ফিরে_আসা ২৪+২৫ লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

0
714

#ফিরে_আসা
২৪+২৫
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

ক্যালেন্ডারের পাতার একেকটা দিনের নামকরণ করার উপায় থাকলে অরা আজকের দিনটার নাম দিতো ‘ঝামেলাময়’। সকাল থেকে একটার পর একটা ঝামেলা বেঁধেই যাচ্ছে। সর্বপ্রথম ঝামেলা বাঁধলো সকাল আটটায়। শ্রীমঙ্গলের উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় শুটিং ইউনিট দিনের প্রথম শটের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই দৃশ্যটা তেমন জটিল কিছু নয়। আরশাদ ও তার বন্ধুরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আরশাদ ও সকল অভিনেতারাও প্রস্তুত মেকআপ-গেটআপ নিয়ে।

আচমকা এই সিনেমার নায়িকা মিহি মাটিয়ে লুটিয়ে পড়লো। অজ্ঞান হয়নি তবে চোখেমুখে অন্ধকার দেখছে। তার না-কি হাইট ফোবিয়া আছে। উঁচু থেকে নিচের দিকে তাকালে মাথা ঘুরপাক খেয়ে ওঠে। সেই থেকে আপাতত শুটিং বন্ধ আছে। মিহি অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর থেকে ইউনিটের সবার ব্যস্ততা তাকে ঘিরে। শুটিং ইউনিটের সঙ্গে সর্বক্ষণ ডাক্তার থাকে না। ডাক্তারকে খবর দিতে লোক গেছে। অজ্ঞান অবস্থায় তাকে পাহাড় থেকে নামানো সম্ভব হয়নি। পাহাড়েই তাবু খাটিয়ে তাকে শোয়ানো হয়েছে। অরা ভেবে পায় না, মিহি মেয়েটা যখন জানতোই তার হাইট ফোবিয়া আছে তখন পাহাড়ে উঠে নিচের দিকে তাকানোর দরকার কী ছিল?

ঝামেলা এখানেই শেষ হয়ে গেলে হতো। কিন্তু না! আজকের দিনটার নাম তো আর শুধু শুধু ‘ঝামেলাময়’ রাখা হয়নি। বেলা এগারোটার দিকে ডিরেক্টর এসে দুটো পৃষ্ঠা ধরিয়ে দিলো অরাকে। নতুন একটা দৃশ্য না-কি স্ক্রিপ্টে যোগ করা হয়েছে। এই দৃশ্যের শুটিং আজ সন্ধ্যায়।
নতুন দৃশ্য দেখেই আরশাদ থমথমে গলায় জানিয়ে দিয়েছে এই দৃশ্যে সে অভিনয় তো করবেই না, এই দৃশ্য সিনেমাতেও থাকতে পারবে না। সে যে স্ক্রিপ্ট পড়ে সাইন করেছিল, সিনেমা হুবহু তার মতো হতে হবে।

সমস্যাটা হলো ডিরেক্টর বেচারা স্ক্রিপ্ট লেখেনি। লিখেছে একরামুল চৌধুরী। একরাম পনেরো-বিশ বছর ধরে সিনেমার স্ক্রিপ্ট লিখে আসছেন। ইন্ডাস্ট্রিতে সিনিয়র বলে তিনি আশা করেন সবাই তার সব কথা অন্ধের মতো পালন করবে। তিনি ঢাকায় বসে এই নতুন দৃশ্য লিখে পাঠিয়েছেন। এবং বলে দিয়েছেন অবশ্যই অবশ্যই যেন এই দৃশ্যটা ধারণ করা হয়।

ডিরেক্টর যখন একরামকে জানালো, আরশাদ এই নতুন দৃশ্যে অভিনয় করবে না – তখন তিনি রেগেমেগে বলে দিলেন, “তাহলে আমার স্ক্রিপ্ট দিয়ে তোমাদের সিনেমা বানাতে হবে না। এক্ষুনি আমার স্ক্রিপ্ট ফেরত দাও।”

সিনেমার বিশ শতাংশ শুটিং ইতোমধ্যেই শেষ। স্ক্রিপ্ট ফেরত দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আর আরশাদের জেদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাওয়াও বোকামি। এখন উপায় একটাই, একরামকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে রাজি করানো। এই রাজি করানোর দায়িত্ব পড়েছে আবার অরার ঘাড়ে। তার সঙ্গে ফোনে একদফা কথা হয়েছে। একরাম বলেছেন, “ভেবে জানাচ্ছি।”

