হৃদয়_জুড়ে_তার_ছায়া #পর্বঃ২ #আদওয়া_ইবশার

0
196

#হৃদয়_জুড়ে_তার_ছায়া
#পর্বঃ২
#আদওয়া_ইবশার

উ’ত্ত’প্ত দুপুর। অসহনীয় গরমে হাঁসফাঁস করছে মানব প্রাণ। সকালে ভার্সিটিতে এসেছিল পালক। রোদের তেজটা তখন সহনীয় ছিল। কিন্তু সময় গড়ানোর সাথে সাথে তাপমাত্রা বেড়েই যাচ্ছে। এমন অসহ্য রকম গরমে ক্লাসে টিকে থাকতে না পেরে ভার্সিটির পিছনের পুকুর পাড়ে এসে বসেছে পালক। পুকুরের টলটলে স্বচ্ছ পানিতে পা ডুবিয়ে আপন মনে ভেবে যাচ্ছে হৃদয় জমিনের সমস্তটা জুড়ে বসে থাকা নি’ষ্ঠু’র মানবের কথা। সেই সন্ধ্যার পর কেটে গেছে চারটা দিন। পা’ষা’ণ হৃদয়ের পুরুষটার আর কোনো খোঁজ পায়নি পালক। তার এক পাক্ষিক আকাশ সমান ভালোবাসার বিনিময়ে মানুষটা তাকে তিল পরিমাণ সম্মান’ও দেয়নি কোনো দিন। যতবার ভালোবাসার দাবি নিয়ে ঐ মানুষটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে পালক।ঠিক ততবার তার পবিত্র ভালোবাসাকে তাচ্ছিল্যের সাথে অবহেলা করেছে মানুষটা। তবুও কেন ঐ নি’ষ্ঠু’র পুরুষটার জন্যই তার মনের ভিতর এতো অস্থিরতা? কেন কাঠিন্য মুখটা এক নজর দেখতে না পেলে এতো বেকুলতা সৃষ্টি হয় তার বুকের মাঝে? এর উত্তর জানা নেই পালকের। বেহায়া মনটা নিজের অজান্তেই কখন যে মানুষটাকে এতোটা ভালোবেসে ফেলল একটুও টের পায়নি সে।,

‘কি গো খালাম্মা! জামাই ম’রছে আজ কয়দিন?ভার্সিটিতে আইসা জামাই ম’রা’র শোক পালন করবেন ভালো কথা। একটু বিলাপ কইরা কান্দেন কুন্দেন।শুধু পেঁচার মতো মুখ কইরা থাকলেই তো পাবলিক বুঝবনা যে আপনি জামাই ম’রা’র শোকে গভীরভাবে শোকাহত ।’

হুট করে এমন অদ্ভুত কথা শুনে ভাবনা জগত থেকে বেড়িয়ে এলো পালক। তার থেকে কিছুটা দূরেই এক দল প্রাণোচ্ছল তরুণ-তরুণী বসে আছে। সেখান থেকেই কেউ একজন কথা গুলো বলেছে বুঝতে পেরে ভ্রু কুঁচকে তাদের দিকে তাকায় পালক। বিরক্তি ভাবে বলে,

‘খোঁচা মা’রা কথা ছাড়া তোদের মুখ দিয়ে কি কখনো কোনো ভালো কথা শোনা যাবেনা?’

‘ভুল কি বলছে আকাশ? তোর ভাব দেখে তো একটা দুধের শিশু’ও বলে দিবে তুই জামাই ম’রা’র শোকে আছিস। আর আমরা তোর ল্যাং’টা কালের বন্ধ হয়েও বলে দিতে পারবনা তোর দুঃখের কথা? এতো অপদার্থ বন্ধু এখনো হয়নি আমরা। চাপ নিস না তুই। বুঝতে পারছি অতি শোকে পাথর হয়ে চোখ দুটোও মরুভুমি হয়ে গেছে তোর। যার কারণে কাঁদতে পারছিস না।একটু পর আমরাই কেঁদেকুটে তোর শোক’টাকে পরিপূর্ণ করে দিব। বন্ধু হিসেবে বন্ধুর প্রতি একটা দায়িত্ব আছে না আমাদের!’

