#হৃদয়_জুড়ে_তার_ছায়া
#পর্বঃ২৫
#আদওয়া_ইবশার
কেটে যায় দেড় মাস। এখনো হাসপাতালে নিয়মিত পাপড়ির ট্রিটমেন্ট চলছে। উন্নতি হবার পরিবর্তে দিন দিন আরও ঘায়েল করে ফেলছে ম’র’ন রোগ পাপড়িকে। কড়া মেডিসিনের প্রভাবে পাপড়ির দীঘল কালো চুল গুলো ঝরে পরতে শুরু করেছে। শুকিয়ে মনে হয় শরীরের হাড্ডির সাথে শুধু চামড়া টুকু লেগে আছে। মেয়ের এমন পরিণতি মানতে না পেরে নজরুল সাহেব অনেক বার চেষ্টা করেছে অন্য কোনো ডাক্তারের সরনাপন্ন হতে। কিন্তু এখানকার ডাক্তারেরা সেটা হতে দিচ্ছে না। নাহিদ, নজরুল ইসলাম দুজন মিলেও কিছুই করতে পারছেনা। দেশ ছেড়ে ভিনদেশে তাদের জোর’ই বা কতটুকু? ডাক্তার শুধু আশার আলো দেখাচ্ছে। বারবার বলছে বাঃহ্যিক স্বস্থ্যের অবনতি হলেও ভিতর থেকে রোগটা একটু একটু নিস্তেজ হতে শুরু করেছে।কিন্তু এর কিছুই তারা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেনা। তবুও আশায় বুক বাঁধছে সকলে। মনে প্রাণে চাইছে, অন্ধকার কেটে গিয়ে একদিন ঝলমলে আলো দেখা দিক।
পাপড়ির সাথে সর্বক্ষন কারো থাকার অনুমতি নেই। তবে প্রতিদিন ধরাবাধা একটা নিয়মে রওশন আরা, নজরুল ইসলাম, নাহিদ তিনজন এসে দেখে যায়। নিভু নিভু জ্বলা প্রদিপের ন্যায় পাপড়ির মাথার উপর ভরসার হাত রেখে শান্তনা দেয় এই বলে, ঝড় কখনো চিরস্থায়ী হয় না। এই ক্ষনস্থায়ী ঝড়টুকু থেমে গেলেই পাপড়ি নামক প্রদিপ শিখাটা আবারও আপন শক্তিতে ঝলঝল করে জ্বলে উঠবে। ইদানিং পাপড়ির একটুতেই শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। কথা স্পষ্ট হয়না। গলার ভিতর থেকে কেমন যেন গড়গড় আওয়াজ আসে।দিনকে দিন দৃষ্টি শক্তিও যেন হারিয়ে ফেলছে।লাখ লাখ টাকা খরচ করার পরও চোখের সামনে তাকে এভাবে একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে ঝুকে পরতে দেখে আর সহ্য হয়না কারো।
সন্ধ্যার আগ মুহূর্ত। হাসপাতালে পাপড়ির সাথে দেখা করতে এসেছে নাহিদ। বেডের সাথে লেগে আছে পাপড়ির নিস্তেজ দেহটা। গতকাল তার বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশান করা হয়েছে। সেই থেকেই ব্যথা আর জ্বরের প্রকোপ বেড়েছে তিনগুন। ধীরপায়ে নাহিদ এগিয়ে এসে পাপড়ির মাথার কাছে একটা চেয়ার টেনে বসে। কতক্ষণ পাপড়ির নিস্তেজ মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে মাথায় আলতো স্পর্শে হাত বুলিয়ে দেয়। পাপড়ি টের পায় নাহিদের উপস্থিতি। বন্ধ চোখের কোণ ঘেষে গড়িয়ে পরে নোনাপানির ধারা। নাহিদের পুরুষালী চোখ দুটোও জ্বলে ওঠে।এক হাত পাপড়ির মাথায় রেখে অপর হাতে তার বা হাতটা মুঠোয় পুড়ে নেয়। বারকয়েক ঢোক গিলে রোধ হয়ে আসা কন্ঠনালী সচল করে বলে,
“বেশি খারাপ লাগছে? একটু সহ্য করো। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
পাপড়ির নিরব কান্নাটা এবার যেন আর বাধ মানেনা। ঠোঁট কামড়ে শব্দ করে কেঁদে ওঠে। ভাঙা স্বরে বলে,
“আমি আর পারছিনা নাহিদ।এখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আর কিছুদিন এখানে থাকলে আমি এমনিতেই মরে যাব। প্লিজ আমাকে দেশে নিয়ে চলুন। এই ভিনদেশে পরে আমি মরতে চাইনা।”
জ্বিভ দিয়ে শুকনো খরখরে ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে আবারও ছোট একটা ঢোক গিলে নিজের ভিতরের দলা পাকিয়ে থাকা কান্না গুলো গিলে নেয় নাহিদ। কন্ঠে আদর মিশিয়ে বলে,
“এভাবে বলো না। আর কিছুদিন মাত্র। এরপর তুমি একদম সুস্থ্য হয়ে যাবে। তখন আমরা দেশে ফিরে যাব। দেশে গিয়েই আমার বোকা রানীটাকে একেবারে কাগজে, কলমে আমার করে লিখে নিব। আমাদের নামহীন সম্পর্কটার নতুন একটা নাম দিব। হবেনা আমার? যাবে আমার ঘরে! এই অগোছালো আমিটাকে গুছিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিবে?”
