#হৃদয়_জুড়ে_তার_ছায়া
#পর্বঃ৫
#আদওয়া_ইবশার
রাত প্রায় দশটা। রওশন আরা দুই মেয়েকে নিয়ে খেতে বসেছেন। শান্ত ভঙ্গিতে পাপড়ি নিচের দিকে তাকিয়ে একমনে খেয়ে যাচ্ছে। মা-বোনের এমন নিরব থাকাটা বরাবরই অপছন্দ পালকের। যেখানে পালকের দুই মিনিট কথা না বললেই মনে হয় তার পেটের ভিতর কিছু একটা খোঁচাচ্ছে। সেখানে তার মা-বোন এমনও সময় যায় ঘন্টার পর ঘন্টা কথা না বলে চুপচাপ কাটিয়ে দেয়। কিভাবে পারে এরা কথা হজম করে এভাবে বসে থাকতে? পালকের তো একেবারে দম বন্ধ হয়ে আসে একটুক্ষণ কথা না বলতে পারলেই। যেমনটা এখন হচ্ছে। সেই কখন থেকে উশখুশ করছে কিছু একটা বলার জন্য। অবশেষে মুখটাকে আর বন্ধ রাখতে না পেরে একবার মায়ের দিকে আরেকবার বোনের দিকে তাকিয়ে দুজনের ভাবগতি লক্ষ্য করে মিনমিনে কন্ঠে বলে ওঠে,
‘আম্মু! তোমাকে একটা জরুরি কথা জানানোর ছিল।’
খাবার সময় মেয়েকে হাজার দিন কথা বলতে নিষেধ করেছেন রওশন আরা। কিন্তু এই মেয়ে কথা শুনলে তো! যেটা করতে নিষেধ করা হবে তাকে। সেটা আরও বেশি করে আগ্রহ নিয়ে করবে সে। নিষেধ-উপদেশ গুলো যেন সে এক কান দিয়ে শুনে সাথে সাথেই অপর কান দিয়ে বের করে দেয়। শক্ত চোখে ছোট মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘কতবার বলেছি, খাবার সময় কথা বলবেনা!তোমার কি কোনো কথা কানে যায় না?’
চোখ বন্ধ করে মায়ের ধমকটাকে হজম করে নেয় পালক। দমে না গিয়ে পূণরায় অসহায় মুখে বলে,
‘কথাটা জরুরি দেখেই তো তোমাকে এখন জানাতে চাইলাম। খেতে বসার আগে মনে ছিলনা। এখন মনে পরেছে। পরে যদি আবার ভুলে যায়। তাই এখন বলতে চাচ্ছি।’
খাওয়া থামিয়ে রওশন আরা,পাপড়ি দুজনেই পালকের দিকে তাকালেন। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে জানতে চাইলেন রওশন আরা,
‘কি কথা?’
বন্ধ হয়ে আসা দমটা যেন ফিরে পেল পালক। ফটাফট বলে ওঠল,
‘তোমার বড় মেয়ে প্রেম করছে। শুধু প্রেম’ই না। রীতিমতো বয়ফ্রেন্ডের থেকে টাকাও নিচ্ছে। অথচ তুমি আমি কিছুই জানি না। ভাবো একবার, কত গভীর জলের মাছ তোমার বড় মেয়ে। এই মেয়েকে নিয়ে আবার তুমি গর্ব করো! সবসময় বলে বেড়াও যা কিছুই হয় সবার আগে তোমার মেয়ে তোমার কাছে বলে। এই তার নমুনা?’
মুহূর্তেই ভিষম খেল পাপড়ি। কাশতে কাশতে নাকে-মুখে খাবার ঢুকে যা’তা অবস্থা। পালকের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বড় মেয়ের দিকে দ্রুত নজর দিলেন রওশন আরা। পানি খাইয়ে পিঠে চাপড় দিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। পাপড়ি কিছুটা শান্ত হয়েই ক্ষিপ্ত চোখে তাকাল পালকের দিকে। অত্যাধিক রাগে চেঁচিয়ে বলল,
‘তোর কি মনে হয় না দিন দিন একটু বেশিই ই’ত’রামি করে ফেলছিস! কার সাথে প্রেম করি আমি? কখন প্রেম করেছি আর কখন টাকা নিয়েছি?’
অবাক হবার ভান করে বড় বড় চোখে বোনের দিকে তাকাল পালক। কন্ঠে বিস্ময় নিয়ে বলল,
‘তুমি কি আমার নিজের কান নিজের চোখকে অবিশ্বাস করতে বলছো আপু? বিকেলে কথা বলোনি তুমি একটা ছেলের সাথে? ছেলেটা তোমাকে টাকা দেয়নি বিকাশে? সেটা নিয়ে ঝগড়া করো নি ছলেটার সাথে?’
