ফিরে_আসা ২৩ লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

0
730

#ফিরে_আসা
২৩
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

‘বন্ধুত্ব’ শব্দটার তাৎপর্য একেকজনের কাছে একেক রকম। কারও মতে বন্ধু ছাড়া এই পৃথিবীতে টিকে থাকাই সম্ভব নয়। আবার কারও কারও মতে মতে বন্ধুত্ব কেবলই ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা। কারও কারও বন্ধুত্ব এতটাই দৃঢ় যে তা টিকে যায় আজীবন, আর কারও এতটাই ঠুনকো যে তাতে বিশ্বাস জন্মানোর আগেই মরে যায়।

বন্ধু কে? যার কাছে প্রাণ খুলে মনের কথা বলা যায় সেই বন্ধু। নওশীনের জীবনে একটা সময়ে প্রাণ খুলে কথা বলার মানুষের অভাব ছিল না। সেই মানুষগুলো ধীরে ধীরে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। তবে একজনের কথা তার মনে পড়েছে কানাডায় এসে, অ্যানি। এটা তার আসল নাম নয়, আনিকা থেকে অ্যানি হয়েছে। ভার্সিটি জীবনে দুজনের গভীর বন্ধুত্ব ছিল, অ্যানি বিয়ের পর কানাডায় চলে আসায় সেই বন্ধুত্বে বেঁধে যায় দূরত্ব। এত বছর পর আজ পুরোনো বন্ধুকে ফিরে পেয়ে মনের সব কথাগুলো একেক করে খুলে বলছে নওশীন।

প্রতিটা মানুষের কাছেই নানা রঙের নানা মুখোশ থাকে। পরিস্থিতি বিবেচনা করে তাকে সেই মুখোশ পড়তে হয়। সবসময় যে মুখোশ ব্যবহার করতেই হবে এমনটাও নয়, ব্যবহার না করলেও ক্ষতি নেই। তবে নওশীনের অভ্যাস হলো প্রতিটা মুহুর্তে, প্রতিটা মানুষের সামনে মুখোশ পড়ে থাকা, প্রকৃত নিজেকে প্রকাশ না করা। আজ এতদিন পর অ্যানির সঙ্গে মন খুলে কথা বলতে এসেছে বলেই হয়তো নিজের সবগুলো মুখোশ খুলে রেখে এসেছে।

অ্যানি কফির মগ টেবিলে নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল, “মানে কী এসবের? তুই আরশাদের কাছে ফিরতে চাচ্ছিস? তাহলে ডিভোর্স নিয়েছিলি কেন?”

নওশীনের কফির মগ হাতে নিয়ে তাতে ছোট্ট চুমুক দিয়ে বলল, “বাধ্য হয়ে ডিভোর্স নিয়েছি। আরশাদ জীবনেও আমাকে ডিভোর্স দিতো না। আজীবন ধরে রাখতো, আর চিট করার খোঁটা দিতো। আমি কেন শুধু শুধু কারও খোঁটা সহ্য করতে যাবো? আমি তো চিট করিনি। আমার জন্যে তার কোনোদিনই সময় ছিল না তাই আমি অন্য আরেকজনের কাছে গিয়েছি। দোষ করেছি কোনো?”

আরশাদের প্রসঙ্গে কোনো কথা বলতে গেলেই নওশীন সবসময় বাড়তি আহ্লাদ যোগ করে তাকে ‘শাদ’ বলে সম্বোধন করে। নিঃসন্দেহে তা মন থেকে করে না। আজ কোনো মুখোশ নেই বলেই হয়তো আরশাদকে তার নিজের নামেই ডাকতে পারছে সে।

“তা না। কিন্তু এখন আবার এক হতে চাচ্ছিস কেন?”

নওশীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমার ক্যারিয়ার ডুবতে বসেছে অ্যানি। গতবছর ঘটা করে ঘোষণা দিলাম আবার সিনেমায় ফিরবো, কিন্তু এখন পর্যন্ত একটাও সিনেমার অফার আসেনি আমার কাছে। প্রোডিউসাররা আমাকে সিনেমায় নিতে ভয় পাচ্ছে।”

“ক্যারিয়ার বাঁচাতে আরশাদকে ধরতে হবে কেন? অন্য কোনো নায়কের সঙ্গে প্রেম কর! কিংবা প্রোডিউসারের সঙ্গে।”

“সেটা তো চাইলেই করতে পারি। কিন্তু আরশাদ এই ইন্ডাস্ট্রির একপ্রকার মাফিয়া। ধর অন্য কোনো নায়কের সাথে সিনেমার শুটিং করে ফেললাম, তবুও আরশাদের এক কথায় কোনো হল মালিক সেই সিনেমা চালাবে না। রিলিজের আগেই ফ্লপ!”

