#হৃদয়_জুড়ে_তার_ছায়া
#পর্বঃ৯
#আদওয়া_ইবশার
পৃথিবীতে কাকতলীয় ভাবে অনেক ঘটনায় ঘটে। প্রায় সময় আমাদের অবাক করে দিয়ে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যায় যা একেবারেই অপ্রত্যাশিত। কোনোদিন কল্পনাও করিনি আমরা যে আমাদের জীবনে এমন কাকতলীয় কিছু ঘটতে পারে।
গত কয়েক মাস আগেই যে ছেলেটার সাথে ভুলবসত নিজের একাউন্ট এ টাকা চলে আসায় পাপড়ি বিচ্ছিরি একটা ঘটনা ঘটিয়েছিল। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে সেই ছেলেটার দুর্ঘটনার খবর পেয়েই নিজের আপন মানুষ ভেবে ছুটে আসতে হলো হাসপাতালে। ছেলেটার সাথে যে জীবনের কোনো একটা সময় পাপড়ির সরাসরি দেখা হতে পারে এটাও কল্পনা করেনি কখনো। এক প্রকার তো ভুলেই গিয়েছিল ঐ ঘটনার কথা। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে দেখা হয়েই গেল কয়েক মাসের ব্যবধানে। তাও আবার এমন একটা পরিস্থিতিতে এসে। যে পরিস্থিতিতে পরিবার পরিজন ছেড়ে ছেলেটা হাসপাতালের বেডে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে। কাকতলীয় কত ঘটনার কথায় শুনেছে পাপড়ি। কিন্তু এভাবে যে নিজের জীবনেই এমন একটা মানুষকে জড়িয়ে কো- এন্সিডেন্স ঘটতে পারে এমনটা তো পাপড়ি স্বপ্নেও ভাবেনি। সেই ভাবনাতীত ঘটনার সম্মুখিন হয়ে খেয় হারিয়ে ফেলে পাপড়ি। বোধ বুদ্ধি যেন সব লুপ পেয়েছে তার। শুধু ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে আছে “বেয়াক্কেল” নামে সেইভ করা ছেলেটার ফোনে নিজের নাম্বারের দিকে। ছেলেটার পরিবারের খোঁজ নিতে যে ফোনটা হাতে নিয়েছিল সে সেই কথাও যেন বেমালুম ভুলে বসেছে। মেয়ের এমন হতবুদ্ধি অবস্থা দেখে ভ্রুদ্বয় কুঁচকে ফেলেন রওশন আরা। কঠোর স্বরে ধমকে উঠেন মেয়েকে,
“হ্যাঁ রে, তোর কি জীবনেও আক্কেল জ্ঞান হবেনা? এমন একটা বিপদের মুহূর্তে এসেও তোর কান্ড দেখে আমার কিন্তু মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে। সেই কখন বলেছি ছেলেটার বাড়ির নাম্বার খোঁজে ফোন করার জন্য আর তুই তা না করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফোনের রূপ দেখছিস! দেখি ফোন দে আমার হাতে। তোর আর কিছুই করতে হবেনা। যা করার আমিই করব। দিন দিন মানুষের বুদ্ধি বাড়ে। আর তার বুদ্ধি হাটুর নিচে নামে। নিজের জীবন তেজপাতা করে খাইয়ে পড়িয়ে দুইটা গাধী বড় করছি।”
