#ফিরে_আসা২
২২
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
জানালার ফাঁক দিয়ে মিষ্টি রোদ এসে পড়েছে অরার মুখে। নভেম্বরের মাঝামাঝি এখন, অথচ শীতে রীতিমত দাঁত কটমট করছে। অফিসের জন্যে তৈরি হচ্ছে অরা। তার পরনে সাদা শার্ট, ধূসর বর্ণের লম্বা কোট আর কালো লেগিংস। গলার ওপর দিয়ে গাঢ় বেগুনি রঙের একটা মাফলার বাঁধার চেষ্টা করছে অরা। আজকাল সকলে কেমন কায়দা করে মাফলার বাঁধতে পারে। অরা তা পারে না।
ঘরের আরেক প্রান্তে ব্যাকপ্যাক গোছাতে ব্যস্ত আরশাদ। আগেই গোছানো ছিল, সে কেবল নিশ্চিত হচ্ছে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো ঠিকমত আছে কিনা। আরশাদের এই লেদার ব্যাকপ্যাকে শুটিংয়ের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোই থাকে। এই যেমন স্ক্রিপ্ট, তার বড় বড় দুটো নোটবুক, ইয়ারপড, পাওয়ারব্যান্ড।
হঠাৎ আরশাদের চোখ পড়লো আয়নায় ভেসে ওঠা অরার প্রতিচ্ছবির দিকে। মেয়েটা সেই তখন থেকে মাফলার বাঁধার চেষ্টায় ব্যর্থ হচ্ছে।ব্যর্থতার হতাশা তার চোখেমুখে দৃশ্যমান। আরশাদ হাতের কাজটা ফেলে রেখেই এগিয়ে গেল অরার দিকে।
মাফলারটা অরার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে আরশাদ কৃত্রিম হতাশ গলায় বলল, “এখনো বাচ্চাই রয়ে গেলে। আর তুমি না-কি দুদিন পর বাচ্চার মা হবে!”
যত্ন নিয়ে স্টাইল করে অরার গলায় মাফলারটা বেঁধে দিলো আরশাদ। আড়চোখে অরার দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করলো তার চোখেমুখে বিচিত্র এক মলিনতা। আরশাদ হকের বউয়ের চোখেমুখে মলিনতা জায়গা পায় কোন সাহসে?
আরশাদ কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই আরশাদের ফোন বেজে উঠলো। শুটিং সেট থেকে পরিচালক ফোন করেছেন। নিশ্চয়ই জরুরি কোনো প্রয়োজনে। আরশাদ ফোনটা রিসিভ করে কথা বলতে বলতে অন্যদিকে চলে গেল।
আরশাদের কাজ কখনোই অরার হিংসার কারণ হয়ে ওঠে না। কাজকে বেশি সময় দিতে গিয়ে তাকে হয়তো মাঝেমধ্যে একটু কম সময় দিয়ে ফেলে। দিক গিয়ে! যতটুকু সময় তাকে দেয়, ততটুকু তো একান্তই তার।
স্কুলের জন্যে তৈরি হয়ে বিছানা খাতাপত্র নিয়ে বসেছে কথা। শেষ মুহূর্তে হোমওয়ার্ক করছে। গতকাল আগে আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিল বলে হোমওয়ার্কটা শেষ করতে পারেনি। তাই তো আজ এত তাড়াহুড়ো।
অরা কথার ঘরে প্রবেশ করে বলল, “কথা! নিচে চল, ব্রেকফাস্ট করবি।”
কথা খাতার দিক থেকে চোখ না সরিয়েই বলল, “হোমওয়ার্কটা শেষ করে আসছি অরা।”
কথার খাতার দিকে চোখ গেল অরার। সামান্য যোগ-বিয়োগের অঙ্ক। যদিও এতটুকু বাচ্চার পক্ষে এই সমস্যার সমাধান করা সহজসাধ্য ব্যাপার নয়।
কথার পাশে বসতে বসতে অরা বলল, “এমন তাড়াহুড়ো করলে তো অঙ্ক ভুল হবে। একদিন হোমওয়ার্ক না করলে কী হয়?”
“পানিশমেন্ট হয়!”