অন্যদিনে হাজারটা ঝামেলা একা হাতে সামাল দেওয়ার ক্ষমতা রাখে অরা। তবে আজ সত্যিই শরীরটা সায় দিচ্ছে না। গা কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে। সকালবেলা থার্মোমিটারে মেপে দেখেছিল, একশ দুই। এখন কত কে জানে? এই প্রবল জ্বর নিয়ে কেবল বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। ঝামেলা মোকাবেলা তো যেন দুঃস্বপ্নের মতো।

কপালে আইসব্যাগ চেপে বিছানায় শুয়ে আছে অরা। এই হোটেলের রুম সার্ভিস অসাধারণ। ফোন করে আইসব্যাগ চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে গেছে। তবে এই সুখ দীর্ঘস্থায়ী হবে না। একটু পরেই শুটিং শুরু হবে। আবারও তাকে ফিরে যেতে হবে সেটে। অরার ইচ্ছা করছে সীমাকে তুলে আছাড় মারতে। কী দরকার ছিল বৃষ্টিতে ভিজতে জোরাজুরি করার? অবশ্য প্রকৃত দোষটা অরারই। নিজের ভালো নিজের থেকে বেশি কেউ বোঝে না। অরা খুব ভালো করেই জানে বৃষ্টির পানি তার সহ্য হয় না। মাথায় পড়ার সঙ্গে সঙ্গে জ্বর আসে। কেন সীমার তালে তাল মিলিয়ে ভিজতে গেল কে জানে?

হঠাৎ অরার ঘরের দরজায় টোকা পড়লো। অরা ভেতর থেকে ক্ষীণ স্বরে বলল, “কে?”

“আপু আমি মেহেদী।”

অরা উঠে বসতে বসতে বলল, “খোলা আছে, আয়।”

মেহেদী ভেতরে ঢুকে বিছানার পাশে রাখা সোফায় বসতে বসতে বলল, “কী অবস্থা তোমার আপু?”

“আগের মতোই।”

“আমার কাছে প্যারাসিটামল আছে। খাবে?”

“খেয়েছি। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না।”

“নায়িকার জন্য যে ডাক্তার ডাকা হয়েছে সে কিন্তু এখনো হোটেলেই আছে। ডাকবো না-কি?”

অরা ভ্রু কুঁচকে বলল, “ধুর! কী যে বলিস? সামান্য জ্বরের জন্যে আবার ডাক্তার লাগে না-কি?”

“একশ দুই কিন্তু আপু সামান্য জ্বর নয়।”

অরা কিঞ্চিৎ সন্দেহ নিয়ে বলল, “মেহেদী শোন, তোকে আমি খুব ভালো করে চিনি। আমার জ্বরের প্যাঁচাল করার জন্যে নিশ্চয়ই তুই আসিসনি। মতলবটা কী?”

মেহেদী আহত গলায় বলল, “তোমার আমাকে এতটাই খারাপ মনে হয় আপু? আমি কি তোমার খোঁজ-খবর নিতে আসতে পারি না?”

“পারিস, পারিস! এখন ঝেড়ে কাশ।”

মেহেদী ইতস্তত করে বলল, “ইয়ে মানে… একটা ঝামেলা হয়ে গেছে।”

কোনো মানে হয়? এই ছেলে কিনা হাজির হয়েছে নতুন ঝামেলা নিয়ে? অরার মনে হচ্ছে আজকের ঝামেলাগুলোর সমাধান করতে করতে সে পাগল হয়ে যাবে।

অরা ক্লান্ত গলায় বলল, “আবার কী ঝামেলা?”

“বেশি বড় না, ছোট্ট একটা ঝামেলা।”

“কী করেছিস তুই?”

“কন্টিনিটির কস্টিউম ফেলে এসেছি।”

“কোন কন্টিনিটির কস্টিউম?”

