#ফিরে_আসা২
১৭
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
বাড়ির উৎসবমুখরতায় আচমকা ভাটা পড়লো। অবশ্য পুরো বাড়ির বললে ভুল হবে। এখনো চাপা অস্থিরতা বিরাজ করছে সকলের মাঝে। দিশা-রনিরা ব্যস্ত নিজ নিজ দায়িত্ব নিয়ে। খালা-মামীরা রান্না-বান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। উৎসবমুখরতা নেই কেবল আরশাদের মাঝে। গতকাল পর্যন্ত যে ছেলেটা আগ্রহ নিয়ে সকল কাজের তদারকি করছিল, আজ সেই একই মানুষটা কেমন ম্লান হয়ে আছে। জন্মদিনের আয়োজনে তার মন নেই বললেই চলে। মনটা ঘুরপাক খাচ্ছে ওই উইলের কাগজটাকে ঘিরে।
বাবার স্মৃতি মনে করার চেষ্টা করলো আরশাদ। আবছা আবছা নয়, স্পষ্টই মনে আছে তার। ব্যবসায়ে একের পর এক লোকসানের সম্মুখীন হয়ে, বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন আরমান হক। কাজ থেকে বাড়ি ফিরেই কারণে-অকারণে স্ত্রীয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তেন তর্কে। তার আগে হাত তুলতেও দ্বিধা বোধ করেননি কখনো।
স্ত্রীয়ের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করলেও সন্তানদের সামনে হাসি-খুশি এক মুখোশ পরে থাকবার চেষ্টা করতেন। মাঝেমধ্যেই এটা-ওটা উপহার দিতেন তাদের। বাবাকে সে কারণে কখনো খারাপ মানুষ বলে মনে হয়নি আরশাদের। তবে আশফিয়া তো বড়, সে ঠিকই বুঝে নিয়েছিল বাবার অন্তরটা কেমন। বাবার সঙ্গে তার খুব একটা ভালো সম্পর্ক ছিল না। আরশাদকেও খুব একটা ঘেঁষতে দিতো না তার কাছে।
এরপর তো আরমান হক পালিয়েই গেলেন। বাস্তবতা বুঝতে শেখার বয়স তখন আরশাদের হয়েছে। বাবা নামক মানুষটার প্রতি অচিরেই তার জন্মে গেল তীব্র ঘৃণা।
আরশাদ এবং আশফিয়া বাবার ছায়া ছাড়াই এক অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছে। বাবাকে যখন সবথেকে বেশি প্রয়োজন ছিল তখন তাকে পাশে পায়নি, পেতেও চায়নি। নিজেদেরকে কখনো আরমান হকের সন্তান হিসেবে পরিচয়ও দেয়নি। যদিও চাচা-ফুপুদের
সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেনি তারা। একটা মানুষের অপরাধে তো আর গোটা পরিবারটাকে ছিন্ন করে ফেলা যায় না।
একটা কথা আরশাদ কিছুতেই ভেবে পায় না, জীবদ্দশায় যে মানুষটা সন্তানদের খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করলেন না, মৃত্যুর পর কেন সেই সন্তানদের নামেই সম্পত্তি লিখে দিয়ে গেলেন? অনুশোচনা থেকে? না-কি এর পেছনে রয়েছে অজানা কোনো উদ্দেশ্য?
কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না আরশাদ। মস্তিষ্কের মাঝে অদ্ভুত এক শূন্যতা। কী করবে সে এই সম্পত্তি দিয়ে? নিয়ে নেবে? মরে গেলেও না। আরশাদ তো চাইছে, এই সম্পত্তি যেভাবে আছে সেভাবেই পড়ে থাকুক। বাঁধ সাধছেন সেলিনা হক। তিনি চাইছেন তার সন্তানেরা যেন এই সম্পত্তি গ্রহণ করে।
সৃষ্টিকর্তার কৃপায় কোনপ্রকার অভাব নেই আরশাদের। এই বিশাল অঙ্কের সম্পত্তি তার জীবনে কোনো প্রভাবই ফেলবে না। সে নিলেও যা, না নিলেও তাই। তবুও সেলিনা হক চাইছেন আরশাদ আর আশফিয়া যেন এই সম্পত্তি গ্রহণ করুক। বাবার শেষ স্মৃতিচিহ্ন বলে কথা!
