#ফিরে_আসা২
৭
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
অরা প্রাণপণ চেষ্টা করছে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার। তবে তার সামনে বসে থাকা মানুষটার কারণেই সেই চেষ্টা বিফলে যাচ্ছে বারবার। সকাল সকাল অফিসে এসে কেবল কম্পিউটার অন করে কাজ নিয়ে বসেছে অরা। তখনই রিসিপশন থেকে ফোন এলো, কেউ না-কি দেখা করতে চাইছে তার সঙ্গে।
যে কেউ চাইলেই এমন হুটহাট করে কে ফিল্মসের সিইওর সঙ্গে দেখা করতে পারে না। অরার টিমের কাছ থেকে আগে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হয়। কী কারণে দেখা করবে তার একটা ব্যাখ্যা দিতে হয়। বাছাই পর্ব শেষে তার টিম যদি মনে করে, এই মানুষটার সঙ্গে অরার দেখা হওয়ার প্রয়োজন আছে তবেই তাকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেওয়া হয়।
তবে আজ আমস্মিকভাবে আগত এই আগন্তুকের কাছে কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেই। তবে রিসিপশনে তার জানানো তথ্য অনুযায়ী, অরার সঙ্গে তার আজই দেখা হওয়াটা অনিবার্য। অরার সঙ্গে দেখা না হলে, বড়সর বিপদে পড়ে যাবেন তিনি।
রিসিপশন থেকে যখন মানুষটার নাম বলা হলো, তখনও ঠিক চিনে উঠতে পারেনি তাকে অরা। চিনেছে পরিচয় দেওয়ার পরে। অরার সামনে বসে থাকা মানুষটির নাম ইয়াসমিন বেগম। নওশীনের মা।
অরা চাইলেই পারতো এই মানুষটাকে দেখা না দিয়ে ফিরিয়ে দিতে। তবে তার মনে কোমলতার মাত্রা যেন একটু বেশিই। একটা বয়স্ক মানুষ তার সঙ্গে দেখা করতে এসে ফিরে যাচ্ছে, তা কী করে হয়? এতটা রূঢ় হওয়া সম্ভব নয় তার পক্ষে।
ইয়াসমিনের বেগমের বয়স ষাটের একটু বেশি। চেহারায় বয়সের ছাপ পড়েছে। বয়সের ছাপ ছাড়াও চোখেমুখে দৃশ্যমান হয়ে ফুটে উঠেছে একরাশ দুশ্চিন্তার ছাপ। তার চোখের নিচের কালি স্পষ্ট জানান দিচ্ছে, দীর্ঘ রাত নির্ঘুম কাটিয়েছেন ভদ্রমহিলা। নওশীনের সাজা কমানোর আশায় দীর্ঘদিন দৌড়ঝাঁপ করতে হয়েছে তাকে। ঘুমের আর অবকাশ কোথায়?
ইয়াসমিন বেগম মুখে হাসি হাসি ভাব ধরে রাখার চেষ্টা করে বললেন, “তোমার কথা অনেক শুনেছি মা। এই প্রথম সামনাসামনি দেখার সুযোগ হলো।”
হাসি ব্যাপারটা বড়ই খুব অদ্ভুত। যে কেউ চাইলেই জোর করে ঠোঁটে ফুটিয়ে তুলতে পারি এই জিনিসটি। তবে মানুষ খুব সহজেই জোরপূর্বক হাসি আর প্রকৃত হাসির পার্থক্য করতে পারে। ইয়াসমিন বেগমের এই হাসিটি জোরপূর্বক এতে কোনপ্রকার সন্দেহ নেই। হাসির পেছনে নিশ্চয়ই সূক্ষ্ম এক দুশ্চিন্তা কাজ করছে তার মাঝে।
দুশ্চিন্তা যে অরার মধ্যে কাজ করছে না এমনটা নয়। মনে মনে সে কেবলই ইয়াসমিন বেগমের আগমনের উদ্দেশ্য অনুসন্ধানে ব্যস্ত।
অরা গলার স্বর যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল, “আন্টি আপনি কফি খাবেন তো?”
“আমাকে নিয়ে একদমই ব্যস্ত হতে হবে না মা।”
“না, না! ব্যস্ততা কীসের?”