কথার সমাপ্তি ঘটিয়ে এক টানে মেয়ের হাত থেকে ফোনটা ছিনিয়ে নিলেন রওশন আরা। একে তো এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনার সম্মুখিন হয়ে সেই ঘটনায় এখনো হজম করতে পারছেনা পাপড়ি। তার ওপর মায়ের থেকে এতো গুলো কথা শুনে নিজেকে একেবারে পাগল মনে হচ্ছে তার। ইচ্ছে করছে হাসপাতালেই মেঝেতে হত-পা ছড়িয়ে কতক্ষণ কেঁদে-কুটে নিজেকে শান্ত করতে। অসহায় চোখে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ফুস করে একটা দম ছাড়ল পাপড়ি। ততক্ষণে রওশন আরা কারো নাম্বারে কল ডুকিয়ে কানের কাছে ঠেকিয়ে নিলেন ছোট্ট বাটন ফোনটা। একবার রিং হতেই অপর পাশ থেকে ফোনটা রিসিভ হয়ে যায়। ভেসে আসে উত্তেজিত কন্ঠস্বর,
” হ্যালো, নাহিদ বাবা তুই ঠিক আছিস তো! একজন ফোন করে বলল তোর না কি এক্সিডেন্ট হয়েছে গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে আছিস। খুব বড় কোনো ক্ষতি হয়নি তো বাবা তোর? আমরা আসছি তুই একদম চিন্তা করিস না। তোর মা তোর এমন খবর পেয়ে বারবার জ্ঞান হারাচ্ছে। বল তো কি একটা বিচ্ছিরি কান্ড! লোকটা যেভাবে ফোনে বলল ভেবেছিলাম তোর না জানি কি অবস্থা! মনে হচ্ছিলো পুরো দুনিয়াটাই ঘুরে গেছে আমার। এখন তোর থেকে ফোন পেয়ে যে কতটা শান্তি লাগছে বলে বুঝাতে পারবনা।”
সন্তানের চিন্তায় ব্যকুল বাবার প্রাণটা নিজের ছেলের নাম্বার থেকে ফোন পেয়ে যেন তপ্ত মরুর বুকে এক বিন্দু জলের সন্ধান পেয়েছে। ভেবেছে ফোনটা ছেলেই করেছে। ছেলে ভালো আছে। বড় কোনো ক্ষতি হয়নি এমন চিন্তা করে কত কি বলে যাচ্ছে! ছেলের শোকে কঠোর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন বাবা চরিত্রের হৃদয়টাই যদি এমন উতলা হয়ে থাকে তাহলে না জানি কোমল হৃদয়ের মমতাময়ী মায়ের কেমন করুণ দশা হয়েছে! কথাটা ভেবেই হাহাকার করে ওঠে রওশন আরার মাতৃ হৃদয়টা। সন্তানের বিপদের কথা শুনে মায়ের মনটা যে কেমন মৃত্যুসম যন্ত্রণা নিয়ে ছটফট করে সেটা এক মা ছাড়া অন্য কেউ উপলব্ধি করতে পারেনা। ছলছল নয়নে ইমার্জেন্সিতে রক্তাত্ব অবস্থায় পরে থাকা নাহিদের দিকে এক নজর তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিল রওশন আরা। ঢোক গিলে শুকনো গলাটা ভিজিয়ে বলল,
” ভাই সাহেব! আপনার ছেলের ফোনটা আমার কাছে। আপনার ছেলের অবস্থা খুব বেশি খারাপও না আবার ভালোও না। হাতে-পায়ে একটু আঘাত পেয়েছে। ডাক্তার দেখছে এখনো। আমি আপনাদের খবর দিতেই ফোন করেছিলাম।”
মুহূর্তের মাঝেই যেন সাইদুর রহমানের আশার প্রদিপটা ধপ করে নিভে গেল। নোনাজল এসে ভর করল কঠোর চোখ দুটোতে। কোনোমতে কান্নাটাকে গিলে নিয়ে ভাঙা কন্ঠে আর্জি জানাল,
“আপা, দয়া করে আমরা আসার আগ পযর্ন্ত আমার ছেলেটাকে একটু দেখে রাখুন। বিনিময়ে আমি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব আপনার প্রতি। রাজশাহী থেকে ঢাকার দূরত্বটা তো কম না। ইচ্ছে করছে উড়াল দিয়ে চলে আসি। কিন্তু মানুষ হয়ে উড়ে আসা তো আর সম্ভব না। তবুও চেষ্টা করছি যত দ্রুত সম্ভব চলে আসার। আর টাকা-পয়সার কথা একদম ভাববেন না। একটু খেয়াল রাখবেন টাকার জন্য আমার ছেলের চিকিৎসায় যেন কমতি না থাকে। আমি এসেই হাসপাতালের সব বিল পরিশোধ করে দিব।”