“সে শার্ট পড়ে স্যার ট্রেনে শুটিং করেছে।”

এই সিনেমায় আরশাদ ও তার বন্ধুদের সিলেটের শ্রীমঙ্গলে আগমন ঘটে ট্রেনে করে। ট্রেনে বেশ অনেকগুলো দৃশ্যই রয়েছে। কিছুদিন আগে ট্রেনের দৃশ্যগুলোর শুটিং শেষ হয়েছে। সবগুলো দৃশ্যে আরশাদের পরনে ছিল হালকা ধূসর রঙের শার্ট। আর এই ছেলে কিনা বলছে সেই শার্ট ফেলে এসেছে? শার্টটা জরুরি কারণ সকল বন্ধুরা ট্রেন থেকে নেমে হোটেলে ঢুকছে এমন একটা দৃশ্যের শুটিং আজই করা হবে। শার্ট না থাকলে তো সর্বনাশ!

অরা হতবাক গলায় বলল, “মানে কী? এই গাধা তুই বুঝতে পারছিস কী করেছিস! যে সিনে সব বন্ধুরা প্রথমবারের মতো হোটেলে ঢুকবে, সেই সিনের শুটিং আজ সন্ধ্যায়। আর তুই বলছিস শার্ট নেই? এতবড় ভুল করলি কী করে?”

মেহেদী অনুতপ্ত গলায় বলল, “সরি আপু। আমি ভেবেছিলাম ওই কস্টিউম আর লাগবে না। তাই ঢাকায় রেখে এসেছি।”

“আমি তোকে লিস্ট পাঠিয়েছিলাম না? লিস্টে ছিল তো ওই শার্ট।”

“আমি জানি। ভুল হয়ে গেছে আপু। সরি, সরি, সরি। এখন আমাকে বাঁচাও।”

“স্যার জানে?”

মেহেদী ভয়ার্ত গলায় বলল, “পাগল না-কি তুমি? স্যার জানলে আমাকে কাঁচা গিলে খাবে। তুমি কিছু একটা করো প্লিজ!”

“আমি কী করবো?”

“ডিরেক্টরকে বলো ওই সিনের ডায়লগে অ্যাড করে দিতে যে, স্যারের গরম লাগছিল। তাই সে শার্ট খুলে টিশার্ট পড়ে ট্রেন থেকে নেমেছে।”

“ডিরেক্টর না হয় রাজি হলো, কিন্তু স্যারই তো এসব কারচুপিতে রাজি হবে না।”

“তাহলে কী হবে?”

“কী আর হবে? এই এক শার্টের জন্যে স্যার তোকে আবার ঢাকায় পাঠিয়ে দেবে। তুই ঢাকায় গিয়ে শার্ট আনবি, তারপর ওই সিনের শুটিং হবে।”

“আপু আমাকে বাঁচাও! আমি আবার ঢাকায় যেতে পারবো না।”

“আমি কীভাবে বাঁচাবো?”

মেহেদী কিছুটা সময় ভেবে বলল, “আমি যে ব্র্যান্ডের দোকান থেকে ওই শার্ট কিনেছিলাম, সেই ব্র্যান্ডের একটা শোরুম এখানে আছে। আমি আসার সময় দেখেছি।”

“তুই সিওর?”

“হ্যাঁ সিওর। আমাদের হোটেল থেকে সেখানে যেতে আধ ঘন্টার মতো সময় লাগবে। আমিই যেতাম কিন্তু শুটিংয়ের সময় তো আমার থাকতে হবে। তুমি একটু ওখানে গিয়ে খুঁজে দেখো না আপু সেইম শার্টটা পাও কিনা।”

হতদন্ত করে হোটেল থেকে বেরিয়ে গেল অরা। শার্ট না পেলে আজ সাড়ে সর্বনাশ। একে তো নতুন দৃশ্যের ব্যাপারে আরশাদ বিরক্ত। তার ওপরে আবার শার্টের ঝামেলার কথা তার কানে গেলে আজ সত্যিই হয়তো মেহেদীকে আস্ত গিলে খাবে। ট্রেনে শুটিংয়ের দিন মেহেদী আরশাদের ছবি তুলে রেখেছিল। যাতে পরবর্তীতে কস্টিউম চিনতে সুবিধা হয়। সেই ছবিটাও সাথে করে নিয়ে এসেছে অরা।

কাঙ্ক্ষিত দোকান খুঁজে পেতে আধ ঘন্টাও কম সময় লাগলো অরার। মেইন রোডে চেনাজানা ওই ব্র্যান্ডের বিশাল আউটলেট। অরা বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে প্রবেশ করলো দোকানে। ছবি মিলিয়ে মিলিয়ে পুরো দোকানটা জুড়ে খুঁজলো, কিন্তু খুঁজে পেলো না নিজের কাঙ্ক্ষিত শার্ট। এমনটা কী করে সম্ভব? মেহেদী বলছিল এই শার্ট ব্যান্ডের লেটেস্ট কালেকশনের। যেকোনো আউটলেটে পাওয়া যাবে। তাহলে এখানে নেই কেন?