কল করে একজন স্টাফকে কফি দিয়ে যেতে বলল অরা। তবে তার মধ্যকার অস্থিরতা এখনো কাটেনি। ইয়াসমিন বেগম নিশ্চয়ই শুধু শুধু দেখা করতে আসেনি। তার আগমনের পেছনে নিশ্চয়ই কোনো না কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে। তবে সেই উদ্দেশ্য যে একেবারেই সুখকর হতে যাচ্ছে না, এ বিষয়ে অরা শতভাগ নিশ্চিত।
ইয়াসমিন বেগম ইতস্তত করে বললেন, “আরশাদ কেমন আছে?”
অরা সহজভাবে বলল, “ভালো আছে।”
“তোমার আর আরশাদের ছবি দেখি অনলাইনে। মাঝে মাঝে আবারও যখন দুজনে একসঙ্গে অ্যাওয়ার্ড শোতে যাও, তখনও দেখি। কী যে সুন্দর লাগে দুজনকে পাশাপশি!”
অরা চুপ করে রইলো। কী বলবে ঠিক বুঝতে পারছে না। পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক করতেই ডোরবেল বেজে উঠলো। ওই স্টাফ এসেছে দু কাপ কফি নিয়ে। কফি অরার ডেস্কে নামিয়ে রেখে সে চলে গেল।
ইয়াসমিন বেগম কফির কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, “প্রথম যখন শুনেছিলাম, আরশাদ আবার বিয়ে করেছে, খুব খুশি হয়েছি। প্রত্যেকটা মানুষেরই তো ভালো থাকার অধিকার আছে। আরশাদের মতো ছেলে হয় না! এত বড় সুপারস্টার, অথচ তার আচরণ কী অমায়িক। নিজের মধ্যে কোনো অহংকার তো নেই আছে শুধুই ভদ্রতা। ও ভালো না থাকলে কে ভালো থাকবে?”
ইয়াসমিন বেগম প্রাণপণ চেষ্টা করছেন পরিস্থিতি সহজ রাখার। তবে এ পরিস্থিতি মোটেও সহজ নয়। ভদ্রমহিলা একটা সময়ে ছিলেন আরশাদের শাশুড়ি। তার মেয়ের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল আরশাদের জীবন। কোনো মা নিশ্চয়ই চায় না, তার মেয়ে সংসারটা ভেঙে যাক। ইয়াসমিন বেগমের মেয়ের সংসার ভেঙেছে। তার নিজের কারণেই ভেঙেছে।
অরা আরশাদের জীবনের প্রথম ভালোবাসা নয়। এ সত্য সে মেনে নিয়েছে। প্রথম ভালোবাসা হওয়াটা কোনো কৃতিত্বের ব্যাপার নয়। বরং নিখাদ ভালোবাসা হওয়াটাই গর্বের। অরা সবসময় ভুলে থাকতে চায়, আরশাদের জীবনে নওশীন নামে কেউ ছিল। তাকে যখন এটা কেউ মনে করিয়ে দেয়, তার অস্বস্তি তখন বহুগুণ বেড়ে যায়।
ইয়াসমিন বেগম স্মৃতিচারণ করে বললেন, “আমাকে খুবই সম্মান করতো আরশাদ। দেখা হলেই পা ছুঁয়ে সালাম করতো। এই ছেলেটা যে একসময়ে আমার পরিবারের অংশ ছিল ভাবতেই গর্ব হয়। আমার মেয়েকে নিয়ে আফসোসের শেষ নেই আমার। আরশাদের মতো সোনার টুকরা ছেলেকে পেয়েও তার সঙ্গে থাকতে পারলো না। নিজের দোষেই পারেনি অবশ্য। নওশীন আরশাদের সঙ্গে যা করেছে, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। আমি নিজেও আজ পর্যন্ত তাকে ওই ঘটনার জন্যে ক্ষমা করতে পারিনি।”
অরা চুপ করে রইলো। এমন পরিস্থিতিতে চুপ করে থাকাটাই শ্রেয়। আরশাদের সঙ্গে যা করেছে নওশীন তা সত্যিই ক্ষমার অযোগ্য। তিলে তিলে শেষ করে দিয়েছিল আরশাদের ভেতরটাকে। মনের অসুখ সাংঘাতিক। এর থেকে মুক্তির উপায় সহজসাধ্য নয়। তবুও আরশাদ সেরে উঠেছে, নতুন করে বাঁচতে শিখেছে। তবে এমনটা না হলেও তো পারতো।
এতটা কষ্ট কি সত্যিই আরশাদের প্রাপ্য ছিল?
