#ফিরে_আসা২
৯
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
কথার ঘরটা পরিষ্কার করা হচ্ছে। দুজন স্টাফ দুদিকে কাজে লেগে আছে। আর বিছানার ওপর পা তুলে তাদের কাজের তদারকি করছে অরা। আজ তার অফিসে মিটিং দুপুরের পর। তাই সকাল সকাল আর অফিসে যায়নি। আরশাদ কথাকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে শুটিংয়ে গেছে।
যথেষ্ট গোছানো মেয়ে কথা। তার খেলনা, পড়ার বইখাতা, গল্পের বই – সব গুছিয়ে রাখতে হবে নির্দিষ্ট জায়গায়। জিনিসগুলো একটু এলোমেলো হলেই মুখ ভার করে থাকবে মেয়েটা। তাই অরার এই বাড়তি তদারকি। একজন স্টাফ কথার বুকশেলফটা গোছাতে ব্যস্ত। বইগুলো সব মেঝেতে নামিয়ে রেখে শেলফ পরিষ্কার করছে।
হঠাৎই অরার চোখে পড়লো ওই অচেনা মোড়কের ড্রইং খাতাটা। নিতান্তই কৌতুহলের বশে খাতাটা হাতে তুলে নিলো অরা। অসম্ভব সুন্দর ছবি আঁকে মেয়েটা। তার বয়সী বাচ্চারা ছবি আঁকার সময় খেয়াল রাখে, ছবিটা যেন সুন্দর হয়। কোনো মানুষের ছবি আঁকতে গেলে তার হাত-পা যেন নিখুঁত হয়। রঙ যেন বর্ডারের বাইরে না যায়। কথা অবশ্য ছবি আঁকার সেসব বাঁধাধরা নিয়ম মেনে চলে না। এটাই তার ছবির সবথেকে বড় সৌন্দর্য।
কথার মতে এই খাতার ছবিগুলো না-কি ‘পচা ছবি’। তাই দেখায়নি কাউকে। তবে অরা জানে, কথার কোনো ছবিই পচা হতে পারে না। যেগুলোকে সে পচা বলছে, সেগুলোও হবে সুন্দরের অধিক।
খাতাটা খুলতেই অবাক হয়ে গেল অরা। চমৎকার একটি ছবি। লেকের পাড়ে ফুলের বাগান। বাগানের সবগুলো ফুল হালকা বেগুনি রঙের। আকাশে লাল-কমলা খেলা করে বেড়াচ্ছে। দুয়েকটা পাখিও উড়ে বেড়াচ্ছে। ফুলের বাগানের মাঝে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছে শাড়ি পরিহিত এক নারী এবং ফ্রক পরা ছোট্ট একটি মেয়ে। দুজনের পিঠ দেখা যাচ্ছে, মুখ দেখা যাচ্ছে না।
পাতা উল্টালো অরা। এই ছবি ওই ফ্রক পরা ছোট্ট মেয়েটা সাইকেল চালাচ্ছে। এবার তার মুখ দেখা যাচ্ছে। হাসিতে মাখামাখি একটি মুখ। তার পিছে ছুটছে শাড়ি পরিহিত ওই নারী। তার মুখেই একই হাসি। আবারও পাতা উল্টলো অরা। পরের ছবিতেও এই দুজন। আয়নার সামনে হাস্যোজ্বল ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে তারা।
পাতা উল্টে উল্টে একেবারে শেষ প্রান্তে চলে গেল অরা। পুরো খাতা জুড়েই কেবল এই দুজনের ছবি। কোনো কাল্পনিক চরিত্রের ছবি কথা আঁকে না। তার পেন্সিলে কেবলই ফুটে ওঠে বাস্তবিক চরিত্রেরা। সে তার বাবাকে আঁকে, অরাকে আঁকে, স্কুলের বন্ধুদেরও আঁকে। এই খাতাজুড়ে কাকে এঁকেছে সেটাও বেশ বুঝতে পারছে অরা। তবুও নিজের মনকে যেন বুঝ দিতে চাইছে অন্য কিছু।
আনমনেই খাতার একেবারে শেষ পাতায় চোখ পড়লো অরার। এখানে কোনো ছবি নেই। সাদা পাতার এক কোণায় পেনসিল দিয়ে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা, ‘কথা আর মা’। নিজেকে আর অন কিছু বুঝ দিতে চেয়েও লাভ হলো না। অরার ধারণাই সত্যি হলো।