ভাবনাচিন্তা করে সময় নষ্ট করা যাবে না। অরা সোজা চলে গেল কাউন্টারে। কাউন্টারে যে লোকটা আছে তাকে শার্টের ছবি দেখাতে হবে। অরা ছবিটা এমনভাবে জুম করলো যেন আরশাদকে দেখা না যায়, কেবল শার্টটাই দেখা যায়।

ফোনটা কাউন্টারে থাকা লোকের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে অরা ভদ্রভাবে বলল, “এই শার্টটা কি আপনাদের স্টোরে আছে?”

লোকটা ছবির দিকে ভালো করে নজর দিয়ে বলল, “না ম্যাম, এটা লিমিটেড এডিশনের শার্ট।”

“আপনাদের স্টকে একটাও নেই?”

“সেটা বলতে পারছি না।”

“একটু দেখে বলুন না প্লিজ, আমার খুব দরকার।”

“এই স্টোরে নেই ম্যাম। থাকলে আমাদের ওয়্যারহাউজে থাকতে পারে।”

মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল অরা। অস্ত্রটা শেষমেশ ব্যবহার করতেই হবে। অরা ভেবেছিল আরশাদের কথাটা গোপন রেখেই শার্ট নিয়ে চলে যাবে। কিন্তু সেটা আর হলো কোথায়।

অরা হাসিমুখে বলল, “এই শার্টটা আসলে আমি আরশাদ হকের জন্যে নিতে চাচ্ছি।”

লোকটা বড় বড় চোখে তাকিয়ে বলল, “নায়ক আরশাদ হক?”

অরা জুম করা ছবিটা স্বাভাবিক করে তার দিকে ফিরিয়ে বলল, “হুঁ! এই দেখুন।”

ছবির দিকে হা করে তাকিয়ে আছে লোকটা। নিজের চোখকে যেন এক মুহূর্তের জন্যেও বিশ্বাস করতে পারছে না। দেশের সবথেকে বড় সুপারস্টার তার স্টোরের শার্ট পড়েছে, এই ব্যাপারটা হজম করা আসলেই কষ্টকর।

অরা আবারও বলল, “স্যার আপনাদের স্টোরের শার্ট পড়ে আগেই শুটিং করেছেন। এখন আবার লাগবে, কিন্তু আমরা ভুলে শার্টটা ফেলে এসেছি। তাই এখানে খোঁজ করতে এসেছিলাম।”

লোকটা ব্যস্ত গলায় বলল, “ম্যাম! আপনি একটু বসুন, আমি আমাদের স্টোর ম্যানেজারকে খবর দিচ্ছি।”

স্টোর ম্যানেজার এসে কৃতজ্ঞ ভঙ্গিতে খুশি খুশি গলায় একগাদা কথা বললেন। যে কথাগুলোর সারমর্ম, আরশাদ যে তার দোকানের শার্ট পড়ে শুটিং করেছে এতে তিনি ধন্য।

অরা ঠোঁটে কৃত্রিম হাসি টেনে বলল, “আমি কি তাহলে শার্টটা পেতে পারি?”

স্টোর ম্যানেজার আনন্দে গদগদ হয়ে বলল, “অবশ্যই, অবশ্যই! কিন্তু ম্যাম আপনাকে যে একটু অপেক্ষা করতে হবে। শার্ট আমাদের ওয়্যারহাউজে আছে। আপনি চাইলে আমরা আপনার হোটেলে গিয়েও ডেলিভারি দিয়ে আসতে পারি।”

অরা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “কোনো সমস্যা নেই, আমি অপেক্ষা করবো।”

অপেক্ষা করার মাঝেই ফোন এলো একরামুল সাহেবের। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, “ঠিক আছে, নতুন দৃশ্যের শুটিং করতে হবে না। কিন্তু এবারই শেষবার, আগামীতে আমি কোনো নতুন দৃশ্য পাঠালে তার শুটিং করতেই হবে। এবার আমি আপনার ভালো ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে রাজি হয়েছি। সামনেরবার কিন্তু রাজি হবো না।”

