#ফিরে_আসা২
১৫
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
শীত কি এ বছর আগে আগেই চলে এলো না-কি? না বোধ হয়। ঢাকায় তো এ সময় অসহনীয় গরম। মাথার ওপরে কড়া রোদটার উত্তাপে চোখ মেলে তাকানোই দুঃসাধ্য। অথচ এখানে শীতের রীতিমতো থরথর করে কাঁপছে অরা। সকাল আটটা, অথচ রোদের দেখা নেই। শীত সহ্য করতে না পেরে শাড়ির ওপরে আরশাদের একটা শার্ট গায়ে জড়িয়ে রেখেছে। তবুও যেন মানছে না শীত।
গ্রামে না-কি আগেভাগেই শীতে এসে যায়। অরার শ্বশুরবাড়িটাকে ঠিক গ্রামের কাতারে ফেলা যায় কিনা কে জানে? বাড়ির চারিদিকে পাহাড়ঘেরা চা বাগান। রান্নাঘরের জানালা থেকে চমৎকার একটা দৃশ্য দেখতে পেল অরা। কুয়াশাঘেরা আকাশের মাঝে ডুবে আছে বিশাল এক পাহাড়। পাহাড়ের নিচে সারি সারি চা গাছ। মনে অজান্তে মিষ্টি এক হাসির ফুটে উঠল অরার ঠোঁটে। আচমকা এই ছুটিটা আসায় ভালোই হলো। মন খানিকক্ষণের জন্যে হলেও স্বস্তি পেয়েছে।
শুধু তার মন কেন? তার মাঝে লুকিয়ে থাকা ওই ছোট্ট সুপারস্টারও স্বস্তি পেয়েছে খানিকটা। অরা কনসিভ করার পর থেকে কেবল ঢাকার যান্ত্রিকতার মাঝে ডুবে রয়েছে। বাবুকে প্রকৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া সময়টাই হয়ে ওঠেনি।
আরশাদের ব্যস্ত শিডিউলের মাঝ থেকে সময় বের করে সিলেটে বেড়াতে এসেছে তারা। উপলক্ষ, মায়ের জন্মদিন। প্রথমবারের মতো ঘটা করে সেলিনা হকের জন্মদিন পালন করা হবে। তিনি অবশ্য এসবের কিছুই জানেন না। তাকে বলা হয়েছে, এমনি ছুটি কাটাতে পরিবারের সকলে বেড়াতে এসেছে এখানে। জন্মদিনে আচমকা সারপ্রাইজ দিয়ে তাকে চমকে দেওয়াই সকলের উদ্দেশ্য।
পানিতে বলক ফুটে উঠেছে। জানালা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে চায়ে মনোযোগ দিল অরা। ওদিকে বাংলাঘরে গুরুতর মিটিং চলছে। আরশাদ তার কাজিনদের নিয়ে সারপ্রাইজ প্ল্যানিং করছে। সেই মিটিংয়ে অরার প্রবেশাধিকার নেই। যদিও এ নিয়ে ভোরবেলা এক দফা তর্কাতর্কি হয়েছে আরশাদ এবং তার মাঝে। সেই তর্ক সসম্মানে জিতেও নিয়েছে আরশাদ।
দুটো কাপে চা ঢেলে তা নিয়ে উঠানোর দিকে পা বাড়ালো অরা। উঠানে কাঠের মোড়ায় বসে আছেন সেলিনা হক।
অরাকে ট্রেন হাতে প্রবেশ করতে দেখি তিনি উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন, “তুমি শুধু শুধু এত কষ্ট করতে গেলে কেন বৌমা?”
অরা মুচকি হাসি হেসে বলল, “চা বানানো বুঝি খুব কষ্টের কাজ?”
অরা সামনের টেবিলে ট্রে নামিয়ে রেখে সেলিনা হকের পাশের মোড়ায় বসলো। সেলিনা হক যত্নের সঙ্গে ধরে বসালেন তাকে।
ওরা চায়ের কাপ তুলে তার দিকে বাড়িয়ে দিলো।
তিনি কাপ হাতে নিয়ে বললেন, “তোমার কষ্ট হলো না?”
