেকেই তারা বাবা-মায়ের থেকে শাসনমিশ্রীত বকা খেয়ে বড় ভাইয়ের ছায়াতলে এসে অভিমানটুকু দূরে ছুড়ে মেতে উঠতো আনন্দের লহরে। খুলে দিতো অভিযোগ- অনুযোগ, আবদারের ঝুলি। নাহিদ’ও নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করতো ভাই-বোন দুটোর আবদার রাখতে। সেই আদর-ভালোবাসার উৎস ভাইটাকে এতোদিন পর কাছে পেয়ে একদম ছোট বাচ্চাদের মতো হয়ে ওঠে নাফিস। ভেবে পায়না মনের আনন্দ অনুভূতি গুলোকে ঠিক কিভাবে প্রকাশ করবে। উৎফুল্ল চিত্তে ভাইকে ছেড়ে কিছুটা দূরে গিয়ে প্রশ্ন করে,

‘তুমি আজকে আসব আগে বলনি কেন? সকালেও কথা বলেছো। তখনও তো বলতে পারতে না কি?’

ভাইয়ের অভিযোগে হেসে ওঠে নাহিদ। দু-হাত দিয়ে নাফিসের ঝাকড়া চুল গুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলে,

‘বলে আসলে কি আর এতো বড় সারপ্রাইজ পেতি গাধা!’

চো-মুখ কুঁচকে ফেলে নাফিস। নাক ফুলিয়ে বলে,

‘এমন সারপ্রাইজের থেকে বলে আসলেই তো বেশি ভালো হতো। তুমি আসার খবর পেয়ে মা সারাদিন রান্নাঘরে পরে থাকতো। আমাকেও আর স্কুলে না যাওয়ার জন্য বকা শুনতে হতনা। ইদানিং মা একটু বেশি বেশি করছে জানো? একটু দেরিতে ঘুম থেকে ওঠলেই ঘুমের মাঝেই ধুপধাপ লাগিয়ে দেয় চড়-থাপ্পর। স্কুলে যাবনা একবার মুখ দিয়ে উচ্চারণ করলেই হলো। সারা বাড়ি মাথায় তুলে ফেলবে বকতে বকতে। এইযে এখন খেলতে বেরিয়েছি চোরের মতো লুকিয়ে নিজের বাড়ি থেকে বের হতে হয়েছে। যেভাবে বেরিয়েছি কেউ দেখলে নির্ঘাত চোর ভেবে দুই-তিনটা লাগিয়ে দিতো। এতো অত্যাচার মানা যায় বলো? আমি তো মাঝে মাঝে ভাবি স্কুলের বাচ্চা গুলো না জানি মা’কে কতটা ডায়নি ভাবে। নিজের ছেলে-মেয়ের সাথেই যে মানুষ সবসময় এমন খ্যাঁকখ্যাঁক করতে থাকে সে না জানি স্টুডেন্টেদের সাথে কেমন করে! নির্ঘাত সবসময় রিনা খানের মতো আচরণ করে। খোঁজ নিয়ে দেখো বাচ্চা গুলো হয়তো তোমার মা জননীকে ‘রিনা খান’ নিকনেম ও দিয়ে দিয়েছে।’

ভাইয়ের সব গুলো অভিযোগ নিরব হয়ে শুনে নাহিদ। নাফিসের কথা শেষ হতেই ভ্রু কুঁচকে বলে,

‘বুঝলাম আমার মা রিনা খান হয়ে গেছে। সে খুবই অত্যাচার করে তার ছোট পুত্রধনকে।কিন্তু ছোট সাহেব কি এটা ভুলে গেছে তার যে সামনে মাধ্যমিক পরীক্ষা? মা তার ভালোর জন্য বকে না কি খারাপের জন্য বকে এটা কি একবার ভেবে দেখেছে সে? পড়াশোনা বাদ দিয়ে সবসময় শুধু খেলা নিয়ে পরে থাকলে রেজাল্ট যে বড়সড় একটা ঘোড়ার ডিম আসবে সেটা বুঝতে পারিস না?’