অরা বিস্মিত গলায় বলল, “তোর স্কুলে পানিশমেন্টও দেয়?”
কথা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, “দেয় তো। কেউ হোমওয়ার্ক না করলে পুরোটা ক্লাস তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।”
মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল অরা। এতটুকু বাচ্চাদের শাস্তি দেওয়ার পেছনে স্কুলগুলোর কোন যুক্তি কাজ করে? বাচ্চারা যাতে পুনরায় একই ভুল না করে? ভুল না হয় শুধরে নিলো। কিন্তু গোটা ক্লাসের সামনে শাস্তি পাওয়ায় তার মধ্যে যে হতাশার সৃষ্টি হলো, স্কুল নামক জায়গাটার প্রতি যে বিতৃষ্ণার সৃষ্টি হলো, তা কি সহজেই মিটে যাবে?
অরা গ্রামের স্কুলে শিক্ষাজীবন পাড় করেছে। সেখানে হোমওয়ার্কের মতো বাড়তি কোনো কাজ শিক্ষার্থীদের দেওয়া হতো না। তবে তাই বলে যে শাস্তির ব্যবস্থা নেই তা নয়। ওখানকার শাস্তি পুরো ক্লাস দাঁড়িয়ে থাকার মতো হালকা-পাতলা নয়। ভয়াবহ রকমের শাস্তি। এই যেমন এক হাতে ইট নিয়ে রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা, কান ধরে উঠবস করা, স্যারদের বেতের আঘাত মাথা পেতে নেওয়া।
শাস্তি পাওয়ার কারণগুলো হতো তুচ্ছ। কেউ যদি ক্লাসে বেশি কথা বলে তাহলে শাস্তি, নিজের খাতার পৃষ্টা নিজেই ছিঁড়ে ফেললে শাস্তি, পরীক্ষায় কম নম্বর পেলে শাস্তি, স্কুলের শিক্ষকের কাছে আলাদাভাবে কোচিং না করলে শাস্তি।
কথা যে স্কুলে পড়ে সেখানে আরও বেশ কিছু সেলিব্রিটি এবং প্রভাবশালী মানুষদের বাচ্চা-কাচ্চা পড়াশোনা করে। স্কুল তাদের ক্ষেত্রে তেমন একটা কড়াকড়ি করে না। স্কুলের নিয়ম প্রতিদিন রোল অনুযায়ী পাঁচজন করে ক্লাসের ফ্লোর ঝাঁট দেবে, বোর্ড মুছবে। এতটুকু বাচ্চারা তো আর ভালো করে কাজগুলো করতে পারবে। তবুও এই নিয়ম তৈরি করা হয়েছে যাতে তাদের মাঝে দায়িত্ব গ্রহণের প্রবণতা গড়ে ওঠে। কথাকে এই নিয়মের বাইরে রাখা হয়েছিল।
এই সংবাদ আরশাদের কানে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে যে স্কুলের অধ্যক্ষকে ফোন করে বলে, “কথা স্পেশাল কেউ নয়। ও অন্যান্য বাচ্চাদের মতোই সাধারণ। ওকে সাধারণদের মতোই ট্রিট করবেন প্লিজ।”
ডাইনিং টেবিলে ব্রেকফাস্ট করতে বসেছে তারা তিনজন। এই ভোরবেলা ব্রেকফাস্ট করার অভ্যাস তার নেই। অন্যান্য সময় তার ব্রেকফাস্ট করতে করতে সকাল দশটা বেজে যায়। তবে এই সময়টা অন্যান্য সময়ের থেকে আলাদা। তার ক্ষুধা না লাগলেও তার মধ্যে যে লুকিয়ে আছে তার তো নিশ্চয়ই ক্ষুধা লেগেছে। তাছাড়া সকালের খাবারের পর একগাদা ওষুধ খেতে হয় তাকে।
আরশাদ লক্ষ্য করলো অরার মধ্যকার মলিনতা এখনো কাটেনি। নিঃশব্দে ব্রেকফাস্ট করে যাচ্ছে মেয়েটা। যেন গভীর এক চিন্তায় মগ্ন তার সমগ্র অন্তরাত্মা।
আরশাদ হালকা গলায় বলল, “মন খারাপ?”