সেলিনা হকের কথার ভঙ্গি শুনে মনে হচ্ছে যেন তিনি বিরাট অপরাধ করে ফেলেছেন। আর এখন সে অপরাধের জন্য অনুশোচনা করছেন।
ছেলে মানুষের ছেলে মানুষই প্রশ্রয় দেওয়ার ভঙ্গিতে হেসে অরা বলল, “আচ্ছা মা, একটা কথা সত্যি করে বলুন তো। আপনিও তো দুই সন্তানের মা হয়েছেন। তারা যখন গর্ভে ছিল তখন কি আপনিও কাঠের পুতুল হয়ে ঘরে বসে থাকতেন?”
সেলিনা হক বুঝ দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, “একেবারেই কাজ করতে নিষেধ করছি না। তবে প্রথম সন্তানের ক্ষেত্রে একটু সাবধান থাকতে হয়।”
অরা আশ্বাস দিয়ে বলল, “আমি সাবধানেই আছি মা। চায়ে চিনি হয়েছে?”
সেলিনা হক প্রশংসার সুরে বললেন, “একদম! তোমার হাতের চা অবিকল আমার শাশুড়ির বানানো চায়ের মতো।”
অরা অবাক গলায় বলল, “তাই না-কি?”
“হ্যাঁ! সকালের নাস্তা বাড়ির বৌয়েরা তখন তৈরি করতাম। শুধু চা তিনি কাউকে বানাতে দিতেন না।”
খানিকটা সময় নীরবতার মাঝে সকালটা উপভোগ করলো দুজনে। এর মাঝে বাড়ির পেপারওয়ালা পেপার বিলি করতে এসে দেরি করার অপরাধে কয়েক দফা সেলিনা হকের ধমক খেয়ে নিল।
চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা দিয়ে সেলিনা হক বললেন, “কথা উঠেছে?”
অরা হাসিমুখে বলল, “না! উনার ঘুম ভাঙতে ভাঙতে বেলা একটা।”
মুগ্ধ দৃষ্টিতে অরার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন সেলিনা হক। কথার প্রসঙ্গ এলে জ্বলজ্বল করে ওঠে মেয়েটার চোখদুটো। কথার প্রতি এই মেয়েটার এত টান না থাকলে কী যে হতো, কল্পনা করেই শিউরে ওঠেন তিনি।
সেলিনা হক ইতস্তত করে বললেন, “তোমাকে একটা মনের কথা বলবো বৌমা?”
অরা আগ্রহ নিয়ে বলল, “বলুন না মা!”
সেলিনা হক কৃতজ্ঞার সুরে বললেন, “আমি তোমার প্রতি সত্যিই অনেক কৃতজ্ঞ। তুমি যেভাবে কথার দেখাশোনা করছো, প্রশংসা না করে পারি না।”
অরা প্রচ্ছন্ন হাসি হেসে বলল, “আপনার সন্তানরা যখন ছোট ছিল তখন আপনি তাদের দেখাশোনা করেননি?”
“করেছি তো।”
“কেউ আপনার প্রশংসা করেছে?”
“না মানে…”
অরা সহজ-স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, “আমি কথার দেখাশোনা করবো না তো কে করবে মা? এজন্যে আবার কৃতজ্ঞতা দেখাতে হয় না-কি?”
সেলিনা হক আবারও মুগ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকিয়ে রইলেন অরার দিকে। এই মেয়েটা বলেই সম্ভব! তার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে, এ জীবনে কোনদিন কথাকে তার মতো আপন করে নিতে পারতো না।
বাংলাঘর থেকে হইচইয়ের শব্দ ভেসে আসছে। এরই মাঝে আবার আরশাদের কড়া ধমকের আওয়াজও পাওয়া গেল।
সেলিনা হক কৌতূহলভরা কণ্ঠে বললেন, “ওরা এই সকাল সকাল কী করছে বলো তো?”