মায়ের দাঁড় করানো এই যুক্তি শুনে বিরক্তিতে রীতিমত শিউরে ওঠে আরশাদ। টাকা-পয়সা আবার মানুষের শেষ স্মৃতিচিহ্ন হয় কী করে? সকাল সকাল আর মায়ের সঙ্গে তর্কে জড়ায়নি আরশাদ। কাল বাড়িতে জন্মদিনের অনুষ্ঠান। ঝগড়া-ঝাঁটি করে আজ শুধু শুধু বাড়ির পরিবেশটাকে ভারী করে তোলার দরকার কী?
বাংলাঘরের উঠানে দাঁড়িয়ে মৌনতার মাঝে ডুবে আছে আরশাদ। সকাল সাড়ে সাতটার কাছাকাছি, তবুও ভোর যেন পুরোপুরি হয়নি। চারিদিক কুয়াশায় মোড়া।
আচমকা কাঁধের ওপর নরম একটা হাত অনুভব করলো আরশাদ। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালো সে। যদিও তার প্রয়োজন ছিল না। এই স্পর্শ তার অতিপরিচিত। এই পৃথিবীর সবথেকে সুখময় স্পর্শ। পেছনে তাকিয়ে অরার মুখটা দেখতেই হাজার দুশ্চিন্তার মাঝেও মৃদু হাসি ফুটে উঠলো আরশাদের ঠোঁটে। কচুপাতা রঙয়ের শাড়ি পরেছে অরা। গ্রামের বাড়িতে এসে অরা কেবল শাড়িই পরছে। মেয়েটা সবসময় শাড়ি পরে না। তবে হঠাৎ হঠাৎ যখন পরে, আরশাদের মনের মাঝে যেন প্রবল আনন্দময় কোনো উৎসব শুরু হয়। সকালের পরিবেশে কেমন শীত শীত ভাব থাকে বলে শাড়ির ওপর দিয়ে আরশাদের একটা শার্ট গায়ে জড়িয়ে রেখেছে অরা। তাকে নিজের শার্টে দেখে মনের মাঝে চলতে থাকা ওই উৎসবের আমেজ যেন তীব্রতর হলো।
অরা কোমল স্বরে বলল, “বাড়িসুদ্ধ সবাইকে এত এত দায়িত্ব দিয়ে নিজে এখানে একা একা দাঁড়িয়ে আছো?”
আরশাদ শুকনো গলায় বলল, “ভালো লাগছিল না অরা।”
আরশাদের কপালের ওপর এসে পড়া চুলগুলো আলতো স্পর্শে সরিয়ে দিতে দিতে অরা বলল, “ভালো না লাগলে কী করে চলবে আরশাদ? আমরা কি আর রোজ রোজ এ বাড়িতে বেড়াতে আসি? কত দিন পর এলাম। তাও আবার মাত্র তিন দিনের জন্যে। এর মধ্যে তুমি মনমরা হয়ে থাকলে কারোরই তো ভালো লাগবে না।”
আরশাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তুমি তো সবটাই জানো অরা।”
“এত ব্যস্ত হওয়ার তো কিছু নেই আরশাদ। এমন তো নয় তোমাকে কেউ ডেডলাইন দিয়ে রেখেছে। আজকের মধ্যেই একটা সিদ্ধান্তে আসতে হবে। ঢাকায় ফিরে ধীরে-সুস্থে না হয় একটা সিদ্ধান্ত নিলে।”
আরশাদ থমথমে ভঙ্গিতে বলল, “আমার সিদ্ধান্ত আমি নিয়ে নিয়েছি। আমি চাই না ওই সম্পত্তি। আপাও চায় না।”
সেলিনা হকের সঙ্গে ভোর বেলাতেই কথা হয়েছে অরার। তিনি হতাশ ভঙ্গিতে জানিয়েছেন তার মনের কথাগুলো। সন্তানেরা তাদের বাবার সম্পত্তি নিতে চাইছে না, এ নিয়ে তার মাঝে অভিযোগের শেষ নেই।
অরা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “তোমরা সম্পত্তি না নিলে সেটা সরকারের কাছে চলে যাবে। যেটা মা চান না।”
আরশাদ তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল, এটা না-কি তার শেষ স্মৃতিচিহ্ন। স্মৃতিচিহ্ন মাই ফুট! বেঁচে থাকতে যে মানুষটা আমাদের খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করলো না, তার স্মৃতিচিহ্ন রেখে কী হবে? তার সব সম্পত্তি আমাদের নামেই লিখে দিয়ে গেল কেন কে জানে?”