অ্যানি দৃঢ় গলায় বলল, “আরশাদ তোকে মাফ করবে না নওশীন।”

নওশীন বিরক্ত গলায় বলল, “ওর মাফ চেয়েছে কে? আমি তো কোনো ভুল করিনি যে ওকে মাফ করতে হবে। আমি শুধু চাই কোনো ক্রমে ওর জীবনে ফিরে যেতে। ফিরে গিয়েই চট করে ওর সঙ্গে একটা সিনেমা সাইন করতে।”

“কিন্তু সেটা করবি কী করে?”

নওশীন হতাশ গলায় বলল, “কিছুই বুঝতে পারছি না। এত কষ্ট করে একটা প্ল্যান করলাম কিন্তু কবিরের জন্য সেটাও ভেস্তে গেল।”

“নওশীন?”

“হুঁ?”

“কবিরের বাচ্চাটা কি আসলেই মিসক্যারেজ হয়ে গিয়েছিল?”

“আরে না! অ্যাবর্শন করে ফেলেছি।”

অ্যানি অবাক গলায় বলল, “কিন্তু কেন? বাচ্চাটার তো কোনো দোষ ছিল না।”

নওশীন ভ্রু কুঁচকে বলল, “বোকার মতো কথা বলিস না তো অ্যানি। ডিভোর্সের পর আচমকা একটা বাচ্চা নিয়ে কীভাবে হাজির হতাম মানুষের সামনে? ক্যারিয়ার তো শেষ হয়ে যেতই, আরশাদের ফ্যানরা মিলে নির্ঘাত আমাকে বয়কট করতো।”

“আমার মনে হয় তোর আরশাদের ফিরে পাওয়ার চিন্তাভাবনা না করাই ভালো। It’s next to impossible.”

নওশীন দৃঢ় আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল, “I will make that possible. আরশাদকে আবারও আমার হতেই হবে। তার জন্যে যা যা প্রয়োজন, আমি তাই করবো।”

নওশীন আর অ্যানির বন্ধুত্ব খুব একটা সুবিধার নয়। অ্যানি ভেতরে ভেতরে পছন্দ করে না নওশীনকে, সবসময় চেয়েছে একটা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে। নওশীন যে তাকে খুব একটা পছন্দ করে তাও নয়। তবুও এতদিন পর দেখা করে মনের কথা বলছে। মুখোশ পড়ে সকলের সঙ্গে মিশতে মিশতে এমন একটা অবস্থা হয়ে গেছে যে চাইলেই কারোর সঙ্গে মনের কথা বলতে পারে না।

বন্ধুত্বের উৎকৃষ্ট উদাহরণ অরা এবং সীমা। তারা একে অপরের সঙ্গে মন খুলে কথা বলে, হাসাহাসি করে, রাগারাগি করে, মজা করে তার থেকেও বড় কথা কোনো একজন ভুল পথে যাওয়ার চেষ্টা করলেও আরেকজন গিয়ে তার পথ আটকে দেয়।

উপুড় হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে সীমা। তার হাতে একটা ছবির ফ্রেম। ফ্রেমে বাঁধাই করা তার এবং আরশাদের ছবি। গত পরশু আরশাদের বাড়িতে তোলা ছবিটা। এই দুই দিনে হাজারবার ছবিটা দেখেছে এবং হাজারবার মুগ্ধ হয়েছে সীমা। এক মুহুর্তের জন্যে হাতছাড়া করেনি ফ্রেমটাকে।

সীমা ছবির দিকে তাকিয়ে থেকেই উৎফুল্ল ভঙ্গিতে বলল, “উফ! আমি তো পাগল হয়ে যাচ্ছি!”