আরশাদের প্রতি নওশীনের করা অন্যায়ের জন্যে অরা মনে মনে তার প্রতি ক্ষীণ ঘৃণা জমিয়ে রেখেছে। তবে একজন মায়ের সামনে নিশ্চয়ই তার সন্তানদের প্রতি রাগ-ক্ষোভ প্রকাশ করা যায় না। অরা যথাসম্ভব ভদ্রভাবে বসে রইলো।
ইয়াসমিন বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “নওশীন সবসময় বলে, ওই সময়ে আমি ভুল করেছি। মানুষ হয়ে জন্মে কেউ ভুল না করে পারে? মানলাম, সেবার না হয় ভুল ছিল। কিন্তু তোমার সাথে নওশীন যা করলো!”
অরা ক্ষীণ গলায় বলল, “থাক না আন্টি, এসব কথা এখন বলে আর কী লাভ?”
ইয়াসমিন বেগম আক্ষেপজড়িত কণ্ঠে বললেন, “কেন বলবো না? আরশাদ সব ভুলে যখন নতুন করে জীবনটাকে গোছাতে শুরু করলো, তখনই তোমার বিশাল ক্ষতি করার চেষ্টা করলো আমার মেয়ে। কোথায় রাখি এই লজ্জা? লজ্জায় তোমার সামনে এসে দাঁড়ানোর সাহসও পাচ্ছিলাম না।”
“এভাবে বলবেন না আন্টি। ওই ঘটনা তো আমি প্রায় ভুলেই গেছি।”
ইয়াসমিন বেগম হতাশ গলায় বললেন, “আমার মেয়ের এই হাজারো অন্যায়ের জন্যে তার প্রতি এক ধরনের ঘৃণা জন্মে গেছে। তার দিকে তাকিয়ে কথা বলতেও আমার রুচিতে বাঁধে। কিন্তু কী আর করার? মা তো, মেয়ের বিপদে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না। কানাডা থেকে তাই ছুটে এলাম। প্রায় এক বছর কেবল উকিলের বাড়ি আর কোর্টে ঘোরাঘুরি করেই কেটে গেল। মেয়েটার সাজা কমে এলো, জামিনও পেলো। তুমি হয়তো আমাকে সেজন্যে খারাপ ভাবতে পারো…”
ইয়াসমিন বেগমকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে অরা বলল, “না আন্টি! আপনার মেয়ের জন্যে আপনি তো লড়াই করবেনই। খারাপ ভাবার কী আছে?”
“মায়েরা তো এমনই। পৃথিবী উল্টে গেলেও সন্তানের প্রতি তাদের টানের কোনো কমতি নেই।”
চুপ করে রইলো অরা।
“শুনছি তুমিও মা হতে যাচ্ছো। নিজের সন্তানকে অনুভব করতে পারো?”
অরা ইতস্তত করে বলল, “হ্যাঁ, পারি তো।”
“তোমার কাছ থেকে যদি তোমার সন্তানকে কেউ কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে, সহ্য করতে পারবে?”
অরা আবারও চুপ করে রইলো। যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মেয়ে সে। বেশ বুঝতে পারছে কোনদিকে ইঙ্গিত করে কথাটা বললেন ইয়াসমিন বেগম। মনে মনে নিজেকে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো অরা। ইয়াসমিন বেগম নির্ঘাত এমন কোনো কথা বলতে যাচ্ছেন, যা মোটেও সুখকর হবে না তার জন্যে।
ইয়াসমিন বেগম কোমল স্বরে বললেন, “আমি তোমার কাছে এসেছি মা একটা অনুরোধ নিয়ে। নওশীন তার মেয়েকে একনজর দেখবে বলে পাগল হয়ে আছে। প্রায় দুবছর হয়ে গেল মেয়েটাকে দেখে না ও। কথা হয়তো নিজের মাকে ভুলেই গেছে। কিন্তু মা তো আর নিজের সন্তানকে ভুলতে পারে না।”
শুকনো ঢোক গিললো অরা। মনে মনে যে ভয়টা সে পাচ্ছিল, সেটাই সত্য হয়ে সামনে এলো তবে। এবার কী হবে?