আরশাদের দিকে কয়েক মুহূর্ত নিষ্পলক তাকিয়ে রইল অরা। বাবা নামক মানুষটার শূন্যতা চিরকালই থেকে যাবে তার মাঝে। ছেলেরা কি বড় হয়ে অবিকল তাদের বাবার মতো হতে চায়? আরশাদ তো কখনোই চায়নি। বরং প্রাণপণ চেয়েছে যেন বাবার সামান্যতম কোনো বৈশিষ্ট্য তার মাঝে না থাকে। এজন্যেই তো কথাকে এতটা আগলে রাখা তার। অরার মধ্যে বসবাসকারী ছোট্ট প্রাণটাও নিঃসন্দেহে একই ভাগ্য নিয়ে পৃথিবীতে আসছে।
অরা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, “মায়ের সঙ্গে এতদিন পর সবকিছু ঠিকঠাক হলো। এমন কিছু কোরো না যাতে আবার এই সম্পর্কে ফাটল ধরে।”
আরশাদ হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে বলল, “আমিও চাই না সম্পর্কে ফাটল ধরাতে। তাই বলে মায়ের কথামতো সম্পত্তির টাকাগুলোও নিতে পারবো না। এটা আমার এথিক্সের বাইরে।”
অরা হঠাৎ কী যেন মনে করে বলল, “আমার কাছে একটা বুদ্ধি আছে।”
“কী বুদ্ধি?”
অরা সুন্দর করে গুছিয়ে বলল, “এই টাকা তুমি আর আপা নিতে চাইছো না। তোমাদের প্রয়োজনও নেই। কিন্তু এমন অনেকেই তো আছে, যাদের এই টাকাগুলোর প্রয়োজন হতে পারে।”
আরশাদ অবাক গলায় বলল, “মানে?”
“পুরো টাকাটা তুমি আর আপা ডোনেট করে দাও। বিভিন্ন অনাথআশ্রম আর এনজিওর ভাগ করে দাও। তোমরা এই টাকা নিজেদের কাছে রাখতে চাইছো না, ওদিকে মা চাইছেন তোমরা যাতে নাও। ডোনেট করে দিলে তোমাদেরকেও সেই টাকা নিতে হলো না, মায়ের ইচ্ছাও পূরণ হলো। সাথে সাথে অনেক মানুষের উপকারও হলো।”
মুগ্ধতার ঝড়ো হাওয়া বয়ে গেল আরশাদের মাঝে। এত সুন্দর একটা চিন্তা তার মাথায় এলো না কেন? যতই দিন যাচ্ছে, অরার ওপরে তার গর্ব ততটাই বেড়ে যাচ্ছে। এই না হলে আরশাদ হকের অর্ধাঙ্গিনী!
সম্পত্তি দান করার বুদ্ধিটা আশফিয়ার বেশ পছন্দ হলো। সে তো পারলে এখনই সব সম্পত্তি দান করে দিয়ে আসে। পছন্দ হলো না কেবল সেলিনা হকের।
তিনি মুখ ভার করে বললেন, “তোদের বাবা কি এতগুলো টাকা একসঙ্গে খরচ করে ফেলার জন্যে দিয়ে গেছেন?”
আরশাদ বিরক্ত ভঙ্গিতে ভ্রু কুঁচকে বলল, “আমরা বলেছি দিয়ে যেতে?”
আশফিয়া চোখের ইশারায় ভাইকে চুপ করিয়ে বলল, “আমার নামে টাকা লিখে দিয়ে গেছে। কীভাবে খরচ করবো সেটা তো আর বলে দিয়ে যায়নি।”
“তোদের বাবা এতে খুব কষ্ট পাবেন।”
“একটা ভালো কাজে খরচ করছি মা। কতগুলো এতিম বাচ্চার উপকার হবে, কত ঘরহারা মানুষ নতুন করে ঘর পাবে। বাবা নির্ঘাত খুব খুশি হবে। তাই না আরশাদ?”