পাপড়ির চোখ দিয়ে এখনো অনর্গল অশ্রু গড়িয়ে পরছে। কান্নার দমকে বেড সহ পুরো শরীর কাঁপছে। নাহিদের ঐ কথা গুলো যেন পাপড়ির কান্নার মাত্রা দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছে। বুকটা ভিষণ ব্যথা করছে তার। এই ব্যথা বুঝি মৃত্যুর আগ পযর্ন্ত কখনো পাপড়িকে নিস্তার দিবেনা। বাবা-মা, আদরের ছোট বোন, নাহিদ নামক আস্ত এক ভালোবাসার মানুষ। এই সবাইকে ছেড়ে একদিন চলে যেতে হবে তার। ভাবতেই নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগে। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। পুরো শরীর জুড়ে অসহনীয় এক যন্ত্রণা হয়। বুকের ভিতরটা খুবলে খায় বিষাদ পোকা। বিধাতা কেন তার ভাগ্যে এতো করুণ পরিনতি লিখেছেন? কি অপরাধ ছিল তার? ভাগ্যে যদি এমনই হবার ছিল তাহলে কেন শেষ মুহুর্তে এসে ভালোবাসা নামক মিছে মায়ায় জড়ালো তাকে?”
“আমি বাঁচতে নাহিদ। আমি বাঁচতে চাই। আপনি, বাবা-মা, পালক সবাইকে নিয়ে বাঁচতে চাই। একটুও মরতে চাইনা আমি। জানেন!আমার খুব শখ, একদিন আপনার জন্য লাল টুকটুকে বউ সাজব আমি। আমাদের গাজীপুরের ছোট বাড়িটা আমার আর আপনার বিয়ের আমেজে বাহারী রঙের সেজে উঠবে। বাবা-মা’কে ছেড়ে আপনার হাত ধরে আমার স্বপ্নের সংসারে পদার্পণ করব আমি। আমাদের দুজনের ছোট্ট একটা সংসার হবে। একটা সুখের সংসার। যে সংসারের সর্বত্র জুড়ে থাকবে শুধু সুখ আর সুখ। প্রতিদিন আপনি অফিসে গেলে আমি আপনার পথ চেয়ে অপেক্ষা করব। সন্ধ্যায় যখন ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরবেন তখন আমার শাড়ির আঁচল দিয়ে আপনার ঘার্মাক্ত মুখটা মুছে এক গ্লাস ঠান্ডা লেবুর শরবত বাড়িয়ে দিব। তৃপ্তি নিয়ে আপনি সেটা পান করবেন। প্রতিদিন রাতে আপনার কাধে মাথা রেখে জোৎস্না বিলাস করব। আরও কত কত স্বপ্ন ছিল আমার। আচ্ছা! আমার এই এতো এতো স্বপ্ন গুলোর একটাও কি পূরণ হবেনা নাহিদ? আমাকে এই এতো এতো অপূর্ণতা নিয়েই ম’র’তে হবে? আপনাকে নিয়ে দেখা স্বপ্ন গুলো যদি আমার পূরণ না’ই হবে তবে কেন আপনার জন্য মনের কোণে ভালোবাসার সৃষ্টি হলো? আমি সত্যি বাঁচতে চাই নাহিদ। এই এতো এতো অপূর্ণ ইচ্ছে নিয়ে আমি মরতে চাইনা।”
পাপড়ির আহাজারি আর এতো এতো স্বপ্নের কথা শুনে নাহিদ নিজেও আর ঠিক থাকতে পারেনা। পাপড়ির একটা হাত তার দুহাতের মুঠোয় নিয়ে কপালে ঠেকিয়ে কেঁদে ওঠে। যে কান্নার কোনো শব্দ নেই। নিঃশব্দে শুধু ঝরে পরে অশ্রুকণা। নাহিদের পুরুষালী হৃদয়ে আঁচড়ে পরে প্রকান্ড ঝড়ে উথালপাথাল সাগরের অশান্ত ঢেউ। বহু কষ্টে নিজেকে সামলে কাধের কাছে শার্টে চোখের অশ্রু টুকু নিঃশ্বেস করে। পাপড়ির দুগালে আলতো হাতের আদুরে স্পর্শ দিয়ে বলে,