অবনীর কথা শেষ হতেই বন্ধু মহলের সবথেকে ছটফটে সদস্য রামিম বলে ওঠে,

‘আমি ভাই তোদের মেয়েদের মতো ঐসব ন্যাকা কান্না করতে পারবনা। তবে তোরা চাইলে অনেক বড় একটা মানবিক দায়িত্ব পালন করতে পারি।’

‘কি দায়িত্ব?’

উৎসুক কন্ঠে জানতে চাইল প্রিয়ন্তী। বাদ বাকী সকলেও তার মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। একটু নড়েচড়ে বসে জবাব দিল রামিম,

‘আমাদের ভাবের রাণীর যদি গোপনে দুই-একটা আন্ডা বাচ্চাও থেকে থাকে। আমি তাদের বাপের দায়িত্বটা নিতে পারি। দয়ার শরীর আমার। চোখের সামনে প্রাণপ্রিয় বান্ধবীর এ’তি’ম বাচ্চা কাচ্চার কষ্ট দেখে সইতে পারবনা।’

রামিমের কথা শুনে মুখটাকে অসহায় করে ফেলল প্রীয়ন্তি। ব্যথিত কন্ঠে বলল,

‘পালক! আমি এইসব কি শুনতেছি? তুই গোপনে বিয়ে করে বি’ধ’বা হবার আগে বাচ্চা কাচ্চাও ডাউনলোড করে ফেলছিস? একবারও আমাদের জানানোর প্রয়োজন মনে করলি না? এই তোর বন্ধুত্ব? এই দিন দেখার জন্য আমরা তোর সাথে বন্ধুত্ব করছিলাম?’এতো বড় অ’ন্যা’য়টা করতে পারলি তুই আমাদের সাথে?

বুল ফুলিয়ে একটা নিশ্বাস ছাড়ল পালক। এদের সাথে এখানে আর এক মুহূর্ত থাকা যাবেনা। সব কয়টাকে হারে হারে চেনা আছে তার। যতক্ষণ পর্যন্ত মুখ দিয়ে আসল কথা উচ্চারণ না করবে ততক্ষণ পযর্ন্ত এভাবে খোঁচাতেই থাকবে। কাওকে কিছু না বলেই পাশ থেকে ব্যাগটা নিয়ে ওঠে হাঁটা ধরল পালক। রাস্তায় এসে রিকশা নিয়ে সোজা চলে গেল বাড়ির দিকে। পেছনে ফেলে গেল কিছু অবাক, বিস্ময়কর দৃষ্টি।