আশ্বাস দিল রওশন আরা। বলল,
” আমি বুঝতে পারছি ভাই সাহেব। আপনারা ধীরে সুস্থ্যে আসুন। আমার পক্ষে যতটুকু সম্ভব আমি এদিকটা সামাল দিতে চেষ্টা করব। টেনশন করবেন না। আপনারা আসার আগ পযর্ন্ত আমি আপনার ছেলেকে নিজের সন্তানের মতোই দেখে রাখব।”
রোগীর পরিবারের লোক হিসেবে রওশন আরার উপস্থিতিতেই নাহিদের চিকিৎসা শুরু হয়। অফিস থেকে আসার পথেই বাস দুর্ঘটনায় নাহিদ সহ বাসের সকল যাত্রীই কম বেশি আহত হয়। ঘটনা স্থলেই মারা যায় একজন। উপস্থিত জনগণ যে যেভাবে পেরেছে আহত যাত্রীদের কাছের হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। পরবর্তীতে ব্যপারটা জানাজানি হলে পুলিশ ফোর্স হাসপাতালে এসে উপস্থিত হয়। ঘন্টা কয়েক এর ব্যবধানে তিন বন্ধু রাফিন, নাজিম, লাবিব ও চলে আসে হাসপাতালে প্রাণ প্রিয় বন্ধুর এক্সিডেন্টের খবর পেয়ে। থানা পুলিশ সামলে নেয় তারা তিন বন্ধু মিলেই। ডাক্তার জানায় মাথার ডান পাশে বড় ধরনের আঘাত পেয়েছে নাহিদ। সেই আঘাতেই জ্ঞান হারিয়েছে। সাথে বাম হাতের হাড় ভেঙেছে বাজে ভাবে। এছাড়াও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছোট-বড় অনেক আঘাতেই পেয়েছে। তবে মাথা আর হাতের আঘাতটাই বেশি জখম করেছে তাকে। ভাগ্য ক্রমে বড় কোনো ক্ষতি না হলেও সুস্থ্য হতে সময় লাগবে অনেক। খবরটা পেয়ে যেন সকলের মন থেকেই একটু হলেও ভয়টা দূর হয়। সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায় বড় কোনো ক্ষতি হয় নি তার এতেই তিন বন্ধু সহ রওশন আরা মনে মনে হাজারবার শুকরিয়া আদায় করেন সৃষ্টিকর্তার কাছে। সাইদুর রহমান শাহিনূর এখনো হাসপাতালে এসে পৌঁছাতে না পারলেও পাঁচ মিনিট অন্তর ফোন করে খোঁজ নিচ্ছেন ছেলের। জানিয়েছেন চলে এসেছে কাছাকাছি। হয়তো খুব তাড়াতাড়ি হাসপাতালে এসে উপস্থিত হতে পারবে। এতো কিছুর মাঝে নিরব দর্শকের মতোই সব কিছু শুধু দেখে যাচ্ছে পাপড়ি পালক। মায়ের থেকে তখন ধমক খেয়ে এখন পযর্ন্ত মুখ দিয়ে একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারেনি পাপড়ি। তবে মনে মনে ঠিকই সৃষ্টিকর্তার দরবারে নাহিদের সুস্থ্যতার জন্য নিরবে প্রার্থনা করে যাচ্ছে। যত যায় হোক, তারও তো মন আছে। একটা মানুষ হয়ে অপর একটা মানুষের এমন বিপদ দেখে যে কারো মায়া হবে। কোনো শত্রুও হয়তো চায়না অপর কোনো শত্রুর সরক দুর্ঘটনার স্বীকার হয়ে নির্মম ভাবে মৃত্যু হোক। সেখানে নাহিদ তো পাপড়ির কোনো শত্রুও না। শুধুমাত্র ফোনের মাঝেই ছোট্ট একটা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছিল তাদের মাঝে। সেটাও হত না যদি পাপড়ি নাহিদের পুরো কথা শুনে রিয়েক্ট করতো। আর নাহিদ যদি টাকা দিয়ে পাপড়ির প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার না করত।