অরা সংবিৎ ফিরে পেয়ে দৃঢ় গলায় বলল, “না।”
“তাহলে মুখ ভার করে আছ কেন? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন স্কুলের টিচারের কাছে কড়া ধমক খেয়েছ।”
কথা আচমকা হতবাক ভঙ্গিতে বলে উঠলো, “বাবা? অরাও স্কুলে যায়?”
“না বাবা। কথার কথা বললাম।”
কথার মজার ছলে বলল, “কথার কথা মানে কী? আমার কথা?”
মেয়েটা এতটুকু বয়সেই ঠাট্টা করতে শিখে গেছে। আরশাদ আর অরা দুজনেই একসঙ্গে হেসে উঠলো।
আরশাদ হাসি থামিয়ে বলল, “হ্যাঁ তোর কথা। এখন ব্রেকফাস্টটা শেষ কর তো।”
কথা আবারও ব্রেকফাস্টে মনোযোগ দিলো। আরশাদ লক্ষ্য করলো আবারও চিন্তায় ডুবে গেছে অরা। নিঃসন্দেহে শুটিং সেটের ওই ঝামেলা এখনো ভাবাচ্ছে তাকে। এই মেয়েটাকে নিয়ে আর পারা যায় না। কাজ ছাড়া মাথায় তার কিছুই ঘুরপাক খায় না।
আরশাদ উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, “কী ব্যাপার তোমার?”
“কোনো ব্যাপার নেই তো।”
“তাহলে মুখ গোমড়া কেন?”
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে অরা শুকনো গলায় বলল, “আমার শুটিং সেটে যাওয়াটা দরকার আরশাদ।”
আরশাদের ধারণাই সত্যি হলো। এখনো সেই শুটিংয়ের চিন্তার তার মাথায়। অন্য সময় হলে অরার কাজে কোনপ্রকার বাঁধা দিতো না আরশাদ। আগেও কখনো দেয়নি। কাজের প্রয়োজনে অরা অনেক সময়েই ঢাকার বাইরে শুটিং সেটে গেছে। তবে এই অবস্থায় যাওয়া কতটুকু উচিত হবে, আরশাদ তাই বুঝতে পারছে না।
আরশাদ গম্ভীর গলায় বলল, “তুমি এখনো ওই চিন্তা নিয়ে পড়ে আছো? আমি তো একবার বলে দিয়েছি, তুমি কোথাও যাচ্ছো না।”
অরা চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, “আমি না গেলে তো সমস্যার সমাধান হচ্ছে না আরশাদ। শুটিং বন্ধ হয়ে আছে, পত্রিকায় আমাদের কোম্পানি নিয়ে আজেবাজে কথা লেখা হচ্ছে। সিইও হিসেবে এটা আমার দায়িত্ব যত দ্রুত সম্ভব সমস্যার সমাধান করা।”
“আমি খুব ভালো করেই জানি এটা তোমার দায়িত্ব। কিন্তু এই অবস্থায় এতটা লম্বা পথ জার্নি করা কি তোমার জন্যে ঠিক?”
অরা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “কথাটা আমার হাসব্যান্ড হিসেবে বলছো। আমার বস হিসেবে বলতে পারতে।”
আরশাদ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “আমি যা, তাই হিসেবে বলছি।”
অরা প্রতিবাদের সুরে বলল, “প্রেগন্যান্সির জন্যে একটা মেয়ের কাজ থেমে থাকবে কেন? আমি প্রেগন্যান্ট, অসুস্থ তো নই।”
আরশাদ ভ্রু কুঁচকে বলল, “এসব ফেমিনিস্ট টাইপের কথাবার্তা আমার কাছে বলে লাভ নেই।”
অরা পাল্টা উত্তর দিয়ে বলল, “আমি ফেমিনিস্ট টাইপের কথা বলছি না, সত্যি কথা বলছি।”
আরশাদ কথার দিকে তাকিয়ে অভিযোগের সুরে বলল, “দেখ কীভাবে ঝগড়া করছে আমার সাথে!”