মা। এই ডাকটা কথা একজনকেই ডাকে। মা বলতে সে ওই একজনকেই চেনে। অরার মনের মাঝে একখণ্ড কালো মেঘ একে জমা হলো। মায়ের কথা সে প্রথম প্রথম জিজ্ঞেস করলেও একটা সময়ে বন্ধ করে দেয়। প্রায় এক বছর তো হলোই তার মুখে মাকে নিয়ে কোনোপ্রকার প্রশ্ন শোনেনি কেউ। তবে মনে মনে সে ঠিকই পুষে রেখেছে মায়ের খোঁজ। মাকে দেখার আকাঙ্ক্ষা।
অরা কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। আরশাদের সঙ্গে কথা বলবে ব্যাপারটা নিয়ে? না-কি কথাকে জিজ্ঞেস করে দেখবে? কথাকে জিজ্ঞেস করার মানেই তো বেচারির অতটুকু মস্তিষ্কের ওপর চাপ প্রয়োগ করা। নিদারুণ দ্বিধায় পড়ে গেল অরা।
দুপুরের আগ দিয়েই অরা বেরিয়ে গেল। ডাক্তার তাকে কড়াভাবে ড্রাইভ করতে নিষেধ করে দিয়েছে। তার ড্রাইভার রমিজ গাড়ি চালাচ্ছে। রমিজের পাশে প্যাসেঞ্জার সিটে বসে রয়েছে অরার বডিগার্ড জহুরুল। সবার আগে অরা গেল কথাকে স্কুল থেকে তুলতে।
কথা উঠে আসতেই আবারও গাড়ি চলতে শুরু করলো ঢাকার ব্যস্ত রাস্তায়। অরা লক্ষ্য করলো সেই তখন থেকে মুখটা ভাড় করে রেখেছে কথা।
অরা কোমল স্বরে বলল, “মুড অফ?”
কথা গাল ফুলিয়ে রেখেই বলল, “হুঁ!”
অরা চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, “ওমা! কেন?”
কথা আক্ষেপের সুরে বলল, “আমি আর স্কুলে যাবো না অরা।”
“স্কুলে যাবি না কেন?”
কথা স্কুলব্যাগের চেন খুলে একটা খাতা বের করলো। তার ক্লাসটেস্টের খাতা। বিশে সতেরো পেয়েছে কথা।
অরা প্রচ্ছন্ন এক হাসি হেসে বলল, “গ্রেট জব সোনা!”
কথা গোমড়া মুখে বলল, “মোটেও গ্রেট জব না! তুমি দেখো, আমি সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি। তাও মিস আমাকে বিশ না দিয়ে সতেরো দিয়েছি। আমি যখন মিসকে বললাম, সে আমাকে বকা দিয়ে বলল, জায়গায় গিয়ে বসো।”
ছেলেমানুষের ছেলেমানুষী! না হেসে পারলো না অরা।
কথা আহত গলায় বলল, “তুমি হাসছো?”
অরা হাসি থামিয়ে বলল, “আচ্ছা কথা? তোর ফ্রেন্ডরা কত পেয়েছে?”
কথা খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, “স্নেহা পনেরো পেয়েছে। আর নায়লা তেরো। নীতি একটু কম পেয়েছে, নয়। তাই ওর মন খারাপ।”
“কেউই কিন্তু সতেরো পায়নি। তুই পেয়েছিস। ওরা তো চাইলেই ভাবতে পারে, আমি যদি কথার মতো নম্বর পেতাম! ওরা তো আর জানে না, এদিকে কথাও তার নম্বরের জন্য আফসোস করছে।”
কথা কিছু বলল না। গভীর চিন্তা-ভাবনায় ডুবে গেল।
অরা হাসিমুখে বলল, “আমাদের যা আছে তাই নিয়ে খুশি থাকা উচিত। যে যেমন প্রিপারেশন নিয়েছে, সে তো তেমন নম্বরই পাবে। তোর প্রিপারেশন ভালো ছিল, তাই তুই নম্বরও ভালো পেয়েছিস। আর যার প্রিপারেশন খারাপ ছিল সে পেয়েছে কম নম্বর। তুই সতেরো পেয়ে দুঃখ করছিস! তাহলে একবার নীতির কথা চিন্তা কর। ও তোর থেকে কত কম পেয়েছে। অন্যের দুঃখের কথা চিন্তা করলেই তোর নিজের দুঃখটা কমে যাবে।
কথা চমকে উঠে বলল, “তাই তো! তাহলে আমি আর মন খারাপ করবো না?”
“একদমই না!”