আপার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আরশাদ মায়ের উদ্দেশ্যে বলল, “শেষ স্মৃতিচিহ্ন বাঁচাতে এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাও মা। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই।”
দিনশেষে আশফিয়া বুঝিয়ে-সুঝিয়ে মাকে রাজি করিয়েই ফেলল।
জন্মদিনের বিকেল
আজ বাড়ির সকলের মাঝে ব্যস্ততার কোনো কমতি নেই। আশফিয়া সেই সকাল সকাল সেলিনা হককে নিয়ে বেরিয়ে গেছে চেকআপের উদ্দেশ্যে। বছরে একবার তাঁর সমস্ত চেকআপ করানো হয়। এবার বছর পেরোবার আগেই কেন আশফিয়া চেকআপে নিয়ে গেল, সেলিনা হক ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না।
কাল সকলে ফিরে যাচ্ছে ঢাকায়। তিনি চেয়েছিলেন আজ সারাটাদিন বাড়িতে সকলের সঙ্গে কাটাতে। আশফিয়ার চেকআপে নিয়ে যাবার কথায় তিনি প্রথম মন ভার করলেও, সারাটাদিন মা-মেয়ে একসঙ্গে কাটাতে পারবেন ভেবে খুশি হলেন।
তারা বেরিয়ে যাওয়ার পরপরই বাড়িতে শুরু হয় তোর-জোর। রান্নার ব্যাপক আয়োজন করা হয়েছে। এত রান্না, রান্নাঘরে বসে করা সম্ভব হবে না। তার বাড়ির সামনের জায়গাটায় রান্নার সকল আয়োজন করেছেন আরশাদের খালা আর মামীরা। গ্যাস সিলিন্ডারসহ রান্নার প্রয়োজনীয় সব হাঁড়ি-পাতিল ডেকোরেটর থেকে দিয়ে গেছে।
দিশা, মেহের, রনি, আকাশ পুরো বাড়িটা সাজানো শুরু করলেও, আধ ঘন্টার মধ্যেই হিমশিম খেয়ে ওঠে। আকাশ পর্দার স্ট্যান্ডে বেলুন ঝুলাতে গিয়ে নিজেই পর্দাসুদ্ধ পড়ে যায়। ভাগ্যিস ব্যথা-ট্যথা পায়নি। আরশাদ জানতো তার আদরের ‘ছাগলদের’ দ্বারা এ কাজ সম্ভব নয়। তাই সে আগে থেকেই ডেকরেশনের লোকদের খবর দিয়ে রেখেছিল।
তাদের আগমনে এই চারজন কিছুটা হলেও স্বস্তি পেলো।
তবে ব্যস্ততার শেষ এখনো হয়নি। দিশা আর মেহের রান্নাঘরে গিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো তাদের কেকের ব্যাটার বানাতে। ওদিকে রনি ফুরফুরে মেজাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রান্না-বান্নার তদারকি করছে।
দিশা রান্নাঘর থেকে ভেংচি কেটে রনিকে উদ্দেশ্য করে বলল, “খুব যে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছো! সন্ধ্যার আগে টেবিলে কেক এনে রাখতে পারবে তো?”
রনি ফূর্তির মেজাজে বলল, “তোমরা তো পাঁচশ বছর আগে থেকেই কেক বানানো শুরু করেছো। যারা এক্সপার্ট তাদের কেক বানাতে বেশি সময় লাগে না। ঠিক সময়মতো আমাদের কেক তৈরি হয়ে যাবে।”
ওপরে ওপরে বেশ ভাব নিলেও ভেতরে ভেতরে দুশ্চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছে রনি। আরশাদ যারা বাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর সকলের কাজের তদারকি করছে। এক মুহূর্তের জন্যেও তার মন সরছে না অন্যদিকে। এভাবে চলতে থাকলে তো অরা তাদের কেকটা বানাতেই পারবে না। শেষমেশ জন্মদিনের অনুষ্ঠানে তাদের মান-সম্মান নিয়ে টানাটানি।
