#ফিরে_আসা
৫২
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
একটার পর একটা অভিযোগ এসেই যাচ্ছে নওশীনের বিরুদ্ধে। আরশাদের করা অপহরণের মামলার ভিত্তিতে তার নামে ওয়ারেন্ট ইস্যু করা হয়। তবে গ্রেফতারের সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ তার বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা করে। তল্লাশির সময় তার বাড়ি থেকে পাওয়া যায় কয়েক গ্রাম মাদকদ্রব্য। পরিমাণ অল্প হলেও মাদক মামলা কঠিন জিনিস। এতসবের পর আচমকা কোথা থেকে যেন উদয় হয়েছে কবির। আজ সকালে সে নওশীনের নামে আরেকটি মামলা করে। গর্ভপাতের মামলা। বাংলাদেশে গর্ভপাত আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।
এতসব অপরাধের ভীড়ে সাধারণ জনগণ বড় করে দেখছে ওই একটা অপরাধকে। সুপারস্টার আরশাদকে চিট করার অপরাধ। ইন্টারনেটে ভেসে বেড়াচ্ছে নওশীন এবং কবিরের ওই ঘনিষ্ট ছবিগুলো। লোকে দেখছে আর ছি ছি করছে। ইন্টারনেট আজ উত্তপ্ত এই একটি খবরেই।
ঠিক বেলা বারোটায় কোর্টে তোলা হবে নওশীনকে। পুলিশ সাত দিনের রিমান্ডের আবেদন করবে। ওদিকে নওশীনের আইনজীবীও জামিনের আবেদন করবে। তবে সমস্যা হচ্ছে আইনজীবীর গাড়ি কোর্টের কাছে পৌঁছাতে পারছে না। উৎসুক জনতা তাকে কিছুই কোর্টে যেতে দেবে না। রাগে-ক্ষোভে ফেটে পড়ছে সকলে। এমন একটা ভাব যেন নওশীনের পক্ষে দাঁড়ানোতে এই আইনজীবীকেও তারা গিলে খাবে। পুলিশ ব্যস্ত ভঙ্গিতে এই ভিড় সরাতে ব্যস্ত।
কোর্টের সামনে হাজারো মানুষের ভিড়। কেউ এসেছে একা, আবার কেউ দল বেঁধে। একে তো সেলিব্রিটিকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তার ওপরে আবার এই কেসের সঙ্গে জড়িত আরশাদ হক। মানুষের আগ্রহের যেন কোনো কমতি নেই। টিভি-চ্যানেলগুলো এখানকার অবস্থা সরাসরি সম্প্রচার করছে। কয়েকজন তরুণী মেয়ে দলবেঁধে এসেছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এরা আরশাদের বিরাট ভক্ত। নওশীনের প্রতি ক্ষোভ ঝাড়তেই তাদের এখানে আসা।
একটা মেয়ে তেজী ভঙ্গিতে ক্যামেরার সামনে বলল, “এইরকম নির্লজ্জ, চরিত্রহীন মহিলাকে আর এক সেকেন্ডও দেশে রাখা উচিত না। ওকে এক্ষুনি দেশ থেকে বের করে দেওয়া উচিত।”
তরুণীর তেজে ঘাবড়ে গিয়ে সাংবাদিক বলল, “নওশীন হকের প্রতি আপনার এত রাগ কেন?”
মেয়েটি আবারও তেজে আগুনের ন্যায় জ্বলে উঠে বলল, “কারণ এই বেয়াদব মহিলা আরশাদের ওপর চিট করছে। অন্য একজনের বাচ্চাকে আরশাদের বলে চালায় দেওয়ার চেষ্টা করছে। ডিভোর্স তো তোর কারণেই হইছে। তাহলে এখন যখন আরশাদ নতুন করে সংসার শুরু করছে তখন তোর এত জ্বলে কেন? আরশাদের বউকে কিডন্যাপ করে ভাবছিল আবারও আরশাদ ওকে ঘরে তুলবে। কক্ষনো না!”