কথা সঙ্গে সঙ্গে বাধ্য মেয়ের মতো পরীক্ষার খাতাটা ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখে হাসিমুখে বসে রইলো। মেয়েটার এই হাসিটা অদ্ভুত সুন্দর। তার হাসির সঙ্গে আরশাদের হাসির অনেক মিল রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই বাবার সঙ্গে মিল রয়েছে তার।
অরা একবার ভাবলো কথাকে ওই ছবিগুলোর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করবে। এত বড় একটা ব্যাপার চোখে পড়েও এড়িয়ে যাওয়ার অর্থ হয় না। অরা সঙ্গে করে হ্যান্ডব্যাগে নিয়ে এসেছে ওই ড্রইং খাতা। তবে জিজ্ঞেস করতে গিয়েও থেমে গেল সে। এই পরিবেশটা মোক্ষম নয়।
ড্রাইভার আর বডিগার্ড বসে আছে সামনের সিটে। এদের সামনে কথা মন খুলে কথা বলবে না।
অরা কথার মাথার হাত বুলিয়ে দিয়ে অন্যরকম গলায় বলল, “আজ আমার সঙ্গে অফিসে যাবি?”
কথা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে বলল, “হ্যাঁ যাবো!”
কথাকে নিয়ে অফিসে এসেই কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো অরা। তবে মস্তিকের প্রতিটি কোষে যেন স্থায়ী হয়ে গেঁথে রইলো কথার আঁকা ওই ছবিগুলো। আনমনেই মেয়েটার দিকে চোখ পড়লো তার। টিভিতে কার্টুন দেখছে আর মুখ টিপে টিপে হাসছে। হাস্যোজ্বল-প্রাণবন্ত এক দেবশিশু। বাইরে থেকে যে মেয়েটা এতটা প্রাণচাঞ্চল্যে পরিপূর্ণ, ভেতরে ভেতরে না জানি সে কোন মানুষটাকে পুষে রেখেছে!
দুপুরের আগ দিয়ে অরার মনে হলো, এভাবে হাত গুটিয়ে বসে থাকা যাবে না। কথা বলতে হবে মেয়েটার সঙ্গে। তার ভেতরটাকে বুঝতে চেষ্টা করতে হবে। কথার মতো বয়সে এক ভয়ংকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিল অরা। প্রতিটা দিনই তার কাটতো কষ্টের মাঝে। নতুন মায়ের অত্যাচারের ভয়ে-আতঙ্কে মানসিক বল একেবারেই হারিয়ে ফেলেছিল সে। প্রত্যেকটা মানুষেরই তো শৈশবের হাজারো সুখস্মৃতি থাকে। অরার তেমন কোনো স্মৃতিই নেই। কথাকে এই একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে দেওয়া যাবে না, কখনোই না।
হ্যান্ডব্যাগ থেকে ড্রইং খাতা বের করে ছোট ছোট পা ফেলে অরা এগিয়ে গেল সোফার দিকে। কথা সোফার ওপরে আধশোয়া হয়ে টিভি দেখছে। অরা তার পাশে বসে কতক্ষণ কার্টুন দেখলো। কার্টুনের চরিত্রের নিয়ে প্রশ্ন করে পরিবেশটাকে হালকা করার চেষ্টা করলো।
অবশেষে লম্বা এক শ্বাস নিয়ে বলল, “কথা?”
“হুঁ?”
পাশ থেকে ড্রইং খাতাটা এনে কথার সামনে রাখলো অরা। কথা খানিকটা চমকে গেলেও তার মধ্যে কোনো জড়তা নেই। এমন ভাব নেই যে কোনো অপরাধ করতে গিয়ে ধরা পড়েছে।
অরা যথাসাধ্য স্বাভাবিক গলায় বলল, “আজ এই ছবিগুলো দেখছিলাম। কত সুন্দর সুন্দর ছবি! আগে দেখাসনি কেন আমাকে?”
কথা শুকনো গলায় বলল, “এমনি।”
অরা কয়েকমুহূর্ত অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল কথার দিকে। কী নিষ্প্রভ মেয়েটার মুখভঙ্গি! এমনটা তো হয় না কখনো। কথা তো সারাদিনই হাসিমুখে থাকে!
“এমনি এমনি কেউ ছবি লুকিয়ে রাখে?”
ছবিগুলো এতদিন লুকিয়ে রাখলেও সত্যিটা গোপন করার কোনো প্রয়াস কথার মাঝে নেই।
অস্পষ্ট গলায় সে বলল, “এই ছবিগুলোতে আমি কথা আর মাকে এঁকেছি। মায়ের কথা জিজ্ঞেস করলেই তো বাবা এড়িয়ে যায়। আমি ভাবলাম, ছবিগুলো দেখালে হয়তো রাগ করবে।”
অরা কথাকে কাছে টেনে নিয়ে আদুরে গলায় বলল, “কথার ছবি দেখে বাবা কখনো রাগ করতে পারে সোনা?”