রনিকে অবশ্য বেশিক্ষণ দুশ্চিন্তা করতে হলো না। ঢাকার এক নামকরা ডিজাইনারের কাছ থেকে আরশাদ মায়ের জন্যে বেশ অনেকগুলো উপহার অর্ডার করেছিল। তার মধ্যে বেশ অনেকগুলো শাড়ি, হাতঘড়ি আর পারফিউম রয়েছে। আরও একটা জিনিস রয়েছে, ওটা আরশাদ আর আশফিয়া দুজনের পক্ষ থেকেই। এতসব নিয়ে ওই ডিজাইনার নিজেই এসেছে। কিন্তু বাড়ি চিনতে তার অসুবিধা হচ্ছে।
আরশাদ প্রথমে ভেবেছিল পথ চিনিয়ে আনতে ড্রাইভারকে পাঠাবে। যেহেতু ডিজাইনার নিজে এতদূর এসেছে, তাই ভদ্রতার খাতিরে আরশাদ নিজেই গেল।
এই মোক্ষম সুযোগটার জন্যেই অপেক্ষা করছিল রনি। অরার কেক বানানোর সমস্ত উপকরণ বাংলাঘরে। রনি নিজেই গতকাল এখানে সব এনে রেখেছিল। অনুষ্ঠান করা হবে মূল বাড়িতে, তাই এখানে কারও ভীড় নেই।
রনি আর আকাশ বাড়ির সকলকে বলে এসেছে তারা বাংলাঘরে নিরিবিলিতে কেক বানাতে চায়। আর অরা বলে এসেছে, সে আর কথা তাদের কেক বানানো দেখতে যাচ্ছে।
অরাকে কেক তৈরির ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে ‘এক্সপার্ট’ বলা চলে। দশ মিনিটের মাঝে তার ব্যাটার তৈরি হয়ে গেল। এই বাংলাঘরে পুরনো একটা ওভেন আছে। সেটাতেই ঢুকিয়ে দিলো কেকটা। কেক বেক হওয়ার সময়টুকু অরা আর বাংলাঘরে থাকলো না। কথার সঙ্গে বাড়িজুড়ে ঘুরে বেড়ালো। আর রনি এবং আকাশ এমন একটা ভাব করলো যেন কেক নিয়ে তারা খুব চিন্তিত।
কেক বেক হয়ে গেলে অরা এসে ক্রিম দিয়ে কেকের ওপরে ডিজাইন করলো। সে এমনিতে খুব সুন্দর ডিজাইন করতে পারলেও আজ অতটা সুন্দর করলো না। কেকটা যে আকাশ আর রনিই বানিয়েছে, এটা যাতে সকলের কাছে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়।
এক ঘন্টার মধ্যেই আরশাদ ফিরে এলো। বাড়িজুড়ে চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। বাড়ির সামনের জায়গাটায় প্রকান্ড এক টেবিলে দুই দলের বানানো দুটো কেক, অসংখ্য চকলেট আর স্নো স্প্রে। পাশেই আরেকটা টেবিলে সেলিনা হকের জন্যে আনা সব উপহারগুলো রাখা। বিশাল ব্যানারে টানানো হয়েছে টেবিলের পেছনে। ব্যানারে বড় বড় অক্ষরে লেখা, “Happy Birthday Ma”। সঙ্গে সেলিনা হকের অনেকগুলো ছবি। পুরো বাড়িটাকে সাদা আর সোনালী বেলুনে মুড়ে দেওয়া হয়েছে।
আশফিয়া সেলিনা হককে নিয়ে বাড়ি ফিরলো সন্ধ্যা ছয়টার দিকে। তারা গাড়ি থেকে নামতেই বাড়িতে উপস্থিত সকলে চেঁচিয়ে বলল, “সারপ্রাইজ!”
সেলিনা হকের চোখ যেন কপালে উঠে গেল। তিনি বুঝতে পারছেন তাঁর জন্যেই বাড়িতে এত এত আয়োজন করা হয়েছে। তবে কেন করা হয়েছে ঠিক বুঝতে পারছেন না।
অবাক গলায় সকলকে প্রশ্ন করছেন, “আজ কী? আজ কী?”
আশফিয়া হাসিমুখে বলল, “আজ তোমার জন্মদিন মা!”
সেলিনা হকের বিস্ময়ের কোনো সীমাই রইলো না। তাঁর আবার জন্মদিন আছে না-কি? কই, আগে তো কেউ বলেনি! এরা সকলে খুঁজে বের করলো কী করে?
তিনি সকলকে একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। সকলেও ধৈর্য নিয়ে হাসিমুখে তাঁর জবাব দিয়ে যাচ্ছে। কৃতজ্ঞতায় তাঁর চোখ সকল হয়ে উঠলো। এতগুলো মানুষ কাজ ফেলে শুধুমাত্র তাঁর জন্যে সিলেটে ছুটে এসেছে?