পেছন থেকে আরেকটা মেয়ে একই ভঙ্গিতে বলল, “এই মহিলাকে মেন্টাল অ্যাসাইলামে পাঠানো উচিত!”
বিভিন্ন টিভি চ্যানেল এমন অনেকের ইন্টারভিউ নিচ্ছে। অথচ একটা মানুষও পাওয়া গেল না যে কিনা নওশীনের পক্ষে। অবশ্য নিজের পক্ষে কাউকে পাওয়ার মতো কাজ সে করেনি। প্রতিটা মানুষ আজ ঘৃণা ছড়াচ্ছে তার প্রতি। নিজের দোষেই এমন পরিণতির শিকার সে।
হঠাৎ সব ক্যামেরাগুলো ঘুরে গেল কোর্টের মূল দরজার দিকে। গাঢ় নীল রঙের পুলিশ ভ্যান এসে থেমেছে। হাতে হ্যান্ডকাফ পড়া নওশীনকে বের করে আনা হচ্ছে। তাকে দেখে জনতার রাগ যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেল। একদল পুলিশ সামনের ভিড় সরাতে ব্যস্ত। পুলিশ জায়গা ফাঁকা করে দিচ্ছে আর কয়েকজন মহিলা পুলিশ তাকে কোর্টের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ কোথা থেকে যেন একটা প্লাস্টিকের স্যান্ডেল উড়ে এসে নওশীনের গায়ে লাগলো। হকচকিয়ে চোখ তুলে তাকালো সে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পরপর আরও কয়েকটা স্যান্ডেল তার গায়ে লাগলো। পুলিশ দ্রুত গতিতে কোর্টের দিকে আগাচ্ছে। নওশীন অবাক চোখে তাকিয়ে আছে চারদিকে জমে থাকা জনগণের ভিড়ে। এই সবগুলো মানুষ তাকে এতটা ঘৃণা করে?
পুরো দৃশ্যটা টিভিতে লাইভে দেখলো অরা। ঘুম ভাঙতেই সে আঁতকে ওঠে। কয়েক মুহূর্তের জন্যে মনে হচ্ছিল, এখনো সে বন্দী হয়ে আছে সাবেরের কাছে। যখন উপলব্ধি হলো সে আর বন্দী নেই, নিরাপদে আছে নিজের বাড়িতে – তখনই ভয়টা কেটে গেল। তবে তার তৃষ্ণার্ত চোখদুটো ব্যস্ত খুঁজতে লাগলো আরশাদকে। তাকে আশেপাশে কোথাও খুঁজে না পেয়ে নিচে নেমে আসে অরা।
বসার ঘরের টিভিতে কে যেন আগে থেকেই নিউজ ছেড়ে রেখেছিল। টিভির দিকে চোখ পড়তেই স্তম্ভের ন্যায় দাঁড়িয়ে যায় অরা। নওশীনকে লক্ষ্য করে ক্ষিপ্ত জনগণ স্যান্ডেল ছুঁড়ে মারছে, এই দৃশ্য দেখে তার বুকটা হুহু করে কেঁপে উঠলো। যদিও অরার মনে তার জন্যে ঘৃণা জমা উচিত। এই নওশীনের কারণেই তার জীবনের সবথেকে বাজে দুটো দিন এসেছিল। ওই দুটো দিনে বারবার সে মুক্তির জন্যে আকুতি করছে। বারবার তার মনে সংশয় জাগছিল, আর কোনোদিন আরশাদের কাছে ফিরে আসতে পারবে কিনা। সবটাই নওশীনের কারণে।
সাবেরের কাছে বন্দী থাকা অবস্থায় অরা যখন জানতে পেরেছিল, এসবের পেছনে নওশীন রয়েছে তখনও ঘৃণায় তার মনটা বিষিয়ে উঠেছিল। তবে আজ এই দৃশ্যটা দেখে তার মনে মায়া জাগলো। আহারে! কী অনিন্দ্য সুন্দর চেহারা মানুষটার, কী মিষ্টি ব্যবহার! কেন যে তাকেই এমন নোংরা মনের অধিকারী হতে হলো।
হঠাৎ অরা অনুভব করলো কেউ একজন পেছনে থেকে জড়িয়ে ধরেছে তাকে। সেই কেউ একজনটা যে আরশাদ তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। মৃদু কেঁপে উঠলো অরা। আরশাদের সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর স্পর্শে যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলে সে।
বহুকষ্টে নিজেকে সামলে অরা মলিন কণ্ঠে বলল, “এসবের কী দরকার ছিল?”