অরা রহস্যমিশ্রিত গলায় বলল, “সেটা তো মা আপনাকে বলা যাবে না।”
বাংলাঘরে কী হচ্ছে এ নিয়ে সেলিনা হকের প্রবল কৌতূহল থাকেলও আপাতত তার বহিঃপ্রকাশ ঘটালেন না। আবারও ভেসে এলো আরশাদের ধমকের আওয়াজ। তার বিচ্ছু কাজিনগুলোকে এরূপ ধমকাধমকি ছাড়া সামলে রাখা মুশকিল।
সেলিনা হক নীরবতা ভঙ্গ করে বললেন, “রাগ কোরো না বৌমা। তোমার ওপর আরও একটা কারণে আমি কৃতজ্ঞ।”
অরা মজার ছলে বলল, “আপনি দেখি কৃতজ্ঞতার দোকান খুলে বসেছেন মা! এত ফর্মালিটি করলে আমি কিন্তু উঠে চলে যাবো।”
“আহা শোনো না।”
অরা মনোযোগী শ্রোতার ন্যায় তাকিয়ে রইলো শাশুড়ির দিকে।
সেলিনা হক আর্দ্র গলায় বললেন, “আমার ছেলেটা আজ হাসছে, সকলের সঙ্গে মিশছে। কয়েক বছর আগে যেন নিজের ছেলেকেই চিনতে পারতাম না। ক্যামেরার সামনে হাসতো ঠিকই, তবে সেই হাসি যে আসল নয় সেটা আর কেউ না বুঝলেও আমি বুঝতে পারতাম। নিজেকে কেমন গুটিয়ে নিয়েছিল আরশাদ। আর সেই ছেলেটা কাজ আবারও আগের মতো হয়ে গেছে। শুধুমাত্র তোমার কারণে।”
কথাগুলো বলতে বলতে চোখের পলকেই টপটপ করে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো সেলিনা হকের চোখ বেয়ে।
অরা ব্যস্ত হয়ে কোমল স্বরে বলল, “কাঁদবেন না তো মা! কত বছর পর কাউকে মা ডাকছি জানেন? আমার মা তো সেই ছোটবেলাতেই আমাকে রেখে চলে গেল। এরপর তার জায়গায় আরেকজন এলেও তাকে মা ডাকতে পারিনি কখনো। মা ডাকা কি এতই সোজা? তবে আপনাকে দেখে মনের অজান্তেই মা ডাকটা বেরিয়ে আসে। আপনার চোখে জল সহ্য করি কী করে মা?”
বাংলাঘরের বিছানা আর মেঝেতে এলোমেলো হয়ে বসে আছে আরশাদের সকল কাজিনরা। সেলিনা হকের জন্মদিন উদযাপন করতে ঢাকা থেকে ছুটে এসেছে দিশা, রনি, মেহের, আকাশরা। আধ ঘন্টা যাবত পাকাপোক্ত একটা প্ল্যান দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে আরশাদ। এদের হইচইয়ের কারণে কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না। রাগে-বিরক্তিতে সহ্যের সকল সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে আরশাদের।
দাঁতে দাঁত চেপে আরশাদ বলল, “এই তোরা থামবি?”
থামবার ভাবলক্ষণ কারও মাঝেই প্রকাশ পেলো না। সকলে নিজেদের মধ্যে কথা বলেই যাচ্ছে।
আরশাদ এবার প্রচন্ড এক ধমক দিয়ে বলল,
“চুপ কর ছাগলের দল!”
আচমকা নীরবতার হাওয়া বয়ে গেল বাংলাঘরে। ছোট ভাই-বোনেরা সকলেই তাদের আরশাদ ভাইয়াকে ভয় পায়।
তবুও কী যেন মনে করে দিশা সাহস করে বলল, “ভাইয়া তুমি কিন্তু এভাবে মানুষকে ছাগল ডাকতে পারো না। এটা একই সঙ্গে মানুষ এবং ছাগল দুই জাতিকেই অপমান করা।”
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে আরশাদ বিরক্ত গলায় বলল, “বের হ।”
“মানে?”