অসহায় চোখে মায়ের দিকে তাকায় পাপড়ি। কৈফিয়ত দেবার ভঙ্গিতে বলে,
‘মা তুমি এটার কথা বিশ্বাস করো? দুপুরে একটা অচেনা নাম্বার থেকে ভুল করে আমার একাউন্টে টাকা চলে আসে। আমি সেই টাকা’টা ফেরত দেওয়াই লোকটা আমাকে পাঁচশ টাকা দিয়ে বলেছিল খুশি হয়ে দিয়েছে। তুমিই বলো, আমি কেন অযথা ঐ লোকের টাকা রাখব? টাকা’টা আমি সাথে সাথেই ফেরত দিয়ে লোকটাকে ফোন করে বলেছিলাম যাতে আর কখনো আমার একাউন্ট এ টাকা না পাঠায়। সেটাই তোমার মেয়ে এখন এভাবে রসিয়ে রসিয়ে বলছে।’
একে একে দুপুর থেকে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত সব ঘটনায় খুলে বলে পাপড়ি মা’কে। সবটা শুনে রওশন আরা ছোট মেয়ের দিকে চোখ গরম করে তাকায়।রাগি কন্ঠে বলে,
‘খাওয়া’ই বসে বেঁচে গেলি তুই। নইলে আজকে তোর পিঠে চ্যালা কাঠ ভাঙতাম আমি। দিন দিন তোর ঐদ্বত্যতা সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ফোন করুক আজকে তোর বাপ। আদর দিয়ে দিয়ে বাঁদর বানাচ্ছে দিনকে দিন। আমার পক্ষে আর তার এই বে’য়া’দব মেয়েকে সামলানো সম্ভব নই। হয় সে মেয়েকে নিজের সাথে নিয়ে যাক। না হয় দেশে থেকে সামলাক।’
মায়ের হুমকিতে একটুও দমলনা পালক। বোনের দিকে তাকিয়ে শাসানো স্বরে বলল,
‘তোমার জন্য আজকে আমাকে এই বকা গুলো শুনতে হল না! দেখবে আমার মনের অভিশাপে ঐ ছেলের সাথেই তোমার প্রেম হবে। এরপর ব্রেকআপ। সেই দুঃখে তুমি নার্গিস পাগলির মতো বনেবাদরে ঘুরে বেড়াবে। ছোট ছোট বাচ্চারা তোমার পিছনে ছুটতে ছুটতে পাগল বলে খ্যাঁপাবে। ছোট বোনের মনে কষ্ট দিয়ে কেউ কখনো ভালো থাকেনা।’
পালকের এমন অভিশাপে পাপড়ির পেট ফেঁটে হাসি আসার উপক্রম। কোনো মতে ঠোঁট চেপে হাসি আটকে মুখ ঝামটে বলল,
‘শকুনের দোয়ায় কখনো গরু মরে না জানিস নিশ্চয়?’
প্রতিদিন দুই মেয়ের এমন ছোট ছোট খুনশুটি দেখতে দেখতেই রওশন আরার দিন কাটে। রওশন আরা সবসময় চাইতো কোনো এক যৌথ পরিবারে তার যেন বিয়ে হয়। মনের ইচ্ছেটা পূরণ করেছিল সৃষ্টিকর্তা। নজরুল সাহেবের পাঁচ ভাই তিন বোন আর বাবা-মা নিয়ে সুন্দর একটা যৌথ পরিবার ছিল। চার ভায়েরা ছোট ছিল নজরুল সাহেব। বড় ভাই গুলো বিয়ের পর দশ সদস্যদের পরিবারটা আরও বড় হয়ে উঠে। সেই সাথে আস্তে আস্তে সুখী পরিবারে ভর করে অশান্তি। চার ভাইয়ের বউ হয় চার রকম। ভিন্ন মানসিকতার মানুষ গুলোর একেক জনের মনে ছিল একেক রকম কূটিলতা। দিন-রাত কিছু না কিছু একটা নিয়ে দ্বন্দ্ব লেগেই থাকত তাদের মাঝে। ফলস্বরূপ যত দিন যাচ্ছিল ততই সংসারে বাড়ছিল অশান্তির আগুন। সেই অশান্তির আগুনেই একসময় নজরুল সাহেবের বউ হয়ে আসেন রওশন আরা। দু-চোখ ভরা স্বপ্ন ছিল এমন একটা যৌথ পরিবারে এসে সবার সাথে মিলেমিশে পুরো জীবনটা কাটিয়ে দিবে হাসি আনন্দের মাঝে। কিন্তু বউ হয়ে আসার কিছুদিন পর থেকেই চার জা’য়ের কূটিলতার স্বীকার হন তিনি। বড় চার জনের থেকে শিক্ষিত, নম্র-ভদ্র ছিল রওশন আরা। ছোট বড় সবাইকে সম্মান করে চলতো। যার