অরা থমথমে গলায় বলল, “সীমা, দুইদিন হয়ে গেছে তুই স্যারের সাথে দেখা করেছিস।”

সীমা অবাক গলায় বলল, “দুইদিন কোথায় হলো? আটক্রিশ ঘন্টা হয়েছে। দেখ ছবিটা কী সুন্দর এসেছে! আমার পাশে আরশাদ হক! আমার তো এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না।”

“আমি তোকে এতটা খুশি কোনোদিনও দেখিনি।”

“কারণ আমি এত খুশি কোনোদিন হইনি।”

আরশাদের বাড়িতে কাটানো ওই এক ঘন্টা যেন সীমার জীবনের সেরা এক ঘন্টা ছিল। আরশাদ তার সঙ্গে বসার ঘরে বসে কফি খেয়েছে, আরশাদকে ঘিরে তার মনে জমে থাকা সব গল্পগুলো শুনেছে, তাকে অটোগ্রাফ দিয়েছে, তার সঙ্গে ছবি তুলেছে। আর সবথেকে বড় কথা সুপারস্টার আরশাদ হক সীমার মতো সাধারণ একট মেয়েকে ‘সরি’ বলেছে। একটা মানুষ এতটা ভালো হয় কী করে?

সীমা মুগ্ধ গলায় বলল, “ইস! আরশাদকে সামনাসামনি যা হ্যান্ডসাম লাগে! না দেখলে তো কোনদিন বুঝতেই পারতাম না।”

“সবই ঠিক ছিল, কিন্তু স্যারের সামনে ওভাবে ভ্যা ভ্যা করে না কাঁদলেও পারতি।”

“কাঁদবো না কেন? আরশাদের মতো বড় সুপারস্টার আমাকে সরি বলছে? এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? আরশাদের কোনো প্রয়োজন ছিল আমাকে নিজের বাড়িতে ডেকে পাঠানোর? তাও আবার সরি বলার জন্যে? আমাকে সরি না বললে ওর স্টারডমে বিন্দুমাত্র প্রভাব পড়তো না। কিন্তু আরশাদ এসব করেছে কারণ সে নিজের প্রত্যেকটা ফ্যানকে ভালোবাসে। প্রত্যেকটা ফ্যান ওর কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ।”

“এজন্যেই আরশাদ হকের ভক্তরা তার ব্যাপারে পাগল। তাই না?”

“অবশ্যই। এই যেমন আমি।”

অরা আহ্লাদী গলায় বলল, “তুই একটু বেশিই পাগল। পাগলামির বশে ওই দিন তো প্রায় আনফলো করতে যাচ্ছিলি।”

সীমা আহত গলায় বলল, “বাজে কথা বলবি না তো। একবার শুধু বলেছিলাম আনফলো করবো। কিন্তু শেষমেশ তো আর আনফলো করিনি। করেছি?”

“না।”

“এই অরা?”

“হুঁ?”

“তোর আরশাদকে কেমন লাগে রে?”

অরা স্বাভাবিক গলায় বলল, “কেমন আবার লাগবে? তিনি যেমন, তেমনই লাগে।”

সীমা বিরক্ত গলায় বলল, “তোর মতো আনরোমান্টিক মেয়ে যেন কোনো ছেলের কপালে না জোটে! আমি বোঝাতে চাচ্ছি, আরশাদের চেহারা, পার্সোনালি সবমিলিয়ে একটা মানুষ হিসেবে ওকে কেমন লাগে?”

অরা এবারও স্বাভাবিকভাবেই বলল, “ভালো লাগে। স্যার তো আর খারাপ লাগার মতো মানুষ নয়।”

সীমা তার কণ্ঠে কেমন রহস্য রহস্য ভাব নিয়ে বলল, “আমি না একটা ব্যাপার খেয়াল করেছি।”

“কী খেয়াল করেছিস?”

“আরশাদের সঙ্গে তোকে দারুণ মানায়!”

অরা হতবাক গলায় বলল, “কী যা তা বলছিস?”

সীমা হাসি হাসি গলায় বলল, “যা তা বলছি না। পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে বলছি। তুই যখন ওকে কী সব কাগজপত্র দেখাতে আনলি, ওর পাশের সোফায় বসলি – তখন দুজনকে পাশাপাশি দারুণ মানিয়েছে। একেবারে জোড়ি নাম্বার ওয়ান।”

অরা ভ্রু কুঁচকে বলল, “জোড়ি নাম্বার ওয়ান?”

সীমা মোহিত গলায় বলল, “হ্যাঁ! তুই কখনো খেয়াল করেছিস কিনা জানি না, কিন্তু আরশাদ যখন তোকে নাম ধরে ডাকে তখন ওর কণ্ঠস্বরে আলাদা একটা সফটনেস থাকে। আমি গ্যারেন্টি দিয়ে বলতে পারি এই পৃথিবীতে কেউ অত সুন্দর করে অরা নামটা উচ্চারণ করতে পারে না।”

“স্যারের ভয়েস এমনিতেই অনেক সুন্দর। যার নাম উচ্চারণ করবে, সেটাই পৃথিবীর সেরা নাম হয়ে যাবে।”

“আচ্ছা মানলাম। কিন্তু দুজনকে পাশাপাশি মানানোর ব্যাপারে কী বলবি?”