আরশাদ তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, “বেরিয়ে যা এখান থেকে। গাড়িতে উঠে সোজা ঢাকায় গিয়ে নামবি। এমন সচেতন মানুষের দরকার নেই এখানে।”
দিশা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুরে বলল, “আরে বাবা তুমি রেগে যাচ্ছো কেন?”
আরশাদ ভ্রু কুঁচকে বলল, “বের হবি?”
দিশা গাল ফুলিয়ে বলল, “আচ্ছা সরি, সরি।”
আরশাদ শুকনো গলায় বলল, “আমরা এখানে কেন এসেছি?”
সঙ্গে সঙ্গে আকাশ লাফিয়ে উঠে বলল, “বেড়াতে!”
ঘরে থাকা সকলেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিক্ষেপ করলো তার দিকে। এই ছেলেটার ভুল সময়ে ভুল কথা বলার অভ্যাস আর গেল না!
আরশাদ আবারও ধমক দিতে যাবে তার আগেই রনি হড়বড় করে বলল, “ফুপুর বার্থডে সেলিব্রেট করতে।”
আরশাদ বিরক্ত স্বরে বলল, “একটা বার্থডে পার্টির আয়োজন করতে হবে। কোনো সায়েন্টিফিক গবেষণা তো করতে হবে না। তোরা এত ঘাবড়ে যাচ্ছিস কেন?”
দিশা বলল, “কারণ এটাই খালার প্রথম বার্থডে।”
“তাতে কী হয়েছে? শোন, তোদের সব ছাগলগুলোকে দুটো গ্রুপে ভাগ করা হবে। প্রত্যেক গ্রুপের দায়িত্ব একটা করে কেক বানানো।”
রনি হতবাক গলায় বলল, “কেক?”
“মনে হচ্ছে যেন আকাশ থেকে পড়লি? কেকের নাম শুনিসনি কখনো? ওই যে গোল দেখতে, ক্রিম দিয়ে মোড়া থাকে। ওপরে ক্যান্ডেল জ্বালানো হয়।”
রনির ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে যেন এক্ষুনি কেঁদে ফেলবে। বছরে দুয়েকবার কোনো উপলক্ষ্য উদযাপন করার জন্যে এক হয় তাদের পুরো পরিবার। তবুও কোনোবারই মন মতো আনন্দ করতে পারে না রনি। প্রত্যেকবারই এমন উদ্ভট একটা দায়িত্ব ঘাড়ে তুলে দেয় আরশাদ।
রনি আহত গলায় বলল, “মজা নিচ্ছো ভাইয়া? কেক চিনবো না কেন? কিন্তু আমরা তো কেক বানাতে পারি না।”
দিশা ভেংচি কেটে বলল, “আমরা না, বলো আমি। ভাইয়া আমরা কেক বানাতে পারবো।”
আরশাদ বলল, “ভেরি গুড। আর শোন, কেকের ডিজাইন কিন্তু ইউনিক হতে হবে। ওসব ফুল-লতা-পাতার ডিজাইন করে আনবি না।”
“তুমি কোনো চিন্তা কোরো না ভাইয়া।”
রনি কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, “কিন্তু আমার কী হবে? আমি তো কেক বানাতেই পারি না।”
আরশাদ বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, “এই যুগে পারি না বলতে কোনো কথা নেই। ইউটিউব দেখে শিখে নিবি! আমার একটাই কথা, দুটো গ্রুপ থেকে দুটো কেক লাগবেই। আর খবরদার, বাইরে থেকে কিনে আনার চেষ্টা করবি না।”
দিশা আর মেহের ইতোমধ্যেই কাগজ-কলম নিয়ে কেকের ডিজাইন করতে শুরু করলো। ওদিকে রনি আর আকাশ কী লিখে ইউটিউবে সার্চ করলে কেকের রেসিপি পাওয়া যাবে তা ভাবতে ব্যস্ত।
এরই মাঝে বাংলাঘরে প্রবেশ ঘটলো আশফিয়ার। আরশাদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো তার দিকে। আজকের এই মিটিংয়ের শুরু আশফিয়ারও থাকার কথা ছিল। তার কারণেই তো সকলের জন্মদিন উদযাপন করতে সিলেটে আসা। অথচ সেই কিনা, মিটিং বাদ দিয়ে ঘুমিয়ে ছিল!
