#হৃদয়_জুড়ে_তার_ছায়া
#পর্বঃ১০
#আদওয়া_ইবশার
রাফিনের কথায় সকলের উৎসুক দৃষ্টি পাপড়ির দিকে স্থির হয়। যেন চোখ-মুখের অভিব্যক্তিতেই জানান দিচ্ছে রাফিনের প্রশ্নের উত্তর জানতে উদগ্রীব হয়ে আছে তারাও। এতো গুলো মানুষের উৎসুক নজরের সম্মুখিন হয়ে তীব্র অস্বস্তিতে পরে যায় পাপড়ি। অস্বস্তিতে গাট হয়ে চঞ্চল দৃষ্টি জোড়া স্থির করে মেঝের দিকে। কন্ঠে অঘাত জড়তা নিয়ে একে একে বিবৃতি দেয় শুরু থেকে শেষ পযর্ন্ত ঘটে যাওয়া ঘটনার। পুরোটা শুনে অত্যধিক বিস্ময়ে জড়ীভূত হয়ে যায় সকলেই। একের পর এক কাকতলীয় ঘটনার বিবৃতি শুনে বাকহারা হয়ে যায় সকলেই। কিছু সময় অতিবাহিত করে কন্ঠে অপরিসীম বিস্ময় নিয়ে লাবিব মুখ খুলে,
” কো- ইন্সিডেন্স বুঝি একেই বলে? ভাগ্যের কি খেল রে বাবা! কয়েক মাসের মাঝেই নাহিদের পর পর দুটো বিপদেই সম্পূর্ণ অপরিচিত হয়ে একজন মানুষেই এতো বড় উপকার করল। যার সাথে কি না কখনো সরাসরি দেখাও হয় নি।”
পর পর নাজিম বলে ওঠে,
“তুই ভাবছিস এই কথা আর আমি ভাবছি অন্য কথা। যে ছেলে হাতে গুণা খুব কাছের কয়েকজন মানুষ ছাড়া নিজের ফোনে কারো নাম্বার ও সেইভ রাখেনা। সেই ছেলে কোন চিন্তায় এমন একদম অপরিচিত একজন মানুষের থেকে একদিন সাহায্য পেয়েই নাম্বার সেইভ করে রাখল? এই বুদ্ধি কিভাবে এসেছিল তার মাথায়?”
“এটাই হয়তো সৃষ্টিকর্তার কোনো এক নিরব ইশারা ছিল। কোনো ভাবে হয়তো তার অবচেতন মনে জানান দিয়েছিল এমন একটা পরিস্থিতিতে এসে আবারও সেই অপরিচিতার সাহায্য লাগতে পারে তার জীবনে। আজকে যদি নাহিদের ফোনে আপুটার নাম্বার সেইভ না থাকত তাহলে কি হতো একবার ভেবে দেখেছিস তোরা? যে লোক গুলো তাকে হাসপাতাল পযর্ন্ত এনেছিল তারা কোনো মতে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েই মানবতা দেখিয়ে ফরজ কাজ আদায় করে চলে গেছে। এর ভিতর যদি নাহিদের ফোনে লোকটা আমাদের নাম্বারের পাশাপাশি ওনার নাম্বার না পেতো তাহলে কি ওনারা আসতো? না সময় মতো আসতে পারতাম আমরা দূরত্বের জন্য। আর না ঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা হতো। তখন নাহিদের অবস্থা আরও কত বাজে হতে পারতো ভেবে দেখেছিস? আমার তো ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে।”
রাফিন কথার সমাপ্তি টানতেই শাহিনূর পাপড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। এভাবে নিজের সামনে নাহিদের মা’কে দেখে ঘাবড়ে যায় পাপড়ি। ভাবে মহিলা আবার তাকে অবিশ্বাস করল কি না। মনে করল কি না তার ছেলের সাথে অন্য কোনো সম্পর্ক আছে পাপড়ির। মুখের আদলে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট পাপড়ির। শাহিনূর হয়তো বুঝতে পারলেন পাপড়ির মনের শঙ্কিত অবস্থা। দু-হাতের আঁজলায় পাপড়ির ভিতীগ্রস্থ মুখটা তুলে বললেন,
“তোমাকে হয়তো সৃষ্টিকর্তা আমার ছেলের জীবনে শুভার্থিনী হিসেবেই পাঠিয়েছিল মা। যার কারণে একদম অপরিচিতা হয়েও বারবার আমার ছেলের বিপদে তুমিই আমাদের আগে পাশে দাঁড়িয়েছো। এভাবে যে এক মায়ের সন্তানের জীবন বাচিয়ে মা’কে অনেক বড় ঋণী করে দিলে তুমি। তোমার এই ঋণ আমি কিভাবে শোধ করব মা? আজীবনের জন্য যে তুমি আমাকে ঋণী বানিয়ে দিলে।”
তৎক্ষণাৎ মনের ভয় দূর হয়ে পূণরায় নিজের থেকেও বয়সে এতো বড় একজন মানুষের মুখে এসব কথা শুনে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পরে গেল পাপড়ি। উৎকন্ঠা নিয়ে বলে ওঠে,
“এভাবে বলবেন না প্লিজ আন্টি। আমি তো কিছুই করিনি। আজকে যা করার সব তো আমার মা’ই করেছে। তাছাড়া মানুষ এর থেকেও কত বড় বড় উপকার করে। কিন্তু কয়জন এমন ভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে! আপনি এভাবে বলে আমাকে আর ছোট করবেন না আন্টি।”
মুচকি হাসলেন শাহিনূর। পাপড়ির কাছ থেকে সরে রওশন আরার মুখোমুখি দাঁড়ালেন। কৃতজ্ঞতা স্বরুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
“এই দুনিয়ায় রক্তের সম্পর্কের থেকেও বড় সম্পর্ক হয় আত্মার। আমি আজকে থেকে আপনাকে সেই আত্মিক সম্পর্কের দিক থেকেই বোনের স্থান দিলাম আপা। কৃতজ্ঞতার কথা বলে আর অস্বস্তিতে ফেলবনা আপনাদের। কিন্তু বোন তো হতে পারেন আমার!”