আরশাদের বুঝতে মোটেও অসুবিধা হলো না অরা কোন দিকে ইঙ্গিত করছে। তাদের সামনে টিভিতেই নওশীনের কেসটা লাইভ সম্প্রচার করা হচ্ছে। একজন সাংবাদিক মাইক হাতে ক্যামেরার সামনে পরিস্থিতির সর্বশেষ বর্ণনা করছে।
আরশাদ স্বাভাবিক গলায় বলল, “এই কথা তুমি বলছো? আমি তো ভেবেছিলাম, তুমি চাও ওর একটা শাস্তি হোক।”
“চাই। তাই বলে এত বড় শাস্তি?”
“যত বড় অপরাধ, তত বড় শাস্তি তো পেতেই হবে অরা।”
“পুরনো কথাগুলোও ফাঁস করে দিয়েছেন?”
আরশাদ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আজ আমার অনেক হালকা লাগছে অরা। ওই কথাগুলো এতদিন নিজের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছি, আর মানুষের কটাক্ষের শিকার হয়েছি। আর কত? আমি জানতাম এই দিনটা আসবে। প্রকৃত সত্যিটা সবাই জানবে।”
হঠাৎ অরা কী যেন মনে করে বলল, “কথা?”
আরশাদ তাকে আশ্বস্ত করে বলল, “ওপরে ঘুমাচ্ছে।”
আরশাদ অরাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে কপালে হাত দিয়ে বলল, “জ্বরটা এখনো কমেনি তো! চলো, ব্রেকফাস্ট করবে। একটু পর ডক্টর তোমার চেকআপ করতে আসবে।”
ব্রেকফাস্ট করতে যাওয়ার আগে অরা ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে গেল কথার ঘরের দিকে। আরশাদও তার পিছু নিল। ব্যাঙ্কেটের নিচে লুকিয়ে ঘুমিয়ে আছে মেয়েটা। কাল মাঝরাতে আরশাদ তাকে তুলে দেওয়ার পর আর ঘুমায়নি। ঘুমিয়েছে সকালে। অরা বিছানায় কথার পাশে বসলো। আরশাদ বসলো আরেক পাশে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে অরা হাত বুলিয়ে দিচ্ছে কথার মাথায়। খারাপ পরিস্থিতির আঁচ এই মেয়েটার ওপরে পড়তে দেওয়া যাবে না। কিছুতেই কথার শৈশবটাকে ধ্বংস হতে দেওয়া যাবে না। অরা নিজে সুন্দর একটা শৈশব পায়নি। তাই সে জানে এই সময়টা কত মূল্যবান।
অরা নিচু স্বরে বলল, “উনাকে ওর সামনে অ্যারেস্ট করা হয়নি তো?”
আরশাদ শান্ত গলায় বলল, “না অরা। আমি জেনেবুঝে আমার মেয়েটাকে ট্রমাটাইজড করবো?”
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে অরা বলল, “একটা রিকুয়েস্ট করবো?”