ভাইয়ের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি উপেক্ষা করে আশফিয়া বিছানার ওপরে বসতে বসতে বলল, “কী রে? এই সকাল সকাল তোরা মিটিংয়ে বসে গেছিস?”
আরশাদ থমথমে গলায় বলল, “হাতে মাত্র আজ আর কালকের দিনটা। সময় নষ্ট করার সময় কোথায়?”
“তুই শুধু শুধু এত ব্যস্ত হচ্ছিস আরশাদ। মায়ের যে একটা জন্মদিন আছে, এটা তো সে নিজেই জানে না। ছোট্ট একটা কেকের ওপর ক্যান্ডেল জ্বালিয়ে তাকে উইশ করলেই দেখবি কত খুশি হয়ে যাবে।”
আকাশ আবারও লাফিয়ে উঠে বলল, “সেটাই তো!”
আরশাদ তার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই দমে গেল সে।
আরশাদ ভ্রু কুঁচকে বলল, “ঢাকা থেকে এত দূরে এসেছি ছোট্ট একটা কেক দিয়ে বার্থডে সেলিব্রেট করার জন্যে? তোরা আপার কথা শুনে খুশিতে লাফাবি না। আমি যেভাবে বলেছি, সেভাবেই বার্থডে সেলিব্রেট হবে।”
মেহের হঠাৎ কৌতূহলী গলায় বলল, “আচ্ছা ভাইয়া, আমরা যে এত আয়োজন করবো খালা তো দেখে ফেলবে। সারপ্রাইজ দিবো কী করে?”
আরশাদ কিছু বলতে যাবে তার আগেই আশফিয়া বলল, “আমি ওই দিন সকাল সকাল মাকে নিয়ে চেকআপে চলে যাবো। যতটা সময় পারা যায় বাইরে ঘোরাঘুরি করবো। এই ফাঁকে তোরা সব কাজ সেরে ফেলিস।”
নিজেদের মধ্যে মিটিং সেরে আরশাদ আর আশফিয়া গেল তাদের খালা আর মামীদের সঙ্গে মিটিং করতে। জন্মদিন রান্নাবান্নার দায়িত্ব তাদের ওপরেই পড়েছে।
বেলা একটার আগেই জেগে উঠলো কথা। লাল টুকটুকে একটা ফ্রক পড়ে বেণী দুলিয়ে দুলিয়ে সারা বাড়িজুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর সকলের সঙ্গে মিশছে সে। অরা এই সুযোগে বিছানা গুছিয়ে নিচ্ছে। আরশাদ তো কোনো কাজই করতে দেয় না তাকে। একেবারে কোনো কাজ না করলে যে শরীরটা অকেজো হয়ে পড়বে, এ কথা তাকে বোঝায় কে?
হঠাৎই বেজে উঠলো অরার ফোন। স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে মাহমুদের নাম। অরা একবার ভাবলো ফোনটা রিসিভ করবে না। বেড়াতে এসে কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকার কোনো মানে হয় না। তবে পরমুহূর্তেই জরুরি কল ভেবে রিসিভ করলো সে।
ফোন রিসিভ করতেই শোনা গেল মাহমুদের চিন্তিত কণ্ঠস্বর, “হ্যালো? ম্যাম আপনি কোথায়? আজ অফিসে আসবেন না?”
মনে মনে কিঞ্চিৎ বিরক্ত না হয়ে পারলো না অরা। সে অফিসে যাবে কি যাবে না, তার কৈফিয়ত এই ছেলেটাকে দিতে হবে কেন?
তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে অরা ভদ্রভাবে বলল, “আমি তো ছুটিতে মাহমুদ।”
মাহমুদ সঙ্গে সঙ্গে অনুতপ্ত ভঙ্গিতে বলল, “ও সরি, সরি। আমি আপনার কেবিনে এসেছিলাম একটা ফাইল দেখাতে। অথচ কেউ আমাকে বললই না আপনি ছুটিতে।”
“সমস্যা নেই, তুমি ফাইলটা আমাকে মেইল করে দাও।”
“জি আচ্ছা ম্যাম।”
ল্যাপটপ ওপেন করে মাহমুদের পাঠানো ফাইলটা চেক করলো অরা। তেমন কোনো ভুল চোখে পড়ছে না। ফিরতি মেইলে, ফাইলটাকে অ্যাপ্রুভ করলো অরা।
মিনিট পাঁচেক না পেরোতেই আবারও মাহমুদের কল। অরা ভ্রু কুঁচকে রিসিভ করলো, তবে মুখে কিছুই বলল না।
মাহমুদ বিনয়ী ভঙ্গিতে বলল, “ম্যাম? সরি আবারও বিরক্ত করলাম।”
অরা এক হাতে ফোনটা চেপে ধরে আরেক হাত দিয়ে বেডসাইড টেবিলে রাখা বইগুলো গোছাতে গোছাতে বলল, “না, না বলো।”
“আপনি কি অফিসের সব দায়িত্ব সাদিক ভাইকে দিয়ে গেছেন।”
সাদিক সাহেব কে ফিল্মসের চিফ কর্পোরেশনস অফিসার। অরার একদম নিচেই তার পোস্ট। অরার অবর্তমানে তিনিই কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নিতে পারেন।
“হ্যাঁ, কেন?”
মাহমুদ ইতস্তত করে বলল, “বেয়াদবি মনে না করলে একটা কথা বলি ম্যাম?”
“বলো।”
মাহমুদ নিচু গলায় বলল, “সাদিক ভাই তো নিজেই ফাঁকিবাজি করছে। বারোটা বেজে গেল, এখনো অফিসে আসেনি। অফিসেও কোনো শৃঙ্খলা নেই ম্যাম। যার যখন ইচ্ছা আসছে, যখন ইচ্ছা চলে যাচ্ছে। কাজ তো একেবারেই হচ্ছে না। আমি তো দেখে এলাম এডিটিং টিম কাজকর্ম বাদ দিয়ে ছাদে আড্ডা দিচ্ছে।”
বিচিত্র এক স্রোত বয়ে গেল অরার গা বেয়ে। এই পৃথিবীতে তার সবথেকে অপছন্দের জিনিস এই ফাঁকিবাজি। কারও যদি কাজ করতে ভালো না লাগে, তাহলে সে কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে ঘরে বসে থাকুক। কাজের প্রতি অবহেলা করার তো কোনো মানে হয় না।
অরা ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলল, “আমি তোমাকে একটু পরে ফোন করছি মাহমুদ।”
ল্যাপটপে অফিসের সিসিটিভি ফুটেজ চেক করলো অরা। মাহমুদের বলা প্রতিটা কথাই সত্যি। ছাদে এডিটিং টিম এলোমেলভাবে বসে আড্ডা দিচ্ছে। সাদিক সাহেবের কেবিনটাও ফাঁকা পড়ে আছে।
অরা আর এক মুহুর্তও অপচয় না করে কতগুলো ফোন কল সারলো। সবগুলো কলই কিঞ্চিৎ হুমকিস্বরূপ। তার একটা কলেই আধ ঘণ্টার মাঝে স্বাভাবিক চিত্র ফিরলো অফিসে।
বলতেই হয়, মাহমুদ ছেলেটা কাজের। অফিসের সকলে আড়ালে তাকে ডাকে ‘বসের চামচ’। অরার প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠার চেষ্টায় তার কোনপ্রকার কমতি নেই। চামচামি জিনিসটা একেবারেই অপছন্দ অরার। তবে কেউ যদি চামচামি করতে গিয়ে উপকার করে, তবে ক্ষতি কোথায়?