হাসপাতালের চার দেয়ালের ভিতর থেকে কেউ বুঝতে পারছেনা বাহিরে সন্ধ্যা না কি রাত নেমে এসেছে। কারো অসুস্থতা আবার কারো মৃত্যুতে আপন মানুষের আর্তনাদে ভারী হয়ে আছে হাসপাতালের প্রতিটা দেয়াল। আবার কারো কারো মুখে লেগে আছে নতুন অতিথির আগমতে প্রাপ্তির হাসি। হাসপাতাল নামক একটা জায়গাতেই হাজারটা মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মনের মাঝে ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতি নিয়ে। ফিনাইলের গন্ধে মাথা ধরে গেছে পাপড়ির। এর মাঝে কতক্ষণ পর পর আবার চিৎকার চেচামেচি। সব মিলিয়ে মাথার যন্ত্রণায় মুখ ভরে বমি চলে আসছে তার। মেয়ের অবস্থা দেখে রওশন আরা কাছে এগিয়ে এলেন। কাধে হাত রেখে বললেন,
” বেশি খারাপ লাগছে? এক কাজ কর, পালককে নিয়ে তুই বাসাই চলে যা।”
ঘন্টা খানেক আগেই নাহিদকে একটা কেবিনে এনে রাখা হয়েছে। এখনো জ্ঞান ফিরে নি তার। কেবিনের দরজার সামনেই সরু জায়গাটাতে কয়েকটা চেয়ার পাতানো। সেখানেই রওশন আরা, পাপড়ি, পালক তিন বন্ধু লাবিব, রাফিন, নাজিম সকলেই বসে নাহিদের জ্ঞান ফেরার অপেক্ষায়। বদ্ধ রুমটার দিকে এক নজর তাকিয়ে মায়ের দিকে দৃষ্টি ফেরালো পাপড়ি। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,
“তোমাকে এখানে একা রেখে চলে যাব? তার থেকে বরং ওনার জ্ঞান ফিরলে একবার দেখে তোমাকে নিয়েই যায়!”
তিন বন্ধুই পাপড়িদের দিকে তাকালো। নাজিম ওঠে এসে কৃতজ্ঞতা স্বরুপ রওশন আরাকে বলল,
“আপনারা অনেক উপকার করেছেন আন্টি। এ যুগে এসে এমন নিঃস্বার্থ ভাবে অচেনা কারো বিপদে পাশে দাঁড়াতে সবাই পারে না। আমরা সবাই আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব আপনাদের প্রতি। এতো উপকারের প্রতিদান হয়তো কখনো দেওয়া’ও সম্ভব হবেনা আমাদের পক্ষে। সেই দুপুর থেকে নাওয়া- খাওয়া ছেড়ে এখানে পরে আছেন আপনারা। অনুমতি দিলে আমি আপনাদের বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি! নাহিদের আপডেট না হয় ফোন করে জানিয়ে দিব আপনাদের। আবার না হয় কালকে এক সময় ইচ্ছে হলে নাহিদকে এসে দেখে যাবেন! আপনাকে দেখেও অনেক ক্লান্ত মনে হচ্ছে। এবার একটু বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন আপনার।”
মুচকি হাসলেন রওশন আরা। নাজিমের নম্র ব্যবহারে মুগ্ধ হলেন তিনি। সন্তুষ্ট চিত্তে বললেন,
“এতোক্ষন যখন থেকেছি আর একটা না হয় থাকি বাবা। ছেলেটার বাবা-মা আসুক। তারও জ্ঞান ফিরুক। এরপরই না হয় যায়!”