“করো।”
“কথাকে কোনোদিনও জানতে দেবেন না ওর মায়ের জীবনের বাজে অধ্যায়গুলো।”
আরশাদ ক্ষীণ হাসি হেসে বলল, “তুমি না বললেও দিতাম না। বাচ্চাদের একমাত্র ভরসার আশ্রয় তাদের বাবা এবং মা। তারা যখন জানতে পারে সেই দুজনের একজন ভালো মানুষ নয়, তখন তাদের পৃথিবীটাই এলোমেলো হয়ে যায়। যেমন আমি! খুব কম বয়সে আমি জানতে পেরেছিলাম, আমার বাবা একজন খারাপ মানুষ।”
আরশাদ নিজের হাতে নাস্তা খাইয়ে দিলো অরাকে। ডক্টর ইশতিয়াক সাড়ে বারোটার দিকে এলেন চেকআপ করতে। অরা এখন মোটামুটি সুস্থ। তবে প্রচুর রেস্ট নিতে হবে। গত দুদিনে নেহায়েত কম ধকল যায়নি তার ওপর দিয়ে। সেই সঙ্গে লিখে দিয়ে গেলেন একগাদা ওষুধ। একেকটা ওষুধ মাসখানেক খেতে হবে। কয়েকটা ওষুধ তো ছয় মাস পর্যন্ত খাওয়ার নির্দেশ দিয়ে গেছেন তিনি। ওষুধ খাওয়ার প্রতি অরার যতটা অনীহা, ঠিক ততটাই কড়াকড়ি আরশাদের। ওষুধ খাওয়ার পুরো সময়টায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রেখেছে, যেন একটাও বাদ না যায়।
দিনের বাকিটা সময় আরশাদ অরার পাশেই কাটালো। এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে তার জীবনে। ভেতরে ভেতরে মেয়েটা নিশ্চয়ই অনেক ঘাবড়ে গেছে। পাশে থেকে আরশাদ তাকে আশ্বাস দেওয়ার চেষ্টা করছে, এখন আর তার কোনো ভয় নেই। অরার আরশাদের আশেপাশে বিচিত্র এক নিরাপদ অনুভূতি অনুভূত হচ্ছে। আরশাদের কর্মকান্ডে ক্রমেই অবাক হয়ে যাচ্ছে না। ইন্ডাস্ট্রির সবথেকে ব্যস্ত তারকা, যায় স্বস্তিতে নিঃশ্বাস ফেলার সময় পর্যন্ত নেই সে কিনা সব শিডিউল ক্যানসেল করে তার সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে। এটাও বিশ্বাসযোগ্য?
সন্ধ্যার দিকে সীমা এলো অরাকে দেখতে। প্রিয় বান্ধবীকে এতদিন পর দেখে অরার মনটা আরও ভালো হয়ে গেল। এদের দুজনকে একা ছেড়ে দিয়ে আরশাদ চলে গেল বসার ঘরে। নতুন ম্যানেজার অয়নকে ডেকে পাঠিয়েছে। এই ছেলেটার কাজ যথেষ্ট গোছানো হলেও সে অরার মতো এক্সপার্ট না। কী আর করা?
শোবার ঘরের সোফায় পা তুলে বসে আছে সীমা। তার পাশেই অরা।
সীমা উৎফুল্ল ভঙ্গিতে বলল, “আজ সকালে কোর্টের সামনে গিয়েছিলাম বুঝলি।”
অরা ভ্রু কুঁচকে বলল, “কেন?”
সীমা এমনভাবে অরার দিকে তাকালো যেন তার মতো বোকা মেয়ে এই পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই।
“কেন আবার? মজা দেখতে! উফ! কী যে মজা হয়েছে অরা! মানুষ ঝাঁকে ঝাঁকে ওই শাকচুন্নির গায়ে স্যান্ডেল ছুঁড়ে মেরেছে।”
অরা গম্ভীর গলায় বলল, “একটা মানুষের গায়ে স্যান্ডেল ছুঁড়ে মারা হচ্ছে, এটা তোর কাছে মজার ঘটনা?”
সীমা রাগী কণ্ঠে বলল, “ভালোমানুষী করবি না তো! খবরদার ভালোমানুষী করবি না। যে মহিলার কারণে তোকে কিডন্যাপ হতে হলো, তার প্রতি এত দরদ কীসের রে?”