রওশন আরা নিজেও মুচকি হাসলেন। আনন্দের সাথেই গ্রহণ করলেন শাহিনূর এর আবদার। হাসি মুখেই বললেন,
“আমার বাবার একমাত্র মেয়ে ছিলাম আমি আপা। চার ভাইয়ের মাঝে এই এক আমিই মেয়ে ছিলাম। ভাইদের আমাকে পেয়ে বোনের অভাব পূরণ হলেও আমার হয়নি। আজকে থেকে না হয় আপনাকে বোন হিসেবে পেয়ে সেই অভাবটা পূরণ করব। কিন্তু মাঝ পথে আবার বোনকে ভুলে যাবেন না যেন।”
দুই পরিবারের নতুন একটা সম্পর্কের সূচনায় ক্ষণকালের জন্য সবাই যেন দুঃখটাকে ভুলে গিয়ে এক চিলতে আনন্দকে সাদরে গ্রহণ করে নিল। সবার মুখেই খেলে গেল তৃপ্তির হাসি। জীবনে চলার পথে এমন হাজারটা সম্পর্কের সৃষ্টি হয় যে সম্পর্ক গুলো সত্যিই রক্তের সম্পর্ককেও হার মানায়। রক্তের সম্পর্ক গুলো সময়ের সাথে সাথে মলিন হয়ে গেলেও অনেক ক্ষেত্রে এই আত্মার সম্পর্ক গুলো মলিন হয় না কখনো। বরং সময়ের সাথে সাথে আরো গাঢ় হয় সেই সম্পর্ক গুলোই। দুই পরিবারের মিলন মুহূর্তের মাঝেই নার্স এসে জানায় জ্ঞান ফিরেছে নাহিদের। কথাটা শুনেই তড়িৎ ছেলের কাছে ছুটে যায় শাহিনূর। পেছন পেছন এগিয়ে যায় সকলেই।
চোখ বন্ধ করে চুপচাপ বিছানায় পরে আছে নাহিদ। মুখের আদলে স্পষ্ট বেদনার ছাপ। সারা শরীরের অসহনীয় ব্যথায় চোখ-মুখ কুঁচকে আছে নাহিদের। দূর্বল শরীরটা ব্যথার যন্ত্রণায় চৈতন্যহীন হয়েই যেন লেগে আছে বিছানার সাথে। শাহিনূর নিরবে ছেলের মাথার পাশে একটা টুল টেনে বসেন। সাদা বেন্ডেজে মোড়ানো মাথাটায় মমতাময়ী স্পর্শ এঁকে দিবেন কি দিবেন না সংকোচে আছেন এই ভাবনাতে। পাছে যদি ছেলেটা আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে নতুন করে ব্যথা পায়! ভেবে আর সাহস করে মাথায় হাত দিলেন না। দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা সহ্য করার দরুন শক্ত হয়ে থাকা চোয়ালটাতেই হাতের স্পর্শ এঁকে ডাকলেন ছেলেকে,
“আব্বা!”