“আচ্ছা আপনার যেমনটা ভালো মনে হয়।”
সামান্য হেসে কথাটা বলে পিছন ঘুরে তাকাতেই দেখতে পেল সাইদুর রহমান, শারমিন পাগলের মতো ছুটে আসছেন এদিকে। পিছনে নাফিস নাদিয়াও আছে। কিছুটা উত্তেজিত কন্ঠ নাজিমের। পূণরায় রওশন আরার দিকে ফিরে বলে ওঠেন,
” ঐ তো নাহিদের বাবা-মা চলে এসেছে।”
একে একে সকলের দৃষ্টি গিয়ে স্থির হয় হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসা মানুষ গুলোর দিকে। লাবিব, নাজিম, রাফিন তিজনই এগিয়ে যায়। ছেলের তিন বন্ধুকে দেখেই শাহিনূর পাগলের মতো বারবার বলতে শুরু করে,
“আমার নাহিদ কোথায় বাবা? ঠিক আছে তো আমার ছেলেটা! কিছু হয়নি তো ওর! আমাকে তাড়াতাড়ি নিয়ে চলো ওর কাছে তোমরা।আল্লাহ আমার ছেলেটার এতো বড় বিপদ কেন দিল? কয়েক দিন আগেই সুস্থ্য- সবল ছেলেটা আমার খুশি মনে বাড়ি থেকে এলো। আর আজকে আমি এই কি খবর শুনলাম!”
সন্তান হারানোর শোকে এক প্রকার পাগল মা’কে ঠিক কি বলে শান্তনা দেওয়া যায় জানা নেই তিন বন্ধুর কারো। প্রাণপ্রিয় বন্ধুর এমন হাল শুনে তাদের’ও কষ্ট হয়েছে। বন্ধুর জন্য মন কেঁদেছে ঠিকই তাদের। কিন্তু মায়ের মতো হয়তো এতোটা কষ্ট মনে লাগেনি। শাহিনূরের মনের অবস্থাটা কেমন সেটাও হয়তো তারা ঠিক ভাবে উপলব্ধি করতে পারছে না। তবুও তিনজই শাহিনূরকে শান্ত করার অল্প প্রয়াস চালালো। জানালো ভালো আছে এখন নাহিদ। সৃষ্টিকর্তার দয়ায় তেমন কোনো বিপদ হয়নি ওনার ছেলের। তবুও যেন শান্ত হলনা মায়ের মন। ছেলেকে এক নজর দেখার জন্য ভিষণ ভাবে উদগ্রীব হয়ে আছে। মায়ের সাথে উদগ্রীব হয়ে আছে বাবা, ভাই-বোন সকলেই। ডাক্তারের কাছে অনুমতি চাইতে গেলে এক নজর দেখার জন্য অনুমতি দেওয়া হয়। তবে সাবধান করে দেওয়া হয় নাহিদের সামনে যেন কোনো আওয়াজ না করে। এমনিতেই মাথায় একটা চোট খেয়েছে। বড় কোনো ক্ষতি হবেনা এমন আশ্বাস দিলেও জ্ঞান ফিরার আগ পযর্ন্ত শিওর হয়ে কিছুই বলা যাচ্ছেনা। কারণ কার ভাগ্য কখন কোন দিকে মোড় নেয় কেউ বলতে পারেনা। ডাক্তারের কথা মেনে নিয়েই শুনশান নিরব কেবিনটাতে প্রথমেই প্রবেশ করে শাহিনূর। ছেলের নিথর দেহটা সাদা বেডের সাথে মিশে থাকতে দেখে মুখে আঁচল চেপে ডুকরে ওঠেন শাহিনূর। আদরের রাজপুত্রের এমন করুণ অবস্থা দেখে ছুটে গিয়ে যে বুকের সাথে একটু জড়িয়ে নিবে এমন উপায়টাও নেই। ভিতরে থাকা দুজন নার্স বারবার করে বলছে কাছে না যেতে। জীবাণু ছড়িয়ে ইনফেকশন হতে পারে। দূর থেকেই চোখ ভরে ছেলের নিথর দেহটা দেখে নিঃশব্দে বেরিয়ে যান কেবিন থেকে। দরজার সামনেই হাঁটু মুড়িয়ে বসে পরেন শরীর ছেড়ে। লুটিয়ে পরেন কান্নায়। রওশন আরা এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরেন ভঙ্গুর মা’কে। পিঠে হাত রেখে শান্তনার বাণী শোনায় হাজারটা। এর মাঝে সাইদুর রহমান, নাফিস-নাদিয়া সবাই একে একে গিয়ে দেখে আসে নাহিদকে। কিছুটা সময় নিয়ে শান্ত হয় শাহিনূর। কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকায় রওশন আরার দিকে। একটা হাত নিজের হাতের মাঝে নিয়ে বলে,