“আমি বলবো যে তুই পাগল হয়ে গেছিস। এসব আবার কোনোদিন সম্ভব না-কি? আমি কোনোদিন উনাকে ওই নজরে দেখিনি। উনার সাথে আমার সম্পর্ক পুরোটাই প্রফেশনাল।”

“প্রফেশনাল সম্পর্ক হলে আরশাদ নিজের সবথেকে বড় সিক্রেটটা তোকে বলে দিতো না।”

“বলেছে কারণ স্যার আমাকে বিশ্বাস করে। এতবছর চাকরি করে সেই বিশ্বাসটা আমি অর্জন করতে পেরেছি।”

সীমা ধমকের সুরে বলল, “কচু! তুই কিছুই বুঝিস না অরা। তোর জন্যে আরশাদের মন গলতে শুরু করেছে।”

অরা বিভ্রান্ত ও বিরক্ত গলায় বলল, “এটা সম্ভব না সীমা। স্যারের সাথে আমি… কীভাবে কী?”

“কেন সম্ভব না? আরশাদ ডিভোর্সী বলে?”

“না, আমি কি তা বলেছি না-কি?”

“শোন অরা, আরশাদ এমন একটা ছেলে – ওর দশটা বিয়ে ভাঙলেও হাজারটা মেয়ে ওর জন্যে পাগল হয়ে থাকবে।”

“সেটা তো আমিও জানি। এটা সম্ভব না কারণ আমি উনার ম্যানেজার।”

“অতশত বুঝি না বাবা। কিন্তু দেখে রাখিস তোর সাথে ওর কিছু একটা হবেই। গরীবের কথা বাসি হলেও ফলে।”

অরা বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইল সীমার দিকে। যে মেয়ে মাসে মাসে ডলারে আয় করে, সে কিনা নিজেকে গরীব বলছে!

অরা ব্যঙ্গাত্মক সুরে বলল, “তুই গরীব? আহারে! এমন গরীব যেন দেশের ঘরে ঘরে থাকে।”

সন্ধ্যার আগ দিয়ে সীমা চলে গেল রান্নাঘরে। যদিও দুপুরে বুয়া রান্না করে রেখে গেছে, তবুও আজ সে নিজের হাতে অরার পছন্দের সব খাবার রান্না করবে। কাল সকালে অরা চলে যাচ্ছে সিলেটে। সিলেটেই ‘কানামাছি’ সিনেমার শুটিংয়ের মূলপর্ব। টানা পঁচিশদিন সেখানেই শুটিং হবে। অরাকেও পুরোটা সময় থাকতে হবে সেখানে। এতগুলো দিন অরাকে দেখবে না ভেবে এখন থেকেই অস্থির হতে শুরু করেছে সীমার মন।

এতগুলো দিনের জন্যে যাচ্ছে বলে সাবধানে ব্যাগ গোছাচ্ছে অরা। প্রয়োজনীয় কোনো কিছু যাতে বাদ না যায়। সীমা রান্না বসিয়ে এসে বসলো অরাকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে।

সীমা কৌতুহলী গলায় বলল, “এই অরা? এই সিনেমায় কি আরশাদ খুন করবে?”

অরা ঠোঁট উল্টে বলল, “আমি কী জানি?”

সীমা অবাক গলায় বলল, “খুন করবে কি করবে না এটাই জানিস না? কেমন ম্যানেজার তুই?”

“এটা জানা আমার কাজ না, স্যারের কাজ। উনি স্ক্রিপ্ট পড়ে পছন্দ করেছেন, আমি ডিরেক্টরকে জানিয়েছি, মিটিং ফিক্সড করেছি আর…”

অরাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে সীমা বলল, “হয়েছে, হয়েছে। তোর বোরিং গল্প আর শুনবো না। এখন বল, আরশাদ সেটে কেমন থাকে?”

অরা নিজের শার্ট ভাঁজ করতে করতে বলল, “চুপচাপ থাকে। শটের সময় শট দেয়, এছাড়া বাকিটা সময় কারও সাথে কথা বলে না। ক্যারেক্টারের মধ্যে ঢুকে থাকে হয়তো।”

সীমা উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “একেবারেই কথা বলে না? কিন্তু ওই দিন আমার সঙ্গে তো কত কথা বলল!”