মায়ের ভেজা কন্ঠের ডাক শুনে নাহিদের বেদনার্থ হৃদয়টা যেন এক পশলা বৃষ্টির ছোঁয়া পেল। ভারি হয়ে আসা চোখ দুটো খুলে তাকাল মায়ের মুখের দিকে। ব্যথাতুর কন্ঠে ডেকে ওঠল,
“মা!” ছোট্ট একটা ডাক। এতেই যেন এতোক্ষণের অশান্ত মনটা শান্ত হলো শাহিনূরের। টুপটাপ অশ্রু ঝরে পরল দু-চোখের কুল বেয়ে। মায়ের ব্যকূল চিত্ত দেখে শুকনো মুখেই অল্প হাসে নাহিদ। ব্যথাতুর কন্ঠে নিচু স্বরে বলল,
” আমি তো সুস্থ্য আছি মা। তবুও এভাবে কাঁদছো কেন? তোমার কান্না আমার সহ্য হয়না জানো না! প্লিজ কান্না থামাও।”
কথা গুলো বলতেও যেন নাহিদের জান বেরিয়ে আসার উপক্রম এতোটাই কষ্ট হচ্ছে। সেটা দেখে আরও ভেঙ্গে পরেন শাহিনূর। ঘন ঘন কয়েকটা ঢোক গিলে নিজেকে কোনোরকমে শান্ত করে বললেন,
” আমার কথা ভাবিস তুই? ভাবলে কিভাবে এতোবড় একটা দুর্ঘটনা ঘটে? একটু সাবধানে চলাফেরা করলে কি এমন হতো? চোখের সামনে সন্তানের এমন অবস্থা দেখে মায়ের কেমন লাগে সেটা তুই কি বুঝবি?”
পূণরায় ব্যথাতুর কন্ঠে জাবাব দেয় নাহিদ,
“আমার অসাবধানতায় হলে তো আর পুরো বাস দুর্ঘটনার স্বীকার হতো না মা। এখানে তো আমার একার ক্ষতি হয় নি। বরং আমার থেকেও আরও অনেক খারাপ অবস্থা হয়তো হয়েছে অন্যদের। ভাগ্যে যেটুকু ব্যথা পাওয়া লেখা ছিল সেটুকু পেয়েছি। ভাগ্য সহায় হলে আবার খুব দ্রুত সুস্থ্য হয়ে যাব। তুমি আর কেঁদো না প্লিজ।”
একেকটা শব্দ উচ্চারণ করতে নাহিদের ভিষণ কষ্ট হচ্ছে। টান পরছে কাটা জায়গা গুলোতে। বিষয়টা সাইদুর রহমান বুঝতে পারলেন। বুঝিয়ে স্ত্রীকে শান্ত করালেন। কথা বলতে বারণ করলেন নাহিদকে। বাবার কথায় সায় দিয়ে নাহিদ দুই চোখের পাপড়ি ঝাপটায়। চোখ ঘুরিয়ে বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। বন্ধুদের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে রওশন আরা, পাপড়ি পালক। চিনতে পারেনি নাহিদ। বাবার দিকে তাকিয়ে জানতে চায়,
“ওনাদের ঠিক চিনলাম না বাবা!”
সাইদুর রহমান কিছু বলার আগেই মুখ খুলে নাজিম। উচ্চ কন্ঠে বলে ওঠে,
“শালা মিরজাফর! যে মানুষ গুলোর জন্য এখন পযর্ন্ত দুনিয়ার আলো-বাতাস খাইতেছিস তাদেরই চিনতে পারতেছিস না! তোর মতো অকৃতজ্ঞ মানুষ দুইটা আছে দুনিয়ায়?”
কথা শেষ হতেই ধুমধাম পিঠে কিল বসিয়ে দিল লাবিব। চোখ-মুখ কুঁচকে মুখে ব্যথাতুর শব্দ উচ্চারণ করে কিছু বলতে যাবে সাথে সাথেই মুখ চেপে ধরে মুখ চেপে ধরে লাবিব পূণরায়। চোখ গরম করে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
“শালা ভাঙ খাইয়া মাতাল হইয়া হাসপাতালে আইছিস না কি? চারিদিকে কি কিছুই দেখোস না না কি সব শুধু ডানা কাটা পরী দেখা যায়? আঙ্কেল- আন্টির কথা না হয় বাদই দিলাম। আজকেই মাত্র পরিচয় হইলো এমন তিনজন মানুষের সামনে তোর বিটলামি করার সাহস হইলো কেমনে? মানুষ-গরু ভাসেনা চোখে?”
মুহূর্তেই যেন বর্তমান পরিস্থিতির কথা মাথার এলো নাজিমের। চোরের মতো দৃষ্টি দিয়ে সবার দিকে একবার তাকিয়ে মুখটাকে কাঁচুমাচু করে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল। দুই বন্ধুর মাঝ খানে দাঁড়িয়ে কন্ঠ খাঁদে নামিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
“শালা তোরা তো আসল মিরজাফরের বংশধর। কথা গুলো বলার আগে সাবধান করবিনা আমারে! মান-সম্মান প্লাস্টিক কইরা খান্ত হবার পর সাবধান করার কি দরকার? তোদের মতো এমন শত্রুও যেন কারো না থাকে।”
চলবে…….