_________

রাত প্রায় ১ টা বাজতে চলেছে। ঘুম নেই পালকের চোখে। অশান্ত মনে বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করে ওঠে দাড়াল শোয়া থেকে। ধীর পায়ে এগিয়ে গেল বারান্দার দিকে। গ্রিলের ফাঁকে হাত রেখে উদাস নয়নে তাকিয়ে রইল সামনের দিকে যতদূর চোখ যায়। ভরা পূর্ণিমার চাঁদ। চারিদিকে জোৎস্নার আলো থৈথৈ করছে। রূপালী আলোর ছটায় মনে হচ্ছে অদ্ভুত এক মায়ার জাল বুনে রেখেছে কেউ প্রকৃতিতে। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। পিনপতন নিরবতার জাল ছিড়ে মৃদুমন্দ বাতাসের শো শো শব্দ আর ঝিঝিপোকার ডাক ভেসে আসছে। সারাদিনের দাবাদহের পর এক টুকরো পরশ পাথরের ছোঁয়া নিয়ে এসেছে যেন এই রাতটা। দু-চোখ বন্ধ করে বুক ভরে একটা নিঃশ্বাস টেনে নিল পালক। প্রকৃতির সবটুকু নির্মলতা যেন নিঃশ্বাসের সাথে নিয়ে নিতে চাইছে বুকের ভিতরে অশান্ত হৃদয়টাকে শান্ত করার নিমিত্তে। পূণরায় চোখ খুলে সামনের দিকে তাকাতেই একটা জায়গায় থমকে গেল পালকের দৃষ্টি জোড়া। বুকের ভিতরটা আচমকায় ছলকে উঠল অজানা এক ভয়ে। পালকদের বাড়িটা গাজীপুর শহর থেকে কিছুটা বাইরে নিরিবিলি গ্রামীণ পরিবেশের মাঝে। মাঝারি আকৃতির এক তলা একটা বাড়ি। সামনের দিকটাতে পাকা রাস্তায় দিনের বেলায় মানুষের পাশাপাশি টুকটাক গাড়ির চলাচল থাকলেও পিছন দিকটা সবসময় নিরব থাকে। গাছপালা দিয়ে ঘেরা কিছুটা জায়গা। সেই জায়গা টুকু পেরোলেই পালকদের পারিবারিক কবরস্থান। যেখানে এই মুহূর্তে চাঁদের আলোয় স্পষ্ট জ্বলজ্বল করছে এক ছায়া মূর্তি। প্রথমে ভয় পেয়ে গেলেও পরবর্তীতে মনের মাঝে সাহস যুগিয়ে সেদিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় পালক। পেছন ঘুরে থাকাই মুখটা স্পষ্ট দেখা না গেলেও কয়েক মুহূর্তের মাঝেই ঠিকই বুঝে গেল পালক কে হতে পারে এই ছায়া মূর্তি। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে মানুষটাকে পর্যবেক্ষক করে সন্তর্পণে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল। পা টিপে সাবধানে এগিয়ে গেল ছায়া মূর্তিটার ঠিক পেছনে।,

‘ মাঝ রাতে এভাবে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে থেকে মানুষকে ভয় দেখানোর কোনো মানে হয়? সব মানুষের হৃদয় তো আর কারো মতো পা’ষা’ন না যে, এমন একটা গাঁ ছমছমে দৃশ্য দেখেও কিছুই হবেনা। ভয়ের চোটে কোনো ক্ষতি হয়ে গেলে এর দায়ভার কে নিবে?’

নৈঃশব্দের জাল ছিড়ে ঝঙ্কার তুললো পালকের রিনরিনে গলার স্বর। এমন একটা ভূতুড়ে পরিবেশে মাঝ রাতে হুট করে কোনো মেয়ের আওয়াজ শুনেও ভাবান্তর হলনা ছায়া মূর্তির। নির্বিকার ভাবেই সে দাঁড়িয়ে আছে এখনো। যথেষ্ট বিরক্ত হলো পালক। দিন দিন মানুষটার এমন নির্বিকার ভাব একদম নেওয়া যাচ্ছেনা। র’ক্তে, মাংসে গড়া একটা মানুষের এমন নির্লিপ্ত ভাব কেন থাকবে?,

‘আপনি কি যন্ত্রমানব? এমন অনুভূতিহীন আদও একটা মানুষ হতে পারে!’

‘অনুভূতিদের তো সেই চার বছর আগেই মাটি চাপা দিয়ে ফেলেছি। সেটা তোমার নিশ্চয়ই অজানা নই। তাহলে এমন অহেতুক প্রশ্ন করার মানে কি?’

মুহূর্তের মাঝেই হৃদয়টা কেঁপে ওঠল পালকের। চোখের তারাই ভেসে ওঠল কিছু বিবর্ণ সাদা-কালো অতিত। এক ফোটা জল গড়িয়ে পরল চোখের কোণ বেয়ে। জিবের ঢগায় শুকনো ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে কাঁপা কন্ঠে বলে ওঠল,