অরা মজার ছলে বলল, “হয়তো তোর ওপরে ক্রাশ খেয়েছে!”

সীমা লজ্জা পেয়ে বলল, “কী যে বলিস! আমার অত ভালো ভাগ্য থাকলে তো হয়েই যেত। ক্রাশ তো খাবে তোর ওপরে। কিংবা হয়তো এতক্ষণে খেয়েও গেছে।”

“আবারও শুরু করলি?”

“অসুবিধা কোথায়? আমরা আমরাই তো কথা বলছি, আরশাদ তো আর আমাদের কথা শুনতে আসছে না।”

“আমি যে যাচ্ছি, কার সঙ্গে করবি এসব পাগলামি?”

সীমা শুকনো গলায় বলল, “পঁচিশ দিন তোকে ছাড়া থাকবো কী করে?”

“চিন্তা করিস না, সময় সুযোগ পেলেই তোকে ভিডিও কল করবো।”

“সেটা তো তোকে করতেই হবে। তা না হলে ঢাকার ফেরার পর ওয়াশিং পাউডার দিয়ে ধোবো তোকে।”

অরা হাসিমুখে বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে।”

সীমা অরার ফোনের চার্জারের তার পেচিয়ে তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “চার্জারটা এখনই ব্যাগে রেখে দে।”

“রাতে চার্জ দিতে হবে তো ফোনে।”

“আমার চার্জার দিয়ে দিস। তা না হলে কাল সকালে চার্জার নিতে ভুলে যাবি, শেষে পঁচিশ দিনের কান্না।”

প্রচন্ড শব্দে জানালা বন্ধ হয়ে গেল। বাইরে প্রবল হাওয়া বইছে। দুজনে গল্পে এতটাই মেতে উঠেছিল যে বাইরের প্রকৃতির দিকে খেয়ালই করা হয়নি।

সীমা উঠে গিয়ে দাঁড়ালো জানালার পাশে। অরাও উঠে এলো তার পিছু পিছু। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো প্রবল বর্ষণ। বৃষ্টির শব্দের আলাদা একটা ভাষা থাকে। যার মন নরম কাদামাটি দিয়ে তৈরি, কেবল সেই বুঝতে পারে এই ভাষা। সীমা এবং অরা যেমন পারছে।

সীমা জানালার বাইরে হাত বের করে বলল, “কতদিন পর এমন ঝুম বৃষ্টি দেখলাম!”

অরা উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “সর্বনাশ! কাল নির্ঘাত ফ্লাইট ডিলে হবে।”

“তুই আছিস ফ্লাইটের চিন্তা নিয়ে! বৃষ্টিটা এনজয় কর।”

বৃষ্টি এনজয় করার হাজার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে অরা। কর্মজীবনের এই এক যন্ত্রণা! হাজার সুখকর মুহূর্তেও কাজের চিন্তা করতে হয়।

“এই অরা?”

কথায় কথায় “এই অরা?” বলাটা যেন সীমার মুদ্রাদোষে পরিণত হয়েছে। পঁচিশ দিনে এই অভ্যাসটা আবার হারিয়ে যাবে না তো?

অরা বলল, “হুঁ?”

“চল ছাদে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজি!”

অরা আঁতকে উঠে বলল, “পাগল হয়েছিস? তুই জানিস না বৃষ্টির পানি মাথায় পড়লেই আমার জ্বর আসে?”

“আরে কিচ্ছু হবে না। পঁচিশটা দিন আমাদের দেখা হবে না। পঁচিশ দিনে বাঁচি না মরি তার কোনো গ্যারান্টি আছে? চল আজ শেষবারের মতো এনজয় করি।”

“শেষবার বলছিস কেন?”

“আচ্ছা বাবা, পঁচিশ দিনের আগে শেষবার। চল না!”

সীমার জোরাজুরিতে একপ্রকার বাধ্য হয়ে ছাদে চলে গেল অরা। প্রকৃতি তার সবটা উজাড় করে দিয়েছে আজকের এই বর্ষণে। বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে মিষ্টি শীতল এক বাতাস গায়ে এসে লাগছে। সবমিলিয়ে জাদুকরী এক পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। দুই বান্ধবী মনের আনন্দে হাত ধরাধরি করে বৃষ্টিতে ভিজছে। অরা কি জানতো, এই আনন্দের ছলে বৃষ্টিতে ভেজা চিরকালের জন্যে তার জীবনটাকে বদলে দেবে?

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here