“আমার-তোমার দেখা সব স্বপ্ন পূর্ণতা পাবে। আমি পূর্ণতা দিব। তুমি শুধু একটু সুস্থ্য হয়ে উঠো। দেশে গিয়েই আমরা বিয়ে করব। এরপর আমাদের দেখা এক একটা স্বপ্ন প্রতিদিন বাস্তব রূপ পাবে।”
***
কেটে যায় আরও তিন মাস। দীর্ঘ সাড়ে চার মাস যাবৎ একটানা চিকিৎসায় বর্তমানে পাপড়ির অবস্থা আগের থেকে অনেকটা ভালো। হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ দিয়ে দেয় পাপড়িকে। ঐখানের ডাক্তার নিজেই বাংলাদেশের জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট এর সহকারী অধ্যাপক ডাক্তার লুবনা মারিয়ম’কে সাজেস্ট করেন পাপড়ির প্রতি সপ্তাহের চেকআপ এর জন্য।
অবশেষে যেন সকলের আগুনের দিন শেষ হয়। পাপড়ির জীবন থেকে একটু একটু করে অন্ধকার কেটে গিয়ে নতুন ষূর্যের দেখা দেয়। দেশে ফেরার পর থেকে দিন গুলো ভালোই যাচ্ছিলো পাপড়ির। একদম স্বাভাবিক আট-দশটা মানুষের মতোই চলাফেরা করতে পারছিল। প্রতি সপ্তাহে ডাক্তার লুবনা মারিয়মের চেকআপ এর পাশাপাশি ইন্ডিয়ার ডাক্তারের সাথেও ইমেইল এ যোগাযোগ করে দুই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ধরাবাধা নিয়মে চলছিল পাপড়ির দিন।
দেশে এসে পাপড়ির অনুরোধে নাহিদ আবারও নতুন চাকরিতে জয়েন করে। পাপড়ির দাদার বাড়ির আত্মীয় বাদে সমস্ত আত্মীয় স্বজন কিছুদিন পর পরই এসে দেখে যায় তাকে। নাজিম, রাফিন, লাবিব তিনজনেও যখনই সময় পায় ছুটে এসে নাহিদকে সঙ্গে নিয়ে পাপড়ির সাথে দেখা করে যায়। তাদের চার বন্ধুর লাগামছাড়া কথার জালে ফেঁসে গিয়ে পাপড়ির মন থেকে ক্ষণিকের জন্য হলেও বিষাদ গুলো উড়ে গিয়ে তখন মন আকাশে হাজারটা সুখের পাইরা উড়াউড়ি করে। মা-বাবা, বোন, নাহিদের সাথে আবারও সেই আগের ছন্দে কেটে যায় বেশ কিছু দিন। মাঝে কিছুদিনের জন্য ঢাকা থেকে রাজশাহী যায় নাহিদ। ছেলেকে আগের তুলনায় একটু হাসিখুশি দেখে সাইদুর রহমান শাহিনূরের মনে প্রশান্তির ঢেউ খেলে যায়। কিন্তু যখন নাহিদ জানায় পাপড়িকে সে বিয়ে করতে চায়, তখনই যেন আকাশ ভেঙে পরে তাদের মাথায়। শাহিনূর সাথে সাথেই ছেলের কথার প্রতিবাদ জানিয়ে বলে দেয়,
“আমি বেঁচে থাকতে কিছুতেই এমন একটা ক্যান্সারে আক্রান্ত মেয়ের সাথে তোর বিয়ে হতে দিবনা। কিভাবে ভাবলি তুই তোর এই আবদার আমি মেনে নিব? কোনো বাবা-মা কখনো তার সন্তানের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ চাইবে? নিশ্চয়ই চাইবেনা। তবে কেন আমি জেনে শুনে আমার ছেলের এতো বড় একটা ক্ষতি হতে দিব?”