“দেখো মা, আমি জানি কথাকে তুমি নিজের সন্তানের মতোই মানুষ করছো। তোমার কাছে নিশ্চয়ই ওর কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। এমন না যে, নওশীন মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে রাখতে চাইছে। ওকে তো আবার সেই জেলেই ফিরে যেতে হবে। শুধু মেয়েকে একবারের জন্যে দেখতে চাইছে। তুমি প্লিজ কথাকে নওশীনের সঙ্গে দেখা করতে দাও!”
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে লম্বা লম্বা শ্বাস নিলো অরা। তার চোখেমুখে যেন অন্ধকার নেমে এসেছে। মনে মনে সে কথা গোছাচ্ছে কেবল।
কথাগুলো গুছিয়ে নিয়ে অরা বলল, “আন্টি, কথা আমার মেয়ের মতোই। আমার নিজের সন্তান পৃথিবীতে এলে তাকে যতটা ভালোবাসবো, তার থেকে ওকে কোনো অংশে কম ভালোবাসি না। তবুও কাগজে-কলমে তো আর আমি ওর কেউ নই। তাই চাইলেই ওকে নিয়ে একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। আপনি এই বিষয়টা নিয়ে যদি ওর বাবার সঙ্গে কথা বলতেন…”
ইয়াসমিন বেগম গম্ভীর ভঙ্গিতে বললেন, “আরশাদ রাজি হবে না। কোনোদিনই চাইবে না নওশীনের ছায়াও যেন কথার ওপরে পড়ুক। তাই তো তোমার কাছে এসেছি। আমি জানি মা, তুমিই পারবে।”
ইয়াসমিন বেগম চলে যাওয়ার পরও কাজে মন বসলো না অরার। মাথায় ভর করছে কেবল ওই একটা চিন্তাই। ভদ্রমহিলার দৃঢ় বিশ্বাস কেউ যদি নওশীনের সঙ্গে কথাকে দেখা করাতে পারে, তবে সেটা অরাই পারবে। তবে অরা ভাবছে ভিন্ন কিছু। সে কি আদৌ পারতে চায়? সে কি চায়, কথার সঙ্গে তার মায়ের দেখা হোক?
নিজেকে নিজেরই বুঝতে কষ্ট হচ্ছে অরার। যথেষ্ট বাস্তববাদী মেয়ে সে। ঠিকই জানতো, নওশীন আজীবন জেলে বন্দি থাকবে না। একটা না একটা সময়ে ফিরে আসবে সে। মায়ের কাছ থেকে মেয়েকে দীর্ঘ সময় আলাদাও রাখতে পারবে না আরশাদ। ঠিকই কোনো না কোনোদিন কথার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে নওশীনের। এই সত্যগুলো বহু আগেই মেনে নিয়েছিল অরা। তবে আজ কেন আচমকা বিচিত্র এই ভয় ঝেঁকে ধরেছে তাকে?
আচ্ছা, এটাও কি নওশীনের কোনো ‘প্ল্যানের’ অংশ? না-কি সত্যিই মায়ের অশান্ত হৃদয় মেয়েকে দেখার জন্যে ছটফট করছে? কিছুই বুঝতে পারছে না অরা। চিন্তাভাবনা করার পর্যায়ে আর নেই তার মস্তিষ্ক।
দুপুরের পরপরই অফিস থেকে বেরিয়ে গেল অরা। এমন গভীর দুশ্চিন্তা নিয়ে কাজে মন দেওয়া সম্ভব নয়। ব্যাপারটা নিয়ে আরশাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। দিন কয়েক যাবত বেশ বিরক্ত বেচারা। অনলাইন নিউজ পোর্টাগুলোতে নিউজের মেলা বসেছে।
“আরশাদ হকের প্রাক্তন স্ত্রীর জামিনে মুক্তি!” শিরোনামে একেকটা নিউজ বের হচ্ছে। নওশীনকে ঘিরে যতগুলো আর্টিকেল লেখা হচ্ছে, সবগুলোতেই তার এই একটাই পরিচয়। ‘আরশাদ হকের প্রাক্তন স্ত্রী’। আরশাদ তো মনে করে তার নামের সঙ্গে একই নিঃশ্বাসে কারো নওশীনের নাম উচ্চারণ করাটাও অন্যায়। সেখানে এতগুলো নিউজ চোখের সামনে পড়ায় আরশাদ পৌঁছে গেছে বিরক্তির চরম শিখরে। তবুও চেষ্টা করছে যতটা সম্ভব ব্যাপারটাকে এড়িয়ে চলার, নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার। কখনো পারছে, কখনো পারছে না।
অসময়ে অরাকে বাড়িতে পেয়ে কথার মাঝে উচ্ছ্বাসের সীমা রইল না। দুজনে একসঙ্গে লাঞ্চ করলো। অরা মন দিয়ে কথার স্কুলের গল্প শুনলো। লাঞ্চ শেষে একটু বিশ্রাম নিতে এলেই কথা বায়না ধরে বসলো, “অরা গল্প শুনবো!”