কথা অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল, “আচ্ছা অরা? মা এত পচা কেন? সেই কবে বেড়াতে গেছে। এখনো ফিরে আসলো না।”
অরার বুকটা ধ্বক করে কেঁপে উঠলো। এতটুকু একটা মেয়ের এতটুকু হৃদয়। মায়ের কথা ভেবে ভেবে না জানি কবে থেকে উতলা হয়ে আছে সে। না জানি কতটা মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে সে।
অরা আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “আসবে তো সোনা। খুব শীঘ্রই ফিরে আসবে। মা কখনো পচা হয়?”
“কবে আসবে অরা? আমি সেই কবে থেকে ওয়েট করছি!”
গভীর অপরাধবোধ নিঃশেষ করে দিচ্ছে অরা। এত বড় একটা ভুল কী করে করলো সে? মায়ের জন্যে যে মেয়েটার মন কেমন করতে পারে, এই চিন্তা তার মাথাতেই এলো না কেন কখনো?
মানুষ শুধু বাইরে থেকেই একটা বাচ্চার যত্ন নেয়। খিদে পেলে পরম যত্নে খাইয়ে দেয়, ব্যথা পেলে ওষুধ লাগিয়ে দেয়। তবে মনটার খবর কেউই নেয় না। অরা যেমন নেয়নি।
অরা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “মাকে খুব মিস করিস তাই না?”
কথা নিঃশঙ্কোচে বলল, “হুঁ। আগে মাঝে মাঝে মা আমাকে পার্কে নিয়ে যেত। আমি খেলতাম আর মা বসে থাকতো। বাসায় ফেরার পথে আমরা আইস্ক্রিম খেতাম। আমার আর মায়ের মাঝে তখন কম্পিটিশন শুরু হতো। কে আগে আইস্ক্রিম শেষ করতে পারে।”
“এই কথাগুলো আগে বলিসনি কেন?”
“বললে তো ওই একই কথা বলতে। মা বেড়াতে গেছে।”
দুপুরটা তাদের ম্লানভাবেই কেটে গেল। কথা আর টিভির দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হাসলো না। অরাও ডুবে যেতে পারলো না কাজের মাঝে। বুকের ওপর কেউ যেন ভারী পাথর চেপে ধরেছে রেখেছে। শ্বাস নেওয়াও তাই হয়ে উঠেছে দুঃসাধ্য।
এমন তো নয় যে আরশাদ বা অরা কথাকে খুব কড়া শাসনের মধ্যে রাখে। শাসন জিনিসটা যে কী, কথা তাই জানে না। বাবা কথার সবথেকে প্রিয় মানুষ। তার মনে জমে থাকা সব কথাগুলো বলে দেয় তাকে। আর অরা তো তার বেস্ট ফ্রেন্ড। এই দুজনের আশেপাশে থেকেও কেন মনের কথাটা বলতে পারলো না কথা? একবার বললেই তো পারতো, “আমি মাকে মিস করি।”
বলতে পারেনি তার কারণটা মূলত আরশাদ এবং অরাই। আরশাদ বরাবরই মেয়েকে বলে আসছে, “মা বেড়াতে গেছে।” এই তিন শব্দের বাক্যের বাইরে মায়ের বিষয়ে আর কোনো কথাই বলেনি সে। বারবার এড়িয়ে গেছে প্রসঙ্গ। তাই তো মেয়েটা শেষমেশ ক্লান্ত হয়ে লুকিয়ে রেখেছে মনের অনুভূতিগুলো।
আরশাদকে ক্ষেত্রে দোষারোপ করা যায় না। গত আড়াই বছর ধরে নওশীন জেলে। কথা চাইলেও তো আর দেখা করতে পারতো না তার মায়ের সঙ্গে। আর সত্যির মুখোমুখিও তাকে হতে দেওয়া যাবে না। আরশাদ তাই চেয়েছে মেয়েকে মায়ের কথা ভুলিয়ে রাখতে। তবে সন্তান কি আর মাকে ভুলতে পারে?