‘তাই বলে কি সবসময় খেলা রেখে বইয়ের মাঝে মুখ ডুবিয়ে পরে থাকব? পড়াশোনার পাশাপাশি যে খেলাধুলাও করতে হয় মাইন্ড ফ্রেশের জন্য সেটা কি তোমার শিক্ষিকা মা জানে না?’

এবার নাহিদ একটু চোখ গরম করে তাকায় ভাইয়ের দিকে। পিঠে হালকা চাপড় দিয়ে বলে,

‘পড়াশোনা, খেলাধুলা দুটো ব্যালেন্স রেখে করলে মা তোকে বকতে যাবে কখনো? চরকির মতো সারাদিন ঘুরলে,খেললে তো বকবেই। সব কিছুই একটা নির্ধারিত সময়-নিয়ম মেনে করতে হয়। খেলাধুলা যেমন মাইন্ড ফ্রেস করে শরীর ভালো রাখে তেমন অত্যাধিক খেলাধুলা ক্ষতিও করে। আর আমার শিক্ষিকা মা মানে কি হ্যাঁ? মা কি আমার একার? আদর দিয়ে দিয়ে বাঁদর করে ফেলছি না তোকে! দিন দিন বেয়াদবির মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছিস কিন্তুু।’

নিজের বিরুদ্ধে গিয়ে মায়ের পক্ষ নিয়ে কথা বলায় ভাইয়ের প্রতি কিছুটা রুষ্ট হলো নাফিস। তাড়া দিয়ে বলল,

‘হয়েছে! আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে জ্ঞান দিতে হবেনা। বাসায় চলো।’

অলস বিকেল। সাইদুর রহমান, শাহিনূর দুজনেই অনেক আগেই নিজ নিজ কর্মস্থল থেকে ফিরে এসেছে। দুই কাপ চা নিয়ে স্বামী- স্ত্রী দুজনে ড্রয়িং রুমে বসে পারিবারিক খুটিনাটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করছেন। সংসার, সন্তানের কথা ভেবেই নিজেদের সখ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে জীবনের অর্ধেক সময় কাটিয়ে দিয়েছেন দুজন মানুষ কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে। তবুও যেন মানুষ দুটোর শরীরে এখনো ক্লান্তিরা এসে ভর করতে পারেনি। অবিশ্রান্ত ভাবে ভেবে যাচ্ছে এখনো সন্তানদের সুন্দর ভবিষ্যতের কথা। বাবা-মা মানুষ গুলো মনে হয় এমনই হয়। মৃত্যুর আগ পযর্ন্ত তারা নিজেদের কথা বাদ দিয়ে সন্তানের ভালোটাই চিন্তা করে যায়। কখনও ক্লান্তিরা এসে ভর করতে পারেনা তাদের শরীরে। শাহিনূর কথার ফাঁকে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সদর দরজার দিকে তাকাতেই দেখতে পেল ছোট ছেলের সাথে হাসি মুখে বাড়ির ভিতর এগিয়ে আসছে বড় ছেলে নাহিদ। সাথে সাথেই ওঠে দাঁড়ালো শাহিনূর। তড়িৎ বেগে দরজার কাছে ছুটে গিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরেন ছেলেকে। ব্যস্ত হয়ে পরে মায়ের তৃষ্ণার্ত মনটা ছেলেকে বুকে নিয়ে তৃষ্ণা মিটাতে। নাহিদ’ও ছোট বাচ্চাদের মতোই মিশে থাকে মায়ের সাথে। অর্ধাঙ্গীনির পেছন পেছন এগিয়ে আসেন সাইদুর রহমান। নাফিসের হৈহুল্লোর শুনে একমাত্র বোন নাদিয়াও বেরিয়ে আসে রুম থেকে। চোখের সামনে বড় ভাইকে এতোদিন পর দেখতে পেয়ে মেতে ওঠে উৎফুল্লতায়। কয়েক মুহূর্তের মাঝেই যেন সাইদুর রহমানের বাড়িটাতে আনন্দ উৎসব ছড়িয়ে পরে। মায়ের বুকের সাথে মিশে থেকেই কিছু সময় অতিবাহিত করে নাহিদ বলে,