“একটা মানুষ হিসেবে আরেকটা মানুষের প্রতি দরদ থাকবে না?”
সীমা হুমকির ভঙ্গিতে বলল, “না থাকবে না! আর একবার ভালোমানুষী করলে থাপ্পড় দিয়ে তোর গাল ফাটিয়ে ফেলবো।”
অরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে রইলো।
সীমা আবারও দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে বলতে লাগলো, “তারপর শোন না কী হলো! একদল ঠিক করলো ওই মহিলার পুতুল বানিয়ে আগুনে পোড়াবে। কিন্তু কোর্টের সামনে বাঁশ পায় কই? শেষমেশ গাছের ডাল দিয়ে অখাদ্য দেখতে একটা পুতুল বানালো। তার কম্পিউটারের দোকান থেকে ওর একটা ছবি প্রিন্ট করিয়ে আনলো। মাথার জায়গায় ছবিটা বসানো হলো। এই পুতুল পোড়ানোটা তো টিভিতেও দেখানো হয়েছে। তুই দেখিসনি?”
অরা ক্লান্ত স্বরে বলল, “না। টিভি খুললেই এই এক টপিক। বিরক্ত লাগে।”
কিছুটা সময় চুপ করে থেকে সীমা নরম স্বরে বলল, “তোর খুব কষ্ট হয়েছিল না? তোকে সারাদিন বেঁধে রেখেছিল তোকে?”
অরা কাতর স্বরে বলল, “সীমা, এসব নিয়ে আর কথা না বলি প্লিজ?”
সীমা প্রচ্ছন্ন একটা হাসি হেসে বলল, “আচ্ছা।”
সীমা চুপ করে আছে। একটা কথা অরাকে জানাবে বলে সেই কবে থেকে তার মনটা ছটফট করছে। আজ যখন অবশেষে সেই সুযোগ পেয়েছে তখন কথাটা শুরু কী করে করবে বুঝতে পারছে না।
এক পর্যায়ে ভাবনা-চিন্তায় বিসর্জন দিয়ে সীমা বলল, “শোন না! তোকে একটা কথা বলা হয়নি।”
“কী কথা?”
“আমি না…”
কথাটা বলতে গিয়েও থেমে গেল সীমা।
অরা বলল, “তুই কী?”
সীমা ইতস্তত করে বলল, “আমি না ওই সিঙ্গাপুরীকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছি।”
অরা চমকে উঠলো। তার ঠোঁটে চওড়া একটা হাসি ফুটে উঠলো। হাসিতে ঝলমল করছে সে।
অরা ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে বলল, “মানে? তুই সত্যি বিয়ে করবি?”
সীমা লজ্জিত ভঙ্গিতে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লো।
অরা কৌতূহলী গলায় বলল, “কখন হলো এসব?”
“বেশিদিন আগে না। তুই আর ভাইয়া কয়েকদিন আগে বেড়াতে গেলি না? তখন।”
অরা মেকি অভিমান নিয়ে বলল, “এত বড় ঘটনা ঘটে গেল, আর আমি কিছুই জানলাম না?”
“আরে বাবা আমি তো সেদিনই ফোন করো বলতাম, তুই ছিলি নেটওয়ার্কের বাইরে। বলবো কী করে?”
“আচ্ছা বাদ দে! শুরু থেকে বল, কীভাবে কী হলো?”
“ওই সিঙ্গাপুরী…”
অরা বাঁধা দিয়ে বলল, “কথাটা সিঙ্গাপুরিয়ান হবে সীমা!”
সীমা জোর গলায় বলল, “আমি সিঙ্গাপুরীই ডাকবো!”
“কেন বেচারার নাম নেই?”