অরাও বিনা বাক্য ব্যয়ে গল্প বলতে শুরু করলো। প্রত্যেকবারই তাকে ডিজনি প্রিন্সেসের গল্প বলতে হবে। যদিও এই গল্পগুলো সবই কথার মুখস্ত। তবুও অরার মুখ থেকে নতুন করে শোনার মাঝে যেন বিচিত্র এক আনন্দ।
গল্প শুনতে শুনতে কথা অরার গলা জড়িয়ে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেল। আবারও গভীর চিন্তায় ডুব দিলো অরা। বাবা-মাকে একসঙ্গে দেখার কোনো স্মৃতি নেই কথার মস্তিষ্কে। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে মেয়েটা মায়ের কাছে থেকেই অভ্যস্ত। মায়ের সঙ্গে থাকবে, মাঝে মাঝে বাবার কাছে বেড়াতে আসবে। এটাই ছিল কথার কাছে স্বাভাবিক জীবন।
তার স্বাভাবিক জীবনটা একটু হলেও এলোমেলো হয়ে যায় নওশীনের গ্রেফতারের পর। মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে আসে আরশাদ। মায়ের অভাব এক মুহূর্তের জন্যেও তাকে টের পেতে দেয়নি আরশাদ এবং অরা। তবুও আগে কথা মায়ের খোঁজ করতো। তাকে নিশ্চয়ই বলা যায় না, নওশীন প্রকৃতপক্ষে কোথায় রয়েছে। আরশাদ প্রতিবারই উত্তরে বলতো, “মা বেড়াতে গেছে।”
এখন আর মেয়েটা মায়ের খোঁজ করে না। তার বেড়ানো শেষ হয়েছে কিনা, তাও জিজ্ঞেস করে না। আচ্ছা, কথার মস্তিষ্কে আদৌ মায়ের কোনো স্মৃতি অবশিষ্ট রয়েছে তো?
রাত দশটার দিকে বাড়ি ফিরলো আরশাদ। আজও তার পুরোটা দিন কেটেছে ‘দূরে হারিয়ে’র প্রমোশনে। যতগুলো টিভি চ্যানেল বা পত্রপত্রিকায় সে ইন্টারভিউ দিতে গেছে, সবগুলো জায়গাতেই আরশাদের ম্যানেজার কড়াভাবে জানিয়ে দিয়েছে নওশীন সংক্রান্ত কোনপ্রকার প্রশ্ন তাকে করা যাবে না।
সেই কথা সকলে মেনেছেও বটে। নওশীনকে নিয়ে কোনপ্রকার সরাসরি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়নি তাকে। তবুও একজন সঞ্চালক সাহস করে করে ফেলে ইঙ্গিতপূর্ণ একটি প্রশ্ন। প্রশ্নটা এমন, “আজকাল সেলিব্রিটিদের মাঝে অপরাধ প্রবণতা অনেক বেড়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে আপনার কী বলার আছে?”