হাফ ছেড়ে বাঁচলো অরা! যাক, একটা ঝামেলা থেকে রেহাই পাওয়া গেছে। এখন শার্টের ঝামেলা ভালোয় ভালোয় মিটলে হয়! অপেক্ষা করতে করতে জ্বরটা আরও বেড়ে গেল অরা। পুরো স্টোরজুড়ে কড়া এসি। সম্ভবত সেই কারণে। জ্বরের সঙ্গে এবার শুরু হয়েছে তীব্র মাথা ব্যাথা। মাথার মাঝখানটা জুড়ে ভোঁতা ধরনের ব্যথা। সারা শরীর ছেয়ে গেছে ক্লান্তিতে। অরা ভয়ে আছে, এখান থেকে হোটেলে পৌঁছাতে পারবে কিনা।

শার্ট হাতে পেতে প্রায় ঘন্টাখানেক সময় লাগলো। হোটেলে পৌঁছাতে বেশ কষ্ট হলেও পৌঁছে গেল অরা। শার্ট পেয়ে মেহেদীর মুখভঙ্গি এমন হলো যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে। তার এই আনন্দের জন্যে এতটা কষ্ট সার্থক বলে মনে হলো। তার থেকেও বড় কথা আরশাদকে না জানিয়ে, না রাগিয়ে এত বড় একটা ঝামেলা পাড় করে আসতে পেরেছে সে।

মেহেদীকে শার্ট বুঝিয়ে দিয়ে সোজা সেটে চলে গেল অরা। ভেবেছিল ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নেবে কিন্তু সেই ভাবনা আপাতত স্থগিত রাখলো।
শুটিং শুরু হয়েছে দুঘন্টা হলো। এতক্ষণে একবারও সেটে যায়নি।

শট রেডি হচ্ছে। আরশাদ চেয়ারে বসে এক মনে স্ক্রিপ্টের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ তার চোখ পড়ল অরার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে ধমক দিয়ে বলল, “কী ব্যাপার তোমার অরা? তোমাকে তো আজ দেখাই যাচ্ছে না।”

অরা স্বাভাবিকভাবে বলল, “সরি স্যার। একটা সমস্যা হয়ে গিয়েছিল।”

আরশাদ বিরক্ত গলায় বলল, “বোরহান আমাকে ফোন দিয়েছিল। তার কাছে আমার নম্বর গেল কী করে?”

অরা বিভ্রান্ত গলায় বলল, “কোন বোরহান স্যার?”

“ডিরেক্টর বোরহান।”

মাঝে মাঝে আরশাদের ওপরে বিরক্তির শেষ থাকে না অরার। বোরহান আরশাদের ক্যারিয়ারের প্রথম দিককার ডিরেক্টর। যদিও একদম প্রথম সিনেমা থেকে আরশাদের খ্যাতি তুঙ্গস্পর্শী, তবে প্রথম কয়েকটা সিনেমার শুটিং চলাকালীন সে ডিরেক্টরদের নিজের নম্বর দিতো। এখনকার মতো ম্যানেজারের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতো না।

অরা ভদ্রভাবে বলল, “আপনার নম্বর তো স্যার আগে থেকেই উনার কাছে ছিল।”

আরশাদ থমথমে গলায় বলল, “তাকে বলে দেবে আমাকে যেন ফোন না করে। কোনো কথা থাকলে যেন তোমাকে বলে।”

“জি স্যার।”

“আরেকটা কথা! আগামী সাত দিনে নয়টা মিটিং রেখেছ তুমি। এসবের মানে কী? আমি কি এখানে শুটিং করতে এসেছি না-কি মিটিং করতে?”

সুপারস্টার আরশাদের সঙ্গে নতুন সিনেমা নিয়ে মিটিং করার জন্যে পরিচালক প্রযোজকেরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে। আরশাদ সিলেটে এসেছে তো কী হয়েছে, পঁচিশ দিনের জন্যে মিটিং তো আর আটকে থাকতে পারে না। পরিচালক প্রযোজকেরা নিজ থেকে সুদূর ঢাকা থেকে এখানে আসতে প্রস্তুত তার জন্যে।

অরা বলল, “তাহলে কি স্যার শিডিউল চেঞ্জ করবো?”