‘অনেক দূর থেকে এসেছি মা। ধুলাবালিতে শরীর একদম নাযেহাল হয়ে আছে। একটু ফ্রেস হয়ে আসি আগে? তারপর না হয় যতক্ষণ ইচ্ছে জড়িয়ে ধরে বসে থেকো।’

ছেলের কথায় যেন হুস ফিরে পেলেন শাহিনূর। নাহিদকে ছেড়ে পাশে দাঁড়িয়ে চোখে আনন্দ অশ্রু নিয়ে ছেলের মুখের দিকে তাকালেন। হাত বাড়িয়ে নাহিদের গালে স্পর্শ করে বললেন,

‘শুকিয়ে কি অবস্থা করেছিস শরীরের? খাস নি না কি? তোর থেকে তো আমার নাফিসকেই শরীর স্বাস্থ্যের দিক থেকে কেউ দেখলে বলবে সে বড়। যা তাড়াতাড়ি ফ্রেস হয়ে আয়। আমি খাবার দিচ্ছি। খেয়ে তারপর বিশ্রাম নিবি।’

মায়ের এমন কথায় নাহিদ হতাশ হয়। অভিযোগের স্বরে বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,

‘দেখো তো বাবা কোন দিক থেকে মনে হচ্ছে শুকিয়ে গেছি আমি? আগের থেকে ওজন কতটা বেড়েছে জানো তোমরা? এভাবে ওজন বাড়তে থাকলে আর কয়েক মাসের মাঝেই পেট মোটা দারগা হয়ে যাব। দুনিয়ার সব মায়েদের মনে হয় এটা একটা কমন রোগ। সন্তান যতই স্বাস্থ্যবান হোক তবুও তাদের চোখে মনে হবে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। এটা কেমন ধারণা মায়েদের?’

অল্প হাসলেন সাইদুর রহমান। ছেলের কাধে হাত রেখে বললেন,

‘ঐসব মহিলা মানুষের কথায় কান দিস না তো। এরা সবসময় দু-লাইন বেশি বুঝে। যা, আগে ফ্রেস হয়ে কিছু খেয়ে রেস্ট নে। রাতে যা কথা হবার হবে।’

স্বামীর প্রথম কথায় কিছুটা রুষ্ট হলেন শাহিনূর। চোখ গরম করে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘এই দুই লাইন বেশি বোঝা মেয়ে মানুষ যদি দুনিয়ায় না থাকতো তাহলে তোমাদের পুরুষদের কি হাল হতো একবার ভেবে দেখেছো? সবসময় মেয়েদের দোষ না দিয়ে তোমরা পুরুষ জাতি যে অকৃতজ্ঞ সেটা স্বীকার করে নিলেই হয়।’

নাহিদ, নাফস নাদিয়া তিনজন ছোট বেলা থেকেই দেখে এসেছে মাঝে মাঝে বাবা-মায়ের মাঝে এমন মিষ্টি ঝগড়ার সূচনা হয়। তবে তার স্থায়ীত্ব বেশিক্ষন থাকেনা। বাবা ঠিকই মা’কে কথার ছলে মানিয়ে নেয়। হঠাৎ হঠাৎ তাদের মাঝে এমন ছোট ছোট বিষয়ে ঝগড়াটা হয় দেখেই হয়তো তারা একে অপরের প্রতি ভালোবাসার গভীরতাটুকু বুঝতে পারে। যে ভালোবাসার জোরেই একে অপরের সাথে কাটিয়ে দিয়েছে ত্রিশটা বছর। বাবা-মায়ের এমন ঝগড়ায় আর দাঁড়ায় নি তারা ভাই-বোন। চুপচাপ তাদের একান্তে মান-অভিমানের পালা শেষ করতে দিয়ে চলে যায় যে যার রুমে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here