অরা এবার নিজেই মাহমুদকে ফোন করে বলল, “থ্যাংক ইউ মাহমুদ। তুমি না বললে তো বুঝতেই পারতাম না ওখানে কি হচ্ছে।”
মাহমুদ কৃতজ্ঞতায় মোমবাতির মতো গলে গিয়ে বলল, “কী যে বলেন ম্যাম, এটা তো আমার দায়িত্ব।”
মায়ের জন্মদিনের প্ল্যানিং করতে সুপারস্টার সাহেব সারাটা সকাল এতই ব্যস্ত ছিলেন যে বউয়ের খোঁজ নিতে রীতিমত ভুলেই গেছেন। অরার অবশ্য এ নিয়ে কোনো রাগ নেই। সারাটা বছর তো অরাকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে আরশাদ। এই কয়েকটা দিন জন্মদিন নিয়ে ব্যস্ত থাকাই তো স্বাভাবিক।
ঘরে এসে আরশাদ কেবল তার ল্যাপটপ খুলে বসেছে।
ওদিকে অরা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে অভিমানী স্বরে বলল, “তুমি না-কি সবাইকে কেক বানানোর দায়িত্ব দিয়ে এসেছো?”
আরশাদ ল্যাপটপের দিক থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই বলল, “হুঁ।”
অরা গাল ফুলিয়ে বলল, “বাড়ির সবাই কেক বানাবে, অথচ জাতীয় কেক বিশেষজ্ঞ বানাবে না?”
আরশাদ অরার দিকে তাকিয়ে বিভ্রান্ত স্বরে বলল, “কে বিশেষজ্ঞ? তুমি?”
“নয়তো কে?”
আরশাদ আবারও ল্যাপটপে মন দিয়ে বলল, “অরা! সেই ইচ্ছা বাদ দাও। কেক-টেক তুমি বানাতে পারবে না।”
“কিন্তু কেন?”
আরশাদ কড়া ভঙ্গিতে বলল, “প্রথম তিন মাস শেষ হয়েছে এখনো? ডক্টর কী বলেছে মনে নেই? প্রথম তিন মাসের আগে কোনো ধকলের কাজ করা যাবে না।”
অরাও পাল্টা রাগ দেখিয়ে বলল, “কেক বানানো মোটেও ধকলের কাজ না।”
“সেটা আমি জানতে চাইনি।”
“আরশাদ আমি প্রেগন্যান্ট, অসুস্থ নই। তোমাকে এই কথা হাজারবার বলেছি।”
আরশাদ অরার যুক্তির পেছনে যুক্তি দেখিয়ে বলল, “আমিও হাজারবার বলেছি যে এসব কথা আমাকে বলে লাভ নেই।”
অভিমানে মুষড়ে পড়ে অরা বলল, “বাড়ির সবাই বার্থডের আয়োজন করবে আর আমি হাত গুটিয়ে বসে থাকবো? আমার কোনোই কাজ নেই? তাহলে এনেছো কেন আমাকে এখানে?”
হঠাৎ সুপ্ত এক দুষ্ট বুদ্ধি খেলে গেল আরশাদের মস্তিষ্কে। ল্যাপটপটাকে সরিয়ে রেখে উঠে দাঁড়িয়ে ছোট ছোট পা ফেলে অরার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। মুহুর্তও সমস্ত অভিমান গলে জল হয়ে গেল অরার। আরশাদের চোখের দিকে একবার চোখ পড়তেই দৃষ্টি সরিয়ে নিলো সে। ওই চাহনি খুব ভালো করে চেনা আছে তার। তার ভেতরটাকে উন্মাদনায় ভাসিয়ে দেওয়ার মতো চাহনি।
আরশাদ মোহগ্রস্ত কণ্ঠে বলল, “কে বলেছে তোমার কোনো কাজ নেই? কাজ আছে তো।”
অরা অস্পষ্ট গলায় বলল, “কী কাজ?”