“অবশ্যই চেঞ্জ করবে। আর সবগুলো মিটিং শুটিংয়ের পর রাতে রাখবে। কারো সমস্যা থাকলে সে মিটিং ক্যানসেল করবে।”

“জি স্যার।”

“আজ রাতে শুটিংয়ের পর আমি তোমার সাথে শিডিউল নিয়ে বসবো। তার আগে সব ঠিকঠাক করে ফেলবে।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরে ফিরে এল অরা। অসুস্থ শরীরের ওপর দিয়ে আজ দিনভর অনেক ধকল যাচ্ছে। জ্বরের সময়ে বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নিলেও কেমন একটা অস্বস্তি কাজ করে। আর সেখানে বেচারি জ্বর নিয়ে এত ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে। ঘরে ফিরেই ল্যাপটপ নিয়ে বসলো অরা। আগামী সাত দিনের শিডিউল আবার প্রথম থেকে নতুন করে সাজাতে হবে। তাও আবার কাজ রাতের মধ্যে। শিডিউলের চিন্তায় মাথাব্যথাটা যেন কয়েকগুণ বেড়ে গেল। ব্যাগে মাথাব্যথার ওষুধ আছে, কিন্তু এই মুহূর্তে উঠে গিয়ে তা বের করতে আলসেমি লাগছে। অরা কাজে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলো।

আচমকা বেজে উঠলো তার ফোনের রিংটোন। মোবাইল স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে সীমার নাম।

অরা ফোন রিসিভ করতেই সীমা উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “এখন কী অবস্থা অরা? জ্বর আছে?”

অরা অস্পষ্ট গলায় বলল, “হুঁ।”

“কত?”

“চেক করিনি আর।”

সীমা ধমকের সুরে বলল, “চেক করিসনি মানে কী? থার্মোমিটার দিয়ে দিয়েছি কেন? সাজিয়ে রাখার জন্যে।”

অরা ল্যাপটপে কী যেন টাইপ করতে করতে বলল, “আচ্ছা করবো বাবা, এখন বিরক্ত করিস না তো। কাজ করছি।”

সীমা অবাক গলায় বলল, “কাজ করছিস মানে? এই অবস্থায় কীসের কাজ?”

“স্যার শিডিউল ঠিক করাতে বসিয়ে রেখেছে।”

“অরা, নিজের ওপরে এত চাপ দিস না তো। রেস্ট নে।”

“কাজটা শেষ করেই রেস্ট নেবো।”

“কাজ তো পরেও শেষ করা যাবে।”

“না রে, রাতে আবার স্যারের সাথে এই শিডিউল নিয়ে বসতে হবে।”

“তাহলে তো মোটেও রেস্ট নেওয়ার সময় পাবি না। অরা তুই আরও অসুস্থ হয়ে পড়বি।”

“কিচ্ছু হবে না। তুই চিন্তা করিস না তো।”

অরার এই এক বদভ্যাস। নিজেকে জোর করে কাজের মুখে ঢেলে দেওয়া। কাজের যতই ধকল আসুক না কেন, কখনো পিছিয়ে যায় না সে। নিজে যতই অসুস্থ থাকুক না কেন, কাজটা তার সর্বোচ্চ প্রাধান্যে থাকে। এই অভ্যাসটা হয়তো গঠিত হয়ে গেছে ছোটবেলা থেকে। ছোটবেলায় তাকে ঘরের হাজারটা কাজ করতে হতো। ভাইদের সামলানো, ঘর পরিষ্কার করা, কাপড় ধোয়া, বাসন মাজা। দিনভর এসব কাজ করে ক্লান্তিতে ছেয়ে যেত তার সমস্ত শরীর। রাত নেমে আসতেই তার ইচ্ছে হতো বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে।

তবে কোনোদিন সেই ইচ্ছা পূরণ করেনি সে। ইচ্ছাটা দমিয়ে রেখে হাজার ক্লান্তি নিয়ে সকলের অগোচরে বইখাতা নিয়ে পড়াশোনা করতে বসে যেত। শিক্ষার মাধ্যমে আমরা যা অর্জন করি, তা সারাজীবন থেকে যায় আমাদের সঙ্গে। তা এখনো অরার সঙ্গে আছে বলেই হয়তো আজকের এই জীবনটা পাচ্ছে সে।