মায়ের এমন অভিব্যক্তিতে সহসা থমকে যায় নাহিদ। হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে মায়ের মুখের দিকে। অবাক কন্ঠেই জানতে চায়,
“ওকে বিয়ে করলে আমার কিসের ক্ষতি হবে মা?”
“কিসের ক্ষতি হবে মানে? ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে গেছিস তুই? না কি বোধ বুদ্ধি লোপ পেয়েছে? যে মেয়ের আজ বেঁচে থাকলেও কাল বাঁচবে কি না তার কোনো আশা নেই। সেই মেয়েকে কিভাবে বিয়ে করতে চাস তুই? শুন নাহিদ! বিয়ে কোনো ছেলে খেলা না বাপ। তুই এমন অযৌক্তিক আবদার আর কখনো করবিনা।”
দু-চোখ বন্ধ করে হতাশামিশ্রীত একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে নাহিদ। মায়ের কথায় রাগ হয় তার। মনে হয় মা তার ভালোবাসার অপমান করছে। যা শাহিনূরের কাছে নাহিদ একদম আশা করেনি। দুহাত মুঠো করে ছোট ছোট কয়েকটা ঢোক গিলে রাগটাকে হজম করে নেয়। মা’কে বোঝানোর ভঙ্গিতে বলে,
“সৃষ্টিকর্তা কার মৃত্যু কখন লিখে রেখেছেন কেউ বলতে পারে মা? এমনও তো হতে পারে পাপড়ির আগে আমিই মরে যেতে পারি। তখন কি করবে তুমি?”
আতকে উঠেন শাহিনূর। ছেলের মুখে এহেন কথায় মায়ের বুকটা হু হু করে ওঠে। ছুটে এসে ছেলের মুখে হাত চেপে রাগি স্বরে বলে,
“এরকম অলক্ষুণে কথা আর একবার বললে কিন্তু এই বয়সে এসেও মা’র খাবি বলে দিলাম। মাথা ঠিক আছে তোর? কার সাথে কি তুলনা করে কেমন হাবিজাবি কথা বলছিস! আর কখনো যেন তোর মুখে এসব না শুনি আমি। বিয়ে করতে চাস তো ভালো কথা। পাপড়ির থেকেও হাজারগুণ সুন্দরী মেয়ে এনে দিব আমি তোর জন্য। তবুও আর এমন পাগলামি করিস না বাবা।”
স্লান হাসে নাহিদ। নিজের মুখ থেকে মায়ের হাতটা সরিয়ে দুহাতের ভাজে নিয়ে বলে,
“আমি শুধু উদাহরণ দিয়েছি মা। তুমি এতো সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছো কেন? আর বিয়ে করতে হলে আমি পাপড়িকেই করব। একজনকে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখিয়ে অন্যজনের সাথে সুখে সংসার করার ছেলে আমি নই। তুমি তো আমাকে সবথেকে ভালো বুঝো। তোমার ছেলে কেমন তুমি জানোনা? আমি কখনো মুখ ফুটে তোমাদের কাছে কিছুই চাইনি। আজ চাইছি। আমার এই চাওয়াটুকু পূরণ করো তোমরা। বিনিময়ে শুধু পাপড়িকে ছেড়ে দেবার কথা বাদে তোমরা যা চাইবে তাই মেনে নিব আমি। ঐ মেয়েটাকে তোমার ছেলে ভালোবাসে মা। আমার পুরো সত্বার সাথে জড়িয়ে গেছে সে। প্রতিদিন তাকে নিয়ে তোমার ছেলে হাজারটা স্বপ্ন দেখে মা। সেই স্বপ্ন গুলো যদি অপূর্ণ থেকে যায় তবে তোমার ছেলে বেঁচে থেকেও জীবন্ত লা’শ হয়ে থাকবে। পাপড়ি কতদিন বাঁচবে এটা নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই। সে যদি একদিনও বেঁচে থাকে আমি সেই একটা দিনই তাকে নিয়ে সংসার করতে চাই। আমার পক্ষে ঐ একদিনে যতগুলা স্বপ্ন পূরণ করা সম্ভব সেগুলোই পূরণ করে নিব। তুমি আমার থেকে