“আমার সাথে রোম্যান্স করা।”
আর এক মুহুর্তও অপচয় না করে আরশাদ অরার হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে তাকে এনে ফেলল নিজের বুকে।
অরা আঁতকে উঠে বলল, “এই কী করছো! দরজার লক খোলা।”
আরশাদ তার কথায় একেবারেই কর্ণপাত না করে বলল, “থাকুক।”
মোহগ্রস্তের ন্যায় অরার ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে দিলো আরশাদ। যেন এই মুহুর্তটাই পৃথিবীতে তার শেষ মুহূর্ত। যত পারছে তাই, প্রাণ ভরে ভালোবাসার সাগরে ভাসিয়ে দিচ্ছে প্রিয় মানুষটাকে। অরাও ভেসে যাচ্ছে নির্দ্বিধায়। আরশাদের ভালোবাসাময় একেকটা স্পর্শ যেন একটু একটু করে পাগল করে তুলছে তাকে। উত্তেজনায় নিজেকে সামলাতে খামচে ধরলো আরশাদের শার্ট।
হঠাৎ দরজায় টোকা পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে আরশাদের থেকে ছিটকে দূরে সরে গেল অরা। হৃদস্পন্দন যেন এক লাফে বেড়ে গেল একশ পঞ্চাশে।
দিশা বাইরে থেকে উচ্চস্বরে বলল, “ভাইয়া?”
মোহনীয় মুহূর্ত বাধাগ্রস্ত হওয়ায় একরাশ বিরক্তি নিয়ে আরশাদ বলল, “কী?”
“খালা ডাকছে।”
“আসছি।”
দিশা চলে গেছে, ঘরের ভেতর থেকে স্পষ্ট পাওয়া গেল তার পায়ের শব্দ। আরশাদ দেরি না করে আবারও কাছে টেনে নিলো অরাকে।
অরা ভীত গলায় বলল, “কী করছো? আবারও যদি কেউ চলে আসে?”
অরার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলো না আরশাদ। তার ঠোঁটজোড়া যে অরার শরীরজুড়ে অবাধ বিচরণ করবে বলে ছটফট করছে।
(চলবে)
[এই পর্বটা লিখতে গিয়ে আরেকটুর জন্যে হার্ট অ্যাটাক করিনি। গত বৃহস্পতিবার কলেজে অফ পিরিয়ডে খাতার পিছনের পাতায় পর্বটা শুরু করি। আমার কলেজে সুন্দর একটা বারান্দার মতো আছে, নিরিবিলিতে ওখানেই লিখছিলাম। পরের পিরিয়ডের ঘন্টা পড়ার আগেই আমার ক্লাসের সামনে থাকার কথা। লিখতে লিখতে কোথায় যেন হারিয়ে গেছিলাম। ঘন্টা পড়ার সাথে সাথে তাই দৌড় দিতে হয়। ভাগ্যিস স্যার তখনও ক্লাসে আসেনি। কিন্তু আরেকটা ঝামেলা বাঁধিয়ে ফেলি। বারান্দায় ফেলে আসি আমার প্রাণের প্রিয় পেনসিল ব্যাগ। আমার পেনসিল ব্যাগটাতে আমার পুরো সংসার থাকে। ক্লাসে এসে যখন বুঝতে পারলাম, পেনসিল ব্যাগ ফেলে এসেছি, তখন থেকেই আমার মন ভার। ক্লাসে মনোযোগ দিবো কী? আমার চোখের সামনে শুধু ওই সবুজ পেনসিল ব্যাগ! 😆 ক্লাস শেষে এক নিঃশ্বাসে দৌড় দিই ওই বারান্দায়। ভাগ্য ভালো, বেচারি ওখানেই পড়ে ছিল। আর যাই করি, এখন থেকে অফ পিরিয়ডে ওই পেনসিল ব্যাগ নিয়ে গল্প লিখতে যাবো না। 🤣]