” আপনার ঋণ আমি কোনোদিন সুধ করতে পারবনা আপা। আমার ছেলেটার কেউ নেই এই ঢাকা শহরে। দু-চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে ছেলেটা আমার রাজশাহী ছেড়ে ঢাকায় এসেছিল পড়াশোনার জন্য। একা একা কখন কি করছে কিভাবে থাকছে এসব নিয়ে খুব চিন্তায় থাকতাম সবসময়। এতোদিন তারা চার বন্ধু একসঙ্গে ছিল তবুও একটু নিশ্চিন্ত ছিলাম। ছেলেটা আমার লেখাপড়া শেষ করে সবে সাফল্য অর্জনে নেমেছিল। ইন্টার্নশীপে চার বন্ধু আলাদা হয়ে যায়। চেনা পরিচিত বলে আর কেউ থাকেনা আমার ছেলেটার পাশে। আমার দুশ্চিন্তাকে সত্যি করে দিয়ে আজকে যে ঘটনা ঘটে গেল আপনি না থাকলে এতোক্ষনে হয়তো আমার ছেলেটার বিনা চিকিৎসায় আরও করুণ দশা হতো। আমি আপনার এই ঋণ কোনো দিন শোধ করতে পারবনা। যতদিন বেঁচে থাকব কৃতজ্ঞ থাকব আপনার প্রতি।”
বারবার সকলের মুখে এমন কৃতজ্ঞতার কথা শুনে একটু অপ্রস্তুত হন রওশন আরা। শাহিনূরের দিকে তাকিয়ে বলেন,
“এসব বলে আমাকে আর ছোট করবেন না আপা। আপনার ছেলের জায়গায় যদি আমার কোনো সন্তান থাকতো তাহলে তো আমাকে এটুকু করতেই হতো। দুপুরে যখন বড় মেয়ের নাম্বারে কল দিয়ে একজন বলে আমাদের পরিবারের কেউ এক্সিডেন্ট করেছে তখন ভেবেছিলাম হয়তো আমার ছোট মেয়েটার কোনো দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। ঠিক সেই মুহূর্তে আপনার মতোই অবস্থা হয়েছিল আমার।”
এরপর একে একে সমস্ত কিছুই খুলে বলে রওশন আরা। বাবাকে দেখে আসার পথে বড় মেয়ের নাম্বারে ফোন আসা। ছোট মেয়ের এক্সিডেন্ট হয়েছে ভেবে নেওয়া। বাড়ি গিয়ে মেয়েকে সুস্থ্য দেখেও অন্য কোনো আপনজন এক্সিডেন্ট করেছে কি না ভেবে হাসপাতালে ছুটে আসা। একে একে সব কিছু শুনে উপস্থিত নাহিদের পরিবারের মানুষ গুলোর রওশন আরার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ দ্বিগুণ বেড়ে গেল। কিন্তু এখনো কেউ এটা ধরতে পারলনা নাহিদের নাম্বারে কেন পাপড়ির নাম্বার সেইভ ছিল। কথাটা প্রথম মাথায় আসে রাফিনের। পাপড়ির দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
” নাহিদের সাথে আপনার কিভাবে পরিচয় আপু? আমাদের জানা মতে ঢাকায় আমরা তিন বন্ধু ছাড়া আর কারো সাথেই নাহিদের তেমন কোনো সক্ষতা নেই। অন্তর্মুখী হওয়াই ভার্সিটিতেও আমরা ছাড়া আর কোনো বন্ধু হয়নি তার। সেখানে আপনার নাম্বার ওর ফোনে আসলে বিষয়টা বুঝতে পারছি। এজন্যই আপনাকে প্রশ্নটা করা। অন্য কিছু ভাববেন না প্লিজ।”
চলবে….