কিছুই বুঝতে পারছে না অরা। ভেতরে ভেতরে হাজারো দ্বিধা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে তাকে। অরার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তীক্ষ্ণ। এই বিশাল কোম্পানির বড় বড় সিদ্ধান্তগুলো তো তাকেই নিতে হয়। তবে জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার বেলায় বারবারই থমকে যায় সে।
জীবনের কোনো পর্যায়ে আটকে গেলে অরা একটা মানুষেরই দ্বারস্থ হয়, সীমা। অফিস থেকে বাড়ি ফিরে অরা ফোন করলো সীমাকে। প্রথম থেকে খুলে বলল পুরো ঘটনা। ইয়াসমিন বেগমের দেখা করতে আসা, আরশাদের বারণ, অরার ব্যাপারটাকে একেবারেই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলা আর সবশেষে কথার আঁকা এই ছবিগুলো।
সবটা শুনে সীমা আঁতকে উঠে বলল, “তুই কি একেবারেই পাগল হয়ে গেলি অরা? মাথায় যে কটা স্ক্রু ছিল সব খুলে পড়ে গেছে?”
অরা থমথমে গলায় বলল, “একটা সিরিয়াস বিষয়ে কথা বলছি, আর তুই আছিস ফাজলামি নিয়ে।”
“না আমি ফাজলামি করছি না। আমিও সিরিয়াস। তুই কি চাইছিস? কথা ওই ডাইনি, শাকচুন্নি, বেয়াদব মহিলাটার সাথে দেখা করুক? না মানে, তুই কী হ্যাঁ? মাদার তেরেসা? ভালোমানুষির দেবী? একটা মহিলা হাজারটা অপরাধ করলো, তোকে কিডন্যাপ করিয়ে আরেক দেশে পাঠিয়ে দিতে চাইলো – আর তুই কথাকে তার সঙ্গে দেখা করতে দিবি?”
অরা চিন্তিত গলায় বলল, “আমি প্রথমে তো চাইনি। তোকে তো বললাম উনার মা আমার অফিসে এসেছিল, বেশ কয়েকবার ফোনও দিয়েছিল। আমি তো সঙ্গে সঙ্গে আবেগের বশে কথা নিয়ে যাইনি তার সঙ্গে দেখা করাতে। আরশাদ স্ট্রিক্টলি বলে দিয়েছিল ও চায় না ওই মানুষটার ছায়াও কথার উপর পড়ুক। আমিও ওর কথা মেনেছি। উনার মাকে এড়িয়ে গেছি। কিন্তু আজ যা হলো তার পরেও হাত গুটিয়ে বসে থাকতে বলছিস?”
“কথা বাচ্চা মানুষ। ও কি আর বোঝে ওই মহিলা কতটা ডেঞ্জারাস? বুঝলে আর মিস করতো না।”
“কোনো ডেঞ্জারাস মানুষকে মিস করে না সীমা। মিস করে নিজের মাকে। আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল। আমি তো ভেবেছিলাম কথা ওর মায়ের কথা ভুলেই গেছে।”
সীমা সাবধান করার ভঙ্গিতে বলল, “কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিস না অরা, যার জন্যে পরে তোকে রিগ্রেট করতে হয়।”
অরা উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “বাচ্চাটা ভেতরে ভেতরে ট্রমাটাইজ সীমা। অতটুকু একটা মেয়ে ভেতরে এমন কষ্ট পুষে রেখে বাইরে এমন একটা ভাব করছে যেন সব ঠিক আছে, তুই বুঝতে পারছিস ব্যাপারটা কত ভয়ঙ্কর?”
সীমা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, “তোর নিজের ট্রমার কথা মনে পড়ছে তাই না?”
অরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “হুঁ। আমার ছোটবেলাটা তো ধ্বংস হলোই। আমি চাই না কথার ছোটবেলাটাও একইভাবে শেষ হয়ে যাক।”
“একদিন মায়ের সঙ্গে দেখা করেই বুঝি ওর ট্রমা কেটে যাবে?”
“মনটা শান্ত তো হবে!”
সীমা পরামর্শ দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “আমি বলি কী, আরশাদ ভাইয়ার সাথে এই ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলে দেখ।”
“না সীমা। আরশাদ বুঝবে না। শুধু শুধু রাগ করবে।”
“আমি আবারও বলছি অরা, ওই মহিলা কিন্তু ডেঞ্জারাস। হতেই পারে এটা তার প্ল্যানের কোনো অংশ। কথার সাথে দেখা করে ওকে এমনভাবে ব্রেইনওয়াশ করলো, যে মেয়েটা আর থাকতেই চাইছে না তোদের কাছে।”
সীমার কথাটায় অরার চিন্তা যেন হাজারগুণ বেড়ে গেল। কিছুতেই সে ভেবে পাচ্ছে না কী করবে।
(চলবে)