দয়া করে স্বপ্ন পূরণের সেই একটা দিন কেড়ে নিও না। যেদিন আমার পাশে পাপড়ি নামক আমার ভালোবাসার ফুলটা থাকবেনা সেদিন আমি তার সাথে কাটানো ঐ একদিনের সংসারের স্মৃতি গুলো বুকে নিয়েই বেঁচে থাকব। কিন্তু এখন যদি তোমার ছেলে একটা মেয়েকে ভালোবেসে দেখানো স্বপ্ন গুলোর বাস্তব রূপ দিতে না পারে তাহলে আজীবন আফসোস বুকে নিয়ে ধুকে ধুকে ম’রবে মা। তুমি আমার থেকে সুস্থ্য ভাবে বেঁচে থাকার অধিকার টুকু কেড়ে নিওনা মা। একটু দয়া করো আমার উপর। সাথে ঐ মেয়েটার উপর। মা ঐ মেয়েটা প্রতিদিন আশায় বুক বাঁধে আমার জন্য বউ সাজবে বলে। আমি সেটা নেজেও কিভাবে তার স্বপ্ন গুলো পূরণ না করে ম’রতে দেই তাকে? এতো বড় অবিচার করোনা আমার উপর মা।”
শাহিনূর তবুও নিজের সিদ্ধান্তে অটল। ছেলের আকুল আবেদন একটুও গলাতে পারেনি তাকে। বরং আগের থেকে আরও কঠোর ভাবে বলে ওঠে,
“প্রথমে তোর পাগলামি মেনে নিয়ে চাকরি ছেড়ে ইন্ডিয়া যেতে দিয়েছি বলে এই না যে তোর সব অহেতুক আবদার মেনে নিব। কোনো ক্রমেই আমি ঐ মেয়েকে নিজের ছেলের বউ হিসেবে মানবনা।”
অসহায় নয়নে মায়ের দিকে এক ধ্যানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে নাহিদ।মায়ের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে নিস্তেজ কন্ঠে জানতে চায়,
“তোমারও কি একই কথা বাবা?”
সাইদুর রহমান কিছুপল চুপ থেকে ছেলের পাশে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
“আমি বা তোর মা কখনো তোর খারাপ চাইবনা নিশ্চয়ই। পাপড়ির যদি এমন পরিস্থিতি না হতো তাহলে আমরা কখনোই নিষেধ করতাম না। বরং হাসিমুখে বড় করে আয়োজন করে আমার ছেলের বউ হিসেবে তাকে এই বাড়িতে নিয়ে আসতাম। কিন্তু এমন একটা পরিস্থিতিতে এসে তোর এমন আবদার বোকামি ছাড়া কিছুই না। এটা তোর বুঝতে হবে।”
সহসা চোখ দুটো বন্ধ করে নেয় নাহিদ। ঘন ঘন শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত রাখার প্রয়াস চালায়। তাদের থেকে একটু দূরেই নাদিয়া, নাফিস দাঁড়িয়ে ভাইয়ের অসহায় মুখটা দেখে যাচ্ছে। বড্ড মায়া হচ্ছে তাদের ভাইটার জন্য। তাদের হাতে যদি ক্ষমতা থাকতো তাহলে একটুও কালবিলম্ব করতনা ভাইয়ের ইচ্ছেটা পূরণ করতে। কিন্তু আফসোস! সেই ক্ষমতাটাই তাদের নেই। কিছুক্ষণ মৌন থেকে ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি রেখে নাহিদ বলে,
“এতোদিন ভাবতাম আমার বাবা-মা খুবই সুন্দর মনের দুজন মানুষ। সবসময় তাদের মন-মানসিকতা, বিবেক-বুদ্ধি সবার উপরে থাকে। কিন্তু আজ একদম ভুল প্রমাণ করে দিলে আমায়। যে মানুষ গুলোর কারণেই আজকে তোমাদের ছেলে এখন পযর্ন্ত দিব্যি বেঁচে আছে, সেই মানুষ গুলোর এমন বিপদেই তোমরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছো! আর সবথেকে বড় কথা আমার যদি ওকে বিয়ে করতে কোনো অসুবিধা না হয় তাহলে তোমাদের কেন এতো অসুবিধা?”