এই বিশাল পাঁচতারকা হোটেলে অরার রুম পাঁচ তলায় আর আরশাদের সাত তলায়। প্রিমিয়াম রুমগুলো ওপরের দিকেই থাকে। সাত তলায় বসে আড্ডা দেওয়ার মতো সুন্দর একটা জায়গা আছে। এক কোণায় আকাশি রঙের একটা সোফা, সোফার ওপরে হলদেটে আলোকসজ্জা। জায়গাটা ছোট্ট হলেও অপূর্ব সুন্দর। শুটিং শেষে সেখানে বসেই অরার নতুন করে তৈরি করা শিডিউল দেখছে আরশাদ।

গভীর মনোযোগ দিয়ে ল্যাপটপের দিকে চোখ বুলিয়ে আরশাদ বলল, “সবই ঠিক আছে, শুধু সাত তারিখের মিটিংটা এগারো তারিখের পরে নিয়ে যাও। সাত থেকে এগারো তারিখ অনেকগুলো ইম্পর্ট্যান্ট সিনের শুটিং হবে। আমি ব্যস্ত থাকবো।”

“জি স্যার।”

“আর একটা কাজ করতে হবে অরা। আমার ল্যাপটপে এই শিডিউলটা টাইপ করে দাও।”

“কিন্তু স্যার আমি তো আপনাকে মেইল করে দিয়েছি।”

“ল্যাপটপে মেইল কাজ করছে না বলেই তো বলছি।”

অরা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “জি আচ্ছা স্যার।”

আরশাদ উঠে দাঁড়িয়ে পা বাড়ালো তার ঘরের দিকে। অরাও যাচ্ছে তার পিছু পিছু। আরশাদের ল্যাপটপ তার ঘরেই রয়েছে। ঘরটা হলওয়ের একেবারে শেষ মাথায়।

হলওয়ে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আরশাদ গম্ভীর গলায় বলল, “কাল কলটাইম কয়টায়?”

কথা বলতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে অরার। জ্বরটা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। প্রচন্ড মাথা ব্যথার সাথে সাথে পুরো শরীর জুড়ে ব্যথারা খেলে বেড়াচ্ছে। ওই সময় আলসেমি না করে ওষুধটা খেয়ে নিলেই হয়তো ভালো হতো। চোখের সামনে পুরো জগৎটা ঘুরছে অরার। সবকিছু যেন অন্ধকার দেখছে। তার মনে হচ্ছে পায়ে নিচে জোরালো কোনো চোরাবালি তাকে ক্রমশ নিজের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

তবুও নিজেকে সামলানোর প্রাণপণ চেষ্টা করে বলল, “আটটায় স্যার।”

আরশাদ দ্রুততার সাথে হাঁটতে হাঁটতে বলল, “কাল কিন্তু আমি কোনো ডিলে সহ্য করবো না। এই সিনেমার শুটিংয়ের একদিনেও অন টাইমে ক্যামেরা ওপেন হয়নি। ডিরেক্টরকে বলবে এই বিষয়টা…”

আরশাদ তার কথা শেষ করতে পারলো না। তার আগেই খেয়াল করলো হাঁটতে হাঁটতে মাঝ হলওয়েতে লুটিয়ে পড়েছে অরা। ভীষণভাবে হকচকিয়ে উঠলো আরশাদ। মেয়েটা হঠাৎ করে পড়ে গেল কেন? আরশাদ ভেবেছিল, হয়তো হাঁটতে গিয়ে হোঁচট খেল পড়ে গেছে অরা। এক্ষুনি নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াবে। কিন্তু সেসব কিছুই হলো না। অরা সেভাবেই পড়ে রইল।

আরশাদ নিচু হয়ে বসে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে ডাকল, “অরা! অরা!”

অরার কাছ থেকে কোনো জবাব নেই। মেয়েটা কি অজ্ঞান হয়ে পড়লো? আরশাদ অরার মুখটা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে না। তার চুলগুলো এসে পড়েছে মুখের ওপরে।

আরশাদ আবারও ডাকল, “অরা? তুমি ঠিক আছ?”

অরা ঠিক নেই বলেই হয়তো তার কথার জবাব দিতে পারলো না। আরশাদ বুঝতে পারছে না তার কী অরা উচিত। একটু আগেও তো স্বাভাবিক ছিল মেয়েটা। মুহূর্তের মধ্যে কী হয়ে গেল?