ফলস্বরূপ অল্প দিনেই বড় বউদের থেকে বেশি প্রিয় হয়ে ওঠেন শশুর শাশুড়ির কাছে রওশন আরা। আর সেটাই কাল হয়ে দাঁড়ায় তার জন্য। হিংসার আগুনে পুড়ে চার জা মিলে প্রতিনিয়ত রওশন আরা’র বিরুদ্ধে সরযন্ত্রের জাল বুনেছেন। নজরুল সাহেব প্রবাসে চলে যাবার পর চারজন যেন আরও বেশি সুযোগ পেয়ে যায় রওশন আরা’কে অপদস্থ করার। প্রতিনিয়ত শারীরিক- মানসিক যন্ত্রনার স্বীকার হয়ে একটা সময় ধৈর্য্যহারা হয়ে ওঠেন রওশন আরা। কিন্তু বাবা-মা সমতুল্য শশুর-শাশুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে সবটা হজম করে নেন। এমন পরিস্থিতিতেই জন্ম হয় পাপড়ির। পাপড়ির জন্মের আড়াই বছরের মাঝেই পর পর শশুর-শাশুড়ি দুজনেই মারা যান কিছু মাসের ব্যবধানে। রওশন আরা’র কাছে তখন আর কোনো মানেই ছিল না চার জা’য়ের সরযন্ত্রের স্বীকার হয়ে ছোট মেয়েটাকে নিয়ে এ বাড়িতে পরে থাকার। নজরুল সাহেবকে বাড়ি ছাড়ার কথা জানানো হলে তিনি অসম্মতি জানান। ভাই অন্তপ্রাম নজরুল সাহেব কিছুতেই ভাইয়ের ছেড়ে আলাদা হতে রাজি ছিলেন না। এই নিয়ে আরেক অশান্তির সৃষ্টি হয় নজরুল সাহেবের সাথে মঠুফোনে রওশন আরা’র। এভাবে পালকের জন্মের সময় দীর্ঘ দিনের ছুটিতে নজরুল সাহেব বাড়িতে এসে যখন স্ব-চোক্ষে ভাইয়ের বউদের বিভিন্ন কূটিল মানসিকতাপূর্ণ কাজ লক্ষ্য করেন। সাথে ভাইদের ছেলে-মেয়ের উশৃঙ্খল আচার-আচরণ। তখন দুই মেয়ের মানসিক বিকাশের কথা ভেবেই সিদ্ধান্ত নেন বাড়ি ছাড়ার। এরপর গাজীপুরের মেইন শহরের থেকে কিছুটা দূরে নিরিবিলি পরিবেশে নিজের টাকায় জায়গা-জমি কিনে বাড়ি করে বউ-সন্তান রেখে যায়। এমন নিরিবিলি পরিবেশে প্রথম প্রথম রওশন আরা’র দুই মেয়ে নিয়ে একা থাকতে ভয় হতো খুব। একা একজন মহিলা মানুষ বাচ্চা দুটো মেয়ে নিয়ে থাকবে এটা নজরুল সাহেব’ও যথেষ্ট চিন্তিত ছিল। এরপর পরিচিত একজনের সাথে আলোচনা করে দুই ইউনিট এর মাঝারি আকৃতির বাড়িটাতে এক ইউনিটে বউ-সন্তান রেখে আরেক ইউনিট ফ্যামিলি ভাড়া দিয়ে দেয়। সেই ভাড়াটিয়া ছিল নজরুল সাহেবের পরিচিত বন্ধুর এক ভাইয়ের পরিবার। বাচ্চা দুই মেয়েকে সামলে মাঝে মাঝে ঐ ভাড়াটিয়াদের সাথে টুকটাক গল্পগুজব করেই কাটত রওশন আরা’র সময়। তবুও মাঝে মাঝে নিজেকে খুব একা মনে হতো রওশন আরা’র। যে মানুষটা সবসময় চেয়ে এসেছিল তার একটা যৌথ পরিবার হোক। প্রতিনিয়ত পরিচিত মানুষের কলরবে মুখরিত হোক বাড়ির আঙ্গিনা। সেই মানুষটার পক্ষে শুধু বাচ্চা দুই মেয়ে নিয়ে সংসার করা একটু কষ্টসাধ্যই ছিল। আস্তে আস্তে মেয়ে দুটো বড় হবার সথে সাথে যেন তার সেই কষ্টটাও লাঘব হয়। বড় মেয়েটা একটু চুপচাপ স্বভাবের থাকলেও ছোট মেয়েটা তার হয় যথেষ্ট চঞ্চল। এক পালক এই নিরব বাড়িটাকে মাতিয়ে রাখতে শুরু করে। মেয়ের দূরন্তপনায় ঘুচে যায় রওশন আরা’র একাকিত্ব। এক সময় কথা বলার মানুষ খোঁজে না পাওয়া রওশন আরা’র মুখ ব্যথা হয় এখন দস্যু মেয়ের দস্যিপনা কমানোর জন্য বকতে বকতে।
চলবে…..