“বাবা-মায়ের থেকে কি ঐ দুদিনের মেয়ে তোর কাছে বেশি আপন হয়ে গেছে?”
জানতে চায় শাহিনূর। নাহিদ শুকনা হেসে জবাব দেয়,
“তোমরা আমার বাবা-মা। আমাকে এই পৃথিবীর আলো দেখিয়েছো। তোমাদের থেকে আপন আর কে হতে পারে আমার? কিন্তু আমার জীবনে তোমাদের পর যদি কেউ থেকে থাকে তাহলে সেটা পাপড়ি। স্বার্থপর তোমরা হতে পারো। কিন্তু আমি পারবনা। যাকে সুস্থ অবস্থায় ভালোবেসেছিলাম। তার অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে অন্তত আমি তাকে ছেড়ে আসতে পারবনা। এমন অবিচার করলে আমার বিবেক আমাকে বাঁচতে দিবেনা। প্রতিদিন বিবেকের দংশনে মরব আমি।”
“তাহলে এটাই তোর শেষ কথা? পাপড়িকে বিয়ে করবিই?”
“হ্যাঁ।”
“ঠিক আছে। তবেভেবে নিস আজকে থেকে তুই এতিম। এই পরিবারের মানুষ গুলো কেউ হয়না তোর। বড় হয়েছিস।নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে শিখেছিস। এখন আর বাবা-মায়ের পরিচয় দিয়ে করবি কি?”
স্ত্রীর এমন কথায় এবার যথাপরনায় অবাক হয় সাইদুর রহমান। ধমকে ওঠে উচু স্বরে,
“শাহিনূর! কি ধরনের কথা এসব? এবার কিন্তু মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছো তুমি। কিভাবে এতো বড় একটা কথা বলতে পারো তুমি?”
শাহিনূর নিজেও চেঁচিয়ে বলে ওঠে,
“যেভাবে আমার ছেলে আমাকে পর করে দিতে পারে সেভাবে আমিও পারি। কি বলছে ও শুনতে পারছোনা তুমি? দুদিনের একটা মেয়ের জন্য আমাদের স্বার্থপর পযর্ন্ত বানিয়ে দিল। তো এমন স্বার্থপর বাবা-মায়ের প্রয়োজন কি তার? চলে যাক সব ছেড়ে-ছুড়ে ঐ মেয়ের কাছে।”
ক্লান্ত নাহিদ। একের পর এক মানসিক অশান্তি আর নিতে পারছেনা। মায়ের মুখে এমন একটা কথা শুনে গলা দিয়েও আর কোনো শব্দ আসছেনা। বহু কষ্টৈ কোনো মতে শুকনো মুখে বলে,
“ঠিক আছে। আমার মতে অবাধ্য ছেলেকে তোমাদের পরিচয় দিতে যদি এতোই কষ্ট লাগে তাহলে আর আসব আমি। ভালো থেকো তোমরা।”
কথাগুলো বলে আর এক মুহুর্ত দাঁড়ায় না। এলোমেলো পা ফেলে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। পিছন থেকে বারবার ভাইয়া বলে ডেকে ওঠে নাফিস, নাদিয়া। কারো কথায় যেন কানে যায় না তার। যন্ত্র মানবের মতোই হেঁটে যায় বাড়ির আঙ্গিনা ছেড়ে। পিছনে ফেলে যায় কান্নায় জর্জরিত বাবা-মা, ভাই-বোনকে।
চলবে……