আরশাদ আর আশফিয়ার বিশেষ উপহারটা হলো একটা স্বর্ণপদক। তাতে লেখা, ‘মা তুমিই সেরা’। আজকের দিনটা আচমকা সেলিনা হকের জীবনের শ্রেষ্ঠতম দিনে পরিণত হলো।
এবার সময় এলো কেক কাটা পর্বের। মাকে সারপ্রাইজ দেওয়া নিয়ে আরশাদ এতটাই ব্যস্ত ছিল যে কেকের দিকে ঠিক খেয়াল করে উঠতে পারেনি। এবার দুটো কেকের দিকে চোখ পড়তেই ক্ষীণ সন্দেহ জেগে উঠলো তার মনে। সকল সন্দেহ রনিদের বানানো কেকটার ওপরে। কয়েক মুহূর্তের জন্যে আরশাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি পড়লো অরার ওপরে। অরা হাসিমুখে তার শাশুড়ি আর কথার ছবি তুলে দিচ্ছে।
আরশাদ আগে থেকেই আঁচ করেছিল এই কেক রনিরা বানায়নি। এত সাধ্য তাদের নেই। কেক কাটা পর্ব শেষে কেক খেয়ে সেই ধারণা আরও দৃঢ় হলো। এই স্বাদ খুব ভালো করেই তার চেনা।
রনি এগিয়ে এসে একগাল হেসে বলল, “ভাইয়া? কেকটা কেমন হয়েছে?”
আরশাদ উত্তরে কিছুই বলল না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো রনির দিকে। দৃষ্টি দিয়েই বুঝিয়ে দেওয়া তার কারচুপি আরশাদ ধরে ফেলেছে। সেই থেকে রনি আর আকাশ কোথায় যেন উধাও। তাদের আর খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না।
কেক নিয়েও আর কিছু বলল না আরশাদ। অদ্ভুত সুন্দর উৎসবমুখরতা চলছে বাড়িজুড়ে।
এই পরিবেশটা শুধু শুধু নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। তাছাড়া এমন গুরুতর কোনো পাপও করেনি ওরা। অরাকে পরে দেখে নেওয়া যাবে। মেয়েটা আজকাল কোনো কথাই শুনতে চাইছে না। তাকে যা করতে বারণ করা হয়, সে ঠিক সেটাই করছে। এভাবে তো চলতে দেওয়া যায় না। কঠোর একটা শাস্তি এবার অরাকে দিতেই হবে।
অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে রাত বারোটা। পরিবারের সকলে মিলে হইচই আর আড্ডার মাঝে অদ্ভুত একটা সময় পার করে দিলো। সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে সকলেই ক্লান্ত। যে যার মতো করে তাই ঘুমাতে চলে গেল। কাল সকালেই তো আবার ঢাকার ফ্লাইট। আজ শেষ দিন বলে কথা ঘুমাতে গেল দিশা এবং মেহেরের সঙ্গে। এই কদিনে ওরা দুজন তার বেশ ভালো বন্ধুতে পরিণত হয়েছে।
ফ্রেশ হয়ে এসে বালিশে মাথা রাখলো অরা। আজকাল অল্পতেই বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়ে সে। কাল ঢাকায় ফিরে যাচ্ছে অথচ গোছগাছ এখনো করা হয়নি। তীব্র ক্লান্তি এসে জড়িয়েছে সমস্ত শরীরে। গোছগাছ না হয় কাল সকালে করা যাবে।
এতক্ষণে আরশাদও ফ্রেশ হয়ে এসেছে। কালো টি-শার্ট এবং কালো ট্রাউজারে তাকে দেখতে অপূর্ব লাগলো। অরার চোখে ঘোর লেগে গেল। দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনও বোধ করছে না।
আরশাদ বিছানায় অরার পাশে বসতে বসতে হালকা গলায় বলল, “কী সর্বনাশ! আমার বউই যদি আমার দিকে এমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে, তাহলে বাকিরা কী করবে।”
মুহূর্তেই লজ্জা পেয়ে চোখ সরিয়ে নিলো অরা।
পায়ের কাছে রাখা ব্যাঙ্কেটের ভাঁজ খুলতে খুলতে আরশাদ বলল, “কেকটা কতক্ষণে বানালে?”
অরা উঠে বসে অবাক গলায় বলল, “তুমি বুঝলে কী করে?”
আরশাদ পাল্টা উত্তর দিলো, “আমি যে বুঝবো না, এটা তুমি ভাবলে কী করে?”