‘সময়ের সাথে সাথে আমরা সবাই তো স্বাভাবিক হতে পেরেছি। তাহলে আপনি কেন পারছেন না নাহিদ ভাই? কষ্ট কি আমাদের মাঝে নেই? আপনি কি একাই কষ্ট পাচ্ছেন? প্রিয় মানুষ হারানোর কষ্ট আমাদের’ও আছে। সেই কষ্টটাকে ছাপিয়ে জীবনে টিকে থাকতে হচ্ছে আমাদের। একটা মানুষের জন্য তো আর বাকি মানুষ গুলোকে আমরা কষ্টে রাখতে পারি না। কিন্তু আপনি সেটাই করছেন। সেই এক অতীত বুকে পুষে রেখে প্রতিনিয়ত নিজেকে কষ্ট দিচ্ছেন। সাথে আপনার আশেপাশের প্রতিটা মানুষকে কষ্টে রাখছেন। খুব তো বড় মুখ করে আমাকে বলেন, আমি স্বার্থপর। আমার ভালোবাসায় স্বার্থ লুকিয়ে আছে।আর আপনার নিঃস্বার্থ ভালোবাসার নমুনা বুঝি এই? একজনকে ভালোবেসে তার শোক বুকে পোষণ করে বাকী মানুষকে কষ্ট দেওয়াটাকে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দাবী করেন আপনি?’

নিঃশব্দে পালকের দিকে ঘুরে তাকাল নাহিদ। শান্ত চোখে তাকিয়ে জলদগম্ভীর কন্ঠে বলে,

‘তুমি’ই তো ঐদিন বলেছো, আমাকে ভালোবেসে না পেলে মৃ’ত্যু’কে আলিঙ্গন করতেও দুইবার ভাববে না। তাহলে আমি কিভাবে আস্তো এক ভালোবাসার সাগর হারিয়ে এই পৃথিবীর বুকে এখনো শ্বাস নিচ্ছি ভেবে দেখেছো একবার?’

কোনো উত্তর নেই পালকের কাছে। অসহায় মুখ করে শুধু ছলছল নয়নে তাকিয়ে আছে নাহিদের দিকে। বারকয়েক চোখের পলক ফেলে কান্নায় মিইয়ে আসা কন্ঠে জানতে চাইল,

‘ভালোবাসায় এতো কষ্ট জেনেও মানুষ কেন ভালোবাসে নাহিদ ভাই?’

বেদনামিশ্রীত অল্প হাসল নাহিদ। ঘাড় ঘুরিয়ে একটা ক’ব’রের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে থেমে থেমে জবাব দিল,

‘কারণ মানুষ কষ্ট পেতে ভালোবাসে। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি তাদের ঝোঁক একটু বেশিই থাকে সবসময়। আ’গু’নে পু’ড়ে কয়লা হবে জেনেও জলন্ত আ’গু’নে ঝাপ দেয়। পু’ড়ে ম’রে অনন্তকাল। দেহের মৃ’ত্যু না হয়ে হৃদয়ের মৃ’ত্যু হয় বারবার।’

নিরবে চোখের অশ্রু ঝরছে পালকের। অশ্রুসিক্ত চোখেই অপলক তাকিয়ে দেখে চলছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বিবর্ণ হৃদয়ের মানুষটাকে। চোখ দুটি কেমন ভ’য়ং’কর লাল হয়ে আছে তার। চোখের পলক ফেললেই মনে হচ্ছে যেন টুপ করে ফোটায় ফোটায় র’ক্ত ঝরে পরবে। ভিন্ন দুজন মানুষের হৃদয়ের অনুভূতি গুলো যেন কিছু মুহূর্তের জন্য এক সুতোয় বাঁধা পরে গেছে। নিরব নৈসর্গিক রাতের ঐন্দ্রজালিক মুহূর্ত ছাপিয়ে অশান্ত কা’ল বৈশাখী ঝড়ের সৃষ্টি হয়েছে দুটি মনেই। একে একে মানসপটে ভেসে উঠছে চার বছর আগের কিছু রঙিন স্মৃতি। যে স্মৃতির পাতায় যুক্ত ছিল আরও একটা প্রাণোচ্ছল কিশোরীর মুখাবয়ব। যে স্মৃতির ডায়েরির প্রথম কয়েক পাতা জুড়ে ছিল সুখের মিছিল। আর শেষে ছিল শোকের মাতম।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here