সাত-পাঁচ ভাবনার মাঝে মনের অজান্তেই আরশাদের হাতটা চলে গেল অরার কপালে। কপালে হাত রাখতেই শিউরে উঠলো আরশাদ। এতটা জ্বর নিয়ে একটা মানুষ থাকে কী করে? জ্বরে গা পুড়ে যাওয়ার উপক্রম। আরশাদ এর আগে কারো গায়ে এতটা জ্বর দেখেছে কিনা মনে পড়ছে না। মেয়েটা এই জ্বর নিয়ে এতক্ষণ কাজ করেছে? কোনো মানে হয়?

আরশাদ জানে কোনো সাড়াশব্দ আসবে না, তবুও শেষবারের মতো ডাকলো, “অরা?”

আর অপেক্ষা করা যাবে না। মেয়েটা তো এভাবে পড়ে থাকতে পারে না। আরশাদ ধীরস্থিরভাবে কোলে তুলে নিলো অরা। কোলে নেওয়ায় এবার তার শরীরের উষ্ণতাটা আরও ভালোভাবে বুঝতে পারছে। মেয়েটার জন্যে এবার আরশাদের খারাপই লাগছে। আরশাদ জানে, অরা খুবই ভালো একটা মেয়ে। তবুও কোনো এক অজানা কারণে সবসময়ে তাকে ধমকাধমকির ওপরে রাখে। টিমে অরাই একমাত্র মানুষ যে আরশাদের কোনো নির্দেশ অমান্য করে না। তবুও যে কেন তাকে এত ধমক দেয় আরশাদ নিজেও জানে না।

অরাকে কোলে নিয়ে আরশাদ দ্রুত পায়ে চলে গেল নিজের ঘরে। ঘরে এসে বিছানায় শুইয়ে দিলো তাকে। অরা একটু একটু করে কেঁপে উঠছে। আরশাদ ব্যস্ত ভঙ্গিমায় তার ব্ল্যাঙ্কেট টেনে দিলো অরার গলা পর্যন্ত। নারীবিদ্বেষী আরশাদ হকের বিছানায় তারই ব্ল্যাঙ্কেট জড়িয়ে শুয়ে আছে একটা মেয়ে। এ যেন অষ্টম আশ্চর্য! আশ্চর্য হলেও কিছু করার নেই। মেয়েটাকে তো সুস্থ করতে হবে আগে।

আরশাদ ফোন করলো ডাক্তারকে। এখানে তার পরিচিত এক ডাক্তার আছে। সকালে তিনিই এসেছিলেন নায়িকার চিকিৎসা করতে। ডাক্তারের আসতে আধ ঘন্টার মতো সময় লাগলো। ততটা সময় আরশাদ অরার পাশেই বসে ছিল। ডাক্তার এসে কী একটা ইনজেকশন পুশ করলেন অরার শরীরে। সেলাইন দিলেন, আরও কতগুলো ওষুধ দিয়ে গেলেন জ্ঞান ফেরার পর খাওয়ানোর জন্যে।

ডাক্তার চলে যাওয়ার পর রুমের সঙ্গে লাগোয়া ব্যাঙ্কনিতে গিয়ে দাঁড়ালো আরশাদ। এখান থেকে অপরূপ সুন্দর চা বাগান দেখা যায়। এই হোটেলের নিজস্ব চা বাগান। রাতের বেলা সেখানে আবার নানা রঙের আলোকসজ্জা করা হয়। নিজেকে আজ ভীষণ হালকা লাগছে আরশাদের। এতদিন সে নিজেকে অনুভূতিশূণ্য হৃদয়হীন এক মানুষ বলে মনে করতো। অন্যের আনন্দে যার আনন্দ নেই, অন্যের কষ্টে যার কষ্ট নেই।

তবে আজ তার নিজের কাছেই সেই ধারণা ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে। তার কাছেও একটা হৃদয় আছে। আছে বলেই তো অরার অসুস্থতায় ব্যস্ত হয়ে তাকে ঘরে নিয়ে এসেছে, ডাক্তারকে খবর দিয়েছে।

আবারও ঘরে ফিরে এলো আরশাদ। অরা বেঘোরে বিছানায় পড়ে আছে। আরশাদ গিয়ে আরেকটাবার হাত রাখলো অরার কপালে। জ্বর আছে, তবে এখন অনেকটাই কমে এসেছে।

আরশাদ সরে এসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। এই হোটেলে চমৎকার একটা লাইব্রেরী আছে। এমনিতেই তার অনিদ্রা আছে। বই পড়ার অভ্যাস তার বহু আগেই হারিয়ে গেছে, তবুও পাতা উল্টে আজকের রাতটা পার করে দেবে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here