সীমা হালকা লজ্জা পেয়ে বলল, “এনায়েত! তবে আমি বাবা সিঙ্গাপুরীই ডাকছি। গত সপ্তাহে বাড়িতে যাই। ওই ছেলেও না-কি তখন ওখানে। মা বলল যা গিয়ে দেখা করে আয়। আমি প্রথমে না না করলেও পরে মায়ের জোরাজুরিতে বাধ্য হয়ে দেখা করতে যাই। ছেলেটার ছবি দেখেছিলাম আগে। দেখতে ভালো হলেও আমার কেন জানি মনে হয়েছিল চেহারায় একটা বেয়াদব বেয়াদব ভাব। তার ওপরে আবার বিদেশফেরত ছেলে। নির্ঘাত ভাব বেশি হবে। ওমা! দেখা করতে গিয়ে দেখি ছেলে অসম্ভব বিনয়ী। আর সামনা-সামনি দেখতে ছবির থেকেও বেশি হ্যান্ডসাম।”
অরা মজার ছলে বলল, “ছেলের বর্ণনা দিতে গিয়েই এত লজ্জা পাচ্ছিস? বিয়ের পর না জানি কী হয়!”
“আরে ধুর! শোন তো! কথা বলতে গিয়ে দেখলাম ওর আর আমার মধ্যে অনেককিছু কমন আছে। এই যেমন আমার সমুদ্র ভালো লাগে, ওরও তাই। আমি হরর সিনেমা দেখতে গেলে হাসতেই থাকি, ও না তাই করে। ওই এক দেখায় এমন কতগুলো মিল যে খুঁজে বের করেছি তুই গুণে শেষ করতে পারবি না। বাড়ি ফেরার পর মা রিপোর্ট জানতে চাইলো। আমি চুপ করে রইলাম। রাতে খেয়েদেয়ে যখন ঘুমাতে যাবো তখন শুনি মাকে ওই ছেলের মা ফোন করেছে। ওই ছেলে না-কি বাসায় গিয়ে বলেছে বিয়ে করলে আমাকেই করবে। আর কাউকে নয়।”
অরা মুগ্ধ গলায় বলল, “ভাবা যায়? যে ছেলেকে বিয়ে করবি না বলে চার বছর ফ্যামিলির সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখলি না, সেই ছেলেই কিনা এমন কথা বলছে।”
“আসলেই আশ্চর্যের ব্যাপার!”
অরা আনন্দে ঝলমল করে বলল, “আমি খুব খুশি হয়েছি সীমা। দেখবি! তোর সিঙ্গাপুরী তোকে অনেক ভালো রাখবে।”
সীমা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, “আগামী মাসে ওরা চৌদ্দ গুষ্টি নিয়ে অফিসিয়ালি আমাকে দেখতে আসবে। সেদিনই পানচিনি হবে। তুই যাবি তো?”
“এটা আবার জিজ্ঞেস করার কী আছে রে? অবশ্যই যাবো।”
অরা হঠাৎ কী যেন মনে করে বলল, “সীমা শোন, তোকেও একটা কথা বলা হয়নি।”
“কী?”
“আমরা যখন বেড়াতে গেলাম না? তখন উনি বলে দিয়েছে, এক বছর পর কোনো ডিভোর্স-টিভোর্স হবে না।”
সীমা হাস্যোজ্বল গলায় বলল, “আমি জানতাম! তুই কিডন্যাপ হবার পর ভাইয়ার চোখে তোর জন্য অনেক ভালোবাসা দেখেছি। আর এখন তোর চোখে দেখছি।”
তাদের কথার মাঝে ঘরে হঠাৎ আগমন ঘটলো কথার। মেয়েটা ছুটছে ছুটছে এসে বসলো অরার পাশে। তার হাতে একটা পুতুল।
কথা পুতুলটা অরার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “অরা দেখো! আমি বার্বির চুল বাঁধার চেষ্টা করছি কিন্তু কিছুতেই পারছি না।”
অরা হাসিমুখে বলল, “আচ্ছা দাও, আমি বেঁধে দিচ্ছি।”
“আমার মতো করে বাঁধবে কিন্তু!”