অরা আমতা আমতা করে বলল, “সরি আরশাদ। রনি আর আকাশ একেবারেই কেক বানাতে পারে না। আমার কাছে এসে এত করে রিকুয়েস্ট করলো তাই…”
আরশাদ গায়ে ব্যাঙ্কেট টেনে বিছানায় হেলান দিয়ে বসতে বসতে বলল, “বানিয়েই যখন ফেলেছো তখন এত কৈফিয়ত দেওয়ার কী আছে?”
অরা খানিকটা স্বস্তি পেয়ে বলল, “তার মানে তুমি রাগ করোনি?”
আরশাদ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “হ্যাঁ করেছি। তুমি আমার কথা না শুনলে আমি রাগ না করে পারি?”
মনে মনে মৃদু ধাক্কা খেল অরা। এ জীবনে অগণিতবার রাগতে দেখেছে সে আরশাদকে। তবে কোনোবারই তো রাগের এমন বহিঃপ্রকাশ ঘটেনি।
আরশাদ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, “এখন তোমাকে শাস্তি পেতে হবে।”
অরা সংশয়মাখা গলায় বলল, “কী শাস্তি?”
আরশাদ দুষ্টুমির সুরে বলল, “আজ থেকে আগামী সাত দিন প্রতি রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে আর সকালে ঘুম থেকে উঠে তুমি আমাকে গুণে গুণে একশ.. না! দুইশটা চুমু দিবে।”
সঙ্গে সঙ্গে রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো অরার গালদুটো। বিয়ের এতগুলো দিন হয়ে গেল, অথচ এই ছেলের অসভ্যতা আর গেল না!
অরা লজ্জারাঙা গলায় বলল, “কী? এটা আবার কোন দেশি শাস্তি?”
“বাংলাদেশি শাস্তি।”
“আমি এসব শাস্তি-টাস্তি মানতে পারবো না।”
আরশাদ মজার ছলে বলল, “ভালো শাস্তি দিলাম তো, মানবে কী করে? নাহ্! এ পৃথিবীতে ভালো মানুষের দাম নেই। কঠিন শাস্তিই দিই তাহলে। বাবু আসার আগ পর্যন্ত বাড়ির বাইরে বের হতে পারবে না তুমি। শুধু বাড়ির বাইরে কেন, বেডরুম থেকে লিভিং রুমেও যেতে পারবে না।”
অরা ভ্রু কুঁচকে বলল, “ভয় দেখাচ্ছো?”
“সত্যি বলছি। সত্যি কথায় তুমি ভয় পেলে আমার কী করার?”
আরশাদের কথার কোনপ্রকার উত্তর না দিয়ে অরা ব্যাঙ্কেট টেনে শুয়ে পড়লো তার পাশে।
কয়েক মুহূর্ত কেটে যেতেই আরশাদ অরার চুলে হাত বুলিয়ে বলল, “তো কী ঠিক করলে?”
অরা না বোঝার ভান করে বলল, “কোন বিষয়ে?”
“কোন শাস্তিটা নেবে? ভালোটা না-কি খারাপটা?”
অরা হাই তুলতে তুলতে বলল, “কোনোটাই না।”
“একটা তো নিতেই হবে অরা। তুমি ভালোমানুষী করে কেক বানাতে পারবে, অকারণে ধকল নিতে পারবে আর শাস্তি নিতে পারবে না। এটা কেমন কথা?”
চুপ করে রইলো অরা। বেশ বুঝতে পারছে আজ তার নিস্তার নেই। এই ছেলে তাকে দিয়ে নিজের উদ্দেশ্য সফল করিয়ে তবেই ছাড়বে।
আরশাদ রহস্যের হাসি হেসে বলল, “শুধু শুধু সময় নষ্ট না করে চুমুগুলো দিয়ে ফেলো না। জানোই তো সেই সাত সকালে উঠতে হবে।”
“এত অসভ্য কেন তুমি?”
“তোমার মতো বউ পেলে মানুষকে একটু-আধটু অসভ্য হতেই হয়। এখন কথা না বলে কাজ শুরু করো তো!”
অরা এক হাত আরশাদের গালের ওপরে রেখে আরেক গালে দিলো তার ঠোঁটের মোহনীয় স্পর্শ। এখন তার লজ্জা করছে না। ভালোবাসা-বাসির এই মুহূর্তগুলো তার মাঝে প্রকান্ড এক ভালো লাগার ঝড়ের সৃষ্টি করে।
(চলবে)