ভাবটা এমন যেন সেলিব্রিটি ছাড়া দেশে কেউ অপরাধ করছে না। মূলত তাদের উদ্দেশ্য ছিল ইনিয়ে বিনিয়ে আরশাদের মুখ থেকে নওশীনের ব্যাপারে মতামত আদায় করা। যদিও সেই প্রশ্নের জবাব আরশাদ দেয়নি।
গভীর মনোযোগে ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে আছে আরশাদ। তার ম্যানেজার অয়ন খানিকক্ষণ আগে এ সপ্তাহের শিডিউল মেইল করে পাঠিয়েছে। এ সপ্তাহে ইন্টারভিউয়ের জন্য আরশাদ কোথায় কোথায় যাবে, কোন কোন ডিরেক্টরের সঙ্গে মিটিং রয়েছে, কোনদিন শুটিং আছে – সবই গুছিয়ে লেখা রয়েছে এই শিডিউলে।
হঠাৎ তার সামনে এসে বসলো অরা। আরশাদ একবার তার দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে আবারও মনোযোগ ফেরালো ল্যাপটপ স্ক্রিনে।
অরা হালকা গলায় বলল, “আজ আমার সঙ্গে একজন দেখা করতে এসেছিল।”
আরশাদ ল্যাপটপের দিক থেকে চোখ না সরিয়েই ক্ষীণ স্বরে বলল, “ও আচ্ছা।”
অরা থমথমে গলায় বলল, “আমি কিন্তু একটা জরুরি কথা বলছি আরশাদ।”
আরশাদ এবার অরার দিকে তাকিয়ে বলল, “কে দেখা করতে এসেছিল?”
অরা ইতস্তত করে বলল, “ইয়াসমিন বেগম।”
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলো আরশাদ। তার চোখে মুখে রাগ ও হতাশা দৃশ্যমান হয়ে ফুটে উঠেছে।
আরশাদ ভ্রু কুঁচকে বলল, “তোমার সঙ্গে কি যে কেউ চাইলেই দেখা করতে পারে? আমি তো জানতাম অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষার পর তোমার দেখা পাওয়া যায়। অফিসে কাজ বাদ দিয়ে এভাবেই সবাইকে দেখা দাও?”
“তো কী করতাম আমি? দেখা না করে ফিরিয়ে দিতাম?”
“হ্যাঁ দিতে। অপ্রয়োজনীয় মানুষের সঙ্গে দেখা করে সময় নষ্ট করার তো কোনো মানে হয় না।”
“আরশাদ তুমি খুব ভালো করেই জানো আমি এমন কাজ করতে পারি না। তাছাড়া এই ভদ্রমহিলার তো কোনো দোষ নেই।”
ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে আরশাদ বলল, “কী বলেছে? কথাকে নিজেদের কাছে নিয়ে রাখবে, তাই তো?”
অরা জানতো আরশাদকে বিস্তারিতভাবে কিছু ব্যাখ্যা করতে হবে না। ইয়াসমিন বেগমের নামটা শুনেই সে বুঝতে পারবে তার আগমনের উদ্দেশ্য কী। হলোও ঠিক তাই।
অরা বলল, “না। একবার দেখা করবে শুধু।”
আরশাদ গম্ভীর গলায় বলল, “অরা, একটা কথা মনে রেখো। আমি চাই না ওই নোংরা মানুষটার ছায়াও আমার মেয়ের ওপরে পড়ুক।”
“কথাকে একবার জিজ্ঞেস করলে হতো না?”
“কথা এসবের কী বোঝে? অনেক কষ্টে ওই মানুষটাকে ভুলেছে ও। নতুন করে মনে করিয়ে ওর ট্রমা বাড়ানোর কোনো দরকার নেই। ওকে নিয়ে আমার ডিসিশনই ফাইনাল ডিসিশন।”
আরশাদের উদ্বেগটা স্বাভাবিক। এমন তো হতেই পারে, দেখা করার ছল করে মেয়েকে নিয়ে চিরতরে পালিয়ে যেতে চাইছে নওশীন। নিজের স্বার্থ উদ্ধারে কতটা ভয়ানক নওশীন তা খুব ভালো করেই জানে আরশাদ। যাই হয়ে যাক না কেন, এবার আর কোনো ভুল করবে না সে। এতে যদি কেউ তাকে অমানবিক পাষাণ মনে করে, করুক!
(চলবে)
[কাল নিজের অসুস্থতার কথা জানিয়ে পোস্ট করার পর থেকেই আপনাদের অসংখ্য ভালোবাসা আর দোয়া পাচ্ছি। সত্যিই আমি কৃতজ্ঞ। এখন অনেকটাই ভালো আছি। সকলকে ধন্যবাদ আমার পাশে থাকার জন্যে। ❤️]