কথা বক্তৃতার ভঙ্গিতে বলল, “ভেরি ব্যাড অরা।”
দমে গেল অরা। মুড সুইংয়ের কারণে সে আজকাল অকারণেই রেগে যাচ্ছে, রেগে না গেলেও রাগের প্রকাশ করছে।
অরা শুকনো গলায় বলল, “সরি।”
যে চিন্তারা এতক্ষণ অরাকে জ্বালিয়েছে, তা এবার ঘ্রাস করে নিলো আরশাদকে। শুটিং সেটের ঝামেলাটা নেহায়েত অগ্রাহ্য করার মতো নয়। পত্র-পত্রিকায় লেখালিখির ব্যাপারটা তার কানেও এসেছে, তবে আরশাদ তাকে খুব একটা পাত্তা দেয়নি। দুশ্চিন্তার বিষয় শুটিং আটকে আছে। সিনেমার বাজেট বেড়ে যাচ্ছে। প্রোডাকশন হাউজের জন্যে যা নিঃসন্দেহে বিশাল ক্ষতি।
এই সময়ে একজন দক্ষ সিইও হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারে না। তার মন ঢাকার অফিসে পড়ে থাকার কথা না। তার মন পড়ে থাকার কথা কালিয়াকৈরের ওই শুটিং সেটে। অরার মনের অবস্থাটা আরশাদ বুঝতে পারছে। তবুও কেন জানি তার মন সায় দিচ্ছে না অরাকে যেতে দিতে। বিচিত্র দুশ্চিন্তা ঘিরে ধরেছে তাকে। যেন ওই শুটিং সেটে কোনো জটিল ফাঁদ, যে ফাঁদে পা রাখলেই তলিয়ে যাবে অরা।
আবারও অরার দিকে চোখ গেল আরশাদের। মেয়েটা ঠিক একই ভঙ্গিতে মুখ গোমড়া করে বসে আছে। কথায় কথায় বাচ্চাদের মতো মুখ গোমড়া করার স্বভাব আর তার গেল না। এই গোমড়া মুখটাই তার সবথেকে অপছন্দের। অরা কি বোঝে না, প্রচ্ছন্ন হাসি ছাড়া আর কিছুই তার মুখে মানায় না?
আরশাদ হঠাৎ কী যেন মনে করে বলল, “কয়দিন থাকবে?”
অরা উচ্ছ্বাসে ঝলমলে কণ্ঠে বলল, “তার মানে যেতে দিবে?”
আরশাদ থমথমে গলায় বলল, “আমি কি বলেছি যেতে দিবো?”
দমে গেল অরা। এই ছেলেটা এমন কেন? একবার আশা দেখিয়ে আবারও নিরাশ করে তুলছে অরাকে।
আরশাদ আবারও বলল, “শুধু জিজ্ঞেস করেছি, যেতে দিলে কয়দিন ওখানে থাকবে।”
“একদিন।”
“আর জার্নির সময়ের ধকল?”
“পুরোটা সময় ঘুমিয়েই থাকবো।”
আরশাদ হুমকির ভঙ্গিতে বলল, “যখনই আমি ফোন করবো, এক সেকেন্ডের মধ্যে রিসিভ করতে পারবে?”
অরা বাধ্য মেয়ের মতো বলল, “পারবো।”
“ডক্টর তোমার সাথে যাবে। রাজি?”
অরা অবাক গলায় বলল, “চাইলেই কি ডক্টর রাজি হবেন?”
“সেটা আমার দেখার বিষয়। তুমি রাজি কিনা বলো।”
“হ্যাঁ রাজি।”
আরশাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “কী আর করা, যাও তাহলে।”
অরা উৎফুল্ল ভঙ্গিতে বলল, “সত্যি?”
আরশাদ গম্ভীর স্বরে বলল, “না মিথ্যা।”
“আরশাদ!”
“যাও, যাও। সমস্যাটা মিটিয়ে এসো।”
মুখে হ্যাঁ বললেও মনের মাঝে বিচিত্র ওই দুশ্চিন্তার রেশ রয়েই গেল। ঝামেলা মিটিয়ে অরা ভালোয় ভালোয় ফিরে এলেই হয়!
(চলবে)