সীমা মুগ্ধ চোখে দেখতে লাগলো দুজনের খুনশুটি। কথা খুব সহজেই আপন করে নিয়েছে অরাকে। ছোট ছোট কাজেও তার ওপর নির্ভরশীল হয়ে গেছে।
সীমা হঠাৎ অন্যমনস্ক গলায় বলল, “তোর ওপর অনেক বড় একটা দায়িত্ব এসে পড়লো। ঠিকমতো খেয়াল রাখতে পারবি তো কথার?”
অরা দৃঢ় ভঙ্গিতে বলল, “অবশ্যই পারবো। তুই তো জানিসই আমি কথাকে কতটা ভালোবাসি।”
কথা উৎফুল্ল গলায় বলে উঠলো, “আমিও তোমাকে ভালোবাসি অরা।”
“লবণের মতো?”
“হ্যাঁ! লবণের মতো।”
রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় কাল রাতের লজ্জায় পড়লো অরা। কীভাবে কাল রাতে আরশাদের বুকে ঢলে পড়েছিল! ভাবতেই লজ্জায় রক্তিম হয়ে যাচ্ছে তার গালদুটো। আজও দুজনে পাশাপশি শুয়েছে, মাঝে মাত্র কয়েক সেন্টিমিটারের দূরত্ব। তবে আরশাদের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে খুব শীঘ্রই এই সামান্য দূরত্বটাও ঘুচিয়ে দেবে সে। হঠাৎ আরশাদ অরার হাতের ওপরে নিজের হাত রাখলো। এমন আকস্মিক স্পর্শে কেঁপে উঠলো অরা।
আরশাদ অরার চোখের দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে ডাকলো, “অরা?”
অরা অস্পষ্ট গলায় বলল, “হুঁ?”
“এই বিয়েটা নিয়ে তুমি খুশি তো?”
অরা চমকে উঠে বলল, “হঠাৎ এমন প্রশ্ন?”
“হঠাৎ না। বিকেল থেকেই প্রশ্নটা মাথায় ঘুরছে। কেমন হুট করে হয়ে গেল আমাদের বিয়েটা। আমরা কেউই তো প্রিপেয়ারেড ছিলাম না বিয়েটার জন্য। যদিও আমি একটু একটু করে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এখন তো তোমাকে ছাড়া আমার জীবনটা কল্পনাও করতে পারি না। কিন্তু তুমি?”
“আমি কী?”
আরশাদ চোখেমুখে একরাশ জিজ্ঞাসা নিয়ে বলল, “তুমি কি পেরেছো নিজেকে মানিয়ে নিতে?”
“আপনার কী মনে হয়?”
“সেটাই তো বুঝতে পারছি না।”
অরা হাসিমুখে বলল, “তাহলে একটা সিক্রেট শুনুন। আমি নিজেকে আপনার সাথে আপনারও আগে মানিয়ে নিয়েছি।”
আরশাদ বাঁকা হাসি হেসে বলল, “এই কথাটাও তোমার জার অফ সিক্রেটসে লিখে রাখতে!”
অরা আঁতকে উঠে বলল, “আপনি খুলেছেন?”
আরশাদ স্বাভাবিক গলায় বলল, “হুঁ! না খুলে আর উপায় কী? তুমিই তো বলেছিলে, তোমার কাছ থেকে সিক্রেট শুনতে ইচ্ছা হলেই যেন ওটা খুলে দেখি।”
লজ্জায় মাটির নিচে লুকিয়ে পড়তে ইচ্ছা করছে অরার। ইশ! কেন যে মনের কথাটা অমন নিঃসংকোচে লিখতে রাখতে গেল?
প্রায় অনেকটা সময় আরশাদ চুপ করে থেকে বলল, “অরা?”
“হুঁ?”
আরশাদ ঘোরলাগা কণ্ঠে বলল, “I love you too.”
(চলবে)
[আজকের পর্বটা লিখতে লিখতে হঠাৎ একটা ব্যাপার মাথায় আসলো। সীমা আর তার সিঙ্গাপুরীকে নিয়ে আলাদা একটা গল্প লিখলে কেমন হয়?]